বৃষ্টিময় প্রেম .
লেখনীতে_ তাসফিয়া হাসান তুরফা
পর্ব ১৬
থমথমে মুখে বসে আছে সবাই। কারও মুখে কোন কথা নেই। সবার নজর বড়াব্বুর উপর যিনি এখনও কিছু বলেননি, যেন গভীর কোন চিন্তায় মগ্ন। এদিকে আমার আর তর সইছেনা! মন চাইছে এখনি নিজে থেকেই বড়াব্বুর পক্ষে কথা বলি আর মানা করে দেই রায়হান ভাইয়ার সাথে আমার বিয়ের জন্য!! আমার চিন্তাভাবনার মধ্যে শুনা গেলো বড়াব্বু অবশেষে মুখ খুললেন। অধীর আগ্রহে উনার দিকে চাইলাম আমি,
—দেখেন খালাম্মা, আমার মনে হয় তুরফার বিয়ের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কাজটা ওর উপরই ছেড়ে দেওয়া উচিত। আপনি আমি শুধু নিজেদের মতামতটুকু রাখতে পারবো। কিন্তু বাকি জীবনটা তো ওদেরই একসাথে কাটাতে হবে তাই নিজেদের ডিসিশন জানানোর আগে আমার মনে হয় তুরফা আর রায়হানের থেকে ওদের মতামত নেওয়া উচিত। তুরফা মা, তোর কি মনে হয়? বিনা দ্বিধায় আমাদের সামনে তোর মতামত রাখতে পারিস। তুই যা বলবি তাই-ই হবে। তোর কথার উপর দিয়ে কাউকে কথা বলতে দিবো না আমি।
কথাটা দাদির দিকে তাকিয়ে বললেন বড়াব্বু! অর্থাৎ যেন বুঝালেন তাকে যে এখন তুরফার পরিবার আছে, এখন ওর উপর কোন সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া যাবেনা! বড়াব্বুর কথা শুনে খুব স্বস্তি পেলাম আমি। যাক একদম কাজের কথা বলেছেন উনি! এখনি সময় সুযোগকে কাজে লাগানোর। দেরি করলে রায়হান ভাইয়ার থেকে আগে মতামত নেওয়া হতে পারে আর উনি বাই চান্স “হ্যাঁ” বলে দিলে খুবই বিচ্ছিরি হবে ব্যাপারটা!! তাই তড়িঘড়ি করে আমি বললাম,
—আসলে বড়াব্বু সত্যি বলতে আমি বিয়ের ব্যাপারে এখনও কিছু ভাবিনি। আমার মাথায় এখন শুধু ভর্তিপরীক্ষা-ই আছে। তাই ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার চিন্তার বাইরে বিয়ে-টিয়ের চিন্তাভাবনা মাথায় আসেনি কখনো।
আস্তেধীরে সমস্ত দোষ আমার পড়ালেখার উপর চাপিয়ে দিয়ে বিয়ের ব্যাপারটাকে ধামাচাপা দিলাম আমি। কারণ সরাসরি রায়হান ভাইয়াকে রিজেক্ট করছি বিষয়টা ভালো দেখাবেনা, উনি হয়তো কস্ট পাবেন। আর আমারও প্রকাশ্যে তাকে রিজেক্ট করতে বাজে লাগবে এজন্য পড়ালেখার উপর দিয়েই চালিয়ে দিলাম সবকিছু। ভেবেছিলাম এখন হয়তো সবাই বুঝবে আমি বিয়ের জন্য রাজি না, এব্যাপারে আর কেউ অগ্রসর হবেনা কিন্তু দাদি যেন অন্য মুডে আছেন। আমার ধারণা ভেঙে দিয়ে উনি বললেন,
—আচ্ছা সমস্যা নেই, তুরফা। তোমার যখন মনে হবে বিয়ের জন্য তুমি প্রস্তুত তখনি আমরা এ ব্যাপারে কথা বলবো। তাড়াহুড়োর কিছু নেই। কারণ, রায়হানের জন্য তুরফাকে আমার সবসময়ই পছন্দ ছিলো। শুধু ফ্যামিলির অনুপস্থিতিতে কথাটা তুলতে পারিনি এতদিন।
দাদির কথা শুনে রাগে আমার মেজাজ গরম হয়ে গেলো। আচ্ছা খারাপ মহিলা তো! পিছুই ছাড়ছেন না আমার! নেহাত বড়ো মানুষ আমার চেয়ে আর এতগুলো মানুষ সামনে বসে আছে নয়তো এতক্ষণ আচ্ছামত কথা শুনাতাম উনাকে! তুই থেকে এখন আমি “তুমি” হয়ে গেছি তার কাছে! আবার কি যেন বললেন উনি? রায়হান ভাইয়ার জন্য আমি সবসময় তার পছন্দের তালিকায় ছিলাম? মিথ্যা কথা বলারও একটা লিমিট থাকে, যেটা দাদি এই বয়সে এসেও ক্রস করে ফেলেছেন! এখন যদি উনাকে আমি সরাসরি মানা না করি উনি কোন না কোন উপায়ে এই বিষয়টা আবারও সামনে আনবেন। তখনি মনে পড়লো পূর্ণ ভাইয়ার কথা! উনি বলেছিলেন আমি যদি নিজের জন্য কথা না বলি তবে কেউ আমার জন্য কথা বলবেনা। উনার কথার মর্ম আজ হারে হারে উপলব্ধি করতে পাচ্ছি আমি! তাই একপ্রকার বাধ্য হয়েই নিজের পক্ষে আমি বললাম,
—আমি রায়হান ভাইয়াকে বিয়ে করতে চাইনা দাদি। উনাকে আমি সবসময় ভাইয়ের নজরে দেখেছি। এরকম কিছু আমার মাথায়ও আসেনি কখনো। তাই আমি এই বিয়েতে অগ্রসর হতে চাইনা।
ধীর গলায় বলা আমার কথাগুলো শুনে রুমের মধ্যে পিনপতন নীরবতা সৃষ্টি হলো। সবার দৃষ্টি এখন আমার দিকে। আমি মাথা নিচু করে বসে আছি। আড়চোখে তাকিয়ে দেখলাম দাদি বিস্ফোরিত মুখে চেয়ে আছেন আমার দিকে। হয়তো উনি ভাবেননি আমি কখনো এরকম সাহস করে কথা বলতে পারবো তার মুখের উপর। কিন্তু আজকে আমি পেরেছি কারণ আজ আমার পরিবার আমার পাশে আছে এবং একজনের বলা কথা আমাকে ভীষণভাবে অনুপ্রাণিত করেছে। মনে মনে পূর্ণ ভাইয়াকে ধন্যবাদ দিয়ে উনার দিকে চোখ যেতেই দেখি তিনি মুখ নিচু করে রেখেছেন। তবে আমার নজর কাড়লো উনার মুখের এক চিলতে হাসি! কিন্তু উনি হাসছেন কেন? তবে কি আমি নিজের জন্য স্ট্যান্ড নেওয়ায় উনিও খুশি হয়েছেন?
আমার ভাবনার মধ্যেই শুনলাম বড়াব্বুর কথা। উনি গলা ঝেড়ে বলতে শুরু করলেন,
—তুমি নিজের পক্ষে এভাবে কথা বলবে এটাই আমি চেয়েছিলাম। এজন্যই তোমাকে ডিসিশন নিতে দিয়েছি। তুমি বিয়েতে রাজি হলেও আমার আপত্তি ছিলো না, মানা করে দেওয়াতেও আমার আপত্তি নেই। কারণ এটা তোমার জীবন, এখানে সব সিদ্ধান্ত তোমারই হবে। তবে আমি রায়হানকে বলতে চাই তুমি মনে কিছু নিয়োনা। তুমি কি তুরফাকে বিয়ে করতে চেয়েছিলে? আশা করি তুরফার ডিসিশনে তুমি কিছু মনে করোনি।
রায়হান ভাইয়া ইতস্তত করে বললেন,
—আমার কোন প্রব্লেম নেই আংকেল। আমিও আপনার মতো ডিসিশনটা তুরফার উপরেই ছেড়ে দিয়েছিলাম। ও মানা করাতে আমার কোন সমস্যা নেই, ও রাজি হলেও আমার আপত্তি ছিলোনা।
শেষের লাইনটা উনি খুব ধীরে বললেও আমার কর্নগোচর হলো। আমি অবাক চোখে তাকিয়ে রইলাম উনার দিকে। তবে কি তিনি সত্যিই আমাকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন? উনি কি কোনভাবে আমাকে পছন্দ করতেন? বিষয়টা তালগোল পেকে গেলো আমার মনের ভেতর। কিন্তু যাই হোক, এখন বেশি কিছু ভাবলে চলবেনা৷ যা হওয়ার হয়ে গেছে। একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবলাম আমি।
—তবে তুরফা, আমারও একটা কথা বলার ছিলো। তখন খালাম্মা কথা বলায় আমি আর বলতে পারিনি বিষয়টা। এখন বলা উচিত বলে মনে করি।
বড়াব্বুর কথায় ভ্রু কুচকে তাকালাম আমি। এখন উনি আবার কি এমন বলবেন। তাই আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
—হ্যাঁ, বড়াব্বু বলো। তোমার আবার কি বলার ছিলো??
—দেখ মা, আমি তোর নিজের বড়বাপ। তুই আমাদের রক্ত। নিজের মেয়ের নিশ্চয়ই খারাপ চাইবোনা আমি, তাই না?
—অবশ্যই বড়াব্বু। কিন্তু তুমি এভাবে কেন বলছো?
—বিয়েশাদির কথা যখন উঠেছেই তখন আমারও কিছু বলার ছিলো।
পুনরায় বিয়েশাদির কথা শুনে আমি হয়রান হয়ে গেলাম!! একদিনে আর কতবার বিয়েশাদির প্রস্তাব পাবো? এটা কোন কথা!! যাই হোক, নিজের ভাবনাকে সাইডে রেখে বড়াব্বুর কথায় মনোযোগ দিয়ে শুনলাম,
—বলছিলাম আমার কাছে একটা প্রস্তাব আছে। যদি তুই রাজি থাকিস তবে তুই সারাজীবনের জন্য আমাদের বাড়িতে থাকতে পারবি, আমাদের সাথে। তোর পরিবার সবসময় তোর কাছেই থাকবে।
বড়াব্বুর কথা শুনে চকচক করে উঠলো আমার চোখ! দারুণ বুদ্ধি তো! খুশি হয়ে বললাম,
—আরে বাহ! কি বুদ্ধি, বড়াব্বু? জলদি বলো।
আমার খুশিমুখ দেখে বড়াব্বু যেন খুব উৎসাহ পেলেন। আহ্লাদে আটখানা হয়ে বললেন,
—ভাবছিলাম তোর আর পূর্ণর বিয়ে হলে কেমন হয়। পূর্ণ যেহেতু এখনও বিয়ে করেনি, একদিন তো ওকে করতেই হবে আর তোকে আমরা এতদিন পর ফিরে পেলাম জীবনে, এখন তোকে হাতছাড়া করতে চাইনা আর। পূর্ণর সাথে তোর বিয়ে হলে এক ঢিলে দুই পাখি মারা হবে। আমার এই কাজপাগল ছেলেটাকে একটা বন্ধনে বেধে দিতে পারবো আর তুই, আমদের ঘরের মেয়ে আমাদের কাছেই থাকবি।
বড়াব্বুর প্ল্যান শুনে খুশিতে গদগদ হয়ে উঠলেন বড়াম্মু। হাসিমুখে সায় জানালেন তার স্বামীর কথায়। এদিকে পূর্ণ ভাইয়াকে বিয়ে করার কথা শুনে আমার হার্টবিট বেড়ে গেছে। এমন তো আমি কস্মিনকালেও ভাবিনি। উনাকে আর আমাকে সারাজীবন একসাথে থাকতে হবে? এটাও সম্ভব!! আমার ভাবনার মাঝেই বিষম খেলেন পূর্ণ ভাইয়া। বেচারা হয়তো পানি খাচ্ছিলেন এমন সময় বড়াব্বুর কথা কানে গেছে তার! উনার সারাজীবন সিংগেল থাকার প্ল্যান বড়াব্বু এভাবে নস্ট করে দিতে চাইছেন শুনেই হয়তো বিষম খেয়েছেন উনি। উনার চেহারা দেখে খুব মায়া হলো আমার। আমি বা পূর্ণ ভাইয়া কিছু বলার আগেই বড়াব্বু বললেন,
—তুরফা, পূর্ণ আমি তোদের কাউকেই এখনি ডিসিশন নিতে বলছিনা। আমি চাইনা তাড়াহুড়ায় কোন ডিসিশন নেওয়া হোক। বিয়ে তোমাদের, সিদ্ধান্তও তোমাদের। আমরা আজকে এখান থেকে চলে যাচ্ছি। তুরফা আজকের দিন সময় তোর হাতে। সারাদিন নিয়ে ভাবিস, মা। তারপর তুই রাজি থাকলে কাল একবারে কাবিন করে আমাদের বাসায় নিয়ে যাবো তোকে।
বড়াব্বুর মাথা শুনে মাথা ভনভন করতে লাগলো আমার। এসব কি হচ্ছে আজ!! বিয়ে ছাড়া আর কোন টপিক নেই নাকি? বড়াব্বুর প্ল্যানটা নিঃসন্দেহে উনার দিক বিবেচনা করলে ভালো কিন্তু তবুও! আমি আর পূর্ণ ভাইয়া?? আমাদের বিয়ে ভাবলেই আমার হৃদয় হিম হয়ে যায়!
পরক্ষণেই মাথায় এলো আমার এত চিন্তা করার কি দরকার? এটা তো পূর্ণ ভাইয়া! উনি আর যাই হোক, নিশ্চয়ই আমাকে বিয়ে করতে চাইবেন নাহ!! সুতরাং আমার টেনশন করার কোন কারণ নেই। উনি নিজেই বড়াব্বুকে মানা করে দিবেন। আমার কিচ্ছু করতে হবেনা! ভাবতে ভাবতেই বাকা হাসি দিলাম আমি।
ঠিক ওই মুহুর্তে চোখ পড়লো পূর্ণ ভাইয়ার দিকে, উনি ভ্রু কুচকে আমার দিকে চেয়ে আছেন। উনাকে দেখে অন্যদিকে তাকালাম আমি। অপেক্ষা করতে লাগলাম উনি কখন এ বিয়েতে মানা করে দেন এটা শুনার..!!
#চলবে
.