#গল্প————————- ( পর্ব_দুই)
#চার আনার জীবন
প্রতিজ্ঞা করলাম আজ থেকে আর কোনদিন বাবা-মাকে কিছু বলবো না। নিজের সুখের দায়িত্ব নিজেই নেব।
বিয়ের দুইমাস পেরিয়েছে। এই দুইমাসে প্রাকৃতিক নিয়মের প্রয়োজনে কাছে এসেছে কিন্তু দুজনের মধ্যে এখনো বন্ধনটা তৈরি হয়নি। তাছাড়া ওঁর সম্বন্ধে তেমন কিছুই আমি জানিনা,আর জানার চেষ্টাও করিনি। কারন ওঁর ওই রাগান্বিত চেহারাটা আমার ভিষন অসহ্য লাগে। কিন্তু যখন আমার খুব কাছাকাছি আসে তখন কিন্তু অন্যরকম হয়ে যায় এই রাগটা তখন থাকেনা, অতি যত্ন করে আগলে নেয়।
তাহলে সবার আগে আমার পিয়াস কে বুঝতে হবে,কি ওঁর ভালোলাগা মন্দলাগা পছন্দ অপছন্দ। পারস্পরিক বোঝাপড়াটা নিজেদেরই মিটিয়ে নিতে হবে।
রাতে অফিস থেকে ফেরার পর কড়া করে দুই মগ কফি নিয়ে তাঁর পাশে গিয়ে বসলাম।
বললাম চলেন ছাঁদে যাই, যাবেন?
কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললো চলো যাই।
মফস্বল শহরে শশুরের এই দুইতলা বাড়িটি এলাকার সবার নজর কাড়ে, বাড়ির ভেতরটাতে ও রয়েছে আভিজাত্যের ছাপ। প্রতিটি দেয়ালে রয়েছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কারুকাজের ওয়ালমেট দিয়ে সাজানো। ছাঁদটা ও অনেক সুন্দর, বিভিন্ন ধরনের গাছ চারিপাশ দিয়ে সারি সারি সাজানো আর মাঝখানটাতে চেয়ার টেবিলসহ বসার জায়গা।
জোসনা রাত দুজনে বসে কফির মগে চুমুক দিচ্ছি। আজকে আমার আর ভয় করছেনা।
পিয়াস:- কি ব্যাপার আজকে তোমাকে অন্যরকম মনে হচ্ছে, কারণটা জানতে পারি?
কেন স্ত্রী হিসাবে আমি কি আপনার সাথে একান্তে সময় কাটাতে পারি না? হ্যাঁ আমি স্বীকার করছি বিয়েটা আমার অমতে হয়েছে,তাই বলে কি আমি সব কিছু থেকে বঞ্চিত হবো?স্ত্রীর সব আশা-আকাঙ্খা পূরণ করার দায়িত্ব একমাত্র স্বামীর। আমাকে সুখে রাখার দায়িত্ব ও আপনার। আপনি বুঝতে পারছেন না যে আমি সুখে নাই প্রতিনিয়ত আপনার রাগান্বিত চেহারা আপনার থেকে আমাকে অনেক দূরে সরিয়ে দিচ্ছে।
আমি জানিনা কেন আপনি আমার উপর এতো রাগ, আজকে থেকে সব রাগ উপেক্ষা করে আমাকে কাছে টেনে নেওয়া যায় না?
পিয়াস কফির মগ রেখে ধীরে ধীরে আমার দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো, মনকে সাহস দিলাম আজ আর আমি কিছুতেই ভয় পাবনা যা হয় হবে।
পিয়াস কাছে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। অতি আনন্দে কেঁদে ফেললাম আমি।
পিয়াস:- রিমি আমি এটাই প্রত্যাশা করেছিলাম তোমার থেকে।আমি আর রাগান্বিত হবো না, তুমি শুধু আমাকে এভাবেই ভালবেসো। আমি তোমাকে হারাতে চাইনা।
আজ তোমাকে বলবো কেন তোমার প্রতি আমার রাগ ছিল। মিমি তোমার বড় বোন তাকে আমি খুব ভালোবেসেছিলাম কলেজে যাওয়া আসার পথে আমি তাকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখতাম আর মনের ভিতর তাকে নিয়ে লালন করেছিলাম হাজারো স্বপ্ন। কিন্তু মেয়েটা আমাকে এভাবে ইগনোর করে চলে যাবে বুঝতে পারেনি।
ভুলে যান ওঁর কথা,আজ থেকে আমরা নতুন জীবনের অধ্যায় শুরু করি।
তারপর থেকে আমাদের দাম্পত্যজীবনে শুরু। নিজেকে নিজেই চিনতে পারিনা কারন যে আমি কখনো রান্না তো দূরের কথা রান্না ঘরে কি কি থাকে সেটাই জানতাম না।আজ সেই আমি এখন রান্না ঘরের রাণী।
শাশুড়িকে রান্না ঘরে আসতে দেই না, ননদ তিথি এসে গল্প করে,আমি কাজ করি আর গল্প শুনি।
তিথি আমার সমবয়সী মেডিকেলে পড়াশোনা করছে।
এখন প্রায়ই ছুটির দিনে পিয়াস বেড়াতে নিয়ে যায়, তারপর রেস্টুরেন্টে খাওয়া-দাওয়া সেরে একসঙ্গে টুকটাক কেনাকাটা করে বাসায় ফিরি।
দিনগুলো স্বপ্নের মত কেটে যাচ্ছিল। শশুর শাশুড়ি ও দেখে খুব খুশি। এতো দ্রুত নিজেকে মানিয়ে নিতে পেরে সবকিছু কেমন সহজ হয়ে গেছে।
তরকারিটা সব সময় শ্বাশুড়ি মা ই রান্না করে। সঙ্গে আমি সহযোগিতা করি, রান্নার ফাঁকে শাশুড়ি মা বলছিলেন বৌমা এখনকার সময়ে বেশি দেরি হলে পরে বাচ্চাকাচ্চা নিতে অসুবিধা হয়, তোমরা বাপু দেরি টেরি করো না।
লজ্জায় মাকে পেছন থেকে জাপ্টে ধরলাম।
শাশুড়ি:-দূর বোকা মেয়ে আমিও তো তোর মতন এরকমই একদিন বউ হয়ে এসেছিলাম, এত লজ্জা পাচ্ছিস কেন?
রাতে পিয়াস কে মায়ের বলা কথাগুলো বললাম
পিয়াস:- মা তো ঠিকই বলেছে রিমি। আর মা যেহেতু চেয়েছে তাহলে তো দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হয় আর দেরি করা যাবে না।
সত্যি আল্লাহপাক যা করেন তার বান্দাদের ভালোর জন্যই করেন। বিয়ের সময় মিমি চলে না গেলে হয়তো আমি এতগুলো মানুষের ভালোবাসা পেতাম না।
গ্রামের বাড়ি থেকে ফোন এসেছে শ্বশুরের কাছে, চাচা শ্বশুরের মেয়ে মানে ননদের বিয়ে সবার যেতে হবে। শাশুড়ি মা বললো ভালোই হয়েছে,গ্রামের কেউ বৌমাকে দেখেনি চলো আমরা সবাই যাই। রাতেই যার যার কাপড়চোপড় সবকিছু রেডি করে ফেলো সকালে আমরা যাব।
পরের দিন আমরা সবাই রওনা করি। বাড়ির উঠানে গাড়িটা পৌঁছাতেই দেখি উঠানে মানুষে গিজগিজ করছে নতুন বউ দেখার জন্য।
আমাকে নিয়ে কাছারি ঘরের সামনে চেয়ারে বসিয়ে দিল। আর সবাই আসছে দেখছে, আর মা সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে ওনি তোমার চাচি শাশুড়ি,দাদি শাশুড়ি। অনেকেই মাকে বলছে মেজো বউ খুব সুন্দর বৌমা হয়েছে তোমার। এমনিতেই বিয়ে বাড়ি তার উপর আবার আমি নতুন বউ, রোবটের মতো থাকতে থাকতে আমার নাজেহাল অবস্থা হয়ে যাচ্ছে।
পরের দিন ননদের গায়ে হলুদ । ছোট-বড় থেকে শুরু করে সমবয়সী ছেলেরা মেয়েরা লাল নীল গুড়া রং পানি দিয়ে দুই হাতে মেখে সবার মুখে লাগিয়ে দিচ্ছে। আবার কেউ কেউ
বালতিতে গুলিয়ে শরীরে ঢেলে দিচ্ছে। তাতে অবশ্য কেউ রাগ করছে না। শুধু আমি বাদে সবার মুখই লাল-নীল। দেখে এতো ভালো লাগছে নতুন বউ না হলে আমি নিজেই নেমে পড়তাম।
আমাকে দিবেনা কারণ আমি নতুন বউ, তাছাড়া আমার শশুর সবাইকে নিষেধ করে দিয়েছে।
এর মধ্যেই চার-পাঁচ জন ছেলে সম্পর্কে দেবর হয়, ওঁরা আমার পেছন থেকে বালতি দিয়ে সারা গায়ে নীল রঙ ঢেলে দেয়। আর বলতে থাকলো নতুন বউ বলে রং দেওয়া যাবে না এমন নিয়ম তো নাই! ওমনি ছোট চাচী শাশুড়ি দৌড়ে এসে গালমন্দ করতে লাগলো ওরে হারামজাদা রা নতুন বউরে এ কি করলি? তাঁরা দৌড়ে পালিয়ে গেছে।
নীল রং নাকি সহজে ওঠে না। মা বলছে তাড়াতাড়ি বৌমাকে নিয়ে যা গোসলখানায় না হলে ঠাণ্ডা লেগে যাবে।
ননদের সঙ্গে কাপড় চেঞ্জ করার জন্য যাচ্ছি এমন সময় পিয়াস এসে হাজির। আমার এই অবস্থা দেখে পুরো তুলকালাম কাণ্ড বাধিয়ে দিলো। বাড়ি ভর্তি লোক এর মধ্যে বলতে লাগলো আমার ইচ্ছা না থাকলে ওঁরা আমাকে কিভাবে রং দিল? শাশুড়ী সহ বাড়ির লোকজন ওকে বোঝাচ্ছিল বৌমার কোন দোষ নেই, বৌমা জানেনা ওঁরা পেছন থেকে এসে রঙ ঢেলে দিয়েছে। নাছোড়বান্দা কারো কথাই শুনছে না।
ড্রাইভারকে ফোন দিয়ে আসতে বললো এখানে আর থাকবে না। এতো মানুষ তাকে বোঝানোর চেষ্টা করলো, কারো কথাই সে শুনলো না। আমি আসতে চাইছিলাম না তাই সবার সামনে আমাকে টেনে-হিঁচড়ে গাড়িতে উঠালো। রাগে-দুঃখে বুকটা ফেটে যাচ্ছে। এমন আনন্দের মুহূর্তে মানুষ টা এমন একটি কাজ করতে পারলো?
চলবে_______
লেখা———- Rozina Rose