বৃষ্টিময় প্রেম পর্ব ৭০
লেখনীতে- তাসফিয়া হাসান তুরফা
সপ্তাহখানেক না পেরোতেই একে একে সব পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হলো। ঢাকায় আমার চান্স হয়নি, ওয়েটিং লিস্টে নাম আছে। চোখে এখনো ভাসছে যেদিন ঢাকার শেষ পরীক্ষায় চান্স পাইনি সেদিন দেখা পূর্ণর হতাশ চেহারা। আজ বিকালে রাজশাহীর পরীক্ষার রেজাল্ট দিয়েছে, যেই একটা পরীক্ষায় জিদের বশে পরীক্ষা দিয়ে আশাস্বরুপ ফলাফল করেছি আমি৷ এবার পাব্লিকে চান্স হওয়ায় আর হতাশ হতে হয়নি কাউকে। পরিবারের সবাই দারুণ খুশি, বিশেষ করে বড়াব্বু। কেননা নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে শুধু আমার জিদের কারণে দুজনের রাজশাহী যাওয়া সফল হয়েছে তাই উনার খুশি একটু বেশি। আশেপাশের সবাইকে মিস্টিমুখ তো করিয়েছেন-ই, সাথে আমাকেও সফলতার সাধুবাদ জানাতে ভুলেন নি একবারের জন্যও। এমনকি প্রত্যেকটা মানুষ যারা এতদিন পাব্লিকে চান্স হচ্ছিলোনা বলে আমায় খোটা দিতে বাদ রাখেনি, আজ তারাও আমার প্রশংসায় পঞ্চমুখ! মানুষ সত্যিই অদ্ভুত! রঙ পাল্টাতে সময় লাগেনা কারও। অবশেষে সমালোচকদের মুখ বন্ধ করে দেওয়ায় বাড়ির সবাই প্রচুর খুশি। কিন্তু এতসব খুশির মাঝেও পুরোপুরিভাবে প্রফুল্লিত হতে পাচ্ছেনা আমার মন। হঠাৎ করে বাড়ি ছাড়ার দুঃখ-ই যেন মনের গহীনে বিরাজ করছে বেশি! তাইতো বড়াম্মু কথার ছলে বলেই ফেললেন,
—তোর জন্য সত্যিই খুব ভালো লাগছে রে, মা। অনেক খুশি হয়েছি আমি। কিন্তু একটাই আফসোস যে তোর ঢাকার বাইরে চান্স হলো। ঢাকায় হলে কি এমন হতো? এতবছর পর তোকে পেয়ে আবার অন্যকোথাও যেতে দিতে মন চায়না।
—আমিও ঢাকার বাইরে যেতে চাইনা, মা। ভাবীর অবস্থা দেখে আমার এখন নিজের জন্যই ভয় লাগছে৷ আমি কিভাবে থাকবো তোমাদের ছেড়ে? ভাবী কিভাবে থাকবে?
বড়াম্মুর কথার প্রত্যুত্তরে বলে আতংকিত স্বরে বলে উঠলো প্রিয়া। বড়াব্বু গম্ভীর স্বরে বললেন,
—কেন থাকবিনা? নিজের যোগ্যতায় একটা ভালো জায়গায় চান্স পেলে তো যাওয়াই উচিত। যারা কথা শুনাবে তাদেরকে দেখিয়ে দিবি তুই পারিস। এতে সমস্যা কোথায়? এটা গর্বের বিষয়! তুরফা আমাদের মুখ উজ্জ্বল করেছে!
পূর্ণর দিকে আড়চোখে তাকিয়ে বললেন বড়াব্বু। বাকিরা না বুঝলেও কথাটা যে পরোক্ষভাবে তাকে উদ্দেশ্য করেই বলা বুঝতে অসুবিধা হলোনা আমার ও পূর্ণর। কিন্তু উনি নির্বিকার। শান্তভাবে চুপচাপ সকলের প্রতিক্রিয়া দেখে যাচ্ছেন৷ বড়াব্বুর কথা শুনে চোখমুখ শক্ত করে কোনো কথা না বলেই প্রস্থান করলেন সেখান থেকে। বড়াম্মু সেদিক চেয়ে বললেন,
—কি হয়েছে আমার ছেলেটার? এমন করলো কেন? ও কি খুশি হয়নি তুরফার রেজাল্টে? ছেলেটা আমার এত চাপা কেন? আমি বুঝিনা।
—আরে মা, তুমি বুঝছোনা। বড় ভাইয়া খুশি হবে নাকি কস্ট পাবে সেটাই ভাবছে হয়তো। একদিকে রেজাল্টের খুশি, অন্যদিকে তুরফাকে রাজশাহী যেতে দেওয়া। সে খুব একটা অনুভূতি প্রকাশ করেনা দেখে বলে বুঝাতে পারেনা। উল্টাপাল্টা ভেবোনা!
বিচলিত কণ্ঠে বললেন প্রান্ত ভাইয়া। তার কথায় দীর্ঘশ্বাস ফেললো সকলে। তপ্ত শ্বাস ফেলে আমিও চলে গেলাম রুমের উদ্দেশ্যে। উনার মতো যে দোটানায় আছি আমি নিজেও!
______________________
শান্ত শীতল চাহনিতে পূর্ণ বসে আছেন সোফায়। ভ্রুজোড়া কুচকে মাথার উপর তর্জনীর দুই আংগুল রাখা। ধীর পায়ে এগিয়ে সোফায় উনার পাশে বসতেই নীরবতা ভেদ করে বলে উঠলেন,
—যেটার ভয় ছিলো সেটাই হলো, তাই না? জীবনে বুঝি এমনই হয়!
নিস্তব্ধ রুমে উনার আওয়াজ কিছুটা তাচ্ছিল্যময় শুনালো। সেদিক চেয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম,
—কে জানে হয়তো এর মধ্যেই আমাদের কোন কল্যাণ লেখা আছে। এত চিন্তা করেন না।
পূর্ণ নিষ্পলক চেয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। খানিকক্ষণ বাদে দূর্বল কণ্ঠে বললেন,
—তুমি কি সত্যিই চলে যেতে চাও?
—আমি তো যেতে চাইছিলাম না। কিন্তু সেদিন আপনি আমাকে যা বললেন বড়াব্বুর সামনে এরপর আর না যেয়ে উপায় আছে বলুন? ওইদিন কি আমার আত্মসম্মানে লাগেনি? আপনার উপর রাগ করেই তো জিদের বশে চলে গিয়েছিলাম এবং নিজেকে প্রমাণ করতে চেয়েছিলাম, যেটা আমি পেরেছি এইবার। কিন্তু আপনি যদি আমায় যেতে দিতে না চাইতেন তবে কেন সেদিন ওভাবে কথাগুলো বললেন, বলুন? ওইদিন কেন সান্ত্বনা দিতে পারলেন না আমায়, কেনই বা ওইভাবে কটাক্ষ করলেন?
কিছুটা অস্থিরভাবেই প্রশ্নের তীর ছুড়লাম তার দিকে। উনি যেন আগে থেকেই প্রস্তুত ছিলেন উত্তর দেওয়ার জন্য সেভাবেই আমার দিক এগিয়ে আসলেন খানিকটা। পাশ ঘেঁষে বসে বললেন,
—আমি তোমাকে কটাক্ষ করিনি, তুরফা। না তোমাকে ইনসাল্ট করার কোনো ইচ্ছা আমার ছিলো, তোমার মনে আছে তোমার ঢাকার প্রথম পরীক্ষার রেজাল্ট বের হওয়ার পর যখন তুমি ডিপ্রেশনে পড়েছিলে তখন আমার সাথে একবার তোমার কথা-কাটাকাটি হয়েছিলো? আমি তোমাকে বুঝাতে গিয়েছিলাম কিন্তু তুমি আমার কথা না শুনে বারবার কাদছিলে। সাথে মনের দুঃখে উল্টাপাল্টা অনেককিছু বলছিলে, সেটাও মনে আছে নিশ্চয়ই?
তার কথায় এক পলক চেয়ে কিছুটা ইতস্ততভাবে মাথা নাড়তেই উনি পুনরায় বললেন,
—তোমাকে আমি বারবার বলেছি এভাবে আমার সামনে কাদবেনা, আমার ভালো লাগেনা তোমায় এভাবে দেখতে। তাও তুমি বারবার বলছিলে তোমাকে দিয়ে কিছু হবেনা, তুমি কোনোকিছুর যোগ্য না। তোমার কোন আইডিয়া আছে আমার সেসব কথা শুনতে কেমন লাগছিলো? মন চাইছিলো তখনি দুটো চড় বসিয়ে চুপ করে দিই। কিন্তু তোমার মন হালকা হওয়ার জন্য কাদতে দিয়েছিলাম সেদিন। এরপর ভেবেছি আমার ভালো কথায় কাজ না হলে তোমাকে শাসন করেই বুঝাতে হবে যে তুমি চাইলেই সব সম্ভব। তোমার ভেতরের ক্ষোভকে আত্মবিশ্বাসে পরিণত করাতে হবে। তাই ওইদিন সুযোগ বুঝে বাবার সামনে কথাগুলো বলেছি যাতে তুমি জিদ দেখিয়ে নিজের জন্য কিছু করতে চাও…
—কিন্তু আপনি সেটা আমাকে বড়াব্বুর সামনেই কেন বললেন? একা আমায় বললে কি এমন হতো?
কিছুটা চাপা রাগ দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলাম তাকে। বিনিময়ে উনি মৃদু হেসে বললেন,
—একা বললে কি তোমার মনে ওইভাবে জিদ চাপতো? বাবা এমনিতেই তোমাকে যেতে দিতে চাইছিলেন না, তুমিও তো রাজি হয়ে গিয়েছিলে তার কথায়। তাই ইচ্ছে করেই বাবার সামনে বলেছি যাতে তোমার আত্মসম্মানে লাগে, তোমার হারানো ইচ্ছাশক্তি ফিরে আসে এবং তুমি জিদ দেখাও। আর একটা কারণ হলো একিসাথে বাবাও যেন তোমায় রাজশাহী নিয়ে যেতে রাজি হয়। কারণ প্রান্ত সেইরাতেই আমাকে বলেছিলো রাইসার কথা, পরেরদিন ও অফিসে যেতে চাইছিলোনা। আমিও চেয়েছিলাম ওইদিন সে রাইসার সাথে থাকুক। আমরা দুজন একসাথে ছুটি নিলে বাবার উপর চাপ পড়ে যেতো, তাই আমি ছুটি না নিয়ে বাবার সাথে তোমায় রাজশাহী পাঠিয়ে দিই। প্রান্ত রাইসার সাথে বাসায় থেকেছিলো। বুঝেছো এবার?
উনার কথায় বিস্ময়ে থতমত হয়ে গেলাম! আমার অগোচরেই এত এত প্ল্যান। আর আমি বুঝলামও না? এসব ভাবনার মাঝেই পূর্ণ ফের বললেন,
—আমি চেয়েছিলাম যাতে তোমার শেষ পরীক্ষাটা অন্তত জিদের বশে হলেও ভালো দেও, এখানে না ভর্তি হলেও যেন এটলিস্ট চান্স পেতে পারো আর তোমার মেন্টাল স্যাটিসফেকশন আসে। আত্মসন্তুষ্টি অনেক বড় একটা জিনিস, তাই নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধেও গিয়ে আমি তোমার জন্য এই সিদ্ধান্ত নিই। যাতে তুমি নিজের রেজাল্ট নিয়ে পরবর্তীতে গর্ব করতে পারো, একিসাথে যারা তোমাকে কথা শুনিয়েছিলো, তাদের সবার মুখ বন্ধ করে দিতে পারো। কারণ আমি জানতাম আমার তুরফা চাইলেই সব পারবে এবং দেখো তুমি পেরেছো, করে দেখিয়েছো । তাই এরপর থেকে নিজের যোগ্যতা নিয়ে আর কখনো মনের মধ্যে কোনোপ্রকার সন্দেহ করবেনা, তুরফা রানী। মনে রাখবে, তুমি যেমনই আছো, আই এম প্রাউড অফ ইউ।
আচমকা আমার দু’গালে হাত রেখে স্মিত হেসে কথাগুলো বললেন পূর্ণ। এতক্ষণ উনার একেকটা কথা ঝংকার তুললো বুকে। তার প্রত্যেকটা শব্দে ক্ষণে ক্ষণে স্তম্ভিত হয়েছি আমি। এ মানুষটা কম কথা বলে ভেতরে ভেতরে আমার জন্য এতকিছু ভেবে রাখে? তাকে ভুল বুঝাটা একদমই উচিত হয়নি! কথাটি উপলব্ধি করতেই অনুশোচনায় ভরে গেলো হৃদয়, ছলছল করে উঠলো নয়নজোড়া। তাই চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ার আগেই তাকে সযত্নে হাতের তালুতে মুছে নিয়ে দু’হাতে জড়িয়ে ধরলাম তাকে। তিনিও আগলে ধরলেন আমায়। শক্তহাতের বন্ধনীতে আবদ্ধ হতেই কণ্ঠনিশ্রিত হলো,
—আপনাকে ভুল বুঝেছিলাম। আই এম সরি। কিছু মনে করবেন না…
—হুশ। ইটস ওকে, বউ। তুমি ঢাকায় থেকে যাও তাহলেই হবে! আর কিছু লাগবেনা আমার।
—কিন্তু আমি যে ঢাকায় চান্স পাইনি। ওয়েটিং থেকে ডাকবে নাকি গ্যারান্টি নেই তো?
—সমস্যা কই? প্রাইভেটে পড়াবো।
—কস্ট করে উপার্জনের টাকা এভাবে ব্যয় করার মানে হয়? আমি তো সুযোগ পেয়েছি এক জায়গায়..
—কি লাভ হবে এত কস্টে টাকা উপার্জন করে যদি তোমাকেই নিজের কাছে রাখতে না পারি? একা একা বিলাসিতা করার আমার কোনো ইচ্ছে নাই, তুর পাখি। আমি শুধু তোমার সাথে থাকতে চাই।
এবার উনার কথায় আর বাড়তি কিছু বলার সাহস পেলাম না। মুখের কথাগুলো গলার কাছেই দলা পেকে গেলো যেন! পরিস্থিতি হালকা করতে রসিকতার ছলে বললাম,
—রাজশাহী বেশি দূরে না কিন্তু। বছরে দু-তিন বার তো দেখা হতোই।
—মাইর দিবো কিন্তু, তুরফা।
বাহুতে হালকা চাপড় মেরে বললেন উনি। বিনিময়ে হালকা হেসে তাকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম। তার সান্নিধ্যে হঠাৎ করেই অশান্ত মন শান্ত হয়ে গেলো। তবুও অবচেতন মনে ঘুরপাক খাচ্ছে কিছু প্রশ্ন। অবশেষে মুখ ফসকে বলেই ফেললাম,
—আচ্ছা। একটা কথা ভেবে দেখেছেন?
—কি?
—রাইসার বিয়েতে যদি বড়াব্বু আমার পরিচয় না জানতে চাইতেন, তবে হয়তো আপনারা আমায় খুজেও পেতেন না। তাহলে হয়তো ঠিকি এখন আমার রাজশাহী যেতে হতো। কে জানে এতদিনে হয়তোবা অন্য কারও সাথে…
মুখের কথা শেষ করার আগেই দু বাহু ধরে সরিয়ে দিলেন পূর্ণ। রুক্ষ চাহনীতে বলে উঠলেন,
—এতই সহজ নাকি অন্য কারও হওয়া? রাইসার বিয়েতে বাবা তোমার পরিচয় জানতে না চাইলেও বিয়ে তোমার আমার সাথেই হতো!
—কিভাবে? আপনি তো আমাকে চিনতেনই না! আর যদি আমাকে আগে থেকেই ভালোবাসেন, আমার জন্য অপেক্ষা করেন তবে নিশ্চয়ই তখন রাইসার বিয়েতে আমার পরিচয় না জেনে আমায় বিয়ে করার কথা ভাবতেনও না! তাই না?
আমার বিস্ময়ঘেরা প্রশ্নে দুর্বোধ্য হাসলেন পূর্ণ। ঠোঁটজোড়া কিঞ্চিৎ বেকে গেলো নিমিষেই। খানিকটা ঝুকে এসে চোখে চোখ রেখে বললেন,
—ফর ইউর কাইন্ড ইনফরমেশন, তোমায় আমি প্রথম দেখা থেকেই চিনি। সেই বৃষ্টিময় দিনে যে প্রেমের সূচনা হয়েছিলো সেটা পরিণতি অবশ্যই পেতো। তাই তোমায় বিয়ে না করার কোনো কারণ ছিলোনা। বিয়েটা তোমার আমার সাথেই হতো। কারণ আমাকে ছেড়ে যাওয়ার অপশন আমি কখনোই তোমায় দেইনি, ভবিষ্যতেও দিবোনা। বুঝেছো, তুর পাখি?
পূর্ণর এহেন কথায় চমকে উঠে, বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম। বলছে কি লোকটা? উনি আমায় প্রথম দেখা থেকেই চিনে মানে? কিভাবে?
#চলবে