এক মা’য়ের লেখা না পৌঁছানো চিঠি
আদরের রবি
এ চিঠি তোমার হাতে আমি কখনো পৌঁছাতে চাই নি। তবে তোমার ছোট খালার হাতে খামটা দিয়ে বলেছিলাম আমি চলে যাবার পর এ চিঠিটা যেন তোমাকে দেয়।
তুমি ছিলে রহমানের প্রথম স্ত্রীর সন্তান।
তোমাকে জন্ম দেবার পর তোমার মা সংসার ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন।
মা সম্পর্কে আমি তোমাকে কিছু জানাতে চাই না। আমার পেটে তোমার একমাত্র বোন জয়া । আমার বিশ্বাস, তুমি জানো না ও তোমার সৎ বোন। ও প্রাণের চেয়ে ও তোমাকে বেশি ভালো বাসে।
তুমিও তাই।
ও আমার পেটের সন্তান। আমি যখন তোমাদের বাড়ি এলাম তখন তুমি এক বছরের।
তোমার বাবা রহমান সাহেবের শর্ত মেনে আমি তোমার মা হলাম। জীবনে কখনো বুঝতে দেইনি, তুমি আমার পেটের সন্তান নও।
তিন বছর পর আমি জয়ার মা হয়েছিলাম। তুমি এত আনন্দিত হয়েছিলে তার প্রমান জয়ার পাশ থেকে এক পা ও নড়তে না।
তুমি সবে বুঝতে শিখেছো। ও কাঁদলে আমাকে খুব করে বকে দিতে। আমি কেনো ওকে ফেলে অন্য কাজে চলে যাই!
তোমাকে স্কুলে ভর্তি করানো হলো। আমি জয়াকে নিয়ে তোমার ছুটি না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতাম।
স্কুলে আসার সময় বেশি করে টিফিন দিয়ে দিতাম। বন্ধুদের সাথে শেয়ার করার জন্য। আমিও একজন শিক্ষক ছিলাম।
চাকরী ছেড়ে পুরোপুরি ঘরকন্নার কাজে লেগে পড়লাম।
তোমাকে আমি প্রাইমারি বৃত্তি পরীক্ষার পরে বাসায় টিউটর দিয়েছিলাম। তুমি তার কাছে পড়তে চাইতে না।
সারাক্ষণ জয়ার সাথে তোমার খুনসুটি লেগেই থাকতো। জয়া দোষ না করলেও আমি জয়াকে বকে দিতাম।
আস্তে আস্তে তুমি ওপরের ক্লাসে উঠতে থাকলে। আমি স্কুলের গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিতাম। ছুটির সময় নিয়ে আসতাম। জয়ার ক্লাস বসতো আরো পরে।মেয়েটা রোদ বৃষ্টি বাদল মাথায় করে কষ্ট করতো।
হঠাৎ তোমার ভিতর পরিবর্তন লক্ষ্য করলাম৷ একটু একটু করে আমার কাছ থেকে সরতে আরম্ভ করলে।
যে তুমি আমাকে সুতো জড়িয়ে বেঁধে রাখতে।আর বলতে – দুষ্ট মেয়ে একদম বাইরে যাবে না!
আমি হাসতাম।পাগল ছেলে!
সেই তুমি আমাকে উপেক্ষা করতে আরম্ভ করলে। তোমার বাবা এ জন্য আমাকে দায়ী করলেন। বললেন নিশ্চয় ওর দিকে নজর দিচ্ছো না! নইলে এমন হবার কথা নয়।
খুব কষ্ট পেতাম। একদিন স্কুল থেকে ফেরার সময় বললে – মা আমি বড় হয়েছি। তোমার এ কাজগুলো আমার ভালো লাগে না। আমি একাই আসাযাওয়া করতে পারবো।
ধাক্কা খেলাম। মুখে শুধু বললাম আমার রাজপুত্তুর বড় হয়ে গেছে। পালকীতে চড়ে আমাকে নিয়ে যাবে কোন সুদুরে!
রবি মামা বলে কথা!
কিছু না বলে তুই রুমে চলে গেলি।
আমার মনে ঝড় বইছে।
কী এমন ঘটলো! আমার দিনরাত এক হয়ে গেলো।
এক মা’য়ের লেখা না পৌঁছানো চিঠি।
৷ ২ পর্ব
কী এমন ঘটলো! আমার দিনরাত এক হয়ে গেলো।অদ্ভুত একটা মানসিক পীড়া
আমাকে তাড়িয়ে নেয়ে বেড়াতো!
তুই এসএসসি দিলি।
দূরত্ব! একবার মনে হতো, না!
তুই আগের মত আছিস। আবার তোর ব্যবহারে আমার ভেতরটা ভেঙে গুড়িয়ে যেতো।
অসম্ভব জেদী হয়ে গেলি।
একদিন আমি তোর কথার উত্তর দিয়েছিলাম। তুই হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলি। আমার কন্ঠ চেপে ধরেছিলি। আমার কন্ঠে এখনো মাঝে মাঝে ব্যথা করে।
আমি তোকে ভয় পেতে শুরু করলাম! সঠিক কথাও সঠিকভাবে বলতে পারতাম না!
তুই ঝরাকে ভালবাসতি। আমিও তোর মুখের দিকে তাঁকিয়ে মেনে নিয়েছিলাম।
ওদের বাড়িতে প্রস্তাব নিয়ে গেলাম। ওদের একমাত্র বৌ কে দেখলাম!ওনাদের ব্যবহারে মনে হলো বৌ নয় গৃহকর্মী।
ঝরা কোনো ভাবেই এ বাড়ির বৌ হবার যোগ্যতা রাখে না।
যেদিন ওকে নিয়ে আমাদের বাসায় এলি, তখনই বুঝেছি তোকে ভালো রাখতে গেলে ঝরাকে তোয়াজ করে চলতে হবে।
আমি চাইতাম আমার রবির বৌ, আমাকে ঘিরে সুন্দর একটা সংসার করবে!
বুঝলাম তা হবার নয়!
তোর বাবা হার্ট অ্যাটাক করে আটদিন হাসপাতালে ছিলেন। তুই প্রাণ দিয়ে চেষ্টা করেছিস।
একদিন তোর টেবিলটা গোছাতে গিয়ে আমি প্রচন্ড ভাবে মানসিক আঘাত পেলাম।
বিকালে জ্ঞান হারালাম। ডাক্তার রেস্টে থাকতে বললেন। ঘুমের ঔষধ দিলেন। সারারাত তুই পাশে বসেছিলি।
ভোরে ঘুম ভাঙ্গলে দেখলাম আমার পায়ের কাছে হাত-পা গুটিশুটি মেরে ঘুমাচ্ছিস।
ভুলে গেলাম, মনে হলো আমি যা দেখেছি তা ভুল ছিলো।
তোর যত্নে আমি সুস্থ হলাম।
ঝরাও খুব করেছিলো।
জয়ার খুব ভালো বিয়ে হয়ে গিয়েছিলো। স্বামী পৈতৃক ব্যবসায় জড়িয়ে আছে।ও ভালো আছ।
জানি না তোর কী হয়! সব রাগ আমার ওপর। আমার দিন কাটে আতংকে। তোকে দেখলে ভয় পাই। এখন জয়াকেও ভয় পাই। সামান্য এদিক সেদিক হলেই তোর কানে!
আমার এ সংসার একটা বড় প্রাপ্তি হলো
তুই ঝরাকে পৃথিবীর সর্বোচ্চ স্থানে বসিয়ে ভালবাসতে পেরেছিস।
এটা প্রতিটি মেয়ের কাম্য।এমন ভাগ্যবতি মেয়ে সাধারণত চোখে পড়ে না।
দোয়া করি এভাবেই তোরা একে অন্যের হয়ে বেঁচে থাক।
কদিন ধরে তোদের মন খারাপ! কার সাথে কীহলো!
রুমে গেলাম। অবচেতন মনে টেবিলের কাছে দাঁড়ালাম।
এবার খাতায় খুললাম!
দেখলাম – একটা শকুন এক মহিলার মাথার ওপর আর একটা ছেলে হাত জড়ো করে মহিলার পায়ের কাছে বসে কাঁদছে!
বুঝতে পারলাম, কিন্তু সহ্য করে গেলাম।
এর কিছুদিন পর ঝারাকে নিয়ে রুমে ছিলি। চাপা কান্নার শব্দ পাচ্ছিলাম।
দরজায় নক করলাম।
দরজা খুলে তুই পা জড়িয়ে ধরে বললি – মা আমাকে শান্তিতে বাঁচতে দাও! আমি শান্তি চাই। ঝরাও কাঁদছে!
আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলাম।
আমি আমার বাবার একমাত্র সন্তান। আমি দেখতে সুন্দর ছিলাম না। বয়স বেড়ে যাচ্ছিলো তাই বাবা রহমান সাহেবের সাথে আমাকে বিয়ে দিয়েছিলেন।
বিক্রি করে দিলাম বাবার সব সম্পত্তি।
জয়াকে দিলাম।তোকেও দিলাম।
মনে পড়ে গেলো! তোর বিয়ের পরেরে দিন সকালে নাস্তার টেবিলে ঝরার মুখটা বলে দিয়েছিলো অনেক কথা!
নিজের সাথে যুদ্ধ করতে করতে আমি আর পেরে উঠছিলাম না রবি!
আমি পৃথিবীর কোনো না কোন জায়গায় নিজে মানিয়ে নিয়ে চলতে পারবো।
চিন্তা করিস না। দোয়া থাকলো তোদের জন্য।
( রহমান সাহেবের প্রথম স্ত্রী ঝরার মায়ের আত্মীয়) আমি অনেক পরে জেনেছিলাম।
।।
#এক মায়ের লেখা না পাঠানো চিঠি।
৩য়,ও শেষ পর্ব।
সত্যি আমি হাঁপিয়ে উঠেছিলাম।
জয়াকে বিয়ে দেবার পর থেকে তুই ই আমার অস্তিত্ব জুড়ে ছিলি। তোর মন খারাপ দেখলে আমি স্বাভাবিক জীবনে থাকতে পারতাম না।
তোর একটু হাসি মুখ দেখার জন্য প্রতিটি মুহূর্ত কাটতো।
রান্না বান্নায় সময় দিতাম বেশি। খুঁজে খুঁজে মনে করার চেষ্টা করতাম, আমার রবি কী খেতে পছন্দ করে।
আমি মনোযোগ দিয়ে তা রান্না করতাম। তোদের দু’জনকে খেতে দিয়ে আমি বসে থাকতাম তুই কখন বলবি- মা তুমি সব রান্না জাদু দিয়ে করো! এ খাবারগুলো মাঝে মাঝে বন্ধুদের বাড়িতে খাই।
মা সত্যি তোমার মত করে আর কেউ পারবে না।
আর এখন! দু’টো একটা কথা! পাশে বসে আমি কী খেলাম তাকিয়েও দেখিস না!
কী হয়েছে বাবা!
– কী হবে! ঠিক আছিতো।
কথা আর বাড়ে না।
————————–
এ ব্যাবহার আমি মেনে নিতে পারিনি।তাই
চলে আসার সিদ্ধান্ত নিলাম।
আমি ঘর ছেড়ে চলে এসেছি সপ্তাহ হয়ে গেলো।
তোর ছেলেবেলার বন্ধু জাহিদ।একদিন ওকে মালিবাগ সাউথ পয়েন্ট স্কুলের সামনে দেখা করতে বললাম।
রবিকে কিছু জানাতে বারন করলাম।
জাহিদ এলো। জাহিদকে বললাম, বাবা আমি তোমার কাছে একটা রিকোয়েস্ট করবো! তুমি রাখবে।তুমি আমার রবির ছোট্ট বেলার বন্ধু। তুমি ওর বিষয়ে সব বলতে পারবে।
— আন্টি আপনি এটা কী করলেন! আপনি জানেন রবি এ পৃথিবীতে আপনাকে ছাড়া বাঁচা দুষ্কর! ওতো অফিসেও ঠিকমত যাচ্ছে না।
বাসায় ওর শ্বশুর- শাশুড়ি আছেন। আমি আগামী শনিবার আপনার সাথে এখানে দেখা করবো।মানে আরো চারদিন পর!
আমি এখন অন্য সিম ব্যবহার করি।
তুমি আমার মোবাইল নম্বরটা রাখো।
জয়াকে ফোনে সব বলেছিলাম। আমি ভালো আছি।তুই দুই একদিন পরপর বাড়ি যাবি। রবির পাশে পাশে থাকবি। ও একটু স্বস্তি পাবে।
চারদিন মনে হলো কত যুগ ধরে অপেক্ষা করছি।
অবশেষে শনিবার এলো! অজানা শংঙ্কায়
আমি ঠিকমত হাঁটতে পারছি না। কী অপেক্ষা করছে আমার জন্য!
বেলা পাঁচটায় জাহিদ এলো। মুখ থমথম ভাব। আমি ওকে নিয়ে ম্যাকডোনাল্ডস গিয়ে বসলাম।
কোন ভনিতা ছাড়াই জাহিদ বলতে আরম্ভ করলো, আন্টি! আপনি আপনার ছেলেকে চেনেন! তারপর ও বাড়ি থেকে নিরুদ্দেশ হবার চিন্তা মাথায় এলো কী ভাবে!
আপনি হয়তো জানেন না রবির সাথে ঝরার পরিচয় হয়েছে বেশ আগে।
রবি যখন সমস্ত মনপ্রাণ দিয়ে ঝারাকে ভালোবাসতে আরম্ভ করলো! তার কয়েক মাস পর পরিচয় ঘটে রবি জন্মদাত্রী মা’ জুনের সাথে।
তিনি অনেকটা নাটকীয়তায় রবির সাথে ভাব জমায়।
ঝরার মাও চাইছিলেন মা ছেলের সম্পর্কটা ঠিক হোক!
আমার মা পুরো ব্যপারটা জানতেন।
আমি নিরুপায় হয়ে মা’কে সব বলেছি।
মা আমার সাথে আসতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এখানে এনে রাস্তায় দাঁড়িয়ে কথা বলা ঠিক হবে না।
আপনি আগামীকাল সন্ধ্যার পর আমাদের বাসায় আসুন।
জাহিদ বিদায় নিলো।
অফিস শেষ করে জাহিদ বাসায় ফিরে আমাকে দেখে কুশল বিনিময় করে ফ্রেস হয়ে ওর রুমেই বসলাম।
চা নাস্তার ব্যবস্থা হয়েছে। আকুল হয়ে আছেন জাহেদা বেগম!
জাহিদের মা এলেন।
কিছু সময় পর উন্মাদের মত রবি রুমে ঢুকে মা’কে জড়িয়ে ধরে বিলাপ করতে লাগলো।
এতটাই অসুস্থ হয়ে পড়লো যে ডাক্তার ডাকতে বাধ্য হলো জাহিদ।
ইঞ্জেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হলো। অঝরে কেঁদে যাচ্ছেন জাহেদা।
চার- পাঁচ ঘন্টা পর রবির ঘুম ভাঙ্গলো।
— মা! ওমা! হাত বাড়িয়ে জাহেদা বললো- বাবা! আমি তোর পাশে আছি।
একটু সুস্থ হলে জাহিদের মা বলতে শুরু করলেন।
– রহমান ভাই খুব অমায়িক বন্ধুবাৎসল মানুষ ছিলেন। ওনার বিয়েতে এলাকার সবাইকে নিমন্ত্রণ করেছিলেন।
জুনের সঙ্গে বিয়ে হয়ে গেলো। কিন্তু নতুন বৌ চারমাস সংসার করেছিলেন। তারপর একদিন পালিয়ে গেলেন ফয়সালের সাথে। ফয়সালের সাথে জুনের সম্পর্ক ছিলো। ফয়সাল এলাকায় একটা মূর্তিমান আতংক ছিলো। নেশা সহ এ হেন কাজ সে করেনি।
তাই জুনের আব্বা জোর করে রহমান ভাইয়ের সাথে বিয়ে দেয়।
জুন যখন পালায় তখন তিন মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। মানে রবি পেটে ছিলো।
ফয়সাল জুনকে বললো বাচ্চা হবার পর তুমি চলে আসবে । বাচ্চার বয়স যখন আড়াই মাস জুন তাই করলো।
– আমরা শুনেছি ওরা একমাস কোথাও ছিলো। ফয়সাল একা ফিরে এলো। জুন এলো না।
কঙ্কালসার শরীর নিয়ে জুন দু’বছর আগে পৈতৃক ভিটায় ফিরেছে।
সব কূল হারিয়ে রবিকে আশ্রয় করে নতুন ফিকির আদায় করতে ঝরার মা’য়ের সাথে হাত মিলিয়েছে।
রবি সেই থেকে জাহেদার হাত ধরে রেখেছে।
জাহেদ কাঁদছেন। এক সময় বললেন – বাবা, চিকন সুতো দিয়ে নয়! দাড়ি দিয়ে বেঁধে রাখ মা’কে।
।।৷