১.শৈশব স্মৃতি নিয়ে স্ট্যাটাস
#আমার শৈশব
সত্তরের দশকের শেষের দিকে কথা বলছি। একদিন বিকেলে বাবা অফিস ফেরত আসার সময় এক বিশাল বাক্স নিয়ে আসলো। বাক্স খুলে বের হলো ফিলিপসের 24 ইঞ্চি সাদাকালো টেলিভিশন। বাবা অ্যান্টেনা নিয়ে ছাদে চলে গেল। টিভির কানেকশন দেয়া হচ্ছে আর আর আমরা টিভির সামনে বসে আছি। সাদা স্ক্রিনে কাল পোকার মতো ঝিরিঝিরি দেখা যায়। তাই দেখতে কত ভালো লাগতো। ছাদে অ্যান্টেনা ঘুরাতে ঘুরাতে পাব আবার চিতকার করে জিজ্ঞেস করতো”,আসছে? “
আমার নিজের থেকেও উচ্চঃস্বরে উত্তর দিতাম, “এখনো আসে নাই “। একসময় ছবি আসত। মুগ্ধ নয়নে সবাই বসে টিভি দেখতাম। সেই সময় টিভিতে মালা শাড়ি, কসকো সাবান, মায়া বড়ির বিজ্ঞাপন দেখাতো। প্রতি বিজ্ঞাপনের পরে একটা টুট করে আওয়াজ হতো। ডাবল ডেকার, সুইস ফ্যামিলি রবিনসন,লিটল হাউস অন দা প্রেইরি, হাওয়াই ফাইভও,সিক্স মিলিয়ন ডলার ম্যান, ওয়ান্ডার ওম্যান ঘোর লাগা চোখে বসে দেখতাম।
আশেপাশের কয়েকটা পাড়ার মধ্যে আমাদের বাসাতেই টেলিভিশন এসেছিল।বিকেল বেলা টেলিভিশন চালালে আশেপাশের বাসার বাচ্চারা জানালায় ঝুলে ঝুলে ঘরের ভিতরে টিভি দেখতো। আর যেদিন বাংলা সিনেমা থাকতো সেই দিন দুপুর থেকে বাসায় উৎসবের মতো পড়ে যেত। হয় টেলিভিশন বড় বারান্দায় সেট করা হতো নয়তো উঠোনে সেট করা হতো। আশেপাশের পাড়ার বৌঝিরা সবাই এসে পড়তো সিনেমা দেখতে। রাত আটটার খবর এরপর সিনেমা শুরু হওয়ার কথা কিন্তু বিজ্ঞাপনের আর শেষ নাই। আমরা গুনতে থাকতাম কয়টা বিজ্ঞাপন হচ্ছে। একসময় বিজ্ঞাপন শেষ হয়ে সিনেমা শুরু হতো। সেই সিনেমা শেষ হতে হতে রাত একটা-দেড়টা বেজে
যেত। এত এত মানুষ টিভি দেখতে আসতো আমাদের বাসায় আমাকে কখনো বিরক্ত লাগেনি। যেই দিন সিনেমা থাকতো আমরা জানতাম সবাই চলে আসবে। মাসে একটাই সিনেমা হতো বিটিভিতে। তারপর একসময় আসলো ধারাবাহিক নাটক।
সকাল সন্ধ্যা মনে হয় ছিল বিটিভির প্রথম ধারাবাহিক নাটক। কি যে ভালো লাগতো দেখতে। আমাদের সময় টিভি সেন্টার চালু থাকতো বিকাল চারটা থেকে রাত দশটা। সবাই মিলে পাটি বিছিয়ে বসে টিভি দেখার মধ্যে যে আনন্দ ছিল আজ এসি রুমে সোফায় বসে টিভি দেখায় সে আনন্দ খুঁজে পাইনা।
আর একটা কথা না বললেই না, অ্যান্টেনা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দুরদর্শন এর ছবি আনা। অ্যান্টেনা ঘুরাতে ঘুরাতে অস্পষ্টভাবে দূরদর্শনের যে ছবি আসত, তাই দেখে মনে হতো জীবন ধন্য।সবসময় বুঝতাম না কি দেখাচ্ছে। তারপর ও সামনে বসে তাকিয়ে থাকতাম টিভির দিকে। আজকালতো টিভি ছারলে নাটক সিনেমা কোন কিছুরই কমতি নেই। কিন্তু আছে কি সেই আগের মতো অনুভূতি? 24 ইঞ্চি সে সাদাকালো টিভিতে আমার যে আবেগ লুকিয়ে আছে তা আজ আর স্মার্ট টিভিতে খুঁজে পাইনা। রিমোট হাতে নিয়ে অহেতুক টিপাটিপি করি। চোখের সামনে ছবিগুলি বদলাতে থাকে। কোন কিছুই মনে দাগ কাটে না।
47 বছর পরে আমি আবার আমার সেই শৈশবে দেখা সাদাকালো বাক্সখানি খুজে পেয়েছি। ঘরের এক কোণে অনাদরে অবহেলায় পড়ে আছে। ফিলিপস টিভির সাদা কালো পর্দায় তাকালে আমি আমার শৈশব দেখতে পাই। পর্দায় ভেসে ওঠে গোসলের পরে মা আমার মুখটা হালকা উচু করে তুলে চুল আঁচড়ে দিচ্ছে। দেখতে পাই সকাল দশটায় স্কুলে যাওয়ার আগে মা আমার মুখে তুলে ভাত খাওয়াচ্ছে। আরো দেখি সাড়া উঠান একটা বাঁশের কঞ্চি নিয়ে বিড়ালের পিছে দৌড়াচ্ছে একটা ছোট্ট মেয়ে। দেখতে পাই সত্তরোর্ধ্ব এক বৃদ্ধ কই আমার বুবু মনি বলে তার ছোট্ট নাতনি কে খুঁজে বেড়াচ্ছে। দেখি এক সুদর্শন বাবা তার রাজকন্যাকে কোলে দিয়ে অনেক আদর করছে। কালের বিবর্তনে সেই ছোট্ট মেয়ে আজ মধ্যবয়সে পদার্পণ করেছে, সত্তরোর্ধ্ব সেই বৃদ্ধ আর মেয়েটির মা আজ আকাশের তারা। সুদর্শন বাবা আজ মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে। শুধু 24 ইঞ্চি সাদাকালো ফিলিপস টেলিভিশন সকল স্মৃতি বুকে নিয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে ঘরের এক কোনায়…..
( আমার আবোল তাবোল লিখা ধৈর্য নিয়ে পড়ার জন্য ধন্যবাদ)
২.অতীতের স্মৃতি নিয়ে গল্প
#ফিরে_যেতে _চাই
আমি স্কুলে মোটামুটি ধরণের ছাত্রী ছিলাম। একদম পড়াশোনা করতাম না। পরীক্ষার ফলাফল ততো খারাপ হতো না, বলে আমার পড়াশোনা নিয়ে আম্মার কোনো চিন্তা ভাবনা ছিল না। আমি পরীক্ষার আগে গল্পের বই নিয়ে বসে থাকলেও আম্মা আমাকে কিছুই বলতো না।
আমি বেশ পুরানো দিনের মানুষ, মেঘে মেঘে অনেক বেলা পার করে ফেলেছি। আমাদের সময়ে SSC তে এখনকার মতো জিপিএ ৪ – ৫ এইসব কিছুই ছিল না।বহু কষ্ট করে লেটার / ষ্টার এইসব পাওয়া যেত।
বাতেন স্যার আমাদের স্কুলে অঙ্ক করাতেন। আমি ভালোই অঙ্ক পারতাম। ক্লাস টেনে উঠার পর স্যার বলেছিলেন, প্রতিদিন ৫টা করে অঙ্ক করতে। আমি তাই করতাম। যাই কিছু করি না কেন, প্রতিদিন ৫টা অঙ্ক। এভাবে বইয়ের প্রথম থেকে শুরু করেছিলাম। একসময় বইয়ের সব অঙ্ক আমার জানা হয়ে গেলো।SSC পরীক্ষার দিন কি ভীষণ উত্তেজনা ! বিশেষ করে অঙ্ক পরীক্ষার দিন। গলা শুকিয়ে যাচ্ছে বার বার। কোনো কিছুই মনে থাকছে না। আম্মাকে বললাম,
” আজকে ৫টা অঙ্ক করলাম নাতো আম্মা।”
“আর অঙ্ক করতে হবে না। যাও,পরীক্ষায় সব বুঝে শুনে লিখবা। “
আমি পরীক্ষার হলে প্রশ্ন পেয়ে দেখি, খুব বড় বড় প্রশ্ন এসেছে। তবে সব আমার চেনা অঙ্ক। আমি একটা প্রশ্নের ৩টা শব্দ দেখেই উত্তর দেয়া শুরু করে দেই। এভাবে আমি প্রশ্নপত্রের কোনো প্রশ্ন না পড়েই সব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে আসলাম। বাসায় এসে তো আমি মহা খুশী।
” আম্মা, সব অঙ্ক পেরেছি , খুব সোজা ছিল। একটা প্রশ্নও পড়ি নাই। “
” প্রশ্ন পড় নাই মানে ?”
” মানে, তিনটা word পরেই বুঝে গেসি কোন অঙ্ক ! না দেখেই অঙ্ক করে ফেললাম।”
” যদি নম্বর গুলো change করে দেয় ? প্রশ্ন পড়বে না ? কি আশ্চর্য !”
” নাম্বার চেঞ্জ করবে কেন ?”
“করতে পারে না ? হায়, হায় এই মেয়েতো মনে হয় এইবার পাশ করবে না। “
আমার শুরু হয়ে গেলো টেনশন। তাই তো প্রশ্নগুলা পড়লাম না কেন ? নাম্বারগুলো change করেছে কিনা জানতেই পারলাম না !
পরের পরীক্ষাগুলো কোনো মতে দিলাম। সারাদিন অশান্তিতে থাকি, উদ্ভ্রান্তের মতো ঘুরতে থাকি। রাত্রে ঘুমাতে পারি না। খাওয়া খেতে পারি না।আমার এক বিভীষিকাময় জীবন শুরু হলো !
“আম্মা, পরীক্ষায় ফেল করলে কি হবে ?”
” কি আর হবে, আবার পরীক্ষা দিবা , প্রশ্ন না পরে মানুষ উত্তর কিভাবে দেয় ? আমি তো কিছু বুঝলাম না। “
আমি আরো আতংকিত হয়ে যাই। ভালো দিন, খারাপ দিন সব দিন একদিন শেষ হয়। রেজাল্ট বের হবার খবর পেলাম। বন্ধুরা ফোন করলো।
“চল কখন স্কুলে যাবি ? একসাথে যাই. রেজাল্ট নিয়ে আসি। আবার কখন দেখা হবে। ”
” আমার পেট ব্যাথা। আমি পরে যাবো। তোরা যা। “
” দেখা হবে না যে ?”
” পরে দেখা করবো রে ,তোরা রেজাল্ট দেখে আয়। “
বন্ধুরা স্কুল থেকে এসে আবার ফোন দেয়। “টিচাররা তোর কথা জিজ্ঞাসা করেছিলেন। বাতেন স্যার বার বার তোর খোঁজ করছিলেন।”
আমি পরেরদিন খুব ভোরে একা একা স্কুলে যাই। চুপ করে দেখে চলে আসবো। দারোয়ান ভাই আমাকে দেখেই বললেন
” আপা , কালকে আসেন নাই কেন ? বাতেন স্যার মনে হয় ১০ বার বলছেন আপনি আসলে যেন স্যারকে খবর দেই। “
” থাক , দারোয়ান ভাই , স্যারকে কিছু বলার দরকার নাই , আমি নোটিশ বোর্ড দেখেই চলে যাবো। “
” আপামনি , আমার চাকরি থাকবে না। “
” প্লিজ দারোয়ান ভাই আমি মনে হয় অংকে ফেল করেছি। স্যারের সামনে যাওয়া কি ঠিক হবে ? “
” কি বলেন আপামনি? আচ্ছা যান ! “
আমি পা টিপে টিপে চোরের মতো স্কুলের বারান্দায় উঠি। রেজাল্ট বোর্ডের দিকে যাওয়ার আগেই দেখি বাতেন স্যার একদম আমার সামনে। আমার যে তখন কি খারাপ লাগছিলো বলে বুঝাতে পারবো না।
” এই যে নাজমুন, কাল থেকে কত বার তোমার খোঁজ করেছি। আসো এই দিকে আসো। রেজাল্ট দেখেছো ? “
” জ্বী না স্যার। ”
আমার চোখে পানি চলে আসলো। ফেল করলে কি সবার সামনে অপমান করতে হবে ?
” এই, মেয়ে কাঁদছে নাকি ? আচ্ছা পাগল তো ? আমি বোর্ড থেকে তোমার অঙ্কখাতা আনবার জন্য এপ্লিকেশন দেব। ”
আমার মনে হলো এর চেয়ে আমার মৃত্যু ভালো ছিল। বোর্ড থেকে খাতা এনে স্যার দেখবে মনে হয় যে আমি সব ভুল ভাল অঙ্ক করে এসেছি। আমার চোখ দিয়ে ঝরঝর করে পানি পড়ছে। স্যার এগিয়ে এসে আমার মাথায় হাত রাখলেন।
” জীবনে অনেক ছাত্রী পড়িয়েছি, আরো পড়াবো , কিন্তু তোমার মতো ছাত্রী কখনো পাই নাই ,পাবোও না। মা, তুমি অঙ্কে ১০০ তে ১০০ পেয়েছো। এক্সামিনার তোমার একটা নম্বর কাটতে পারে নাই। তোমার খাতাটা আনতে দিয়েছি। বাকি জীবন ছাত্রীদের দেখাবো। তোমার জন্য আমি সোনার একটা মেডেল বানাতে দিয়েছি কাল।তুমি অঙ্ক নিয়ে পড়াশোনা করো মা। তুমি জীবনে অনেক বড় হবে। “
আমি স্যারের কথা শুনি নাই। ইংরেজি সাহিত্যে পড়াশোনা করেছি। বহু বছর পরে আমেরিকায় এসে আবার মনে হলো স্যারের কথা মতো অঙ্ক নিয়ে পড়াশোনা করে দেখি, আমেরিকান অঙ্ক পারি কিনা ?
স্যারদের সব কথা ঠিক হয় না। আমি জীবনে বড় কিছু হই নাই।
তবে যদি ফিরে যেতে পারি আমি সেই দিনটায় ফিরে যেতে চাই। না , কোনো কিছু পরিবর্তন করবো না। শুধু আমার মাথায় রাখা স্নেহ আর ভালোবাসার হাতটা যদি আবার অনুভব করতে পারতাম ! সেই অনুভূতি ! সেই আনন্দাশ্রু !
কিছু স্মৃতি কখনই ধুসর হয়ে যায়না, বারবার ফিরে আসে। মন প্রাণ দিয়ে চাই আবার ফিরে যেতে সেই দিনটাতে , আরেকবার নিশ্চিন্তে উপভোগ করতে চাই সেই প্রিয় মুহুর্তটা ! মাত্র একটি বার !