রোমান্টিক বিয়ের গল্প
japan Kahini জাপানি বিয়ে অনুষ্ঠান
কখনো জাপানি বিয়ে খেয়েছেন? আই মিন এটেন্ড করেছেন?
গড়ে একটা বিয়েতে লোক হয় ৫০ জন। বরপক্ষ কনেপক্ষ মিলে। নিকটতম আত্মীয় স্বজন, সবচেয়ে কাছের বন্ধু আর অফিসের বস এই মিলে এক পক্ষ ২৫ জন হয়ে যায়। আপনি যদি কোন জাপানি বিয়েতে দাওয়াত পান, ধরে নেবেন আপনি অতি ভাগ্যবান। মুল অনুষ্ঠান একটাই। অনুষ্ঠান গুলো বেশ কম্প্যাক্ট। ৩ থেকে ৪ ঘণ্টার। মজা, কান্না কাটি আর হাসাহাসিতে ভরপুর।
১৯৯০ সালের কথা। আমি তখন আন্ডারগ্র্যাডের ছাত্র। অইতা শহরে থাকি। ছোট শহর, তেমন বিদেশী নেই। আমার পরিচিত এক জাপানি চাচা ছিলেন। নাম উনো। এমেচার হ্যাম রেডিও দিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সাথে কথা বলতেন। তখনো ইন্টারনেট আসেনি। ওনার সাথে টুকটাক ইংরেজি কথা বলা প্রাকটিস করি। একদিন বললেন, অক্টোবরে আমার ছেলের বিয়ে। তোমাকে দাওয়াত দিতে চাই।
মনে সহস্র কৌতূহল। কী হয় জাপানি বিয়েতে? কী পরবো? উপহার হিসাবে কী নেব? আমি তো বর পক্ষের। ওনারা কি গেইট ধরে পয়সা চাবে? জাপানি ভাষায় তর্ক করতে পারবো তো?
বিয়ের দিন ঘনিয়ে আসলো। উনো সান নিজেই বিয়ের অনুষ্ঠানের ব্যাখ্যা দিলেন।
(১) জাপানি বিয়েতে উপহার দিতে হয়। ক্যাশ। কোন পণ্য নয়। জনপ্রতি ৩০ থেকে ৭০ হাজার ইয়েন। ৩০০-৭০০ ডলার। যেন বর-কনের ওপর তেমন অর্থনৈতিক চাপ না পড়ে।
বলে কি? একজনের চান্দা দিয়ে আমাদের গ্রামে একটা বিয়ে দেয়া যায়।
তুমি যেহেতু ছাত্র, তোমার টাকা আমি দেব। এই নাও ৩০,০০০ ইয়েন। বিয়ের গিফট (টাকা) ঢোকানোর জন্য একটা খাম নিয়ে এসেছেন। খামের ভেতরে অনেক গুলো ভাঁজ। অরিগামির মত। সেখানে কোথায় টাকা ঢোকাতে হবে, কোথায় টাকার পরিমাণ লিখতে হবে তা দেখিয়ে দিলেন। এই খাম কখন কীভাবে কাকে দিতে হবে তার একটা রিহারস্যাল ও দিলেন। বললেন, এই হলো আমাদের ফরম্যালিটি, বুঝলে?
আমি ধন্যবাদ দিয়ে টাকা ফিরিয়ে দিলাম। বললাম, আমাদের দেশের ফরম্যালিটি টা ও দেখ। আমাকে আমার মত এগুতে দাও। এঞ্জয় দ্যা তফাৎস।
(২) বিয়েতে খাবার এর মেন্যু সিলেক্ট করা হচ্ছে। তোমার ডায়েটরি প্রেফারেন্স দিতে পারো।
(৩) বর-কনের পক্ষ থেকে সব অতিথিদের গিফট দেয়া হবে। এই গিফট কিন্তু ক্যাশ নয়। ওয়েডিং ম্যানেজম্যান্ট এর লোক তোমাকে একটা ক্যাটালগ ধরিয়ে দেবে। ক্যাটালগ থেকে তুমি তোমার গিফট পছন্দ করে, গিফট নম্বরটা তাদেরকে দিলে সাত দিনের মধ্যেই গিফট তোমার বাড়িতে পৌঁছে যাবে।
কী বুঝলেন? গিফট দেবেন তাঁদের ইচ্ছায়, গিফট নেবেন নিজের ইচ্ছায়।
আমি বিয়েতে গেলাম জাপানি পোশাক হাকামা (পুরুষদের কিমোনো) পরে। আইডিয়াটা দিলেন এক স্টাইলিস মহিলা। আমার জাপানি ক্যালিগ্রাফি শিক্ষক। বাংলাদেশের বিয়েতে একজন বিদেশী লোক আমাদের দেশি পাঞ্জাবি পরে আসলে যেমন দৃশ্য হবার কথা। তার চেয়ে ও বেশি কিছু হলো। সেই কথা পরে হবে।
(১)
অনেকটা হোটেলের মত একটা চেক-ইন কাউন্টার। দাওয়াত কার্ড দেখাতে হলো। ওনারা ওয়েডিং ম্যানেজমেন্ট এর লোক। খুবই প্রফেশনাল। মনে হচ্ছে কার্ড না থাকলে বরের বাপও ঢুকতে পারবেনা।
আমাকে নিয়ে গেল একটা টেবিলে। টেবিল নম্বর, সীট নম্বর সব ফিক্স করা আছে। রিজার্ভড সীট। টেবিলের ওপর অনুষ্ঠান সূচি, অতিথিদের পরিচিতি, খাবার মেন্যু আর কি কি যেন কাগজপত্র রাখা। মনে হচ্ছে বিয়ে নয়, মিটিং করতে এসেছি। ৬০ জনের মত অতিথি ছিলেন। বরপক্ষের আর কনে পক্ষের অতিথি দুই রঙের কালি দিয়ে মার্ক করা। বর-কনের সাথে তাঁদের সকল অতিথিদের সম্পর্ক উল্লেখ করা। আমার নামের শেষে লেখা “বরের বাবার আন্তরিক বিদেশী বন্ধু”।
আমি অতিথি লিস্ট খুঁজছি। কনের ছোটবোন মানে আমার বেয়াইন কোনটা?
এমনিতেই জাপানের জনসংখ্যা কমতির দিকে। ছোটবোন থাকার সম্ভাবনা ৫% এর নীচে। খুঁজে পেলাম। হুররে ইউরেকা বলে চিৎকার দিতে গিয়ে দেখি বেয়াইনের বয়স ছয় বছর।
এইডা কথা? ৩০,০০০ ইয়েন উসুল হবে কীভাবে?
(২)
অনুষ্ঠান শুরু হলো সকাল ১১ টা ৩০ মিনিটে। সবাই নিজ আসনে আছেন। কোন টু শব্দ নেই। একজন প্রফেশনাল উপস্থাপিকা স্টেজে উঠলেন। ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক বেজে উঠলো। প্রথমেই অতিথিদের পরিচয় করিয়ে দিলেন। কনের মা, কনের বাপ, বরের মা, বরের বাপ। লেডিজ ফার্ষ্ট অর্ডারে।
তারপর বর কনের ছোট বেলা থেকে এ পর্যন্ত বেড়ে ওঠার ছবি দেখালেন ওভারহেড প্রোজেক্টরে। স্লাইডশো আকারে। তারপর ঘোষণা দিলেন-“আসছেন আমাদের আজকের অনুষ্ঠানের মধ্যমণি কনে এবং বর”।
সবাই হাত তালি দিয়ে বরণ করলেন। বর-কনে স্টেজে বসলেন। অতিথি সীটগুলো এমন ভাবে বসানো যেন সবাই বর-কনে কে দেখতে পায়।
(৩)
তারপর বক্তৃতা পর্ব। ছোট ছোট বক্তৃতা। ৩ মিনিটের। কিন্তু কী গোছানো। প্রথমেই কনের বাল্যকালের বান্ধবী। কনে ছোট বেলায় কী ধরণের মেয়ে ছিল, কী করতে পছন্দ করতো, বরের সাথে প্রেম করার কাহিনি প্রথম কোনদিন শেয়ার করলো- এইসব। এই তিন মিনিট ও প্রথমে ইন্ট্রো, তারপর ক্লাইম্যাক্স, শেষ মিনিটে হ্যাপি এন্ডীং দেয়ার প্রচেষ্টা। বরের পক্ষ থেকে বক্তৃতা দিল বরের কোম্পানির বস। এটা নাকি একটা কৃতজ্ঞতা প্রকাশের নিয়ম। বরের কর্মস্থলের কারণেই সংসার চলবে। আর সম্ভবত চাঁদার বড় অংশটাও ৬০,০০০ ইয়েন বসকেই দিতে হয়। বস হওয়া মানে অনেক দায়িত্ব।
(৪)
উপস্থাপিকার নির্দেশে খাওয়া পর্ব শুরু হলো। বর-কনে একসঙ্গে কেক কাটলেন। জাপানি একটা জনপ্রিয় গান আছে “কাম্পাই”। আমাদের যেমন রমজানের ঐ রোজার শেষে গান টা ট্রেডমার্ক হয়ে আছে রোজার ঈদের জন্য। এদের ও বিয়ের অনুষ্ঠানে কাম্পাই গান টা থাকবেই।
খাবারে আহামরি তেমন কিছুই নেই। তবে কোন অপচয় নেই। যারা খাবার পরিবেশন করেন, ওনারা ও সবাই ডিগ্রিধারি প্রফেশনাল। ফ্রেঞ্চ, ইটালিয়ান স্টাইলে জাপানি খাবারের পরিবেশন।
এই সুযোগে বর-কনে স্টেজ ত্যাগ করেন। পোশাক পাল্টান। উপস্থাপিকার নির্দেশে আবার প্রবেশ করেন। এবার একটু হাল্কা মুড।
বরের দুষ্টু বন্ধুরা স্টেজ কেড়ে নিলো। শুরু করলো কুইজ প্রোগ্রাম। কুইজের উত্তর দেবে শুধু বর আর কনে। মাল্টিপল চয়েস টাইপের। বর আর কনের হাতে দেয়া হল ৩ টা কাঠি। A, B, C লেখা।
একটা প্রশ্নের সাথে তিনটা উত্তর (A,B,C) বলা হবে। যেটা সঠিক মনে হবে বর-কনে একসঙ্গে কাঠি ওঠাবে।
যেমন-
Q1: তোমাদের প্রথম সাক্ষাত (সাক্ষাত এর মানে অনেক কিছুই হতে পারে) কোথায় হয়েছিল ?
A. বিশ্ববিদ্যালয়ে
B. লিটনের ফ্ল্যাটে (জাপানি ভাষায় লাভ হোটেল)
C. কর্মস্থলে
Q2: আজ রাতে কী করবে ?
A. গল্প করে কাটিয়ে দেব
B. টায়ার্ড। ঘুমাবো।
C. তুই জানস না বাসর রাতে কি করে? জিগাস ক্যারে ?
দুই জনের উত্তরে গরমিল হলেই সবাই হো হা করে হাসে। আমি অনেক গুলো প্রশ্ন বুঝতে পারি নি। দুষ্টুমিতে ভরপুর। এমন ভাবে শব্দ সিলেকশন করা যে আপনি অশালীন, শালীন দুভাবেই নিতে পারেন।
(৫)
এর মধ্যে কেক আসল। কফি আসলো। সব টেবিলে একই সঙ্গে।
তারপর শুরু হলো হৃদয় বিদারক পর্ব।
পৃথিবীর সব বাবারাই কন্যার বিয়েতে কাঁদেন। সামনে হোক, পেছনে হোক।
কনের বাবাকে মাইক দেয়া হলো। কোটের পকেট থেকে বাপজান কাগজ বের করলেন। যতদূর বুঝতে পেরেছি – তা বাংলায় বললে এমন হবে –
মা, তুমি আমাদের পরিবারে এসেছিলে এক আনন্দের উৎস হয়ে। ছোট বেলায় তোমার মা আর আমি মিলে তোমার মুখের দিকে তাকিয়ে কত ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়েছি। তুমি যখন কথা বলতে শিখলে তোমার প্রতিটা ধ্বনি আমাদের মুখে প্রতিধ্বনি হয়ে বন্ধু মহলে আমার মাধ্যমে গিয়েছে। বন্ধু মহল বলতো – এক কথা কত বার বলবি? কিন্তু রে মা, যত বারই বলি, মনে হয় বলা শেষ হয়নি। তুমি এমনি কিউট একটা বাচ্চা ছিলে।
কতদিন মিথ্যা অজুহাত দিয়ে অফিস থেকে ছুটি নিয়ে তোমার চেহারা দেখতে চলে এসেছি।
তুমি একবার খামচি দিয়ে আমার নাক রক্তাক্ত করে দিলে। আমি সেই দাগ গর্ব নিয়ে বন্ধুদের দেখিয়েছি।
..তুমি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে উঠে ঘর ছেড়ে চলে গেলে, কেমন যেন ঘরখানা শূন্য হয়ে গেল। গ্রীষ্ম আর শীতের ছুটি গুলোতে তুমি আসবে বলে বকের মত গলা লম্বা করে তোমার পথ পানে চেয়ে থেকেছি।
তুমি এসেই আমাকে বকাবকি করতে। তোমার মা তোমাকে বলতো – বাবাদের অমন করে বলতে নেই। বিশ্বাস করো – তোমার বকাবকিতে ও একধরনের সুখ ছিল। তোমার অনুপস্থিতিটা অনেক কষ্টের।
আজ তুমি অফিসিয়েলি আমাদের ত্যাগ করছো। তোমার ফ্যামিলি নাম পরিবর্তন হবে।….
একটা ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক চলতে থাকে। অনেকটা আমাদের বাংলা ” আয় খুকু আয় ” টাইপের।
বাপজান কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। কি যেন একটু বিড়বিড় করলেন। কনের মা এসে রুমাল দিলেন।
বরের উদ্দেশ্যে বললেন- বাবা, মেয়েদের ভাষা বোঝা অনেক কঠিন। তারা অনেক কিছুই প্রকাশ করতে পারে না। সৃষ্টিকর্তা তাদেরকে এই গুণটি দিয়ে পাঠাননি। কিন্তু এই অপ্রকাশ্য ভাষা বোঝার দায়িত্ব পুরুষের।
স্বামীরা তাদের স্ত্রীদের ভাষা না বুঝলে ও বাবারা তাঁদের কন্যার ভাষা বোঝে। যদি তোমাদের মধ্যে কোনদিন বোঝাবুঝি নিয়ে দ্বিমত হয়, তুমি আমাকে ডেকো- বাবা নয় বন্ধু হয়ে উপদেশ দেবো।
বাপজান একবার মেয়ের দিকে তাকালেন।
শেষ বক্তৃতাটা হলো কনের পক্ষ থেকে। তার মা এর উদ্দেশ্যে। স্টেজে শুধু দুইজন। মেয়ের হাতে মাইক। মা মুখোমুখি দাঁড়িয়ে।
আমাদের দেশে এই সময় মা-মেয়ের মধ্যে তেমন কোন গোছানো কথা হয় না। শুধুই কান্নাকাটি হয়। গোছানো সম্ভব নাকি? এই ফিলিংস কি আর লিখে প্রকাশ করা যায়?
এই মেয়ে সেই ফিলিংসগুলোই বাক্যে প্রকাশ করেছে। তিন মিনিটে।
শুরু করলো এভাবে-
মা গো …