#চেম্বার কথন পর্ব ৪৪
কিশোর, “আমি প্রচন্ড ভয় পাচ্ছি স্কুল খুললে কিভাবে ডিল করব।”
ছেলেটার চোখে আমি তীব্র ভয় দেখছি। কপালে ফোঁটা ফোঁটা ঘাম জমেছে। শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি দ্রুততম। একটা ১৫ বছরের ছেলের এমন ভয় হওয়া অস্বাভাবিক। কিশোরটি দেশের নামকরা এক ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলে পড়ে।
আমি মৃদু কন্ঠে প্রশ্ন করলাম, ” কি হয়েছিল?”
কিশোর, ” আমাদের ক্লাসে প্রচন্ড পরিমান বুলি হয়। একদল ছেলে মেয়ে যারা খুব ফেমাস, পপুলার তারা জোট বাঁধে। এরপর ক্লাসে যারা উইক স্টুডেন্ট তাদেরকে বুলি করে।”
আমি, ” কি রকম?”
কিশোর, ” যেমন কাউকে বলে তুমি দেখতে কাকের মতন, কাউকে বলে, তোমাকে পছন্দ করি না তুমি আমাদের হোয়াটস অ্যাপ গ্রুপ থেকে বের হয়ে যাও, বা এমনকি কাউকে এটাও বলেছে তুমি ছাদ থেকে যেয়ে লাফ দিয়ে মারা যাও। বা তুমি গলায় দড়ি দাও না কেন? এরকম একেক জনকে একেক রকম কথা। এর উত্তর কি পেলো সেটা নিয়ে সবার সামনে হাসাহাসি করে।”
আমি, “টিচারদেরকে বলো নাই?”
কিশোর, ” বলে কোন লাভ নেই। কারণ ক্লাসে যখন এরা বুলি করে টিচাররা কেউ সেভ করতে আসে না।”
আমি, “টিচাররা কি করেন?”
কিশোর, ” সকালবেলা লাইন করে দাঁড়িয়ে বুলি করা যাবে না এই নিয়ে কথা বলেন, পোস্টার লাগানো আছে যে বুলি করা যাবে না। কিন্তু যারা বুলি করছে ওদের বিরুদ্ধে কোন স্ট্রং ব্যবস্থা নেন না। “
আমি, ” সব টিচার এমন?”
কিছুক্ষণ ভেবে কিশোর বললো, ” না, কিন্তু সবাই না। সব টিচারের তো আর পাওয়ার নেই। আসলে অথরিটি এরকম। ওরা স্কুলের রেপুটেশনের ব্যাপারে খুব সিরিয়াস। বাকি কিছু পাত্তা পায় না।”
আমি বেশ বুঝতে পারছি ছেলেটি কি বলতে চায়। ইদানিং রাজধানীতে কিশোর গ্যাং সুপরিচিত। কিন্তু ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলোতে যে দুঃসহ বুলি হয় তার খুব কমই খোলামেলা আলোচনায় আসে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে স্কুলই নিজেদের রেপুটেশন বাঁচাতে ধামাচাপা দিয়ে দেয়।
তার প্রধান কারণ এটা বিত্তশীলদের জায়গা। বুলি বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। সাইবার, মৌখিক, শারীরিক থেকে শুরু করে যৌন বুলিও হয় এমন খবর শুনেছি।
সব থেকে বেশি যেটা হয় সেটা সাইবার বুলি। সোশ্যাল মিডিয়াতে কোন এক ছাত্রকে নিয়ে গুজব রটানো হয়, আক্রমণাত্মক/ অবমাননা মূলক মন্তব্য করা হয়। মৌখিক বুলি তো আমরা সবাই বুঝতেই পারি। দলবেঁধে একজনকে ভিকটিম করে, জিজ্ঞেসাবাদ করে তুমি কেন এই করলে? কেন সেই করলে? কেন কমপ্লেইন করলে?
এসব ক্ষেত্রে বাবা মা বুঝতে চান না। তাঁরা চকচকে মোড়কের তলে অন্ধকার দেখেন না। মনে করেন এত টাকা দিয়ে যখন পড়াচ্ছি, এত ফিটফাট ভালই তো। কখনো কখনো বোঝার পরে কমপ্লেইন দিলেও, স্কুল অথরিটি সহযোগিতা করেন না। স্কুল বদলের ঘটনা তাই ক্ষেত্র বিশেষে ঘটে।
আমি এমনও শুনেছি সবাই মিলে বাচ্চাটিকে দৈহিক নির্যাতন করেছে। শরীরে আপত্তিকর ভাবে স্পর্শ করেছে। ভিডিও করেছে। পরে সেই ভিডিও দিয়ে ব্ল্যাকমেইল করা হয়েছে। কিছু কিছু স্কুলে ক্লাসে মোবাইল আনা নিষিদ্ধ। তারপরেও গোপনে মোবাইল আনা হয়। খোঁজ নিলে দেখা যাবে এরকম ঘটনার শিকার বেশ কিছু বাচ্চা পড়াশুনায় পিছিয়ে যাওয়া থেকে শুরু করে নানাভাবে ভুগছে। মেয়ে বাচ্চাদের ক্ষেত্রে সমস্যা আরো বেশি। কারণ ইজ্জত তো ঠুনকো জিনিস। টোকা লাগলেই কাঁচের মতন নষ্ট হয়ে যায়।
আমার খুব অবাক লাগে। আমরা বাচ্চাকে নিজেকে সম্মান করতে এবং অন্যকে সম্মান করতে কবে শেখাবো? ইজ্জত কি কাচের গ্লাস?
শিশুদের নিষ্ঠুরতা কিন্তু মাঝে মাঝে সাংঘাতিক হয়। তারা প্রচন্ড আক্রমণাত্মক হতে পারে। শুধু মজা নেওয়ার জন্য মনোসামাজিকভাবে অন্য আরেকজন শিশুকে আঘাত করতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ১৮ বছর পর্যন্ত শিশু ধরছে।
ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের বাচ্চাদের কারো কারো ক্ষেত্রে (অবশ্যই সবার জন্য নয়) গাড়ির মডেল, ফোনের মডেল, ছুটিতে কোথায় ঘুরতে গেল ইত্যাদি স্ট্যাটাস সিম্বল হয়ে যায়। আমি এমন বাচ্চার কথা জানি যাদের গাড়িটি খুব উচ্চ সীমার নয় বলে, স্কুলের গেট থেকে বেশ দূরে গাড়িটি পার্ক করে বাচ্চাটি হেঁটে গেটে ঢুকে।
ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল সবগুলোই কি খারাপ? মোটেও না! কিছু কিছু স্কুল সত্যিই চমৎকার। বাংলাদেশের অনেক মেধাবী ছাত্র-ছাত্রী সেসব জায়গা থেকে বের হয়ে এসে দেশে এবং বিদেশে বাংলাদেশের মুখ উজ্জ্বল করছে। এসব স্কুলগুলো আসলেই সেন্টার ফর এক্সিলেন্স।
মুশকিল হয়ে যায় বর্তমানে বাংলাদেশে একশ্রেণীর মানুষের এত টাকা হয়ে গেছে তারা টাকার মাপকাঠিতে মানুষকে বিচার করে। ফলে বাচ্চারা তো বাবা-মাকেই কপি করবে। এ ধরনের অভিভাবকরা বিবেচনাহীন ভাবে বাচ্চাকে সবকিছু দিতে যেয়ে অস্বাস্থ্যকর বিত্ত ও ক্ষমতা প্রদর্শনের প্রতিযোগিতা শুরু করে দেন। মনে রাখতে হবে অধিকাংশ ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলই কর্পোরেট কালচারের বাইরে নয়।
গোদের উপর বিষ ফোড়ার মতো, খোঁজ নিলে দেখা যাবে কিছু কিছু স্কুলের বাচ্চারাও ড্রাগ পেডলিং এর সাথে জড়িত। অথরিটি কি সব সময় আসলেই কিছু জানেন না?
সন্তান পালনে শাসন এবং আদর দুটোই দরকার। আবার অতিরিক্ত দুটোই অমঙ্গলজনক। স্মার্ট বাবা-মা সাজতে যেয়ে ওভার স্মার্ট হয়ে বাচ্চাদের হাতে তুলে দিচ্ছেন গাড়ির চাবি, হিসেবহীন টাকা। পার্টির নামে আসলে বাচ্চারা কি করছে এই জিনিসগুলো কিন্তু খেয়াল রাখা বাবা মা’রই কর্তব্য। আমার ছেলের রুমে নক করে ঢুকে সে কি করছে জানতে চাওয়াটা মোটেও অস্বাভাবিক কিছু নয়। আমার ছেলে মেয়ে কোন বাসায় যাচ্ছে সেই বাসার পরিবেশ বুঝতে আমার খোঁজ নেয়াটা মোটেও অস্বাভাবিক নয়। ইদানিং বাচ্চা কেন এত মেকআপ করছে? ইদানিং বাচ্চা কেন ঘরেই থাকতে চাইছে? এই গল্পগুলো জানতে হবে।
বুলি কিন্তু কখনো কখনো শিক্ষকরা ও করেন। যাতে তার কাছে প্রাইভেট পড়ে। এটা সব থেকে বেশি চলে আসা গল্প। কিন্তু যৌন হয়রানিও হয়। কিন্তু এই গল্পগুলি গোপন রাখা হয় মানসম্মান চলে যাবে সেই ভয়ে। আর কতদিন গেলে আমাদের সমাজ মানসম্মানকে নতুন করে সংজ্ঞায়িত করবে?
আমরা বাচ্চাদের প্রাইভেসি দেব। কিন্তু বাচ্চারা যা চাইবে তাই দেব না। আমরা বাচ্চাদেরকে সম্মান দেব। কিন্তু বাচ্চা কাউকে অসম্মান করলে সেটাও শুধরে দেবো। আমার বাচ্চা যা করে তাই ঠিক, এটি ভ্রান্ত ধারণা। কারণ তাহলে এই বাচ্চাই বড় হয়ে আপনাকে বলবে, “আমি তো ছোট ছিলাম বুঝিনি, তুমি তো বড় ছিলে, তুমি বোঝোনি কেন?”
আমাদের আলোচ্য কিশোরের কাছে ফিরি। এই বাচ্চাটির মা যখন অথরিটির কাছে কমপ্লেন করলেন অথরিটি কিন্তু শোনেননি। সোজা বাংলায় মোটেও পাত্তা দেয়নি। পরবর্তীতে মা যখন সংবাদ সম্মেলন এবং জিডি করবেন বলে অথরিটিকে জানান। তখন অথরিটি সুরসুর করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়।
কিন্তু ইতিমধ্যে ক্ষতি যা হবার হয়ে গেছে। বাচ্চাটি তীব্র ভয়ে একাধিক বার প্যানিক এ্যাটাকের শিকার হয়েছে। স্কুলের পপুলার ছেলেদের দল, বাচ্চাটিকে সাইবার বুলি করে। সবার সামনে ওর গায়ের রং কালো বলে হাসাহাসি করে। মাকে যখন স্ক্রিনশট দেখায়, মা সেগুলো অথরিটিকে বললেও তারা প্রথমে যখন আমলে নেন না। তখন বুলি দ্বিগুন মাত্রায় বেড়ে যায়। পরবর্তীতে বাচ্চার যখন প্যানিক অ্যাটাক হওয়া শুরু হয়, তখন মা কড়াভাবে অথরিটিকে বলেন যে এগুলি প্রতিহত না করলে তিনি প্রেস কনফারেন্স করবেন, সাইবার ক্রাইমকে জানাবেন। তখন তড়িঘড়ি করে অথরিটি যেই ছেলেগুলো বুলি করত তাদের বাবা-মাকে ফোন করে। ফলে তারা আবার চড়াও হয়।
এসব ক্ষেত্রে অথরিটি যদি দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা না নেয়, ভিকটিম প্রতিবাদ করতে পারবে না। এবং জুলুমবাজ জুলুম করতেই থাকবে।
আমি স্যালুট দেই এই মা’কে। যিনি প্রতিবাদ করেছেন। কারণ, “Unless and until our society recognizes cyber bullying for what it is, the suffering of thousands of silent victims will continue.” ~ Anna Maria Chavez
আমরা চাইনা স্কুলের কিশোররা শাস্তি পাক। আমরা চাই আমাদের কিশোরা নিজেদেরকে ভালবাসুক। বন্ধুদেরকে ভালবাসুক। তাহলেই তারা বড়দেরকে সম্মান করতে শিখবে। মমতাময় সমাজ যদি আমাদের স্বপ্ন হয়, আজকের কিশোর কিশোরী হবে সেই স্বপ্নপূরণের কান্ডারী।
বাচ্চাকে স্কুলে ভর্তি করার আগে স্কুলে বুলি কিরকম হয় সে ব্যাপারে খোঁজ নিন।
আহমেদ ছফার একটা উক্তি আমার প্রচন্ড পছন্দের,
“বড় বড় নামকরা স্কুলে বাচ্চারা বিদ্যার চাইতে অহংকারটা বেশি শিক্ষা করে।” আমরা কি সেদিকেই ধাবিত হচ্ছি?
বাংলাদেশের স্কুলগুলোতে অদৃশ্যভাবে ভয়ংকরতম বুলি হচ্ছে। এখানে বাংলা মিডিয়াম, ইংরেজি মিডিয়াম বলে কোন পার পাওয়া যাচ্ছে না। হোস্টেলগুলোতে কি পরিমান বাচ্চা ধর্ষণের শিকার হচ্ছে তারও কোনো খতিয়ান আমাদের কাছে নেই। আবাসিক মাদ্রাসাগুলোতে বাচ্চা যদি যেতে না চায়, বাবা মাকে বলবো আপনারা বাচ্চা কেন যেতে চায় না বুঝুন তার কাছ থেকে। আগে ইহকালে বাচ্চাটিকে বাঁচতে দিন।
যেসব মেডিকেল কলেজে ফরেনসিক মেডিসিন ডিপার্টমেন্টে শিশুদের ধর্ষণ পরীক্ষা হয় প্রতিদিন সেখানে কোন কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বাচ্চারা ধর্ষণের শিকার হয়ে আসে সেটা খোঁজ নিতে সবাইকে অনুরোধ জানাবো। শুধু মেয়ে বাচ্চারা যে ভোগান্তির শিকার তা কিন্তু নয়। ছেলে বাচ্চারাও উল্লেখযোগ্যভাবে ধর্ষিত হচ্ছে।
এখানে একটা প্রসঙ্গ উল্লেখ না করলে অন্যায় হবে। বাংলাদেশ সরকার এখন নারী, পুরুষ এবং তৃতীয় লিঙ্গ তিনটি পরিচয় নিশ্চিত করেছেন। ২০১৪ সালের ২৬শে জানুয়ারী, বাংলাদেশ মন্ত্রিসভা সরকারী ইশতেহারে তৃতীয় লিঙ্গকে এই বলে স্বীকৃতিপ্রদান ও তালিকাভুক্ত করে যে: “বাংলাদেশ সরকার হিজড়া সম্প্রদায়কে হিজড়া লিঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।” এই ঘোষণা বাংলাদেশের তৃতীয় লিঙ্গের শিশুদের আসলে কতটুকু মানবাধিকার দিয়েছে? আপনি কি নিশ্চিত যে আগামী বার আপনার পরিবারে একটি তৃতীয় লিঙ্গের শিশু জন্মাবে না? তাঁরা কিভাবে বুলি হচ্ছে? কখনো কি দয়া নয়, সম সমঅধিকার নয়, সাম্যতার জায়গা থেকে, একজন মানুষ হিসেবে মর্যাদার জায়গা দিয়ে ভেবেছেন সেটা? আমার কাছে আনা হয়, আমি যেন এই বাচ্চাগুলোকে বাবা-মার কাছ থেকে ভিজিট নিয়ে বুঝতে সাহায্য করি যে সে মানসিকভাবে অসুস্থ। মুখে বড় বড় কথা বলা মানবাধিকার কর্মী, শিক্ষক, চিকিৎসককে এমন সন্তান লুকিয়ে রাখতে দেখেছি। কারণ কি? বুলি হবে সেই ভয়।
এই লেখার মূল উদ্দেশ্য, বুলি নিয়ে। কোন নির্দিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে বা নির্দিষ্ট শিক্ষাব্যবস্থাকে কটাক্ষ করা নিয়ে নয়। সে ব্যাপারে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি এই লেখায় আপনার মন্তব্য করবার আগে।
(কথোপকথনের অংশটুকু আলোচ্য কিশোর এবং তাঁর মায়ের অনুমতি সাপেক্ষে মনো-সামাজিক স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে কনফিডেন্সিয়ালিটি রেখে প্রকাশ করা হলো।
পুনশ্চ: *এই লেখার মূল উদ্দেশ্য শিক্ষা ব্যবস্থায় বুলি কালচার নিয়ে।
*কোন শিক্ষা পদ্ধতি ভালো, কোন শিক্ষা পদ্ধতি খারাপ সেটা এখানে আলোচ্য নয়।
*অপ্রাসঙ্গিক মন্তব্য পরিহারযোগ্য।)
অধ্যাপক ডা. সানজিদা শাহরিয়া
চিকিৎসক, কাউন্সিলর, সাইকোথেরাপি প্র্যাকটিশনার।