ঝর্নার সাথে দেখা হলো অনেকদিন পর।আমার স্কুল লাইফের বেস্টি। ঝর্ণা । আমি এসেছি শান্তিনগর পপুলার ডায়াগ্নোস্টিক সেন্টারে।সেখানেই ঝর্ণার সাথে দেখা।
খুব হাড় গিলে টাইপের ছিল ঝর্না।সাহজাহান পুর রেল ওয়ে কলোনিতে ওদের ৩ বোন ৩ ভাইয়ের বিরাট সংসার। বাবা রেল ওয়ের কর্মচারী।রেলওয়ে কলোনীর স্যাতস্যাতে হলুদ বিল্ডিং বাস করা এই মেয়েটিকে আমরা করুনার চোখেই দেখতাম।কিন্তু সংগীত আর ম্যাথের যে একটা বৈজ্ঞানিক যোগাযোগ আছে সেটার প্রমান আমি ঝর্না কে দিয়েই পেয়েছিলাম।তাই ওকে অবহেলা করার সুযোগ ছিলনা আর।এমন সুকণ্ঠি আর গনিতের বিষেষজ্ঞ আমার সেই সময়ের জীবনে ছিল অদেখা।
আমার বাবা ডাক্তার। পড়াশুনা ভাল লাগেনা আমার। কিন্তু বাবার ইচ্ছে আমি ডাক্তার হবো। নবম শ্রেণিতে আমাকে জোর করে সাইন্স দেয়া হলো। প্রথম সাময়িক পরীক্ষায় ফিজিক্স, হায়ার ম্যাথে ডাহা ফেইল। ক্লাশের সব সাইন্সের মেয়েরা হাসাহাসি করলো। ফরিদ স্যার যে কত অপমান করলো।ফিজিক্সের মুখার্জি মিস তো আর এক কাঠি সরেস। তিনি পেটের চামড়া টেনে ধরে বললেন, শুধু কে এফ সি ফ্রাই চিকেন খেয়ে পেটে চর্বি জমাইছিস। মাথায় কিছু ; নাই।
লজ্জা আর অপমানে মরে যেতে ইচ্ছে হচ্ছিল।ঝর্ণা আমার পাশে বসে শান্তনা দিল। বললো তুই পারবি।আমি তোকে অংক শেখাবো।
সেদিন টিফিন পিরিয়ডে খেলতে না গিয়ে আমাকে অংক বুঝালো ঝর্ণা।
এবং ওর ঐ বয়সের যত্ন করে বুঝানোতে আমি খুব সহযেই সুত্রগুলো মাথায় নিচ্ছিলাম।
তারপরেও বাবা মা ডিসিসন নিলেন, একজন বুয়েটের ছাত্র বাসায় এসে পড়াবে আমায়। আমার কাজিন শিলু আপার ক্লাশমেট ফয়সল ভাই। তাকে ঠিক করা হলো আমার টিউটর হিসেবে।
ফয়সল ভাই খুব সুদর্শন । কিন্তু কেমন যেন খ্যাত টাইপের। পড়ানোর সময় শুধু পড়ান। একটাও অন্য কথা নাই।আমাদের মত নাগরিক সুবিধায় বেড়ে ওঠা মেয়েদের কাছে তিনি মনোযোগ পাওয়ার মত কেউ না।তাঁকেও কিছুটা অবজ্ঞার চোখেই দেখি আমি।
একদিন বিকেলে পড়ানোর সময়ই ঝর্না এলো আমাদের বাসায়। ওর একটা ফিজিক্স খাতা আমার কাছে ছিল। বেচারা অনেকখানি রাস্তা হেঁটে এসেছে। ঘেমে গেছে পুরো। আমি পড়ছিলাম। ওকে সে রুমেই ডাকলাম।ফয়সল ভাইয়ের সাথে পরিচয় করে দিলাম।সে মুহুর্তে আমি ডায়নামিকের একটা অংক মিলাতে পারছিলাম না। যেটা তিন্ দিন ধরে বুঝাচ্ছিল ফয়সল ভাই। ঝর্ণা এক নিমিষে করে দিল। ফয়সল ভাইয়ের চোখে অজস্র প্রশংসা। তিনি তাঁকিয়ে আছেন।
তুমি কার কাছে পড়ো?
ঝর্ণা সলজ্জ উত্তর দিল।
আমি ক্লাসেই বুঝি।
ঝর্নাকে তিনি বললেন, তুমিও শিলার সাথে বসতে পারো।
ঝর্ণা ইতস্তত করছিলো। আমিই আগ্রহ দেখালাম। বললাম, আমার সাথেই পড়বি। সত্যি বলতে কি ঝর্ণাকে ফয়সল ভাই প্রস্তাব দেয়াতে আমি খুশিই হয়েছিলাম। দুজন একসাথে পড়া যাবে। ও আমার কঠিন বিষয়গুলো সহজ করে বুঝিয়ে দেবে। ওর জন্য আলাদা কোন ফি ফয়সল দাবি করেনি।
আমরা পড়ছিলাম বেশ। ঝর্ণা পড়তে আসায় আমার পড়াশুনায় একটা গতি এলো।পড়া শুরুর বেশ কিছুটা সময় আগে ঝর্ণা আসতো।গতকালের হোম ওয়ার্কগুলো ওর কাছে করে নিতাম।
কিরে আমাকে চিনতে পারিস নি। ছিপছিপে গড়ন, শ্যামলা বরণ ঝর্ণা। সাদা অ্যাপ্রোনের আড়ালে বুদ্ধিদীপ্ত কৌতুক মেশানো দৃষ্টির সামনে আমি কেমন জড় সড় হয়ে বসে আছি।
বললাম,চিনেছি তো। কেমন আছিস?
ঝর্ণা স্টেথিস্কোপ লাগানো কান আমার দিকে একটু কাৎ করে, স্যরি জাস্ট এ মিনিট বলে অন্য একজন পেশেন্ট দেখা শুরু করলো।
আমি অপেক্ষা করতে করতে চৌকোশ হাতে ঝর্ণার রোগি ম্যানেজ করা দেখছিলাম। সহসাই চলে যাই ফ্লাসব্যাকে।
আমরা এস এস সি পাশ করে কলেজে ভর্তি হলাম। তখনো পড়ছি ফয়সলে ভাই এর কাছে আমি। কলেজে ভর্তি হবার পর ঝর্ণা আর আমাদের বাসায় পড়তে আসেনি। কারণ দুজন দুই কলেজে।আমি একাই পড়ি। কিন্তু আমি খেয়াল করতাম ঝর্ণার অনুপ্সথিতিতে কোথায় যেন একটা ছন্দ পতন।
এর মধ্যে একদিন ঝর্ণা এলো। যেন নিমেষেই প্রাণের ছোঁয়া। ফয়সল ভাই এর চোখে মুখে উচ্ছাস।নতুন সুত্র বুঝানো যেন তার কাছে সংগীত। ঝর্ণাও খুব মন দিয়ে পড়ছে। অনিচ্ছা স্বত্বেও আমি ঢেকি গিলছি। আর ভাবছি, আমি কোথায় যেন হেরে যাচ্ছি।
ঝর্ণা নতুন কলেজেও ফার্স্ট হয়েছে।
ওর সাথে দেখা তেমন হয়না। ফয়সল ভাই বুয়েট থেকে পাশ করলেন।উনি চলে যাবেন ইউ এস তে। তবুও যাওয়ার আগে আমাকে পড়ান।আমার বাবা মার ইচ্ছে আমি ডাক্তার হবো। সরকারি না হলে বেসরকারি মেডিকেলে। কিন্তু আমার ডাক্তারি পড়ার কোন ইচ্ছাই নেই।ফয়সল ভাই যে কয়দিন আছেন আমাকে তার পড়ানোর নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
2
শীলা আমার ফ্লাইট আগামি পরশু।
ফয়সল ভাইয়ের কথায় আস্বস্ত হলাম। উনি বেশ কিছুদিন ধরে বাইরের ইউনিতে চান্স খুঁজছিলেন।
আমি ফয়সল ভাইকে অভিনন্দন জানালাম।
তুমি কি একটু ঝর্ণাকে ডাকতে পারবে? ওর সাথে দেখা করতে চাই।
ফয়সল ভাই এর চোখে আকুলতা। এমন আকুল চোখ আমি ফয়সল ভাই এর কখনো দেখিনি। ফয়সল ভাইকে আমার কখনো তেমন করে ভাবার সুযোগ হয়নি। আজ
কেন যেন মনে হলো আমি কোথাও পরাজিত। আমার মনে হলো তার চোখে এমন আকুলতা আমার জন্য নয় কেন?
খুব হঠাৎ করেই মনে হলো ফয়সল ভাইএর সাথে ঝর্ণার দেখা হতে দেবোনা।
তাই
হঠাৎ করে মিথ্যা বানিয়ে বললাম,
ঝর্ণারা তো গ্রামে গেছে। অনেক দিন পর আসবে।
ফয়সল ভাইয়ের অবয়বে ভীষন কষ্ট ফুঁটে উঠলো।সব হারানোর কষ্ট ওনার চোখে মুখে।
ঝর্ণাকে আমার কিছু বলার ছিল শীলা।
আমাকে বলে যান। আমি ওকে বলবো।
একজনের কথা কি অন্য কাউকে বলা যায়?
ফয়সল ভাই কিছু বললেন না। একটা কবিতার বই আমার দিকে এগিয়ে দিলেন, জীবনান্দের বনলতা সেন।
লেখা আছে, অপেক্ষা করো বনলতা সেন। আমি ফিরবো তোমার কাছে।
আমাকে বললেন, আমি তোমাদের ল্যান্ড ফোনে কল করবো আমাকে ঝর্ণার সাথে কথা বলিয়ে দেবে।
আমি বইটি রাখলাম। আমি জানতাম ঝর্ণা গ্রামের বাড়িতে যায়নি। সে পরদিনই আমার বাসায় এলো।
টেবিলে বনলতা সেন দেখে আমার কাছে জানতে চাইলো।
কে দিয়েছে? কাকে দিয়েছে?
আমি অবলীলায় বললাম, ফয়সল ভাই দিয়েছে আমাকে।
ঝর্ণা কেমন যেন চুপসে গেলো,
ফয়সল ভাই চলে গেছে? এক আকাশ বেদনা ওর চোখে মুখে।
বললাম, হ্যারে, সময় ছিলনা। তাই কারো সাথে দেখা
করতে পারেনাই।
ঝর্ণা কেমন যেন অবিশ্বাসের চোখে আমার পানে চাইলো।
ও খুব কষ্ট পাচ্ছিল আমি বুঝেছি।
আমার সাথে দেখা না করে চলে গেলো।
তোর সাথে কিভাবে দেখা করবে। তারতো সময় ছিলনা।ঝর্ণা নিঃশব্দে বেরিয়ে গেলো। ওর চলার গতি দেখে মনে হলো সাতটি হিলায়পাহাড় মাথায় নিয়ে গাটছে স্র।
এরপর ফয়সল ভাই পৌঁছে আমাদের বাসার ল্যান্ড ফোনে অনেকবার কল করেছে, ঝর্ণার কথা জানতে চেয়েছে।
বইটি দিয়েছি কিনা জানতে চেয়েছে।
আশ্চর্য আমি অবলীলায় বলেছি, বইটি ও নেয়নি।
কেন যেন ফয়সল ভাই চলে যাওয়ার পর ঝর্ণা খুব কম আসতো আমাদের বাসায়। আমিও চাইতাম না ও আর আসুক। ফয়সল ভাইকে পাওয়ার জন্য আমি আমার এতদিনের বন্ধুত্বের সাথে প্রতারণা করলাম।
ফয়সল ভাই এম এস শেষ করে এলেন। আবার যাবেন পি এইচ ডি করতে। আমি শিলু আপাকে আমার পছন্দের কথা জানালাম।
ফয়সল ভাই কিছু আমাকে বলার চেষ্টা করেছিলেন। আমি কিছুই শুনিনি। আমার একরোখা চাওয়ার কারণেই আমাদের বিয়েটা হয়ে গেলো।
৩
ঝর্ণা অন্য একটা পেশেন্ট দেখে আবার আমার কাছে ফিরে এলো।
কিরে কেমন আছিস? কিছু বলছিস না যে।
এবার আমি ঝরঝর করে কেঁদে ফেললাম।
ঝর্ণা আমি তোকে ঠকিয়েছি। আমি তোর সাথে প্রতারণা করেছি।
কেন কি করেছিস তুই?
আমি আদ্যপান্ত ঝর্ণাকে বললাম।
ঝর্ণা খানিক চুপ করে থাকলো।
আমি ভুল করেছি রে।আমি কখনো ফয়সলের ভিতরের জায়গাটা নিতে পারিনি।কোনদিন না।
ঝর্ণা জোর করে হাসলো।
যাকে এত করে কাছে পেলি সে পাওয়াটা ভুল বলছিস কেন?।ঝর্ণা এবার বিস্ময়ভরা কণ্ঠে জানতে চাইলো।
আসলে জোর করে কারো ভালোবাসা আদায় করা যায় না।
আমি সারাক্ষণ ভাবতাম ও আমাকে ভালোবাসেনা
আর এ থেকে আমাদের সংসারে অশান্তি লেগেই থাকতো।
ঝর্ণার পেশেন্ট আছে। ওর উঠাবার তাড়া।কিন্তু ও বসে আছে আমার পাশে।।
বললাম, আমাকে ক্ষমা করে দিস বন্ধু। আমি তোকে কষ্ট দিয়েছি।
আমি কষ্ট পেয়েছি কে বললো তোকে।ঝর্ণা হেসে বললো।
তুই বরং আমার উপকার করেছিস।
কিভাবে উপকার? আমি জানতে চাই।
ঝর্ণা আমার ব্লাড প্রেসার মাপতে মাপতে বললো, ফয়সল ভাইকে পাওয়ার লোভ আমারও হয়েছিল।
তবে তাকে না পেয়ে আমার অনেক লাভ হয়েছে রে।
কি লাভ?
ফয়সল ভাই এর বউ হলে হয়তো তোর মত আজ আমিও
নিজেকে অসুখি ভাবতাম।
আমি বললাম তা কেন ভাববি, উনি তো তোকে ভালোবাসতেন।
নারে শীলা ওটা ভালোবাসা ছিলনা। সত্যিকারের ভালোবাসলে আমাকে উনি খুঁজে বের করতোই।
কিন্তু তুই কি আমাকে ক্ষমা করতে পেরেছিস?
তুই কোন দোষ করিসনি।ঔ বয়সে কাউকে চাইলে মানুষ এমন করেই চায়।তোরটা সত্যিকারের ভালোবাসা ছিল।
কিন্তু তুই?
আরে আমি কি তোর মত বোকা নাকি?আমার ক্লাসমেট রাসেলকে আমি বিয়ে করেছি।
তোর কি ফয়সল কে মনে পড়েনা।আমি অবাক হয়ে জানতে
চাইলাম।
আমি অংকে অনেক পাকা ছিলাম। তুইতো জানিস।
জীবনের যোগবিয়োগ হিসেবটাও ভালো বুঝি।
চোখ বড় বড় বললাম, অথচ তোকে কষ্ট দিয়েছি ভেবে আমি অনেক কষ্ট পেয়েছি।
আর কষ্ট পাসনা। এবার চলে যা। মন দিয়ে সংসার কর।
আমি চলে আসতে আসতে পিছন ফিরে তাঁকাই।
ঝর্ণার বুদ্ধিদীপ্ত চোখদুটো বেদনার্ত দেখাচ্ছে কেন?
আমার জন্য, ফয়সলের জন্য নাকি ওর নিজের জন্য।
যোগবিয়োগ