# এক মুঠো রোদ .
# writer :নৌশিন আহমেদ রোদেলা
# পর্ব -১০
১৮.
সোহেল সোফায় বসে আছে। তার দৃষ্টি তীক্ষ্ম। তার ঠিক সামনে দাঁড়িয়ে আছে যুবতী একটা মেয়ে। পড়নে সাধারণ সুতি কাপড়ের লম্বা গাউন, পায়ে উঁচু জুতো, চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। চশমার আড়ালে যেটুকু বুঝা যাচ্ছে তাতে মন হয় মেয়েটি জোড়া ভ্রুর অধিকারী। পাতলা ঠোঁটের নিচে কালো তিল। গলায় বিভিন্ন কালারের মিশ্রনে একটি ওড়না পেঁচানো। চুলগুলো পিঠে পড়ে আছে খুব শান্ত ভঙ্গিতে। মেয়েটিকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত ভালো করে দেখে নিয়ে মুখ কুঁচকালো সোহেল। তারকাছে হোম ম্যানেজমেন্টের জবের জন্য মেয়েটাকে পার্ফেক্ট মনে হচ্ছে না। মেয়েটার মুখে কেমন একটা “অতি নিষ্পাপ” “অতি নিষ্পাপ” ভাব আছে যা সোহেলের পছন্দ হচ্ছে না। তার ধারনা অতি জিনিসটায় খারাপ। অতি জিনিসটার পেছনে অনেক কিছুই লুকিয়ে থাকে। এই অতি নিষ্পাপ মেয়েটা হয় চরম বোকা নয়তো চরম রকম বুদ্ধিমান। এই “অতি” টাইপের মানুষদের উপর কখনো বিশ্বাস করতে নেই। সোহেলের এই দুই টাইপের মানুষের মধ্যে কোনো টাইপের মানুষকেই তেমন একটা ভালো লাগে না। যদিও এগুলো তার নিজের কথা নয় সবই মৃন্ময়ের থেকে শেখা বুলি। তার ধারনা মৃন্ময়ের মতো বুদ্ধিমান লোক এই দুনিয়ায় দ্বিতীয়টি নেই। কেউ মিথ্যা বললে মৃন্ময় না তাকিয়েই সেকেন্ডের মধ্যে বুঝে যায় যে লোকটি মিথ্যা বলছে। কি সাংঘাতিক! এই একটি কারণেই মৃন্ময়ের সামনে কথা বলতে গিয়ে ভয়ে কাঁপে সোহেল। মেয়েটি এখনও আগের মতোই ভাবলেশহীনভাবে দাঁড়িয়ে আছে। চশমার আড়ালে পড়ায় মেয়েটির চোখের ভাব ঠিক বুঝতে পারছে না সোহেল। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে নড়েচড়ে বসলো সে। গলায় গাম্ভীর্য এনে বলে উঠলো,
— আপনার নাম কি?
— এলিনা সরকার।
— বাড়ি কোথায়?
— ময়মনসিংহ। বাবার সাথে ১৫ বছর বয়স থেকে ঢাকায় থাকি। মা নেই। ময়মনসিংহ এ কোনো আত্মীয় আছে বলেও জানা নেই। পরিবার বলতে আমি আর বাবায় ছিলাম। কিন্তু বাবা হুট করে মারা যাওয়ায় একদম অতল পাথারে পড়েছি।
— আপনাকে কি এসব জিগ্যেস করেছি?
— জিগ্যেস করেন নি কিন্তু আমি জানি আপনি জিগ্যেস করবেন। তাই আগে থেকেই বলে দিলাম। আপনি শুধু শুধু কষ্ট করে প্রশ্ন জিগ্যেস করতে যাবেন কেন?
সোহেল ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ছাড়লো। আক্ষেপের নিঃশ্বাস। সে সত্যিই ভেবেছিলো এসব প্রশ্ন করে মেয়েটাকে খানিক ভরকে দিবে। কিন্তু তা আর হলো কই? এই মেয়েটাকে সোহেলের একদমই পছন্দ হচ্ছে না। কিন্তু কিছু বলতেও পারছে না সে। পাশেই দাঁড়িয়ে আছেন রহিম চাচা৷ তার দাবি মেয়েটাকে চাকরীটা দিতে হবে নয়তো তিনি মৃন্ময়ের কাছে বিচার দিবেন৷ মৃন্ময় আবার রহিম চাচার সব কথায় মেনে নেওয়া টাইপ মানুষ। সোহেল এখানে কি-ই বা করতে পারে? তার অবস্থাটা এখন ইংরেজদের দ্বৈত শাসনের মতো হয়ে গেছে। একগুচ্ছ আফসোসমাখা দীর্ঘশ্বাস ফেলে এলিনা নামের মেয়েটিকে তার কাজ বুঝিয়ে দিলো সোহেল।
বাড়িটা ঘুরে ঘুরে দেখছে রোজা। হাউজ ম্যানেজমেন্টের কাজটা পেয়ে বেশ সুবিধায় হয়েছে তার। তার কাজই এখন বাড়ি মনিটরিং করা। তাই বাড়িতে অবাধে ঘোরাফেরা করতে পারবে সে। কারো সন্দেহের চোখে পড়তে হবে না আপাতত। মেইন বাড়ির ডানপাশে কন্ট্রোলরুম। ওখানে সিকিউরিটি চিপ ও তার এসিস্ট্যান্টের অফিস। বাড়ির সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজগুলো ওখানেই কালেক্ট করা হয়। আর তীর্থ বর্তমানে ওই রুমটাতেই আছে। তীর্থের ডিউটি হলো সকাল দশটা থেকে সন্ধ্যা সাতটা। এরমধ্যে তার একার ডিউটি হলো বিকাল তিনটা থেকে বিকাল পাঁচটা। এই দু’ঘন্টা সময় অফিসরুমে তীর্থ একা। তারমানে এই দুই ঘন্টায় তাদের সুযোগ। এখন কেবল এগারোটা বাজে অর্থাৎ এখন বাড়িটা ঘুরে দেখা ছাড়া রোজার কোনো কাজ নেই বললেই চলে। কোথা থেকে খোঁজা শুরু করবে সেটা ঠিক করে রাখার এটাই বেস্ট সুযোগ।।
১৯.
হাতের ঘড়িটিতে টোকা দিয়ে চলেছে আরু। ঘড়িতে ১২ঃ০০ টা বাজে৷ অথচ তার খুব ভালোভাবে মনে আছে সে বাসা থেকে বেরিয়েছে ঠিক ১০ঃ০০ টায়। কি আশ্চর্য! দু দুটো ঘন্টা কেটে গেলো আর সে বুঝতেই পারলো না? কথাগুলো ভাবতেই কপাল কুঁচকে যাচ্ছে আরুর। ১২ টায় আলিফ স্যারের ক্লাস। এই স্যারের ক্লাসে কখনোই ঠিক সময়ে পৌঁছাতে পারে না আরু। তার ধারনা ব্যাপারটা ইচ্ছেকৃত নয় আলিফ স্যারের পালা জ্বিন বা প্রেতের কাজ এটা। কলেজে তো অনেকেই বলে আলিফ স্যার নাকি বোতলে ভরে জ্বিন পালেন। সিএনজিটা হঠাৎ ব্রেক করায় ভাবনার সুতো কাঁটলো আরুর। ভ্রু কুঁচকে বলে উঠলো,
— কি হয়েছে মামা? সিএনজি থামালেন কেন?
— আপা? সামনে আর যাওন যাইতো না। সিএনজি ব্যাকে নিতে হবো।
— কেনো? সামনে এগুবে না কেন? আমার কলেজ টাইম চলে যাচ্ছে আর আপনি এতোক্ষণে বলছেন সামনে এগুবে না! ফাজলামো নাকি?
— আমি কি করবো আপা? সামনের বাজারে দুই গ্রুপের মারামারি চলতাছে। ওইখানে ঢুকলে মরণ ছাড়া গতি নাই আপা।
— মারামারি? কিসের মারামারি?
— সেভেন স্টারের রাফিন চৌধুরীর নাকি ফাইফ স্টারের পোলাগোর মারতাছে। আমি ভালা কইতে পারি না। একটা ড্রাইভারের থেকে শুনলাম।
রাফিনের নামটা শুনেই লাফিয়ে সিএনজি থেকে নেমে পড়লো আরু। সিএনজি ড্রাইভারকে ভাড়াটা মিটিয়েই দৌঁড় দিলো বাজারের দিকে। সিএনজি ড্রাইভার পেছন থেকে বেশ কয়েকবার ডেকেও আটকাতে পারলো না তাকে। কিছুদূর গিয়েই ভাঙাচোরা গাড়ি, উল্টে যাওয়া তেলের ট্যাংক, এখানে সেখানে আগুন দেখতে পেলো আরু। এখানে সেখানে জড়বস্তুর মতো পরে আছে মানুষের শরীর। কারো মাথা ফেঁটে গেছে তো কারো হাত-পা থেকে রক্ত পড়ছে। আবার কারো শরীর একদম নিথর হয়ে পড়ে আছে কোন এক কোণায়। মুভিতে এসব স্বাভাবিক হলেও বাস্তবে তা মর্মান্তিক। আরুর গলা শুকিয়ে এলো মুহূর্তেই। কাঁপা কাঁপা পায়ে কিছুটা এগুতেই কোথা থেকে একটা ছেলে ছিঁটকে পড়লো তার পায়ের কাছে। আরু চমকে ওঠে কয়েক পা পিছিয়ে গেলো। বার কয়েক ঢোক গিলে সামনে তাকাতেই রাফিনকে চোখে পড়লো তার। রাফিনের চোখে-মুখে কি নিদারুণ হিংস্রতা! তার দু’হাতেই চাকু। দু’পাশের দু’জন ছেলের গলার রগ দুটো কেটে দিলো কি নিঃসংকোচে! গলা থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত পড়ছে কিন্তু বিন্দুমাত্র দয়া লাগছে না তার৷ আরু স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কি করবে বুঝতে পারছে না সে। হঠাৎ করেই একটা ছেলে এসে চাকু ধরলো ওর গলায়। রাফিনের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,
— যেতে দে আমায়। নয়তো নয়তো এই মেয়ের গলাটা আলাদা করে দিবো বলে দিলাম।
ছেলেটার কথায় উচ্চস্বরে হেসে উঠলো রাফিন। একটা গাড়ির উপর বসে পড়ে চুয়িংগাম চিবুতে চিবুতে বলে উঠলো,
— মার। আরে মার মার.. এই মেয়ে কি আমার বউ নাকি রে? যে তুই ওর গলায় চাকু ধরবি আর আমি ভয়ে কাঁপা-কাঁপি করবো। নাকি তুই আমাকে সোশাল ওয়ার্কার ভাবছিস? সো সিলি ইয়ার! এই পৃথিবীতে রাফিন চৌধুরীর কোনো দুর্বলতা নেই। আর মানবতা? হা হা হা সেটা তো একটা ফ্যাশন মাত্র। আমি কোনো ফিল্মের হিরো নই আমি ভিলেননননন (চিৎকার করে) এসব মায়া, দয়া, মানবতা আমার মাঝে নেই রে। এসবে কাজ হবে না। সো স্যাড ফর ইউ!
— দে দে দেখ আমি কিন্তু সসসত্যি মেরে দেবো।
— আরে দে না। আমি কি মানা করেছি? যাহ্ তোকে পাঁচ মিনিট সময় দিলাম। এই পাঁচ মিনিটে তুই মেয়েটাকে মেরে সোজা আমার কাছে চলে আসবি। দেন আই উইল কিল ইউ। তুই রাফিন চৌধুরীকে “শালা” ডেকেছিলি না? এবার শালাকে নিজের প্রাণ ভোমরাটা উপহার দে। ইউর টাইম স্টার্টস্ নাও….
কথাটা বলেই সিগারেট জ্বালালো রাফিন। আরুর পা’দুটো যেনো ঠান্ডা হয়ে গেছে একদম। গলায় লেগে থাকা ছুঁড়িটার ধারে রক্ত পড়ছে ফোঁটা ফোঁটা। কপাল দিয়ে ঘাম ছুঁটছে অনবরত। হঠাৎই প্রচন্ড শব্দে চমকে উঠলো আরু। তার পেছনে দাঁড়ানো লোকটা ধীরে ধীরে লুটিয়ে পড়লো মাটিতে। আরু ঘোরের মাঝেই ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো। লোকটির কপালে গোল একটি বৃত্ত। সেখানে থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে অনবরত। রাফিন রিবলভারটা পাশে দাঁড়ানো ছেলেটির দিকে ছুঁড়ে মেরে সিগারেটে সুখটান দিলো। নাক-মুখ দিয়ে ধোঁয়ার কুন্ডুলি ছড়িয়ে বলে উঠলো সে,
— বয়েজ? আধাঘন্টার মধ্যে সবকিছু ক্লিয়ার চাই। রক্তের একটা ছাপও যেন না থাকে আশেপাশে আর না থাকে কোনো প্রমাণ। গট ইট?
— ইয়েস বস।
আরু এখনও একইভাবে দাঁড়িয়ে আছে। চারদিকে এতো রক্তে শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে তার। শ’ খানেক মানুষ পড়ে আছে রক্তে মাখামাখি হয়ে। এমন একটা পরিস্থিতিতে একটা মানুষ কি করে এতো শান্তিতে সিগারেট টানতে পারে জানা নেই আরুর। আরু বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে আছে। তার মনে হচ্ছে এখনই মরে যাবে সে। এই এখনই শেষ হয়ে যাবে সব। সিগারেটটা শেষ করে গাড়ি নিয়ে চলে গেলো রাফিন। আরুর দিকে একবার তাকিয়েও দেখলো না সে। আরু দু’পা পিছিয়ে কাঁপাকাঁপা পায়ে বসে পড়লো একটা উল্টে পড়া তেলের ড্রামে। মাথায় হাত চেপে বসে আছে সে। চারপাশে গুন্ডা নামক মানুষগুলো লাশগুলোকে বস্তার মতো ছুঁড়ে ছুঁড়ে তুলছে ট্রাকে। আরু আর বসে থাকতে পারলো না। চারপাশের রক্তের বোটকা গন্ধে গা ঘুলাচ্ছে তার। কোনোরকম ওঠে দাঁড়িয়ে উলোট পালোট পা ফেলে এগিয়ে গেলো রাস্তার দিকে। বড় রাস্তায় এসেই হুড়মুড় করে বমি করে দিলো সে। চারপাশটা কেমন দুলছে, হয়তো এখনই খেঁই হারাবে শরীর। পাশ থেকে কারো হালকা কন্ঠ কানে এলো তার। চোখ তুলে তাকালো আরু। ঝাঁপসা দেখতে পেলে স্কুল ড্রেস পড়নে বাচ্চা একটা ছেলে দাঁড়িয়ে তাকেই ডেকে চলেছে ক্রমাগত,
— হ্যালো ম্যাম? আপনি কি অসুস্থ? আপনার কি সাহায্য লাগবে?
আরু হালকা গলায় বলে উঠলো,
— বাসা! বাসায় যাবো আমি।
ছেলেটা কৌতূহলী চোখে তাকিয়ে আছে। উজ্জল শ্যামা চেহারায় অদ্ভুত সুন্দর দুটো চোখ। নাকের নিচে মাত্রই খোঁচা খোঁচা গোঁফের চিত্র ফুঁটে উঠছে। মাথা ভরা ঝাঁকরা চুল। ডানহাতে কপাল থেকে চুলগুলো সরিয়ে নিয়ে দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁটটা চেপে ধরে খানিক চিন্তা করে বলে উঠলো সে,
— কিন্তু আপনার বাসাটা কোথায়?
আরুর গলা ধেবে এলো এবার। মুখ দিয়ে কথা বেরুচ্ছে না তার। আবারও মুখ ভরে বমি করলো সে। চোখটা বন্ধ করার আগে মৃদু কন্ঠে বলে উঠলো,
— ব্যাগে ফোন আর আইডি আছে। প্লিজ বাসায় পৌঁছে দাও আমায়….প্লিজ!
মাথাটা ভার ভার লাগছে আরুর। চোখদুটো খুলতেও কষ্ট হচ্ছে বেশ। তবুও চোখ মেলে তাকালো সে। চোখ মেলতেই চোখে পড়লো সাদা ধবধবে টাইলস করা ছাদ। আরু আশেপাশে তাকিয়ে বুঝার চেষ্টা করছে এক্চুয়েলি কোথায় আছে সে? একটু পরই দরজা খোলার শব্দ হলো। দরজার শব্দকে অনুসরণ করে ডানদিকে ফিরে তাকালো আরু। ট্রে হাতে একজন নার্স ঢুকলো কেবিনে। আরুকে তাকিয়ে থাকতে দেখেই মুচকি হেসে “হ্যালো” বললো মেয়েটি। আরু কিছু বলছে না। আসলে কি বলবে বুঝতে পারছে না। নার্সটি আরুর হাতের স্যালাইনটা চেইক করে নিয়ে আবারও মুচকি হেসে বেরিয়ে গেলো। সাথে সাথেই ঢুকলো একটি ছেলে। আরু অবাক চোখে ছেলেটিকে দেখছে। সাদা-কালো স্কুল ড্রেসে বেশ মানিয়েছে তাকে। ছেলেটি ধীর পায়ে আরুর কাছে এসেই মুচকি হাসলো। আরুর মনে হলো এতো সুন্দর হাসি পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি থাকতে পারে না। কখনোই না। আরুর চোখে-মুখে কৌতূহল, কে এই ছেলে? ছেলেটি তারপাশে চেয়ার টেনে বসে হাসিমাখা মুখে বলে উঠলো,
— হ্যালো ম্যাম? কেমন লাগছে এখন? আমি কি আপনাকে আপু ডাকতে পারি? ম্যাম ডাকতে কেমন বিশ্রী লাগে। তাছাড়া আমারও একটা আপু আছে।
আরু মাথা নাড়লো। যার অর্থ তাকে আপু ডাকা যেতে পারে। আরুর মাথা নাড়ায় আবারও হাসলো ছেলেটি। দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে বলে উঠলো,
— আমার নাম রেদুয়ান আহমেদ। আপনি রাস্তায় সেন্সলেস হয়ে গিয়েছিলেন বলে কাছের একটা হসপিটালে নিয়ে এসেছি আপনাকে। আপনার ভাইয়াকে কল করেছি উনি আসছেন। আর সরি আপনার ফোনটা ধরার জন্য এছাড়া উনার সাথে যোগাযোগ করার কোনো ওয়ে ছিলো না আমার।
কথাটা বলেই ব্যস্ত ভঙ্গিতে একবার ঘড়ি দেখে নিলো ছেলেটি। চিন্তিত মুখে বলে উঠলো,
— আমার এখন যাওয়া উচিত। প্রায় তিনটা বাজে। এখন বাড়ি না ফিরলে আম্মু অনেক বকবে আমায়। এমনিতেও আজ ক্লাস করি নি।
ছেলেটাকে অনেক কথা জিগ্যেস করতে ইচ্ছে করছে আরুর। কিন্তু কেনো জানি মুখ ফুঁটে প্রশ্নগুলো বলতে ইচ্ছে করছে না তার। মন বলছে, থাক না কিছু অজানা। অসময়ে ছেলেটার পরিচয় নিয়ে ভেবে ভেবে সময় ব্যয় করা যেতে পারে। শুনে ফেললেই তো সব কৌতূহল শেষ। তবু কি মনে করে ছেলেটির দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো আরু।
— কোন ক্লাসে পড়ো তুমি?
— ক্লাস নাইনে পড়ি। আজ আমাদের হাফ ইয়ার্লি এক্সামের রেজাল্ট দিয়েছে। আমি ফার্স্ট হয়েছি তাই ক্লাস ফাঁকি দিয়ে আপুর জন্য গিফ্ট কিনতে এসেছিলাম।
ছেলেটার কথায় অবাক হলো আরু। কৌতূহলী চোখে বলে উঠলো,
— ফার্স্ট তো হয়েছো তুমি তাহলে তোমার আপুর জন্য গিফ্ট কেন?
ছেলেটি আবারও হাসলো। আরু লক্ষ্য করলো হাসলে ছেলেটির বাম গালে হালকা টোলের মতো হয়। ছেলেটি মুখে হাসি নিয়েই বলে উঠলো,
— এমনি। আমার সাথে ভালো কিছু হলেই আপুর জন্য গিফ্ট কিনি আমি। কিন্তু কখনোই দিই না ওকে। নিজের কাছে রেখে দিই। আপুর যখন বিয়ে হয়ে যাবে তখন দিবো। এক কার্টুন গিফ্ট দিয়ে আপুকে চমকে দিবো। আমার আপু কখনই চমকায় না। আপু বলে, পৃথিবীতে যা কিছু ঘটে সবই পসিবল এতে চমকে গিয়ে জ্ঞান হারানোর কিছু নেই।
রেদুয়ানের কথায় হাসলো আরু। আরুর কেনো জানি রেদুয়ানের বোনটাকে দেখতে ইচ্ছে করছে খুব। আচ্ছা মেয়েটার নামটা কি হতে পারে? রোদেলা টাইপ কিছু? রেদুয়ান -রোদেলা? হতেও পারে। আরু কি রেদুয়ানকে তার বোনের নামটা জিগ্যেস করবে? আরুর দ্বিধাদ্বন্দের মাঝেই দরজা ঠেলে কেবিনে ঢুকলে আরিফ-লিনা। রেদুয়ানকে জড়িয়ে ধরে ধন্যবাদ জানালো আরিফ। রেদুয়ান তার বিখ্যাত হাসিটা ঠোঁটে ঝুলিয়ে বেরিয়ে গেলো চুপচাপ। আরু একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। রেদুয়ানের বোনের নামটা জানা হলো না তার। থেকে গেলো একটা আক্ষেপ, একটা আকাঙ্খা আর একগুচ্ছ কৌতূহল!
২০.
ঘড়িতে তিনটার ঘন্টা বাজতেই সতর্ক হয়ে উঠলো রোজা। দুপুরের খাবার চেইক করতে গিয়ে কাজের লোকদের খাবারে ঘুমের ঔষধ মিশিয়েছিলো সে। এতোক্ষণে ঘুমিয়ে পড়ার কথা সবার। রোজা নিচের সব কটা ঘরে উঁকি দিয়ে দেখতে লাগলো সবাই ঘুমিয়েছে কিনা। সিকিউরিটি চিপ বেরিয়ে যেতেই রোজাকে ফোন লাগালো তীর্থ। ব্লোটোথটা কানে লাগিয়ে দু’তলার এক কোনায় গিয়ে দাঁড়ালো রোজা।
— হ্যালো রোজা? সিকিউরিটি চিপ বেরিয়ে গেছে। আমাদের হাতে মাত্র দু’ঘন্টা আছে। যা খোঁজার তাড়াতাড়ি খোঁজ। এই দু’ ঘন্টা ক্যামারা তাই দেখাবে যা আমি দেখাতে চাইবো। সো এটাই সুবর্ণ সুযোগ রোজা।
— বুঝতে পারছি। বাট দেয়ার ইজ আনাদার প্রবলেম ডুড।
— প্রবলেম? কি প্রবলেম?
— ওপারের তলায় আটটা ঘর আছে। আর নিচের তলায় ছয়টি। নিচের তলার সবগুলো রুমেই কেউ না কেউ থাকে। তারমানে নিচের রুমগুলোতে ১৪ বছর আগের কোনো ক্লু থাকা ইম্পসিবল। তাহলে বাকি রইলো উপরের আটটা রুম। এই আটটা রুমের একটাতে মৃন্ময় থাকে বাকিসব ফাঁকা। বাইরে থেকে সব কটারই তালা বন্ধ। এখন প্রশ্ন হলো এই তালার চাবিগুলো কোথায়? আমাদের আগে চাবি খুঁজতে হবে তীর্থ।
— চাবি! এটা আবার আরেক নতুন ঝামেলা রে ভাই। চাবিটা কোথায় পাবো এখন? একটা কাজ কর…মৃন্ময়ের রুমে যা। সার্চ করে দেখ ড্রয়ার ট্রয়ারে আছে কি না।
— মৃন্ময়ের রুমে যাওয়াটা সেইভ নয় তীর্থ। হি ইজ এন ইন্টেলিজেন্ট বয়। ধরা পড়ে যেতে পারি। প্রথমেই এমন কোনো রিস্ক নেওয়াটা ঠিক হবে না তীর্থ। অন্যকোনো উপায় বের করতে হবে। সামথিং ইল্স!
— তাহলে! তাহলে! ইয়েস…আসলাম ভাই!
— হু ইজ আসলাম ভাই?
— তোর মনে নেই? পুরান ঢাকার আসলাম ভাই। তালা দেখেই চাবি বানাতে পারেন উনি। তুই একটা কাজ কর খুব ভালো করে তালার কিছু ছবি তুলে নে ফোনে। তারপরেরটা নাহয় আসলাম ভাই-ই দেখে নিবে।
— বাহ্। তোর মাথায় তাহলে গোবর ছাড়াও কিছু আছে। এনিওয়ে তাহলে প্ল্যানটা ওয়ার্ক করছে না আজ। আমি বরং বাসার একটা ম্যাপ বানিয়ে নিই। তুইও একটু অফিস ঘেটে দেখ কোন ম্যাপ ট্যাপ আছে কি না। এমনও তো হতে পারে যে আমাদের দৃষ্টির অগোচরেও অনেক কিছু আছে। আই মিন…এনি সিক্রেট রুম!
— ওকেহ! আই উইল চেইক। এই এই মৃন্ময় বাড়ি ঢুকছে। টেইক পজিশন রোজা। বাই।
রোজা তাড়াহুড়ো করে ব্লুটুথ খুলে নিজেকে চেইক করে নিলো। তারপর নেমে গেলো নিচে। সোফায় গিয়ে চুপচাপ বসে একটা ম্যাগাজিন হাতে তুলে নিলো হাতে। মৃন্ময় ব্রাউন কালার শার্ট পড়েছে আজ। উপরের দু’ তিনটা বোতম খোলা হওয়ায় বুকের অনেকটায় দৃশ্যমান। দরজা দিয়ে ঢুকেই উপরের দিকে হাঁটা দিলো সে। সোফায় যে একটা মেয়ে বসে আছে সেটা যেনো চোখেই পড়লো না তার। সোহেল একগাদা ফাইল নিয়ে মৃন্ময়ের পিছু ছুঁটছে। মৃন্ময় সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে বলে উঠলো,
— মিস এলিনা? এক কাপ হার্ড কফি প্লিজ। আই থিংক এসির পাওয়ারটা বাড়িয়ে দেওয়া উচিত, আপনি ঘামছেন। এন্ড ম্যাগাজিনটা সোজা করে ধরুন।
মৃন্ময়ের কথায় চরম রকম অবাক হলো রোজা। অবাক বিস্ময়ে ম্যাগাজিনের দিকে তাকালো সে। সত্যিই ম্যাগাজিনটা উল্টো করে ধরে আছে রোজা। কপালেও বিন্দু বিন্দু ঘাম। বিস্ময়ে মুখটা হা হয়ে গেছে রোজার। মৃন্ময় ওর দিকে না তাকিয়েই এতোটা নিখুঁতভাবে কি করে বলে দিলো সব? হি ইজ আ ডেঞ্জারাস পয়েন্ট ফর দেম, রোজাদের আরো সতর্ক হতে হবে। অনেক বেশি সতর্ক।
# চলবে…