#মুসলিম_বিয়ে_তালাক_এবং_সন্তানের_ভরণপোষণ
#ফারহানা_সলিম_সিন্থিয়া
মুসলিম আইন অনুযায়ী বিয়ে একটি চুক্তি। এই চুক্তি যে কোন পক্ষ রদ বা ভঙ্গ করতে পারেন। বিয়ের মাধ্যমে স্থাপিত সম্পর্ককে আইনগত উপায়ে ভেঙ্গে দেয়াকে তালাক বা বিয়ে বিচ্ছেদ বলে। স্বামী বা স্ত্রীর যে কোন একজনের ইচ্ছাতেও (শর্তাধীন) বিয়ে বিচ্ছেদ ঘটতে পারে। কিন্তু স্বামী যৌতুকের জন্য তালাক দিলে যা অন্যায়।একজন মুসলিম পূর্ণ বয়স্ক সুস্থ মস্তিস্কের পুরুষ যে কোন সময় স্ত্রীকে তালাক দিতে পারেন।মুসলিম আইনে বিয়ে একটি চুক্তি, তাই এ চুক্তি নানা কারণে সমাপ্ত বা ভংগ করা যায়।স্বামী-স্ত্রীকে কোন প্রকার কারণ ছাড়াই তালাক দিতে পারেন। মুসলিম পারিবারিক আইনে বিয়ের চুক্তি ভেঙ্গে বিয়ে-বিচ্ছেদ ঘটানো সম্ভব কিন্তু সে মুখে বা লিখে যেভাবে তালাক দিক না কেন তালাক সাথে সাথে কার্যকর হবে না।১৯৭৪ সালের মুসলিম বিবাহ ও তালাক রেজিষ্টেশন আইন অনুযায়ী একজন উকিল বা কাজীর মাধ্যমে তালাকের নোটিশ স্বামী কর্তৃক স্ত্রীকে অথবা স্ত্রী কর্তৃক স্বামীকে এবং স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ/পৌরসভা/সিটি কর্পোরেশনকে পাঠাতে হবে।
১৯৬১ সনের মুসলিম পারিবারিক আইনের ৭ (৬) ধারা অনুসারে তালাকের মাধ্যমে কোন বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটলে, বিচ্ছেদপ্রাপ্ত/ তালাকপ্রাপ্ত স্বামী-স্ত্রী পুনরায় একত্রে ঘর- সংসার করতে চাইলে নতুন করে নিয়ম অনুসারে বিয়ে করতে হবে; তবে পুনর্বিবাহ করে ঘর-সংসার করায় আইনতঃ কোন বাধা নেই।
মুসলিম আইনে তালাকের প্রক্রিয়া-
স্ত্রী কীভাবে স্বামীকে তালাক দিতে পারে?
একজন স্ত্রী যখন ইচ্ছা তখন স্বামীকে তালাক দিতে পারেন না। মুসলিম আইনে স্বামীকে তালাক দেয়ার ক্ষেত্রে স্ত্রী সীমিত অধিকার ভোগ করেন।
নিম্নে লিখিত যেকোন উপায়ে একজন স্ত্রী তালাক সম্পন্ন করতে পারেন।
ক. স্ত্রী আদালতের মাধ্যমে বিচ্ছেদ ঘটাতে পারেন।
খ. তালাক-ই-তৌফিজ এর মাধ্যমে বিচ্ছেদ ঘটাতে পারেন।
গ. খুলা-র মাধ্যমে বিচ্ছেদ ঘটাতে পারেন।
ঘ. স্বামী-স্ত্রী দুজনই মুবারাতের মাধ্যমে বিচ্ছেদ ঘটাতে পারেন।
১.১৯৩৯ সালের মুসলিম বিবাহ বিচ্ছেদ আইন অনুযায়ী একজন স্ত্রী কী কী কারণে স্বামীর বিরুদ্ধে আদালতে বিয়ে বিচ্ছেদের আবেদন করতে পারে?
চার বছর যাবৎ স্বামী নিরুদ্দেশ থাকলে বা কোন খোঁজ খবর না নিলে।
২ বছর যাবৎ স্ত্রীর খোরপোষ প্রদানে অবহেলা বা ব্যর্থ হলে।
স্বামী ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ লঙ্ঘন করে একাধিক স্ত্রী গ্রহণ করলে।
স্বামী ৭ বছর বা তার বেশী সময়ের জন্য কারাদণ্ডে দণ্ডিত হলে।
স্বামী কোন যুক্তি সম্মত কারণ ছাড়া ৩ বছর ধরে দাম্পত্য দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে ব্যর্থ হলে।
বিয়ের সময় স্বামী পুরুষত্বহীন থাকলে এবং তা মামলা দায়েরের সময় তা পর্যন্ত বজায় থাকলে।
স্বামী ২ বছর ধরে অপ্রকিতস্থ থাকলে অথবা কুষ্ঠ ব্যাধিগ্রস্থ বা মারাত্মক যৌনরোগে আক্রান্ত থাকলে।
১৮ বছর পূর্ণ হওয়ার আগে অর্থাৎ নাবালিকা অবস্থায় বিয়ে হয়ে থাকলে এবং ১৯ বছর হওয়ার আগে বিয়ে অস্বীকার করলে তবে এক্ষেত্রে স্বামীর সাথে দাম্পত্য মিলন অনুষ্ঠিত হয়ে থাকলে মামলা করা যাবে না।
★★নিম্নলিখিত যে কোন অর্থে স্বামী স্ত্রীর সাথে নিষ্ঠুর আচরণ করলে –
ক. স্বামী যদি স্ত্রীকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করে থাকেন।
খ. স্বামী খারাপ চরিত্রের মেয়েদের সাথে মেলামেশা করলে কিংবা নৈতিকতা বর্জিত জীবনযাপন করলে।
গ. স্ত্রীকে জোর পূর্বক নৈতিকতা বিহীন জীবন যাপনের জন্য বাধ্য করার চেষ্টা করলে।
ঘ. স্ত্রীর অমতে তার সম্পত্তি হস্তান্তর করা কিংবা স্ত্রীকে তার সম্পত্তির ওপর বৈধ অধিকার প্রয়োগে বাধা দেওয়া।
ঙ. স্ত্রীকে তার ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান পালনে বাধা দিলে।
চ. যদি স্বামীর একাধিক স্ত্রী থাকে এবং পবিত্র কুরানের নির্দেশ অনুসারে স্বামী তাদের সাথে সমান ব্যবহার না করে।
মুসলিম আইনে স্বীকৃত অন্য যে কোন যুক্তি সঙ্গত কারণের জন্য মামলা করতে পারেন।
২. তালাক-ই-তৌফিজ
কাবিন নামার ১৮ নং কলামে স্বামী কর্তৃক স্ত্রীকে বিয়ে বিচ্ছেদের ক্ষমতা দেয়াকে তালাক-ই-তৌফিজ বলে। এই তালাক-ই-তৌফিজ এর ক্ষমতা দেয়া থাকলে স্ত্রী আদালতের আশ্রয় ছাড়াই স্বামীকে তালাক দিতে পারেন। এক্ষেত্রে স্বামীর মতোই স্ত্রী তালাকের নোটিশ চেয়ারম্যান এর কাছে পাঠাবেন। নোটিশ প্রাপ্তির ৯০ দিন পর তালাক কার্যকর হবে।
৩. খুলা –
খুলা তালাক হলো স্ত্রীর পক্ষ থেকে স্বামীর দাম্পত্য অধিকার থেকে মুক্তি পাওয়ার প্রস্তাব।এক্ষেত্রে স্ত্রী কোন কিছুর বিনিময়ে স্বামীকে বিচ্ছেদের বিষয়ে রাজী করানোর চেষ্টা করবেন। স্বামী রাজী না হলে এভাবে বিচ্ছেদ ঘটতে পারে। বিচ্ছেদের উদ্যোগ অবশ্যই স্ত্রীর কাছ থেকে হতে হবে।
৪. মুবারাত –
স্বামী – স্ত্রী উভয়ের সম্মতিতে বিয়ে বিচ্ছেদ সম্পন্ন হলে তাকে মুবারাত বলে। যখন স্বামী – স্ত্রীর মধ্যে বিয়ে বিচ্ছেদের ইচ্ছাটি পারস্পরিক হয় তখন একপক্ষ প্রস্তাব করে এবং চুক্তির মাধ্যমে তাদের বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে। যিনি বিয়ে বিচ্ছেদের প্রস্তাব দিবে তিনিই নোটিশ পাঠাবেন।
স্বামী কীভাবে স্ত্রীকে তালাক দিতে পারবেন?
একজন মুসলিম পূর্ণ বয়স্ক সুস্থ মস্তিষ্কের পুরুষ যে কোন সময়ে স্ত্রীকে তালাক দিতে পারেন। কিন্তু সে মুখে বা লিখে যেভাবে তালাক দিক না কেন তা সাথে সাথে কার্যকর হবে না।
১৯৬১ সালের পারিবারিক আইন অধ্যাদেশর ৭(১) ধারা অনুযায়ী যে ব্যক্তি তালাক দিবেন তিনি লিখিত ভাবে তালাকের নোটিশ স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান / সিটি কর্পোরেশন বরাবরে ও স্ত্রীর কাছে এক কপি নোটিশ পাঠাবেন।
নোটিশ না পাঠালে ১ বছর কারাদণ্ড বা ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয়দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
নোটিশ পাওয়ার পর ৩০ দিনের মধ্যে চেয়ারম্যান/মেয়র শালিসী পরিষদ গঠন করে উভয়ের মধ্যে সমঝোতা আনার চেষ্টা করবেন।
শালিসী পরিষদ উভয়কে ৯০ দিনের মধ্যে প্রতি ৩০ দিনে একটি নোটিশ করে মোট ৩ টি নোটিশ প্রদান করবেন। এর মধ্যে স্বামী নোটিশ প্রত্যাহার না করলে তালাক কার্যকর হবে।স্বামী নোটিশ প্রত্যাহার করলে তালাক কার্যকর হবে না।
তালাক প্রদানের সময় স্ত্রী গর্ভবতী থাকলে তালাক কার্যকর হবে না।তবে সন্তান প্রসব হওয়ার পর পর্যন্ত নোটিশ বহাল থাকলে সন্তান জন্ম নেওয়ার ৯০ দিন পর তালাক কার্যকর হবে।স্বামী নোটিশ প্রত্যাহার করে নিলে এক্ষেত্রে তালাক কার্যকর হবে না।
১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইনের অধ্যাদেশের ৭(১)ধারা কোথাও নোটিশ প্রদান না করলে তালাক হবে না । একজন স্বামী তার স্ত্রী কে যে ভাবেই তালাক দিন না কেন তিনি অবশ্যই ( shall) লোকাল চেয়ারম্যান কে নোটিশ দিবেন। তবে স্বামী শাস্তি পাবেন।
স্বামী কর্তৃক তালাকের ক্ষেত্রে স্বামী যখন ইচ্ছা তখন একতরফা ভাবে তালাক প্রদান করতে পারে। তাকে তালাকের কারণ দেখাতে হয়না। কেন স্বামী স্ত্রীকে তালাক দিলেন তা স্ত্রী জানতে চাইতে পারেন না। এটা স্বামীর একতরফা ক্ষমতা।
তালাকের পর নারীদের পরবর্তী পদক্ষেপ –
আমাদের দেশে ডিভোর্স এর পর এ্যালিমনির কোন নিয়ম নেই। এই ব্যাপার সবার এগিয়ে আশা দরকার।একটা মানুষ জীবনের সুন্দর সময়গুলো একজন কে দিল তারপর তার যখন জীবনে এই সংসার ছাড়া আর কিছুই নেই তখন তাকে বলা হল তোমাকে আর দরকার নেই বিদায় হও তালাক দিলাম। তখন মানুষ টার না আবার বিয়ের বয়স থাকে না যাওয়ার জায়গা। হয়তো সংসার করতে গিয়ে চাকরি করার সুযোগ পায়নি। মেয়েদের জীবন এই যুগেও যে কতটা খারাপ অবস্থা তা না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট এই ব্যাপারে এক রায়ের মাধ্যমে আজীবনের মত এই পথ বন্ধ করে দিয়েছে।তাই চাইলেও আইনের সাহায্য পাওয়া যাচ্ছে না।আবার কাবিন বেশী দাবি করাও যাচ্ছে না তাতে সন্দেহ করা হয় মেয়ে কাবিনের টাকার লোভে ডিভোর্স দিতে পারে।সমস্যা হচ্ছে কিছু মেয়েরা হয়তো এই ধরনের প্রতারণার সাথে জড়িত থাকে কিন্তু সবাই না।আবার একটা মেয়ে সাবলম্বী হবে তার ব্যাপারে পরিবার থেকে বাধা থাকে।প্রথমত নিজেকে সাবলম্বী না করে কোন মেয়ের বিয়ে করা ঠিক হবে না এবং বিয়ের পর নিজের কাজ চালিয়ে যেতে হবে। দ্বিতীয়ত যখন ডিভোর্স হবে তখন অবশ্যয় নিজের আইনজীবী কে বলতে হবে সে সময়ের কাবিনের অর্থ বর্তমান সময় ব্যাংক ইন্টারেস্ট এর সাথে বা কোর্টের ৬% সুদের যে নিয়ম আছে তা তার অনুসারে দাবি করে কাবিনের অর্থ দাবি। সেক্ষেত্র একটা সামাঞ্জস্য পূর্ন অবস্থানে আসতে পারে।মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ ১৯৬১ সালের দেনমোহর সংক্রান্ত একটা ধারা যোগ করে, যখন তালাক হবে তখন কার সোনার দামে দেন মোহর পরিশোধ হবে দিলেই হয় বা ডলার এর দামে। যেমন, ১৯৯৯ সালে হাসানের বিয়ের দেনমোহর ছিল ১৫০০০০/- টাকা সেই সময়ে ঐ টাকায় যত ডলার বা সোনা পাওয়া যেত, তালাকের সময় সেই পরিমান সোনার দাম বা ডলার তার স্ত্রীকে দিতে হবে।তালাকের তিন বছরের ভিতরে দেনমোহর দাবি করতে হবে, তা না হলে তামাদি হয়ে যাবে।এর মানে এই না এই অর্থ আমাকে কেউ দয়া করে দিচ্ছে এইটা আপনার হক হিসাবে আপনি দাবি করবেন। বিয়ে ইচ্ছামত করলাম ছেড়ে দিলাম আইন সম্পর্কে জানা থাকলে আমরা সময়মত পদক্ষেপ নিতে পারি ।
বিবাহ বিচ্ছেদের পর সন্তানের অবস্থান-
মুসলিম আইন অনুযায়ী, বাবাই অপ্রাপ্তবয়স্ক সন্তানের আইনগত অভিভাবক আর মা হচ্ছেন সন্তানের তত্ত্বাবধায়ক। সন্তানের মা যদি বাবার কাছ থেকে আলাদা থাকেন কিংবা তাঁদের মধ্যে বিচ্ছেদ হয়ে যায়, তাহলে মা তাঁর সন্তানের তত্ত্বাবধান করার ক্ষমতা হারাবেন না। ছেলের ক্ষেত্রে সাত বছর বয়স পর্যন্ত এবং মেয়েসন্তানের বয়ঃসন্ধি বয়স পর্যন্ত মা সন্তানদের নিজের কাছে রাখতে পারবেন। সন্তানের ভালোর জন্য যদি সন্তানকে মায়ের তত্ত্বাবধানে রাখার আরও প্রয়োজন হয়, সে ক্ষেত্রে এ বয়সসীমার পরও মা সন্তানকে নিজের কাছে রাখতে পারবেন। তবে এ জন্য ক্ষেত্রবিশেষে আদালতের অনুমতির প্রয়োজন হতে পারে। মা যদি দ্বিতীয় বিয়ে করেন, তাহলে সন্তানকে নিজের হেফাজতে রাখার ক্ষমতা হারাতে হতে পারে।
যদি আদালতে গড়ায় বিচ্ছেদের পর সন্তান কার কাছে থাকবে-
এ নিয়ে বিরোধ দেখা দিলে পারিবারিক আদালতে আশ্রয় নেওয়া যাবে। পারিবারিক আদালত তখন আইন অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেবে, সন্তানেরা কার কাছে থাকবে। তবে আইনের পাশাপাশি আদালতের ক্ষমতা রয়েছে সন্তানের কল্যাণের দিকটি বিবেচনা করা। আদালত সন্তানের সুস্থ, স্বাভাবিক বিকাশের দিকটি বিবেচনা করে বাবা বা মা যে কারও কাছে রাখার আদেশ দিতে পারেন।
সন্তানের মতামতের গুরুত্ব –
অনেক সময় সন্তানের যদি ভালো-মন্দ বোঝার ক্ষমতা থাকে, তাহলে সন্তানের মতামতকেও আদালত গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। এ জন্য প্রয়োজন হলে সন্তানকে আলাদা করে বিচারক নিজের কাছে নিয়ে তার মতামত জেনে নিতে পারেন। আবার মা-বাবা পর্যায়ক্রমে সন্তানকে কাছে রাখা কিংবা একজনের কাছে থাকলে অন্যজনকে দেখা করার অনুমতিও দিয়ে থাকেন। পারিবারিক আদালতে নিজেদের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে সন্তানকে কাছে রাখার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ারও সুযোগ রয়েছে।
সন্তানের ভরণপোষণের দায়িত্ব কার-
বিচ্ছেদের পর সন্তান যদি মায়ের কাছে থাকে, অনেক বাবা মনে করেন সন্তানের ভরণপোষণ দিতে হবে না। এটা ঠিক নয়। সন্তান বাবা কিংবা মা—যার কাছেই থাকুক না কেন, সন্তানের ভরণপোষণের দায়িত্ব সম্পূর্ণ বাবার। অর্থাৎ মা-বাবার মধ্যে বিচ্ছেদ হলে কিংবা মা-বাবা আলাদা বসবাস করলে বাবাকেই সন্তানদের ভরণপোষণ দিয়ে যেতে হবে। ইচ্ছে করলে মা আলাদা থেকেও বিবাহবিচ্ছেদ হোক বা না হোক, সন্তানের ভরণপোষণ আদায় করার জন্য নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে(সন্তান সাবালক না হওয়া পর্যন্ত এর মধ্য মামলা করা যাবে ভরণপোষণ দাবী করে।ও মেয়েদের বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত ভরনপোষন পাবে ) পারিবারিক আদালতে মামলা করতে পারবেন।
যে বিষয়ে আইনগত: বিধান রয়েছে আমরা যেন এমন কোন বিষয়ে নিজেদের মনগড়া সিদ্ধান্ত না নিয়ে এক বা একাধিক জীবনকে নিশ্চিত ধ্বংসের মুখে ঠেলে না দেই এ বিষয়ে সকলের সজাগ থাকতে হবে..
নারী নিকাহ রেজিস্ট্রার: ইসলাম ও আইন কী বলে?
——————————————————
১.
“মুসলিম বিবাহ একটি দেওয়ানী চুক্তি” মর্মেই মুসলিম আইন পড়েছি ও বুঝেছি! বৈধ মুসলিম বিবাহের আবশ্যকীয় ৩ টি শর্ত হলো:
১। ভয়ভীতিহীনভাবে বর ও কনের সম্মতি দেয়ার মতো মানষিক সুস্থতা;
২। এক পক্ষ হতে বিবাহের প্রস্তাব প্রদান; এবং
৩। অন্য পক্ষ হতে প্রস্তাব গ্রহন।
এই শর্তগুলো পালিত হলেই হয়ে গেলো মুসলিম বিবাহ। হ্যাঁ! বৈধ বিবাহের জন্য এই প্রস্তাব প্রদান ও গ্রহনকালে ২ জন পুরুষ সাক্ষী অথবা ১ জন পুরুষ ও ২ জন মহিলা সাক্ষী থাকা আবশ্যক! সাক্ষী না থাকলেও বা প্রয়োজনসংখ্যক সাক্ষী না থাকলেও বিবাহ কিন্তু অবৈধ নয়, হয় অনিয়মিত!
উল্লেখ্য যে, যে মেয়ের বিবাহ হবে তিনি বিবাহের দিনে বা সময়ে ঋতুবতী হলে বিবাহ হবে না এমন কিছু কিন্তু ইসলামে নেই! অথবা যে মেয়ে বিবাহের সাক্ষী হবেন তাঁকেও ঋতুবতীহীন অবস্থায় থাকতে হবে এমন বিধানও কিন্তু ইসলামে নেই। বিবাহ মসজিদে বা কোন ধর্মিয় পবিত্র স্থানে পড়াতে হবে এমন কোন শর্তও ইসলামে নেই। তাছাড়া, আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় কোনদিন শুনিনি বা দেখিনি যে, মসজিদে বিবাহ পড়ানো হয়! ইসলাম বিবাহ পড়ানোকে এমন সহজ করেছেন যে, এতে কোন মন্ত্র বা ধর্মীয় দোয়া পড়াও বাধ্যতামূলেক করেনি। নেই কোন মাওলানা বা ইমাম উপস্থিত থাকার বাধ্যবাধকতা। মুসলিম বিবাহ যে কোন সুস্থ ও স্বাভাবিক মানুষ পড়াতে পারেন! এখানে কোন মাওলানা বা ধর্মীয় পন্ডিতের আবশ্যকীয়তা ইসলাম আরোপ করেনি। মানুষ মাওলানাকে ডেকে বিবাহ অনুষ্ঠান সম্পন্ন করেন এই বিবেচনায় যে, তাঁরা সাধারণত শ্রদ্ধেয় ও সম্মানিত ব্যক্তি হোন এবং বিবাহ শেষে মহান আল্লাহর কাছে সকলকে নিয়ে দোয়া পরিচালনা করে নব দম্পতির সুখ-সমৃদ্ধি কামনা করেন। মনে রাখা দরকার যে, যে কেউ কিন্তু নব দম্পতির জন্য দোয়া পরিচালনা করতে পারেন এবং এক্ষেত্রে পিতা-মাতার চেয়ে উত্তম আর কে হতে পারে?
২.
অন্যদিকে, নিকাহ রেজিস্ট্রারগণ মুসলিম বিবাহ ও তালাক রেজিস্ট্রেশন আইন, ১৯৭৪ এর অধীনে আইন মন্ত্রানালয় হতে নিয়োগপ্রাপ্ত (লাইসেন্সপ্রাপ্ত) হন স্থানীয় অধিক্ষেত্রের মধ্যে বিবাহ ও তালাক রেজিস্ট্রেশন করার জন্য! এটি কিন্তু কোন সরকারী চাকুরী নয়। এই বিবাহ রেজিস্ট্রেশন হলো রাষ্ট্রীয় আইনি বিধান এবং তা বিবাহের জন্য কোনভাবেই ইসলামিক শর্ত নয়! একসময় স্থানীয় বিচারকগণ (কাজী) ছিলেন সর্বজন শ্রদ্ধেয় ও ধর্মীয় পন্ডিত! তাঁরাই বিবাহ অনুষ্ঠান সম্পন্ন করতেন! তাই তাঁদের পদবী কাজী (বিচারক) বর্তমান নিকাহ রেজিস্ট্রারগণ বেআইনীভাবে ব্যবহার করেন এবং জনগন তা না বুঝেই নিকাহ রেজিস্ট্রারকে কাজী সম্বোধন করেন। রাষ্ট্রীয় আইন মতে তাদের পদবী নিকাহ ও তালাক নিবন্ধক বা সহজভাবে নিকাহ রেজিস্ট্রার!
রাষ্ট্রীয় আইন মতে মুসলিম বিবাহ ও তালাক সংক্রান্তে রাষ্ট্রীয় রেজিস্ট্রার মেইনটেইন করার জন্য নিয়োগ প্রাপ্ত একজন নিকাহ রেজিস্ট্রারের কাজ হলো মূলত: বিবাহ ও তালাক রেজিস্ট্রেশন করা! মুসলিম বিবাহ ও তালাক (নিবন্ধন) বিধিমালা, ২০০৯ এর ২১ বিধি মতে, এজন্য একজন নিকাহ রেজিস্ট্রার প্রতি ১০০০ টাকা দেনমোহর এর বিপরীতে ১০ টাকা ফি আদায় করবেন এবং একটি বিবাহ রেজিস্ট্রেশনের জন্য সর্বনিন্ম ১০০ টাকা ও দেনমোহরের পরিমান যত বেশিই হোক না কেন সর্বোচ্চ ৪০০০ টাকা ফি গ্রহন করবেন। আর তালাক রেজিস্ট্রেশনের জন্য ফি প্রাপ্য হবেন ২০০ টাকা! আইনে একজন নিকাহ রেজিস্ট্রারের বিবাহ অনুষ্ঠান সম্পন্ন করার কোন বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়নি। অর্থাৎ একজন নিকাহ রেজিস্ট্রারের কাজ হলো আইনত: করনিক ধাঁচের। তাছাড়া, বর্নিত বিধিমালার ৮ নং বিধিতে একজন নিকাহ রেজিস্ট্রারের যোগ্যতার পূর্বশর্ত হিসেবে বলা হয়েছে যে, তিনি কমপক্ষে আলীম পাশ হবেন; আবেদনকালে তাঁর বয়স হবে ২১ থেকে সর্বোচ্চ ৪০ বছর; এবং তার বাড়ি যে এলাকার নিকাহ রেজিস্ট্রার হতে চান সেই এলাকায় হতে হবে। আইনে কিন্তু একজন নিকাহ রেজিস্টারের লিঙ্গ কী হবে তা বলা হয়নি!
৩.
তাহলে দেখা যাচ্ছে যে, বিবাহের একপক্ষ মহিলা হতে এবং তিনি বিবাহ কালে ঋতুবতী থাকলেও ইসলামে ও রাষ্ট্রীয় আইনে বাঁধা নেই! বিবাহের সাক্ষী মহিলা হতে এবং তিনি ঋতুবতী অবস্থায় সাক্ষী হলেও সমস্যা নেই। রাষ্ট্রীয় আইনে নিকাহ রেজিস্ট্রার প্রার্থীর যোগ্যতার ক্ষেত্রে লিঙ্গগত নেই কোন পূর্ব শর্ত! সামাজিক আচারে মসজিদ বা ধর্মীয় স্থানে বিবাহ অনুষ্ঠানের লক্ষণমাত্র নেই! মহিলারা বিচারক অর্থাৎ কাজী হতে এবং তাদের ঋতুবতী অবস্থায় বিচার করতে বাঁধা নেই! ইসলামে ও রাষ্ট্রীয় আইনে বিবাহ পড়াতে নেই কোন নির্দিষ্ট বা নির্ধারিত ব্যক্তির উপস্থিত থাকার আবশ্যকীয়তা! তাহলে নিকাহ ও তালাক রেজিস্ট্রেশনের মতো করনিক ধাঁচের কাজের জন্য মহিলারা অযোগ্য হোন কোন যুক্তিতে? যে রাষ্ট্র পরিচালনা করছেন নারী, সেই রাষ্ট্রে ইসলামের সাথে সামান্যতম সংঘর্ষ নেই এমন রেজিস্ট্রেশন সংক্রান্ত কাজে একজন নিকাহ রেজিস্ট্রার মহিলা হতে পারবেন না কেন? তাও আবার এই একবিংশ শতাব্দিতে! মনে রাখা দরকার, এদেশেই একসময় মহিলারা বিচারক হতে পারতেন না! বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানাদের হাত ধরেই মহিলারা এদেশে বিচারিক কাজে যোগ দিয়েছেন! আজ বিচার ব্যবস্থার একটি উল্লেখযোগ্য অংশই পরিচালিত হচ্ছে তাঁদের হাতে! শুধু মানসিকতা ও দৃষ্টিভঙ্গির একটু পরিবর্তন হলেই অনেক অর্জন সম্ভব; ধর্ম তাতে কোন মতেই বাঁধা সৃষ্টিকারী নয়।
লেখক: আমিনুল ইসলাম
(পিএইচডি গবেষক, ইউনিভার্সিটি অব সাসেক্স, যুক্তরাজ্য)।