#চেম্বার_কথন_21
ভদ্রলোক, ” বাবার বয়স বাহাত্তর। ডায়াবেটিস, প্রেশার, প্রোস্টেট আছে। ইদানিং ছোটো ছোটো জিনিষ ভুলে যাচ্ছেন। সকালের কথা, দুপুরে ভুলে যাচ্ছেন। আত্মীয় স্বজন আসলে কখনো চিনতে পারেন, কখনো মনে করিয়ে দিতে হয়। বারবার জিজ্ঞেস করতে থাকেন, কখন এসেছে? খেয়ে ভুলে যান। এখন তো একদমই চুপচাপ হয়ে গেছেন। কথাও বলতে চান না। অথচ আগে প্রচুর গান গাইতেন, আড্ডা দিতেন। সময়ও মনে রাখতে পারেন না।”
আমি, ” আপনারা নিউরোলজিস্ট দেখিয়েছেন?”
ভদ্রলোক, ” না! আপনার কাছেই প্রথম আনলাম! কোথাও যেতে চান না! হাসপাতালে নেওয়া মহা মুশকিল। আপনার এখানে সাইনবোর্ড নাই বলে রক্ষা। তাই এইটুকু আনতে পেরেছি।”
আমি, ” আগে নিউরোলজিস্ট দেখিয়ে ডিমেনশিয়া হলে পিজি হাসপাতালের প্যালিয়েটিভ মেডিসিনে যোগাযোগ করবেন। রোগী যেহেতু বের হতে চান না তাই হোম কেয়ার লাগতে পারে। সেখানে রেজিস্টার্ড রোগীদের জন্য ফ্রী হোম কেয়ারের ব্যবস্থা আছে। ভালো হবে না, বাড়ী নিয়ে যান বলে আজকাল রোগীদেরকে ছেড়ে দেয়া হয় না। ভালো না হওয়া অসুখেরও যত্ন আছে।”
ভদ্রলোক, ” ডিমেনশিয়া মনে তো স্মৃতিভ্রষ্টতা!”
আমি, ” ডায়াগনোসিস করার জন্যই নিউরোলজিস্ট দরকার। আমি না।”
তারপর বাবার দিকে তাকিয়ে বললাম, ” আমি সানজিদা, মানুষের রাগ, দুঃখ, ভয় নিয়ে কাজ করি। আপনি কি আমাকে কিছু বলবেন?”
বাবা কিছুক্ষণ তাকিয়ে বললেন, ” আপনি কে?”
আমি আবার একই কথার আস্তে আস্তে পুনরাবৃত্তি করলাম। কিছুক্ষণ একই প্রশ্নোত্তর পর্ব চলতে লাগলো।
মানুষের মস্তিষ্কের সাথে বাইরের পৃথিবীর সরাসরি সংযোগ নাকি রেটিনা। আমি বাবার চোখের তীব্র ভয় খেয়াল করলাম। প্রতিবার কথোপকথনে ঝিলিক দিয়ে উঁকি মারে। আবার গায়েব হয়ে যায়। স্থির চোখে তাকিয়ে প্রশ্ন করলাম, ” মনটা কি চায়?”
বাবা, ” খোকা থাকুক কাছে। ও চলে যায়।”
আমি, ” কোথায় যায়?”
বাবা অনিশ্চিত কণ্ঠে, ” কাজে! অফিসে?”
আমি আঙুল দিয়ে ভদ্রলোককে দেখিয়ে, ” খোকা চলে গেলে আপনার ভয় করে?”
ভয় বাবার চোখে ঝলসে উঠলো। উনি ভদ্রলোকের হাত চেপে ধরলেন।
আমি, ” বাসায় আর কেউ নেই?”
ভদ্রলোক, ” আমরা দুজনই। কাজের লোক আছে।”
আমি বাবাকে প্রশ্ন করলাম, ” খোকা আপনার কে হয়?”
বাবা স্পষ্ট গলায়, ” জামাই!”
অবাক হয়ে খেয়াল করলাম বাবার গলাটা কি একটু ভেঙে আসলো শেষের দিকে?
জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালাম ভদ্রলোকের দিকে। উদ্ধার হলো, ভদ্রলোক ওনার মেয়ের জামাই। বেশ কয়েক বছর আগে কোন এক রোড ট্রাফিক অ্যাকসিডেন্টে ভদ্রলোকের নিজের বাবা-মা এবং স্ত্রী স্পট ডেড। তারপর থেকে শ্বশুর জামাই একসাথে থাকেন। (ভদ্রলোক কেন নতুন জীবন সঙ্গী গ্রহণ করলেন না সেই প্রসঙ্গ এখানে টানছি না।) এই পরিবারে বাচ্চা নেই। কিন্তু আমার কেন জানি মনে হল, এই খোকার বুড়ো খোকা হলেন তাঁর শ্বশুরমশাই স্বয়ং। যেভাবে পরম মমতায় পানির গ্লাসটি মুখে তুলে ধরলেন আমার দেখে অবাক লাগল বউ মরে যাবার পরেও এভাবে শ্বশুরের যত্ন করে করা যায়?
আচ্ছা!
মানুষ এরকমও হয়!
অথচ ভিন্ন গল্পগুলো শুনতেই আমরা অভ্যস্ত।
প্রত্যেকটা মানুষের জীবনে লুকিয়ে থাকে এক একটা গল্প। উহু! প্রত্যেকটা মানুষের ভেতরে লুকিয়ে থাকে বহু গল্প। ইদানিং খুব মনে হয় কতটুকুই বা বুঝি মানুষকে! যত দিন যাচ্ছে নিজের না বোঝার পাল্লা ততো ভারী হতে দেখছি।
আমার সেই অদৃশ্য ভদ্রমহিলার প্রতি একটু ঈর্ষা হলো কি? হয়তোবা! কত মানুষ বেঁচে থেকেও একজন অপরজনের কাছে মৃত! অথচ মরে যেয়েও এই মানুষটি এখনো কি ভীষণ জীবন্ত!
এক বিগত নারীর বৃত্তবন্দী দুজন অসম বয়সী পুরুষ, আমার চেম্বার থেকে পরম মমতায় এবং নির্ভরতায় পরস্পরের হাত ধরে বের হয়ে গেলেন… আমার ক্ষুদ্রতাকে চোখে আঙুল দিয়ে, ‘না বলা ভাষায়’ দেখিয়ে!
(আমার চেম্বারে আসা মানুষদু’টির অনুমতি সাপেক্ষে আলোচনার এই অংশটুকু কনফিডেনশিয়ালিটি রেখে প্রকাশ করা হলো।)
অধ্যাপক ডা. সানজিদা শাহরিয়া
চিকিৎসক, কাউন্সিলর, সাইকোথেরাপি প্রাকটিশনার।