#চেম্বার_কথন_২৯
ভদ্রমহিলা, ” আমি জীবনে একটা মাত্র মানুষকেই পাগলের মতো ভালোবেসেছি সেটা হচ্ছে আমার হাজব্যান্ড। ও যা বলতো, যেভাবে বলতো সেটাই আমার কাছে ধ্রুব সত্য। যেহেতু সে দীর্ঘদিন আমার প্রাইভেট টিউটর ছিল আমাদের বাসার সমস্ত গল্প ওর জানা। আমি যখন ইউনিভার্সিটিতে ততদিনে সে পিএইচডিতে। উভয়পক্ষের পারিবারিক সম্মতিতেই ওর বিদেশে যাওয়ার আগেই আমাদের আকদটা হয়। মাঝে মধ্যেই খবর পেতাম বিদেশে তাঁকে এই মেয়ে, সেই মেয়ের সাথে দেখা গেছে। মোটেও বিশ্বাস করতাম না। বরং যাঁরা বিভিন্ন সময় এই কথাগুলো বলতেন তাদের সাথেই সম্পর্ক ছেদ করতাম চিরতরে। প্রথমবার ও যখন দেশে ফিরল তখন কনসিভ করলাম। যাবার আগে বলে গেল এখনও যেহেতু আমরা দুজনেই সেটেল না তাই এই মুহুর্তে বাচ্চা নিতে সে প্রস্তুত না। বাসায় কাউকে না জানিয়ে যেন অ্যাবরশনটা করিয়ে ফেলি ও চলে গেলে। এটা কোনো ব্যাপারই না। হরহামেশাই মেয়েরা করে। ওর প্রতিটি কথা তখন আমার কাছে বেদবাক্য। একাই বাসায় মিথ্যা বলে এবরশন করতে গেলাম। সবার কি তীব্র বাঁকা দৃষ্টি। ইনজেকশন দেওয়ার সময় ব্যথায় উহু করে উঠলে, সিস্টার বলল, ‘শোবার সময় এই উহু আহা কই ছিল!’ সবার তখন কি বিশ্রী নিষ্ঠুর হাসি। কি অশ্লীল তাকানো! আমার শ্বশুরবাড়ি আজও অসম্ভব আদর করে আমাকে। আমি বাবা-মা, বন্ধুবান্ধব কাউকে জানাইনি এই ঘটনাটা। এরপর সে দেশে ফিরল। আমরা সংসার শুরু করলাম। প্রথম ছয় মাসের মধ্যে তাকে ধরলাম অফিস কলিগের সাথে। সেদিন আমি খুব আহ্লাদ করে নিজ হাতে লাঞ্চ বানিয়ে নিয়ে যেয়ে টোকা না দিয়ে ওর কেবিনে ঢুকতেই দেখি ওরা চুমু খাচ্ছে। এরপর বিস্তর সরি বলা। কাউকে যেন না জানাই সেই অনুরোধ। এর বছরখানেক পরে ওর এক ইন্টার্ন এর সাথে আবার ধরি, অফিস ছুটির পরে। ওকে সারপ্রাইজ দেবো বলে যেয়ে নিজেই সারপ্রাইজড হয়ে যাই। আবার বিস্তর সরি বলা, হাত-পা ধরা। ততদিনে বাজে জায়গা থেকে এবরশন করানোর জন্য আমার কম্প্লিকেশন শুরু হয়েছে। বাচ্চা হচ্ছে না। তৃতীয়বার ধরি আমার এক বান্ধবীর সাথে। চতুর্থবার আমার ননদের বান্ধবীর সাথে। এরপরে
আর হিসেব রাখি নাই। আমাদের বিয়ের ১৫ বছর পেরিয়ে গেছে। ও নাকি আমাকে এতই ভালবাসে যে আমাকে ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করতে পারবে না। আমি বাজা হওয়া সত্বেও। এটা নাকি আমার অসাধারণ সৌভাগ্য। এই কথা আমার নিজের বাবা-মা’ র। আমার দুই ভাই ওর টাকায় প্রাইভেট থেকে পড়ে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হয়েছে। আমার নিম্নবিত্ত বাবার পুরো সংসার ও চালায়। কিন্তু আমাদের দুজনের সংসারে ওর মন টিকে না। প্রচুর ট্যুরে যায়। শরীরে বিভিন্ন দাগ দেখি। প্রথম প্রথম জিজ্ঞেস করলে বলতো, ‘মশার কামড়।’ এখন প্রশ্ন করা বন্ধ করে দিয়েছি। আমি জানি সামনের ঈদেও লাখের উপরের দামী শাড়িটা আমিই পাবো। একসেট ভারী গহনাও পাবো। পেইন্টিং পছন্দ করি বলে দামী কোনো বিখ্যাত শিল্পীর একটা পেইন্টিং ও পাবো। কিন্তু আমি যেই মানুষটিকে চাই সে যেন একটু একটু করে পেন্সিলের শীষের মত ক্ষয়ে গেছে আমার জীবন থেকে। এখন শুধু তার একটা হারিয়ে যাওয়া রক্তমাংসের ছায়া আমার চারপাশে ঘুরে। মনে হয় একজন অশরীরীর সাথে সংসার করছি।”
আমি, “কাউন্সেলিং থেকে কি চান?”
ভদ্রমহিলা, ” আমি চিৎকার করে কাঁদতে চাই পারি না। আমার শ্বশুর-শ্বাশুড়ি এত আদর করেন যে আমি উফ্ করলেই ওনারা মরে যাবেন। আবার মাঝে মাঝে মনে হয় আসলেই কি আমি চিৎকার করতে চাই? নাকি আমি সোনার দাড়ে বসা এক রাজকীয় হীরামন পাখি?”
আমি, ” আমার কাছে কেন এসেছেন?”
ভদ্রমহিলা, ” আমি শুধু একটা জিনিস জানতে চাই। আমার হাসবেন্ড যে সব সময় বলে, ও ভুল করেছে, ক্ষমাপ্রার্থী। কারণ ওই মেয়েগুলোই নাকি বারবার ওকে প্রলুব্ধ করে ওর টাকা দেখে। ওর সৌন্দর্য দেখে। সে দেখতে আসলেই চমৎকার। ও নাকি প্রতিবারই নির্দোষ। আমি বুঝতে চাই, আসলে কি মেয়েগুলোই ওকে প্রলুব্ধ করে? ওর নিজস্ব কোনো দায়িত্ব নেই প্রলুব্ধ না হতে? “
আমি আস্তে আস্তে দৃঢ় গলায় ভদ্রমহিলার চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম, ” Cheating is a Choice, Not a Mistake… জীবন সঙ্গীর অগোচরে বারবার পরকীয়ায় জড়ানোটা নিজের ইচ্ছা এবং সিধান্ত। কথায় বলে, একটা সম্পর্কে আমি কেমন আচরণ করবো সেটা সম্পূর্ণ নিজস্ব পছন্দ অনুসারেই আমি সিধান্ত নেই। আমরা জীবনসঙ্গীকে তখনই আঘাত করি যখন তাঁর কষ্ট পাওয়াটাকে গুরুত্ব দেইনা।”
প্রশ্ন হলো কিভাবে বুঝব যে জীবনসঙ্গী আমাকে গুরুত্ব দিচ্ছেন? গুরুত্ব দিলে তিনি শুধু মুখে মুখেই সরি বলবেন না। কারণ মুখের কথার ফুলঝুরির দাম নেই, লাভও নেই। কাজে প্রমাণ করে দেখাতে হবে। কেউ যদি সত্যিই অনুতপ্ত হন তবে তিনি নিজের আচরন বদলাবেন। একটা প্রবাদ আছে, ‘এক ভুল বারবার তার মুখে জুতা মার।’ আমরা অনুভুতি বা চিন্তা অন্যকে নিজের হৃদয়টা মেলে বা মাথাটা খুলে দেখাতে পারি না। শুধু আচরণটা দেখাতে পারি। ভুল করলে ক্ষমা মহত্ব! কিন্তু কতবার ?
আমি, ” আপনার স্বামীর একই ঘটনার পুনরাবৃত্তিতে আপনি নিজে কি ভূমিকা নিয়েছিলেন? একটু কি নিজের চোখের সামনে নিজেই আয়না ধরা যায় যে আমি কি করেছিলাম তখন?”
ভদ্রমহিলা, ” আমি নিজের বুকে পাথর চেপে, একই ভুলের জন্য বারবার তাকে সুযোগ দিয়েছিলাম।”
আমি, ” ফলশ্রুতিতে কি হলো?”
ভদ্রমহিলা, ” আমি তার জীবন থেকে অদৃশ্য হয়ে গেলাম। শুধু কাগুজে বউ হওয়া ছাড়া।”
আমি, ” এখন আবেগে বিগলিত না হয়ে ঠান্ডা মাথায় ভেবে বলুন কি করবেন ?”
অনেকক্ষণ চুপচাপ।
তারপরে ভদ্রমহিলা বললেন, ” আমি আর এই অসম্মানের বোঝা বহন করবো না।”
আমি, ” কিভাবে?”
ভদ্রমহিলা, ” নিজেকে চালানোর যোগ্যতা আছে কারণ আমি স্বাবলম্বী। শ্বশুর শ্বাশুড়ীর সাথে সম্পর্ক মোটেও ছিন্ন করবো না। আমি একটু আমার মতন করে বাঁচবো এখন থেকে। আমার নিজের শর্ত অনুসারে।”
যদি বিবাহিত সম্পর্ক না টিকে তবে ধর্মীয়, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় বিধান আছে আলাদা হয়ে যাবার। কিন্তু জীবনসঙ্গীর সাথে, একই ছাদের নিচে থেকে, তাঁর আত্মমর্যাদায় আঘাত করবার, কোন অধিকার প্রকাশ্যে বা গোপনে পৃথিবীর কোনো মানুষের নেই।
(পুনশ্চ: আমার চেম্বারে আসা মানুষটির অনুমতি সাপেক্ষে কনফিডেনশিয়ালিটি বজায় রেখে জনসচেতনতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে কথোপকথনের এই অংশটুকু প্রকাশ করা হলো।)
অধ্যাপক ডা. সানজিদা শাহরিয়া
চিকিৎসক, কাউন্সিলর, সাইকোথেরাপি প্রক্টিশনার