ঢলুয়া জামে মসজিদ। মসজিদের মোয়াজ্জিন আজিজুর রহমান খুব শান্ত গলায় মাইকে ঘোষণাটি দিলেন।
ঘড়ির দিকে তাকালেন আজিজুর। ফজরের ওয়াক্ত হতে এখনো মিনিট দশেক বাকি আছে। গতরাত থেকে এই নিয়ে প্রায় আট-দশবার ঘোষণাটি দেওয়া হয়েছে। আজিজুর রহমান ইচ্ছে করেই দিলো। ঘোষণা শেষে মোয়াজ্জিন আজিজুর রহমান মসজিদ লাগোয়া পুকুর ঘাটে এসে দাঁড়ালেন।
শীতটা এবার বেশিই পড়ছে। কুয়াশার মাত্রাটাও বেশি। পুকুরের ঘাট লাগোয়া কাঁঠাল গাছের পাতা বেয়ে কুয়াশার পানি পুকুরে পড়ছে শব্দ করে। কুয়াশায় আচ্ছাদিত গুমোট এই নীরব পরিবেশে পানির শব্দ ষ্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। পুকুর ঘাটে মজিদুল ব্যাপারি ওজু করছে। কুয়াশার কারণে ঘাটের উপর থেকে মজিদুল ব্যাপারিকে পুরোপুরি দেখা যাচ্ছে না। দেখা না গেলেও পানির শব্দ শুনে বুঝতে পারে এটা মজিদুল ব্যাপারি। ফজরের আযানের আগে আগে ব্যাপারি মসজিদে আসে। এই সময়টায় ব্যাপারির সাথে আজিজুর রহমানের খুব একটা কথা হয় না। প্রায় দিন ফজরের ওয়াক্তে একমাত্র মুসল্লি মজিদুল ব্যাপারি। মাঝে মাঝে দু-একজন মুসল্লি বাড়লেও ফজরের ওয়াক্তে মজিদুল ব্যাপারি’কে কখনও যে দেখেনি এমন মনে করতে পারে না আজিজুর রহমান। জুমার নামাজ ছাড়া এই মসজিদের সব ওয়াক্তের নামাজ এই আজিজুর রহমান পড়ান। জুমার দিন মৌলবী আবদুল বাতেন আসেন। মাঝে মাঝে তাঁর অনুপস্থিতিতে আজিজুর রহমান জুমা পড়ান।
পুকুর ঘাটে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ওয়াক্ত হতেই আযান দিতে গেল আজিজুর রহমান। নামাজ শেষ করে আজিজুর আবার ঘোষণা দিলেন। মৃত্যু সংবাদের ঘোষণা। আকরাম পাটোয়ারী মারা গিয়েছেন গতকাল। মারা গেছেন ঢাকায়। ঢাকার খুব দামি একটা হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন অনেকদিন যাবৎ। আকরাম পাটোয়ারীর ছেলেমেয়েরা এত টাকা পয়সা খরচ করেও বাঁচাতে পারেনি। পাটোয়ারী এলাকার খুব সম্মানিত লোক। সবাই খুব মান্য করে। টাকা-পয়সাও বিস্তর। বছরে দু-একবার গ্রামে আসেন। গ্রামে আসলে দু-হাতে টাকা-পয়সা বিলিয়ে দেন। এলাকার মানুষের কাছে বেশ জনপ্রিয়ও। জনপ্রিয় সেই মানুষ হুট করে মারা গেল। আকরাম পাটোয়ারীর মৃত্যু নিয়ে ঢলুয়া গ্রামে শোক চলছে। গত রাত থেকে এলাকার অনেকে এই নিয়ে খুব হা-হুতাশও করছে। কেউ কেউ কান্নাকাটি করছে।
আজিজুর রহমান মসজিদ থেকে বাসার দিকে রওনা দিল। গতরাতে এশার শেষ করে আকরাম পাটোয়ারীর মৃত্যু সংবাদ শুনে আর বাসায় ফিরেনি। ইচ্ছে করে ফিরেনি। সারারাত জেগেই ছিল। জেগে থেকে কয়েকবার আকরাম পাটোয়ারীর মৃত্যুর সংবাদ মাইকে ঘোষণা করল।
মসজিদ থেকে মিনিট পাঁচেক হাঁটলে গোরস্থান। গোরস্থানের পশ্চিমেই টিনের ঘরটা আজিজুর রহমানের। টেবিলে খাবার রাখা আছে। এই খাবার গতরাতের। আজিজুর রহমান গতরাতে বাসায় ফেরেনি বলে এখনো ঠিক আগে জায়গায় আছে । শীতের দিনে খাবার নষ্ট হয় কম। আজিজুর হাত ধুয়ে খেতে বসল। শোল মাছের তরকারি। মাছের রান্নাটা বেশ স্বাদের হয়েছে। ভাত-তরকারি ঠান্ডা হলেও খেতে খুব ভালো লাগছে। গতরাত থেকে কিছুই খাওয়া হয়নি। তাই বোধহয় এত স্বাদের লাগছে। আজিজুর রহমান ঠান্ডা খাবার খুব একটা খেতে পারেন না। আজ খাচ্ছেন। বড় ছেলের বউ জেগে থাকলে এমন করে ঠান্ডা খাবার কিছুতেই খেতে দিত না।
খাওয়া প্রায় শেষের দিকে। খাওয়া-দাওয়া শেষ করে আজিজুর রহমান আলমারি থেকে নতুন পাঞ্জাবি বের করে পরলেন। পাঞ্জাবিটা আজিজুর রহমানের খুব পছন্দ হয়েছে। এই পাঞ্জাবি আজিজুর রহমানের মেঝো মেয়ের জামাই কিনে দিয়েছে। এতদিন ইচ্ছে করে আজিজুর রহমান এই পাঞ্জাবি পরেনি। কোনো আয়োজন ছাড়া নতুন কিছু পরতে আজিজুর রহমানের খুব অনীহা। আজ এই পাঞ্জাবি গায়ে দিয়ে আকরাম পাটোয়ারীর বাড়ি যাবেন। মুর্দা বাড়ি। মুর্দা বাড়িতে নানা চেনা-জানা লোকজন আসবে। এই সময় পুরাতন জামা-কাপড় গায়ে দিলে কেমন অস্বস্তি লাগে।
মোয়াজ্জিনের কাজ ছাড়াও আজিজুর রহমান আরও একটি কাজ নিয়মিত করে থাকেন। মৃত মানুষ গোসল দেওয়া মানে মুর্দা গোসল। ঢলুয়া গ্রাম ছাড়াও আশে-পাশের দুই একটি গ্রামের মুর্দা গোসলের কাজ এই আজিজুর রহমান করে। গত ত্রিশ বছর ধরে এই কাজ আজিজুর রহমান বিনা পারিশ্রমিকে খুশি মনে করে। কেউ মারা গেলে প্রথমে আজিজুর রহমানের ডাক আসে। এলাকার সবাই জানে মুর্দা গোসল মানে মোয়াজ্জিন আজিজুর রহমান। কাজটা করতে আজিজুরের খুব ভালো লাগে। তাছাড়া অনেকের এই কাজে অনীহা। ভালো লাগে বলেই এই কাজ করে কখনও কারো কাছ থেকে টাকা পয়সা নিতেও চায় না।
আজিজুর রহমান বসে আছে আকরাম পাটোয়ারীর বিশাল বাড়ির উঠানে। উঠানে গ্রামের লোকজনের আনাগোনা বাড়ছে। আজিজুর রহমান একটু সরে গিয়ে বাড়ির দক্ষিণে বড় লিচু গাছটার নিচে গিয়ে দাঁড়ালো। লিচু গাছের গোড়ায় খুব সুন্দর করে বসার জন্য আসন করে দেওয়া আছে। আজিজুর রহমান সেই আসনে না বসে দাঁড়িয়ে আছে। লাশ এখনো আসে নি। সবাই বলাবলি করছে লাশ খুব কাছাকাছি চলে এসেছে। পাঁচ-দশ মিনিটের মধ্যে বাড়িতে এসে পৌঁছাবে।
আকরাম পাটোয়ারীর আত্বীয়-স্বজনদের অনেকে চলে এসেছে। কেউ কেউ খুব কান্নাকাটিও করছে। তাঁর ছোট মেয়েটা বেশ চিৎকার করে কাঁদছে। কান্না দেখেই বুঝা যাচ্ছে বাবার প্রতি মেয়েটার খুব মায়া। আকরাম পাটোয়ারীর বড় ছেলেও এরই মধ্যে চলে এসেছে। এসেই এদিক-সেদিক দৌঁড়া-দৌঁড়ি করছে। লাশের গোসলের বিষয়ে আজিজুর রহমানের সাথে কথা হয়েছে। মানুষজনের ভীড় বাড়ছে। লাশ আসার আগেই পুরো বাড়ি মানুষের জনস্রোত হয়ে গেল।
লাশ এসে পড়েছে। চারিদিকে কান্নার আওয়াজ। মোয়াজ্জিন আজিজুর রহমান এখনো সেই লিচু গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছে। আকরাম পাটোয়ারীর আত্বীয়-স্বজনের সংখ্যা অনেক। চার ছেলে, তিন মেয়ে, নাতি-নাতনির কান্নার শব্দে পুরো বাড়ি শোকের ছায়া পড়েছে। সবাইকে দেখে বুঝা যাচ্ছে এই আকরাম পাটোয়ারী কতটা প্রিয় ছিলেন। আজিজুর রহমান লিচু গাছের নিচ থেকে সরে গিয়ে বাড়ির এদিক-ওদিক ঘুরে সবাইকে দেখছেন। যদিও মুর্দা বাড়ি গেলে এমনটা তিনি কখনো করেন না। আকরাম পাটোয়ারীর বাড়ি এসে তিনি ইচ্ছে করেই সবকিছু ঘুরে ঘুরে দেখছেন। এদিক সেদিক ঘুরে দেখে আজিজুর রহমান আবার ফিরে গেলেন লিচু গাছটির নিচে। এখানে লোকজন একটু কম। মুর্দা গোসলের জন্য পানি গরম দেওয়া হচ্ছে। আকরাম পাটোয়ারীর ছোট ছেলে এসে বলে গেল তাঁর বাবার গোসল যেন গরম পানি দিয়ে হয়। ছোট ছেলের কথা শুনে আজিজুর রহমান শুধু মাথা নাড়লেন।
লিচু গাছ থেকে একটু দুরে বড় হাড়িতে পানি গরম করা হচ্ছে। মুর্দা গোসলের পানি। এই বাড়ি কেয়ার টেকার মোরশেদ খুব আগ্রহ নিয়ে চুলার আগুনে শুকনো লিচু পাতা দিচ্ছে। মাঝে মাঝে এদিক-সেদিক থেকে দু-একটা কাঠ এনে চুলায় আগুনে ছুঁড়ে দিচ্ছে। আজিজুর রহমান তাকিয়ে আছে সেই চুলার দিকে। মোরশেদ কে চুলা নিয়ে এমন ব্যস্ত দেখতে আজিজুরের খুব ভালো লাগছে। একটা লোক মারা গিয়েছে। লোকটা এই বাড়ি মালিক। মোরশেদের চুলার প্রতি আগ্রহ দেখে মনে হচ্ছে এই বাড়িতে এখন এই চুলাটা ভীষণ জরুরী। চুলা জ্বালানোর চেয়ে আর কোনো জরুরী কাজ এই বাড়িতে নেই।
মুর্দা গোসলের জন্য সবকিছু তৈরী করা হয়ে গেছে। সবাই গোসলের কাজটা শেষ করার জন্য আজিজুর রহমানকে তাগাদা দিতেই সে বলল, আকরাম পাটোয়ারীর গোসল আমি দিতে পারব না। আপনারা অন্য লোক দিয়ে গোসল দেন।
আজিজুর রহমানের কথা শুনে উপস্থিত অনেকে কারণ জানতে চাইলো। আজিজুর রহমান চুপ করে আছে। চুপ করে থাকতে দেখে মৃত আকরাম পাটোয়ারীর বড় ছেলে ছুটে এসে বলল, কী হয়েছে? আমার আব্বাকে গোসল দিতে আপনার সমস্যা কোথায়?
-সমস্যা আছে। এই গোসল আমি দিতে পারব না।
আজিজুর রহমানের কথা শুনে গ্রামের চেয়ারম্যান সাহেব কাছে এসে বলল, এই এলাকার সব মুর্দা গোসল তো তুমিই দাও। তাছাড়া এলাকায় তোমার মত এমন আর কে্উ তো নেই যে মুর্দা গোসল দিবে। এখন এই লাশ গোসল দিবে কে?
আজিজুর রহমান খুব শান্ত গলায় বলল, সেটা আপনারা ঠিক করেন।
আজিজুরের কথা শুনে চেয়ারম্যান সাহেব খুব রাগ করলেন। সেই রাগে তিনি আজিজুরের সাথে চিৎকার চেঁচামেচি করে যাচ্ছেন । আজিজুর খুব স্বাভাবিক। চেয়ারম্যান আর মৃত আকরাম পাটোয়ারির ছেলেরা বার বার অনুরোধ করছেন কিন্তু আজিজুর খুব শান্তভাবে বলে যাচ্ছে একই কথা। মুর্দা বাড়িতে আসা লোকজন আজিজুর রহমানের কাছে এসে নানাভাবে অনুরোধ করেও কোনো কাজ হলো না।
আকরাম পাটোয়ারীর আত্বীয়-স্বজনরা খুব ক্ষেপে উঠল। এটা তাদের জন্য খুব অপমানের। এলাকার লোকজনও আজিজুর রহমানের উপর অসন্তুষ্ট হতে লাগল। যে মানুষ এতটা সম্মানের সাথে, দাপটের সাথে এলাকার মানুষজনের কাছে পরিচিত ছিল সেই মানুষকে গ্রামের সাধারণ একজন মুয়াজ্জিন এমন করে অপমান করবে তা কেউ মেনে নিতে পারছে না। মুর্দা গোসলের জন্য লোক খোঁজা হচ্ছে।
আজিজুর রহমান লিচু গাছের নিচেই দাঁড়িয়ে আছে। এখনো গোসলের জন্য লোক পাওয়া যায়নি। মুর্দা গোসলের জন্য লোক না পেয়ে সবাই আবার আজিজুর রহমানের উপর ক্ষিপ্ত হয়ে তাঁর সামনে এসে জড়ো হলো। আজিজুর রহমান চুপ করে দেখছেন। কেউ একজন আজিজুর রহমানকে উদ্দেশ্য করে গালি দিয়ে কিছু একটা বলতেই তিনি চিৎকার দিয়ে বলে উঠল, একজন রাজাকার আর আমার মায়ের ধর্ষকের গোসল আমি দিতে পারব না। আমার জীবন নিয়ে গেলেও আমি এই গোসল দিব না। এই লোক একজন রাজাকার, রাজাকার, রাজাকার। এই লোক আমার মায়ের ধর্ষক।
কথাগুলো বলতে বলতে আজিজুর রহমান হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। দিনের পর দিন নিজের ভেতর কষ্ট পুষে পুষে একটা মানুষ যখন খুব সাহসী হয়ে উঠে তখন তার চোখ দেখলেই বুঝা যায়। আজিজুর রহমান কাঁদলেও তাঁর চোখ দুটি যেন সেই সাহসের আলো ছড়াচ্ছে।
আজিজুর রহমান চিৎকার করে সবাইকে উদ্দেশ্যে বলতে লাগল, এই আকরাম পাটোয়ারী, এই রাজাকার আকরাম পাটোয়ারী আমার সামনেই আমার নিরীহ মা’কে একাত্তর সালে ধর্ষন করেছে। বুঝলেন সবাই? এই রাজাকার আমার সামনে আমার মায়ের উপর নির্যাতন চালাতো। একটা আট বছরের শিশুর সামনে এমন একটা কাজ করতে এই অমানুষের বুক কাঁপেনি। দিনের পর দিন এই কষ্ট আমার ভেতর লুকিয়ে রেখেছি। আমি এই সময়টার জন্য অপেক্ষা করেছি। আজ আমার বিজয়ের দিন। এই দিনে এমন অমানুষের কথা আমি ভুলি কেমন করে!
সবাই চুপচাপ হয়ে তাকিয়ে আছে আজিজুর রহমানের দিকে। আকরাম পাটোয়ারীর ছেলেমেয়ে, নাতি-নাতনি, এলাকার লোকজন সবাই। সবাই কেমন যেন চুপচাপ আর শান্ত। কেউ কোনো প্রতিবাদও করছে না আজিজুরের কথা শুনে। কীভাবে করবে এই প্রতিবাদ! আজিজুর যে সবারই প্রিয় একজন। সেই ছোটবেলা থেকে আজিজুর রহমান ভীষণ ভালো মানুষ। এলাকায় সৎ আর শান্তশিষ্ট মানুষ হিসেবে সবাই সম্মান করে। মোয়াজ্জিন আজিজুর রহমানের কথা শুনে সবাই কেমন যেন চুপচাপ হয়ে গেল। সবাই বুঝতে পারে আজিজুরের এই কথা সত্য। যে মানুষ আজ পযর্ন্ত মসজিদ ছাড়া কোনো বিষয়ে কখনো কারো সাথে কথা বলেন না, কখনো কারো সাথে ঝগড়া-ঝাটি করেন না, সেই মানুষ এতদিন পর এমন করে এসব কথা বলার নিশ্চয় কারণ আছে। তাছাড়া নিজের চোখে দেখা মায়ের উপর এমন নির্যাতনের কথা কেউ মিথ্যা বলতে পারে না।
একাত্তর সালে আকরাম পাটোয়ারীর কাজ-কর্ম নিয়ে নানা কথা প্রচলিত থাকলেও কেউ কখনো সরাসরি বলতে সাহস পেত না। আজ মোয়াজ্জিন আজিজুর রহমান বলল। আজ বুঝা গেল কেন গতরাত থেকে আজিজুর রহমান এমন করে মসজিদের মাইকে বার বার রাজাকার পাটোয়ারীর মৃত্যু সংবাদ ঘোষণা দিচ্ছে। এই দেশ থেকে একজন রাজাকার, ধর্ষকের বিদায় নিশ্চয় আনন্দের। এই আনন্দ উপভোগ করতেই হয়তো আজিজুর রহমান সারারাত বার বার করে মাইকে ঘোষণা দিল।
কথাগুলো শেষ করে আজিজুর রহমান রাজাকার আকরাম পাটোয়ারীর বাড়ি থেকে বের হয়ে সোজা গোরস্থানের দিকে হাঁটতে লাগল। আকরাম পাটোয়ারীর সন্তান, নাতি-নাতনি, এলাকার লোকজন কেমন যেন অসহায় হয়ে তাকিয়ে আছে এই আজিজুর রহমানের দিকে। বয়স্ক, সৎ আর শান্ত এই মোয়াজ্জিনকে কিছু বলার সাহস যেন কেউ খুঁজে পায় না। নিজ চোখে একজন মা-কে ধর্ষিত হতে দেখা সন্তানকে কিছু বলার সাহস কারো যে নেই।
একাত্তর সালে এই আজিজুর রহমানের বয়স সাত-আট হবে। আজিজুরের বাবা যুদ্ধের মাস দুয়েক আগে কলেরায় মারা গেল। যুদ্ধ শুরুর পর মা-ছেলে খুব অসহায় হয়ে পড়ে। আকরাম পাটোয়ারী তখন গ্রামেই থাকত। তখন সবাই বলাবলি করে এই পাটোয়ারীর সাথে মিলিটারির খুব ভালো সর্ম্পক। একদিন আকরাম পাটোয়ারীর অনুরোধেই তাঁর বাড়িতে যুদ্ধকালীন আশ্রয় নিল অসহায় মা-ছেলে। আশ্রয়কালীন সময় এই আকরাম পাটোয়ারী জোর করে আজিজুর রহমানের মা’কে প্রায় ধর্ষণ করত। যে রাতে এমন করত সেই রাতে মা-ছেলে সারারাত জেগে থাকত। আজিজুর মায়ের বুকে মাথা লুকিয়ে শুধু কাঁদত। ভয়ে, লজ্জায়, অভিমানে সেই কথা কাউকে না বলে একদিন মা-ছেলে পাটোয়ারীর বাড়ির থেকে পালিয়ে গেল পাশের গ্রামে। যুদ্ধের পর আজিজুর মাকে নিয়ে গ্রামে আসলেই আজিজুরের মা বেশিদিন বাঁচেনি। তারপর হয়তো বছর তিনেক হবে। মা মারা যাওয়ার পর আজিজুরকে মকসুদপুরের এতিমখানায় দিয়ে আসল এক আত্বীয়। সেখানেই বড় হতে লাগল। মকসুরপুরের মাদ্রাসায় ক্লাস নাইন পড়েই গ্রামের মসজিদে মোয়াজ্জিমের কাজ নিল।
বাড়ির কাছের গোরস্থানে দাঁড়িয়ে কাঁদছে আাজিজুর রহমান। কাঁদলেও আজ তাঁর মনটা ভীষণ ভালো। আজ তাঁর বিজয়ের দিন। এতটা বছর নিজের ভেতর যে কষ্টের বিশাল পাহাড় বহন করে বেড়িয়েছেন আজ সেই পাহাড় চূড়ায় দাঁড়িয়ে বিজয়ের হাসি দিচ্ছে আজিজুর রহমান। সাতচল্লিশ বছর আগে ঠিক যে জায়গাটিতে আজিজুর রহমান মা’কে কবর দিয়েছিল ঠিক সেই জায়গায় একটা ছাতিম গাছ লাগিয়েছিল আজিজুর। ছাতিম গাছে এবার খুব ফুল হয়েছে। প্রতিবার অনেক আগেই এই ফুল ঝরে পড়ে। এবার এখনো গাছ জুড়ে ফুলে ভরে আছে। ফুলে ফুলে পুরো গাছ সাদা হয়ে আছে। ছাতিম ফুলের ঘ্রাণ নাকে লাগছে। এই ফুলের ঘ্রাণ আজিজুরের মায়ের খুব পছন্দ ছিল। প্রতিবার যখন এই গাছে ফুল আসে তখন আজিজুর রহমান এই গাছের নিচে এসে দাঁড়িয়ে থাকে। তবে এত বছর এই গাছের নিচে দাঁড়িয়ে কখনো কাঁদেনি। আজ কাঁদছে। আজ যে আজিজুর রহমানের বিজয়ের দিন।
বিজয়ের জন্য অপেক্ষা করতে হয়। এই কথাটা আজিজুরের মা বলতেন। মারা যাওয়ার আগে আজিজুর রহমানের মা ছেলেকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল, যুদ্ধ শেষে সবাই বিজয় পেলেও তোমার বিজয়ের জন্য অপেক্ষা করবে বাপ। নিশ্চয় একদিন তুমি সেই বিজয় এসে তোমার ভেতর লুকিয়ে থাকা কষ্টগুলো ফুল হয়ে আলো ছড়াবে।
ছাতিম ফুল দেখে মনে হচ্ছে সেই বিজয়ের আলো।
—বিজয়
——রুহুল আমিন
.