#ভয়ংকর নির্জন পর্ব ৪
১৮+ সতর্কতা
১.
ডোরা সারা শরীরে ভীষণ একটা ব্যথা নিয়ে চোখ মেলে। আশেপাশে তাকায়, একটা আধো অন্ধকার রুমের মতো। কাল শেষ রাতে ওকে চোখে কাপড় বেঁধে এই রুমটায় নিয়ে এসেছে। এখন অবশ্য চোখ খোলা। উপরে লোহার গরাদ দিয়ে সকালের এক ফালি রোদ এসে পড়েছে। অন্ধকারে রুমটা দেখা হয়নি। কেমন স্যাঁতসেঁতে চারদিক। ডোরা সামনের দেয়ালের দিকে তাকায়, দেয়ালের গায়ে ইটের টুকরো দিয়ে কিছু লেখা। ডোরা এবার উঠে বসে, সামনে এগিয়ে যেতেই পায়ে বাঁধা শিকলটায় একটা টান পড়ে। দাঁত চেপে একবার তাকায় শিকলটার দিকে, ওকে একদম মধ্যযুগীয় কায়দায় আটকে রেখেছে। ডোরা যতটুকু পারে সামনে এগিয়ে দেয়ালের লেখাগুলো চোখ কুঁচকে পড়ার চেষ্টা করে –
‘মা, আমাকে ওরা মেরে ফেলবে। ক্ষমা করে দিও।’
ডোরার সারা শরীর শিউরে ওঠে। এবার আরেকটা লেখার দিকে নজর পড়ে –
‘ভাইয়া, তোর এই বোনটাকে ক্ষমা করে দিস।’
‘এই অপমান, লজ্জার চেয়ে মরে যাওয়া ভালো।’
ডোরা আর পারে না, ওর কেমন যেন বমি বমি লাগছে। এখানে ওর আগে অন্য মেয়েদেরও এনে বন্দি করে রাখা হয়েছিল! তারমানে আমজাদের কথাই ঠিক। কথাটা মনে হতেই ডোরার সারা শরীর কেঁপে ওঠে, মায়ের কথা মনে হয়। মা হয়ত এখনও জানে না ওর এই অবস্থার কথা। কাল ওর বাসায় ফিরে যাবার কথা, মা অপেক্ষা করে বসে থাকবে। মায়ের অপেক্ষা ফুরোবে না। পাগলের মতো মা ছুটোছুটি করবে। আহারে, আমার অসহায় মা!
এই যখন ভাবছে ঠিক তখন বদ্ধ দরজাটা খুলে যায়। ডোরা নিশ্বাস বন্ধ করে অপেক্ষা করে। আড়চোখে দেখে জন আর দারুল ঢুকছে। দারুল ওর সামনে একটা খাবারের প্লেট রাখে। জন একটা কাঠের চেয়ারে বসে ওর দিকে তাকায়। ডোরা ঘৃণা নিয়ে সরাসরি জনের দিকে তাকায়। আফসোসের সাথে ভাবে ও ঘুণাক্ষরেও এটা বুঝতে পারেনি এমন সুন্দর চেহারার পেছনে একটা সাইকো লুকিয়ে আছে।
জন ইশারায় দারুলকে চলে যেতে বলে। দারুল চলে যেতেই জন রুক্ষ গলায় বলে, ‘খেয়ে নাও।’
ডোরা তীব্র গলায় বলে, ‘আমি খাব না। তুমি আমাকে এখনই ছেড়ে দাও, না হলে পুলিশ ঠিক চলে আসবে আমার খোঁজে।’
জন নিঃশব্দে একটা শীতল হাসি দেয়, মাথা নেড়ে বলে, ‘পুলিশ খোঁজেই পাবে না তোমার। তোমার মোবাইল সিলেট হাইওয়েতে বন্ধ হয়েছে। ওরা ওখানেই তোমাকে খুঁজে বেড়াবে। আর তুমি আমার কথা শুনলেই ভালো থাকবে। আমি যখন যেমন চাইব তেমনই করতে হবে। না হলে, আমি কতটা ভয়ংকর হতে পারি তুমি ভাবতেও পারবে না।’
ডোরা কেঁদে ফেলে, আকুল গলায় বলে, ‘আমাকে কেন তুমি এমন বন্দি করে রেখেছ? আমি তো তোমাকেই বিয়ে করব বলে ঠিক করেছিলাম। আমি নিজেই তোমার কাছে এসে থাকতে চেয়েছি। কেন এমন করলে জন??’
জন এক দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে, তারপর বলে, ‘বিয়ে করতে কিন্তু থাকতে না। সুমিও থাকেনি, চলে গেছে। আমি সুমিকে ভালোবাসতাম, বিয়ে করেছিলাম। কিন্তু ও থাকেনি। তাই আমি এখন যাকে চাই তাকে বন্দি করেই রাখি। ভালো না লাগলে মেরে ফেলি।’
ডোরা স্তম্ভিত হয়ে ওর কথা শুনছিল। জন বিয়ে করেছিল এটা ও জানত না। সুমি নামের মেয়েটা ওকে ছেড়ে চলে গিয়েছে, শুধু এজন্য প্রতিশোধ নেবার জন্য ও এমন সাইকো হতে পারে? ব্যাপারটা ঠিক বিশ্বাস হয় না। আরও গভীর কারণ আছে নিশ্চয়ই।
জন এবার তাড়া দিয়ে বলে, ‘ঠিকঠাক খেয়ে নাও। আর আজ রাতে তোমাকে দেখব। মানে নিশ্চয়ই বুঝেছ।’
ডোরার সারা শরীর কুঁকড়ে ওঠে, লজ্জায় অপমানে গা টা রি রি করে ওঠে। চোখে আগুন নিয়ে ও জনের দিকে তাকিয়ে থুতু ফেলতেই জন পাগলের মতো হেসে ওঠে, বলে,’বাহ, এই তো চাই। অক্ষম জেদ দেখতে ভালো লাগে। আমি চাই তুমি রাগে জেদে ফুঁসতে থাকো, আমাকে কামড়াও, বিষহীন সাপের মতো।’
কথাগুলো বলে জন বের হয়ে যায়। দারুল ওর দিকে একটা লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ, তারপর দরজাটা আটকে দেয় বাইরে থেকে।
ডোরা এবার শব্দ করে কেঁদে ওঠে। এমন কেন হলো ওর সাথে! কোথায় ও মায়ের বুকে গুটিশুটি মেরে ঘুমিয়ে থাকবে, আর ও এমন অসহায়ের মতো বন্দি হয়ে এখানে পড়ে আছে। কাঁদতে কাঁদতে একসময় ক্লান্ত হয়ে ডোরা ঘুমিয়ে পড়ে।
কতক্ষণ ঘুমিয়েছে বলতে পারবে না ডোরা। হঠাৎ গালের উপর ভেজা একটা কিছু অনুভব করে। ক্লান্ত চোখটা টেনে খুলতেই ওর পুরো শরীর কেঁপে ওঠে। দেখে দারুল ওর উপর ঝুঁকে আছে, মুখ দিয়ে লালা ঝরছে, কুকুরের মতো জিভ দিয়ে ওর গাল চাটছে।
ডোরার মনে হয় এমন কুৎসিত দৃশ্য ও ওর জীবনে কখনও দেখেনি। তীব্র ঘৃণায় দুই হাত দিয়ে ওর মাথায় জোরে একটা ধাক্কা দিয়ে সবেগে মুখটা সরিয়ে নেয়, তারপর চিৎকার করে ওঠে, ‘দারুল, তুই একটা কুকুর। আমি তোরে মেরে ফেলব।’
আচমকা ধাক্কায় দারুল উলটে পড়ে, তারপর উঠে দাঁড়ায়, হিংস্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বলে, ‘হ আমি কুকুর, তয় কামটা তো আইজ রাইতে আমারই করার লাগব। জন স্যার তো কাম পারে না, তাই তো হের বউ ভাইগা গেছিল। এহন আইজ রাইতে আমি কাম করুম আর স্যার দেখব।’
ডোরার মনে হচ্ছিল ওর কানে কেউ গরম সীসা ঢেলে দিল। এত কুৎসিত কথা ও ওর জীবনে কখনও শোনেনি। ইচ্ছে করছে মাটির ভেতর ঢুকে যেতে। তার আগে এই জানোয়ারটাকে মেরে ফেলতে পারত!
দারুল একটা কুৎসিত হাসি দেয়, তারপর বলে, ‘খাইয়া লও সুন্দরী।’
দাঁতে দাঁত পিষে ডোরা প্রচন্ড ঘৃণা নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে।
দারুল চলে যেতেই ডোরা দিশেহারার মতো ভাবে, ওকে বাঁচতে হবে। এমন লজ্জার অপমানের কাজ ওর সাথে হলে ও যে মরার আগেই মরে যাবে। তার চেয়ে আত্মহত্যা করা ভালো। চোখটা মুছে ভাবনাটা ভাবতেই হঠাৎ ওর আমজাদ মিয়ার কথা মনে হয়। এই একটা লোক ওকে সাহায্য করতে পারে। লোকটা ওর কাছে কৃতজ্ঞ। বাঁচার একটা শেষ চেষ্টা করতে হবে। না পারলে নিজেকেই ও শেষ করে দেবে। কিন্তু আমজাদ মিয়া কোথায়?
ডোরা জনের দূর্বল দিকগুলো ভাবতে থাকে। দারুলের কথায় যা বোঝা গেল জন শারীরিকভাবে অক্ষম, তাই ওর প্রথম স্ত্রী সুমি ওকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল। এবার ডোরার কাছে কিছু জিনিস পরিস্কার হয়। এই নির্জনে একা পেয়েও জন কখনোই ওর সাথে শারীরিকভাবে ঘনিষ্ঠ হতে চায়নি। অথচ অন্য কেউ হলে এটা চাইতই। সুমি নিশ্চয়ই ওকে অনেক অপমান করেছে। আর একটা পুরুষের জন্য এটা মেনে নেওয়া দারুণ কঠিন। তাই বুঝি জন এমন মানসিক বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়েছে? সুমির কাছ থেকে পাওয়া অপমানগুলোর প্রতিশোধ এখন ওর মতো মেয়েদের উপর নিচ্ছে?? এত ভয়ংকর প্রতিশোধপরায়ণ কেউ হতে পারে!
এই সাইকোপ্যাথের হাত থেকে ও বাঁচবে কী করে?
২.
সন্ধ্যা গড়িয়েছে অনকক্ষণ। ভেতরে একটা হলদেটে বাতি জ্বলছে। আজ সারাদিন ডোরা বলতে গেলে কিছুই খায়নি। শরীরটা অবসন্ন লাগছে। কিন্তু স্নায়ুগুলো টান টান হয়ে আছে, বার বার ও দরজার দিকে তাকাচ্ছে। এই বুঝি জন এলো দারুলকে নিয়ে। ভয় পেতে পেতে ও শেষ হয়ে যাচ্ছে।
ঠিক এমন সময় ধীরে ধীরে বন্ধ দরজাটা খুলে যায়। একটা আতংক নিয়ে ডোরা চেয়ে থাকে। দেখে জন ঢুকছে, একা, হাতে একটা কাগজের ব্যাগ। কিছুটা স্বস্তি, দারুল নেই। ডোরা ব্যাগটা চিনতে পারে, ওর সেই শাড়ির ব্যাগটা।
জন ঢুকে একবার তাকায়, তারপর বলে, ‘মুখটা এমন শুকনো কেন? এমন হলে আমি কিন্তু রাগ করব, আর সেটা তোমার জন্য ভালো হবে না। এই ব্যাগে তোমার শাড়ি আছে, পরে নাও। আমি দেখব। আমাকে পরে দেখানোর জন্যই তো শাড়িটা নিয়ে এসেছিলে। নাও এখন আমার সামনেই পরে দেখাও।’
শেষ কথাগুলো বলতে বলতে চোখেমুখে একটা বিকৃত আনন্দ দেখতে পায় ডোরা। ভীষণ আফসোস হয়, যে মানুষটাকে দেখানোর জন্যই ও নিজে আগ্রহ করে, ভালোবেসে শাড়িটা পরার কথা ছিল আজ সেই শাড়িটা এমন গ্লানি নিয়ে পড়তে হবে! ভাবতেই চোখ ফেটে কান্না আসতে চায়।
ডোরা নিজেকে সামলে নিয়ে একটু ভাবে, এই সাইকো লোকটাকে রাগানো যাবে না। ওকে আশ্বাস দিতে হবে। নরম গলায় বলে, ‘জন, আমি বুঝতে পেরেছি তুমি কেন এমন করছ। আমি তোমার সব সীমাবদ্ধতা জেনেও তোমাকে বিয়ে করব। আর কখনোই তোমাকে ছেড়ে যাব না।’
জন চোখ কুঁচকে তীক্ষ্ণ গলায় বলে, ‘তুমি কী জানো আমার সম্পর্কে?’
ডোরা একটু সংকোচের সাথে বলে, ‘সুমি তোমাকে যে কারণে ছেড়ে গেছে সেটা। আমি একজন চিকিৎসক, তোমার সমস্যাটা চিকিৎসায় ভালোও হয়ে যেতে পারে। আর ভালো না হলেও আমি তোমার সাথেই থাকব।’
জনের মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে যায়, তোতলানো গলায় বলে, ‘তোমাকে কে বলেছে আমার কথা? তুমি সুমিকে চেনো কী করে??’
ডোরা মনে মনে ভয় পেয়ে যায়, জন যেভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাল তাতে না ও উলটো বিগড়ে যায়। দ্রুত সামলানোর গলায় বলে, ‘না না, সুমিকে আমি চিনি না। যেই বলুক, জন, আমি তোমাকে ভালোবাসি। তোমাকে ছেড়ে আমি যাব না, প্রমিজ।’
জন স্থির চোখে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে, তারপর চেয়ার থেকে উঠে ওর সামনে এসে দাঁড়ায়। ডোরার বুক ততক্ষনে শুকিয়ে গেছে ভয়ে, নিশ্বাসটা কেমন ভারী হয়ে আসছে।
জন ওর দিকে ঝুকে আসে, তারপর ঘোর লাগা গলায় বলে, ‘তুমি সত্যিই চলে যাবে না?’
ডোরা মুখটা যতটা সম্ভব কোমল করে বলে, ‘না জন, আমি তোমাকে কখনই ছেড়ে যাব না।’
জন একটু পিছিয়ে আসে তারপর সজোরে একটা চড় মারে ডোরার গালে।
আচমকা আঘাতে ডোরা মাথা ঘুরে পড়ে যায়, মুখে নোনা স্বাদ পায়, জিভটা দাঁতে লেগে কেটে গেছে। মাথাটা ভোঁ ভোঁ করছে। গালটা মনে হচ্ছে জ্বলে যাচ্ছে।
জন হিসহিসিয়ে বলে, ‘মিথ্যে কথা। সুমিও প্রমিজ করেছিল। কিন্তু বছর না ঘুরতেই আমাকে ছুড়ে ফেলে দিয়ে চলে গেছে। তুমিও পালাতে নিয়েছিলে, ভাগ্যিস আমি ধরে ফেলেছি। তোমার সব কথা মিথ্যা। দারুল, এখনই আয়। কাজ শুরু কর।’
ডোরার হাত পা দূর্বল হয়ে আসে, নিশ্বাসটা আটকে আসে। বাবার কথা মনে হয়, ওকে হাত ধরে স্কুলে নিয়ে যেত। কী ভরসার একটা হাত ছিল! বাবা তুমি কোথায়?
দারুলের চোখ লোভে চকচক করছে। ডোরা দ্রুত ভাবছে, কী করে একে থামানো যায়।
জন পাগলাটে দৃষ্টি নিয়ে ডোরার দিকে তাকিয়ে বলে, ‘এভাবেই আমি শোধ নেব সব বিশ্বাসঘাতকের।’
ডোরা এবার উঠে দাঁড়ায়, নাহ, নরম গলায় কাজ হবে না, এ নরমের পাত্র নয়। একে এখন চরম আঘাত করতে হবে।
ডোরা তীব্র স্বরে বলে, ‘তুই বিশ্বাসঘাতক। নিজে নপুংসক হয়ে একটা মেয়েকে ঠকিয়েছিস। তুই ভীতু, কাপুরষ। নিজের ক্ষমতা নেই তাই অন্যকে ডেকে এনেছিস।’
খোঁচাটা জায়গামতো লাগে। জন এক ধাক্কা দিয়ে দারুলকে সরিয়ে দেয়, তারপর ডোরাকে এক হাতে ধরে মারতে থাকে। ডোরা দু’হাত দিয়ে আত্মরক্ষা করার চেষ্টা করে। নাক দিয়ে রক্ত পড়ছে, টের পায়। বিশ্রীভাবে ঠোঁটটা কেটে গেছে, মুখে তীব্র নোনা স্বাদ পায়। ডোরা মাটিতে শুয়ে পড়ে, জন জোরে একটা লাথি মারতেই ডোরা ব্যথায় ককিয়ে ওঠে। ডোরা শুধু ভাবে জন যত খুশি মারুক, কিন্তু ওই কাজটা যেন না হয় ওর সাথে।
জন পাগলের মতো দারুলকে ডাকে, বলে, ‘আমজাদরে এখনই ডাক। বল একটা কেউটে সাপ নিয়া আসতে। ওরে আমি কঠিন শাস্তি দিয়া মারমু।’
ডোরার পাঁজরে ভীষণ ব্যথা করছে। কিন্তু জনের শেষ কথাটা শুনে ওর কেন জানি ব্যথাটা কমে যাচ্ছে। একটা শান্তি লাগছে, এটা খুব ভালো হলো। সাপ ওকে কামড় দিক তাও দারুল বা জন না। ওরা যে মানুষ নামে অমানুষ। ওদের হাতে অপমানিত হবার চেয়ে সাপের কামড়ে মরে যাওয়া যে অনেক ভালো।
আমজাদ আসে, হাতে একটা কেউটে সাপ বিপদজনকভাবে ধরা। ডোরা আমজাদের চোখের দিকে সরাসরি তাকাতেই লোকটা চোখ নামিয়ে নেয়। হায়রে মানুষ, যাকে একদিন কেউটের দংশন থেকে ও বাঁচাল আজ সেই এসেছে ওকে সেই সাপের দংশনে মারতে! যাক, তাও ভালো, ও পেরেছে নিজেকে ওই পশুদের দংশন থেকে বাঁচাতে। মায়ের মুখটা মনে পড়ছে, ওর দুঃখী মা, বাবা মারা যাবার পর ওকে একা মানুষ করেছেন, কত কষ্ট সয়েছেন। মাগো, আমাকে ক্ষমা করে দিও।
জন আদেশের সুরে বলে, ‘দারুল, ওরে জানালার সাথে বেঁধে ফেল, যাতে নড়তে না পারে। আর আমজাদ মিয়া, সাপটা ওর পায়ের কাছে ছাড়বি। কিছুক্ষণ খেলা দেখি।’
দারুল ওর দিকে এগিয়ে আসে, তারপর হ্যাঁচকা টান দিয়ে ওকে জানালার কাছে নির্মমভাবে বাঁধে, ওর রাগটা বেশি লাগে। কী কথা কইল আর স্যারের মাথায় খুন চাইপা গেল। ওর হাউসটা মিটল না।
ডোরা শক্ত হয়ে জানালায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হাত দুটো উঁচু করে জানালার গ্রীলের সাথে বাঁধা। আমজাদ মিয়া এগিয়ে আসছে, দক্ষ হাতে কেউটে সাপটা ধরে আছে।
ওর কাছে এসে একবার তাকায়, চুপ করে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। ওকে অমন দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে, জন খেকিয়ে ওঠে, ‘সাপ ছাড়তে এত দেরি করতাছস কেন? তোরে কী ওষুধ দিতে হইব?’
আমজাদ ভয়ে কুঁকড়ে ওঠে, তারপর বিষন্ন মনে সাপটা ছেড়ে দেয় ওর পায়ের কাছে। ডোরা ভয়ার্ত চোখে খেয়াল করে এটা কাল কেউটে, কালো শরীরে সাদা ফিতের মতো রেখা। ভয়ংকর বিষধর এই কাল কেউটে।
ডোরার নিজের অজান্তেই হাত পা শক্ত হয়ে আসে। ভয় পাবে না ভেবেও শেষ পর্যন্ত তীব্র একটা ভয় ওকে গিলে ফেলে। যতটুকু পারে পা দুটো পিছিয়ে আনে। আর তখনই মনে হয়, ভুলটা করল। ও যত নাড়াচাড়া করবে সাপটা ততই উত্তেজিত হবে। সাপকে আঘাত না করলে সাপ কামড়াবে না, এটা ও জানে।
কিন্তু কেউটেটা যেভাবে বিপদজনকভাবে এগিয়ে আসছে তাতে যেকোনো মুহুর্তে ওর পা বেয়ে উপরে ওঠার চেষ্টা করবে। তখন ও কোনোভাবেই নিজেকে সামলাতে পারবে না। মনের অজান্তেই নড়ে উঠবে।
নিশ্বাসটা বন্ধ হয়ে আসে ডোরার। কী ভেবে ও চোখটা বন্ধ করে ফেলে। না দেখলে ও স্থির থাকতে পারবে।
রুমটার গরাদের ফাঁক দিয়ে এক ফালি চাঁদের আলো ভেতরে এসে পড়েছে। সেখানে একটা ভয়ার্ত নারীর মুখের দিকে একটা জান্তব পশু তাকিয়ে আছে। হিতাহিত জ্ঞানশুন্য মানুষটার কাছে এমন অসহায় মুখ যে খুব প্রিয়। ওর নিজের মুখটাও একদিন এমন অসহায় হয়ে গিয়েছিল এমন একটা নারীর কাছেই।
ডোরা টের পায় একটা ভেজা কিছু ওর পায়ের উপর উঠছে, সেইসাথে একটা হিসহিস শব্দ। ও প্রাণপণ চেষ্টা করছে নিজেকে শান্ত রাখতে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ও কী পারবে নিজেকে স্থির রাখতে?
(চলবে)
মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান সুবাস
শিমুলতলী, গাজীপুর