আমার অফিসে আজ আমার প্রাক্তন তার বউ নিয়ে এসেছে। কী যে প্রাণখোলা হাসিতে মেতেছে সে! ভালো লাগছে অনেক দিন পর দেখতে তাকে। অফিসের পিয়ন থেকে শুরু করে সবার সাথে কেমন হাসি হাসি মুখে বউকে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে।
প্রাক্তনের নাম ফরহাদ। তার বউটা দেখতে ভীষণ সুন্দর। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল বিভাগের ৩য় বর্ষের ছাত্রী। আচার – ব্যবহারও ১০০ তে ১০০। সবাইকে সালাম দিয়ে কুশল বিনিময় করছে৷ শুনলাম মেয়েটার নাম পিয়া। খেয়াল করছি, আড়চোখে ফরহাদ আমার দিকে বার বার তাকাচ্ছে। নার্ভাস ফিল করছে নাকি সে? নিজের প্রাক্তনের সাথে স্ত্রীর পরিচয় করে দেয়াটা বোধ হয় খুব একটা সহজ কাজ না। ধীরে ধীরে আমার টেবিলের দিকে এগিয়ে আসছে ওরা দুজন।
“সামিয়া, কেমন আছো? বউকে পরিচয় করিয়ে দিতে নিয়ে এলাম। ভালো করেছি না? দেখো তো, আমার লক্ষ্মী বউটা দেখতে কেমন?”
অনেক দিন পর ফরহাদ এর মুখে নিজের নামটা শুনলাম। তবে আগে তার কন্ঠে আগে নিজের নামটা শুনলে উচ্ছ্বসিত এবং শিহরিত বোধ হতো আজ তার কিছুই হচ্ছে না। মনে হচ্ছে ফরহাদ খুব ন্যাকামি শিখে গেছে। সে আসলে এসেছে তার বউকে দেখাতে যে মেয়েটি আমার চেয়ে বহুগুণে সুন্দর৷ খেয়াল করলাম,
পিয়া ফরহাদ এর পিঠের পিছে লজ্জাবনত দৃষ্টিতে মুচকি মুচকি হাসছে।
বললাম, ” খুব ভালো করেছো। বিয়েতে তো দাওয়াত দিলে না তাই তো আর উপহারও পাঠাতে পারলাম না। কাউকে না হোক, আমায় তো বলতে পারতে। আফটার অল, তোমার সাথে আমার সম্পর্কটা তো একসময় ভালোই ছিলো, তাই না? “
এ কথা শুনে পিয়া এক ঝটিকায় ফরহাদ এর দিকে তাকালো। ফরহাদ এর মুখ থেকে রক্ত যেনো হঠাৎ সরে গিয়েছে। সে আমতা আমতা করে বললো,
” তা তো ঠিক। তবে এতো তাড়াহুড়ো করে বিয়েটা করে ফেললাম! আসলে কী বলো তো, পিয়াকে দেখে আর বিন্দুমাত্র দেরি করতে ইচ্ছে হচ্ছিলো না। বার বার মন বলছিলো, একে এখন নিজের করে না নিতে পারলে হারিয়ে ফেলবো শীঘ্রই৷ দ্রুত বিয়ের আয়োজন করলাম। এজন্য অনেককেই জানাতে পারি নি।”
বউকে দ্রুত ম্যানেজ করে ফেলতে পেরেছে ফরহাদ। এখন তার চোখে দেখা দিয়েছে আত্মবিশ্বাস। বললাম,
” নো প্রব্লেম। তোমরা দুজনেই ভালো থেকো। মন থেকে দোয়া করি।”
হঠাৎ পাশের একজন কলিগ পিয়াকে ডাক দিতেই পিয়া সেদিকে গেলো। এ সুযোগে ফরহাদ বললো,
” হাসালে! ভালো থাকতে হলে তোমার দোয়ার প্রয়োজন নেই। আমরা এমনিতেই ভালো আছি। যাই হোক, তুমি সত্যি ভালো আছো তো?”
” ভালো না থাকার কী কোন কারণ আছে, ফরহাদ?”
” আমি জানি তুমি ভালো নেই। আমাকে ছাড়া কখনো তুমি ভালো থাকতে পারবে না। ভুলে গেছো আমাদের সুখের দিনগুলোর কথা?”
তারপর ভ্রু কুঁচকে চোখ দুটো ছোট ছোট করে বললো,
“তুমি আমাকে বিয়ে করো নি সামিয়া এটা আমি কখনোই ভুলবো না। একটা সামান্য ভুল তুমি ক্ষমা করো নি। আমি কখনোই তোমায় ভালো থাকতে দিবো না।”
একটু হেসে বললাম, ” তুমি চেষ্টা চালিয়ে যাও। আগেও তো কম চেষ্টা করো নি।”
বছর চারেক আগে কলিগ হিসেবে ফরহাদের সাথে পরিচয় আমার। এরপর ভালো লাগা থেকে মন দেয়া নেয়ার পর্ব শুরু হয়। দুজনেই প্রাপ্ত বয়স্ক ছিলাম বিধায় এক পর্যায়ে তাকে বিয়ের সিদ্ধান্ত নেই। অফিসে যাওয়ার পথে তুলে নিতো ফরহাদ আমায়। এরপর একসাথে লাঞ্চ করা, টুকটাক শপিং করা, অফিস থেকে একসাথে ফেরা সবকিছু যেনো স্বপ্নের মতো চলছিলো। একটা ভালো লাগার অনুরণন কাজ করতো সবসময়। অফিসের বেশ কিছু কলিগও ব্যাপারটা জানতেন।
একদিন সন্ধ্যায় অফিসে কাজ শেষ হতে দেরি হয়ে যায়। ১৪-১৫ জন কলিগ ছিলাম আমরা। হঠাৎ বৃষ্টিও শুরু হয়ে যায়। আটকা পড়ে যাই অফিসে। বাসায় ফোন করে আমার অবস্থার কথা জানিয়ে দেই। ফরহাদও অফিসে আছে বিধায় আমার পরিবার নিশ্চিন্ত হয়। এর মাঝে টুকটাক কথা ছাড়া ফরহাদ আমার সাথে বেশি কোন কথা বলে নি। একজন কলিগের সাথে ফিসফাস করে কী যেনো বলে চলছিলো ফরহাদ। ব্যাপারটা সিরিয়াসলি নেই নি। ১১ টার দিকে বৃষ্টি একটু কমলে অফিস থেকে বেরিয়ে দ্রুত একটা সিএনজি নেই। ফরহাদও আমার সাথে উঠে বসে। আমি কিছুটা স্বস্তি পাই।
কিছুদূর সিএনজি যেতেই ফরহাদ নির্দেশ দেয় অন্যদিকে সিএনজি ঘোরাতে। আমি প্রচণ্ড অবাক হই। বলি,
” সিএনজি এদিকে ঘুরলো কেনো? আমার বাসা তো এদিকে নয়। ”
” চিন্তা করো না। আমি তো সাথে আছি। একটু পর না হয় বাড়ি যাবে।”
” মানে কী, ফরহাদ? তুমি বুঝতে পারছো এখন কয়টা বাজে? আরো দেরি করে বাসায় যাবো?” বাসায় কী জবাব দিবো?”
” কেনো, অসুবিধা কোথায়? কাল তো অফ ডে। আমি তোমায় বাসায় পৌঁছে দিবো।”
” কিন্তু আমরা এখন কোথায় যাচ্ছি?” প্রবল ভয় গ্রাস করেছে আমায়।
” মিনহাজ এর বাসায়। ওর রুমমেট নেই। একটা রুম খালি আছে। মিনহাজ বলেছে ও সব ব্যবস্থা করবে। তুমি চিন্তা করো না তো।”
আমার মাথায় যেনো বাজ পড়লো। মিনহাজ মানে মিনহাজ ভাই? আমাদের কলিগ? যার সাথে এতোক্ষণ ফরহাদ ফিসফিস করে কথা বলেছে? তার মানে ফরহাদ আমায় নিয়ে খালি রুমে সময় কাটাতে চায়? ছিঃ!
” এই ছিলো তোমার মনে, ফরহাদ?”
” কাম অন, সামিয়া! আমরা দুজনেই এডাল্ট। এতোদিনের সম্পর্কে আমরা তো এটা চাইতেই পারি।”
” আমরা না। তুমি চাইছো। আমি চাইছি না এটা। গাড়ি ঘোরাতে বলো।”
” এই সামিয়া, রিয়েক্ট করছো কেনো? দুজনার সম্মতিতে হলে ক্ষতি কী! আর আমি তো পালিয়ে যাচ্ছি না। বিয়ে তো আফটার অল তোমাকেই করবো।”
” গাড়ি ঘোরাও, প্লিজ। ফর গডস সেক, গাড়ি ঘোরাও।”
” এই পাগলি, আমি আছি তো। ভয় পাচ্ছো কেনো?”
আমি আর কিছু না বলে ফরহাদকে চড় কষিয়ে দিলাম একটা। ঘটনার আকস্মিকতায় ফরহাদ বাকরুদ্ধ। আমি সিএনজি চালককে গাড়ি ঘোরাতে নির্দেশ দিলাম। আর ঝামেলা করে নি সে। ঐ দিন রাতে আমি বাসায় ফিরেছিলাম ১২ঃ৩০ টায়।
এরপর থেকে ফরহাদ এর সাথে আর সম্পর্কটা এগিয়ে নিতে যেতে চাই নি। ফরহাদকে দেখলেই মুখোশ পরা মানুষ মনে হতো। এই ফরহাদকে তো আমি চিনি না। ফরহাদ অবশ্য কয়েকবার সরি বলেছে। কিন্তু আমি মন থেকে আর সায় পাই নি। মাস দুয়েকের মধ্যেই ব্রাঞ্চ পরিবর্তন করে আমি গাজীপুর চলে আসি।
এরও সাত মাস পর পারিবারিক ভাবে আমার বিয়ে হয় রাশেদের সাথে। বয়সে আমার চেয়ে প্রায় বছর দশেকের বড়। পেশায় সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। বেশ ভদ্র আর শান্ত গোছের মানুষ রাশেদ। বিয়ের পরপরই বুঝেছিলাম সে কথা বলতে তেমন আগ্রহী নয় তবে দারুণ শ্রোতা। আমি বকবক করতাম আর সে শুনতো। তবে সে স্ট্রেইটকাট কথা বলতে পছন্দ করতো৷ কেয়ারিং ছিলো যথেষ্ট। আমি অনেকদিন পর এরকম কাউকে পেয়ে স্বস্তি অনুভব করলাম। কিন্তু বিয়ের আট দিন পর রাত ১১ টায় রাশেদের ফোনে আসা একটা আননোন কল আমার জন্য খুব অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
ওপাশ থেকে কী বলছে ফোনে আমি বুঝতে পারছি না।
রাশেদ বলছে,
” দেখুন ভাই, আপনি কে আমি জানি না। আপনার কথা সত্য না মিথ্যা তা আমি যাচাই করতেও যাচ্ছি না। আপনার আর সামিয়ার আগে যদি সম্পর্ক থেকেও থাকে সেটা তার বিয়ের আগের ব্যাপার। বিয়ের আগের জীবন সে তার মতো করে পরিচালনা করবে এটাই স্বাভাবিক। এখন সে বিবাহিত। এখন থেকে সে যা করবে তার জবাবদিহিতা সে আমাকে করবে। বিয়ের আগের লাইফ নিয়ে আমি তাকে কিছু জিজ্ঞেস করতে পারি না। ভালো থাকবেন আপনি।”
বলেই ঠুস করে লাইনটা কেটে দিলো।
আমি চরম অস্বস্তি নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ” কে ছিলো ফোনে?”
” ফরহাদ বলে একটা লোক। কী সব বলছিলো। বাদ দাও।”
” তোমার কী সত্যিই আমার অতীত সম্পর্কে জানতে ইচ্ছে করে না?”
” নাহ। ওটা তো তোমার একার জীবন ছিলো। কিন্তু এখন তুমি আমার সাথে কমিটেড। এখন থেকে তুমি যা করবে তার জন্য আমার কাছে দায়বদ্ধ থাকবে তুমি।”
রাশেদের প্রতি শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে এলো। তখনই মনে হলো এই লোকটা কথা কম বলুক কিন্তু মানুষের ব্যক্তিগত সম্পর্ককে যথেষ্ট সম্মান করে সে। আর একটি কথাও মনে হলো ভীষণভাবে যে ফরহাদকে ছেড়ে আসা আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সিদ্ধান্ত ছিলো।
হঠাৎ ফরহাদ বলে উঠলো,
” কী কোথায় হারিয়ে গেলে? আমায় নিয়ে নিশ্চয় আগের দিনগুলোতে ফিরে গিয়েছো না? বললাম তো, ভুলতে পারবে না আমায়। আর পিয়াকে দেখেছো? তোমার চেয়ে ১০ গুণ বেশি সুন্দরী। বয়সও কম। আর তুমি একটা বুড়ো হাবড়াকে বিয়ে করে বসে আছো। এবার বুঝতে পেরেছো তো যে কতটা ঠকেছো তুমি!”
আমি চকিতে ফরহাদ এর দিকে তাকিয়ে বললাম,
” তুমি আগেও বেয়াদব ছিলে, এখনো তাই আছো। কে কাকে নিয়ে ভালো থাকবে এটা নিতান্তই তাদের ব্যাপার। নিজের মতো করে অন্যদের বিচার করো না। আমার প্রতিনিয়ত মনে হয় যে তোমায় দ্বিতীয় সুযোগ না দিয়ে আমি সঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছিলাম। তা না হলে রাশেদের মতো মানুষকে আমার স্বামী হিসেবে পেতাম না। যদি তুলনা করি তবে কোনদিক থেকেই তুমি তার যোগ্য না। আমি আশা করবো তোমার সাথে যেনো আমার আর দেখা না হয়।”
বলেই আমি আমার ডেস্ক ছেড়ে ক্যাফের দিকে এগিয়ে গেলাম৷ বুঝতে পারছি ফরহাদ আমার গমন পথে হা করে তাকিয়ে আছে। এতো কথা আমি বলবো এটা হয়তো সে আশা করে নি। যাক গে, এখন আমার এক কাপ চা দরকার। কড়া লিকারের। মাথাটা বড্ড ধরেছে। অনেক দিন পর আজ সকালে মেইলে একটা কাঙ্ক্ষিত রিপোর্ট পেয়েছি। রাশেদকে দ্রুত সুখবরটা দিতে হবে। বাবা হতে যাচ্ছে সে। এই মুহুর্তে রাশেদের হাত ধরে বলতে ইচ্ছে করছে,
” জীবন সুন্দর। শুধু তুমি পাশে থেকো ।”
সমাপ্ত
#গল্প প্রাক্তন এবং অতঃপর….
লেখাঃ নুজহাত তাসনিম