আমাদের শৈশব
সত্তরের দশকের শেষের দিকে কথা বলছি। একদিন বিকেলে বাবা অফিস ফেরত আসার সময় এক বিশাল বাক্স নিয়ে আসলো। বাক্স খুলে বের হলো ফিলিপসের 24 ইঞ্চি সাদাকালো টেলিভিশন। বাবা অ্যান্টেনা নিয়ে ছাদে চলে গেল। টিভির কানেকশন দেয়া হচ্ছে আর আর আমরা টিভির সামনে বসে আছি। সাদা স্ক্রিনে কাল পোকার মতো ঝিরিঝিরি দেখা যায়। তাই দেখতে কত ভালো লাগতো। ছাদে অ্যান্টেনা ঘুরাতে ঘুরাতে পাব আবার চিতকার করে জিজ্ঞেস করতো”,আসছে? “
আমার নিজের থেকেও উচ্চঃস্বরে উত্তর দিতাম, “এখনো আসে নাই “। একসময় ছবি আসত। মুগ্ধ নয়নে সবাই বসে টিভি দেখতাম। সেই সময় টিভিতে মালা শাড়ি, কসকো সাবান, মায়া বড়ির বিজ্ঞাপন দেখাতো। প্রতি বিজ্ঞাপনের পরে একটা টুট করে আওয়াজ হতো। ডাবল ডেকার, সুইস ফ্যামিলি রবিনসন,লিটল হাউস অন দা প্রেইরি, হাওয়াই ফাইভও,সিক্স মিলিয়ন ডলার ম্যান, ওয়ান্ডার ওম্যান ঘোর লাগা চোখে বসে দেখতাম।
আশেপাশের কয়েকটা পাড়ার মধ্যে আমাদের বাসাতেই টেলিভিশন এসেছিল।বিকেল বেলা টেলিভিশন চালালে আশেপাশের বাসার বাচ্চারা জানালায় ঝুলে ঝুলে ঘরের ভিতরে টিভি দেখতো। আর যেদিন বাংলা সিনেমা থাকতো সেই দিন দুপুর থেকে বাসায় উৎসবের মতো পড়ে যেত। হয় টেলিভিশন বড় বারান্দায় সেট করা হতো নয়তো উঠোনে সেট করা হতো। আশেপাশের পাড়ার বৌঝিরা সবাই এসে পড়তো সিনেমা দেখতে। রাত আটটার খবর এরপর সিনেমা শুরু হওয়ার কথা কিন্তু বিজ্ঞাপনের আর শেষ নাই। আমরা গুনতে থাকতাম কয়টা বিজ্ঞাপন হচ্ছে। একসময় বিজ্ঞাপন শেষ হয়ে সিনেমা শুরু হতো। সেই সিনেমা শেষ হতে হতে রাত একটা-দেড়টা বেজে
যেত। এত এত মানুষ টিভি দেখতে আসতো আমাদের বাসায় আমাকে কখনো বিরক্ত লাগেনি। যেই দিন সিনেমা থাকতো আমরা জানতাম সবাই চলে আসবে। মাসে একটাই সিনেমা হতো বিটিভিতে। তারপর একসময় আসলো ধারাবাহিক নাটক।
সকাল সন্ধ্যা মনে হয় ছিল বিটিভির প্রথম ধারাবাহিক নাটক। কি যে ভালো লাগতো দেখতে। আমাদের সময় টিভি সেন্টার চালু থাকতো বিকাল চারটা থেকে রাত দশটা। সবাই মিলে পাটি বিছিয়ে বসে টিভি দেখার মধ্যে যে আনন্দ ছিল আজ এসি রুমে সোফায় বসে টিভি দেখায় সে আনন্দ খুঁজে পাইনা।
আর একটা কথা না বললেই না, অ্যান্টেনা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দুরদর্শন এর ছবি আনা। অ্যান্টেনা ঘুরাতে ঘুরাতে অস্পষ্টভাবে দূরদর্শনের যে ছবি আসত, তাই দেখে মনে হতো জীবন ধন্য।সবসময় বুঝতাম না কি দেখাচ্ছে। তারপর ও সামনে বসে তাকিয়ে থাকতাম টিভির দিকে। আজকালতো টিভি ছারলে নাটক সিনেমা কোন কিছুরই কমতি নেই। কিন্তু আছে কি সেই আগের মতো অনুভূতি? 24 ইঞ্চি সে সাদাকালো টিভিতে আমার যে আবেগ লুকিয়ে আছে তা আজ আর স্মার্ট টিভিতে খুঁজে পাইনা। রিমোট হাতে নিয়ে অহেতুক টিপাটিপি করি। চোখের সামনে ছবিগুলি বদলাতে থাকে। কোন কিছুই মনে দাগ কাটে না।
47 বছর পরে আমি আবার আমার সেই শৈশবে দেখা সাদাকালো বাক্সখানি খুজে পেয়েছি। ঘরের এক কোণে অনাদরে অবহেলায় পড়ে আছে। ফিলিপস টিভির সাদা কালো পর্দায় তাকালে আমি আমার শৈশব দেখতে পাই। পর্দায় ভেসে ওঠে গোসলের পরে মা আমার মুখটা হালকা উচু করে তুলে চুল আঁচড়ে দিচ্ছে। দেখতে পাই সকাল দশটায় স্কুলে যাওয়ার আগে মা আমার মুখে তুলে ভাত খাওয়াচ্ছে। আরো দেখি সাড়া উঠান একটা বাঁশের কঞ্চি নিয়ে বিড়ালের পিছে দৌড়াচ্ছে একটা ছোট্ট মেয়ে। দেখতে পাই সত্তরোর্ধ্ব এক বৃদ্ধ কই আমার বুবু মনি বলে তার ছোট্ট নাতনি কে খুঁজে বেড়াচ্ছে। দেখি এক সুদর্শন বাবা তার রাজকন্যাকে কোলে দিয়ে অনেক আদর করছে। কালের বিবর্তনে সেই ছোট্ট মেয়ে আজ মধ্যবয়সে পদার্পণ করেছে, সত্তরোর্ধ্ব সেই বৃদ্ধ আর মেয়েটির মা আজ আকাশের তারা। সুদর্শন বাবা আজ মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে। শুধু 24 ইঞ্চি সাদাকালো ফিলিপস টেলিভিশন সকল স্মৃতি বুকে নিয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে ঘরের এক কোনায়…..
( আমার আবোল তাবোল লিখা ধৈর্য নিয়ে পড়ার জন্য ধন্যবাদ)
আমার শৈশব স্মৃতি জন্মদিন
শৈশব কৈশোরে জন্মদিনগুলোতে কখনোই কেক কাটা হতো না। আম্মা বাড়িতে ভালোমন্দ রান্না করতেন। আমরা তৃপ্তি নিয়ে খেতাম। দুপুরের দিকে যখন সমস্ত পৃথিবী থেমে থাকতো, খুব নিঃশব্দে আম্মা কাছে আসতেন। উপহার হিসেবে হাতে তুলে দিতেন একটি কলম কিংবা ডায়েরি। মনে হতো পৃথিবীর সবচেয়ে অসাধারণ জিনিষটিই বুঝি দিয়েছেন আমায়। খুব যত্নে তুলে রাখতাম। নির্জন দুপুরে, রাত গভীরে সকলের অগোচরে আমি সেইসব প্রাণভরে নেড়ে চেড়ে দেখতাম।
অঢেল আছে, এমন পরিবারে বেড়ে উঠিনি সত্যি। কিন্তু অভাব দেখিনি। কিছু প্রয়োজন হলে আম্মাকে বলতাম। চাওয়া মাত্রই দিতে পারতেন না হয়ত। কিন্তু অবশ্যই দিতেন কোনো একদিন। অসুখের পর নতুন জামা কিনে দিতেন। বলতেন, নতুন জামা পরলে মন ভালো থাকে। আম্মা সরকারী চাকুরীজীবী ছিলেন। আমাদের চাহিদাগুলো মেটাতে কখনোই আব্বার কাছে চাইতেন না। কোন কোন বিষয়ে কোচিং করতে হবে, নিজেই শিক্ষকদের সাথে কথা বলে ঠিক করতেন।
কষ্টে-শিষ্টে শহরের প্রাণকেন্দ্রে চারতলা দালান বানালেন আব্বা। একবার বাড়ির ছাদ ঢালাই হবে। কথা ছিল আমরা সেবার ঈদে জামা নিবো না। অথচ তার আগ অব্দি ঈদের জামা নেইনি, এমনটি ঘটেনি। সেইবার ঈদের আগের রাতে আমরা হাতে মেহেদি পরলাম না। আনন্দিত উচ্ছ্বসিত হয়ে ঘরময় হেঁটে বেড়ালাম না। অকারণে ঘন ঘন আয়নার সামনে দাঁড়ালাম না। ভোরের দিকে শহরের পুরুষেরা আতর মেখে জায়নামাজ হাতে দলে দলে জমায়াতে গেলো। সুনসান নীরব পথঘাট। আম্মা রিক্সায় চড়ে মার্কেটে গেলেন। শহরে ‘মালঞ্চ’ নামের একমাত্র খোলা দোকানটি থেকে আমাদের জন্যে ঈদের জামা কিনে আনলেন। সেই জামা পরে আমরা পাড়া-প্রতিবেশিদের বাসায় বেড়াতে গেলাম। দিনভর ঘুরে বেড়ালাম। কারণে-অকারণে একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়ালাম। আমাদের ইটের দালানটি বাড়ি হয়ে উঠলো।
এইচ এইচ সির পর বাড়ি ছেড়ে ঢাকায় ভর্তি হলাম। আব্বা অশ্রুজলে ইডেন কলেজ হোস্টেলে রেখে গেলেন। প্রতি মাসে ২০০০ টাকা করে পাঠাতেন। সেই টাকা থেকেও কেমন করে যেনো সাশ্রয় করতাম। ছুটিতে বাড়ি এলে আম্মার হাতে বেঁচে যাওয়া টাকা তুলে দিতাম। আম্মা খুশি হতেন না। কষ্ট পেতেন। মন খারাপ করতেন। ভাবতেন, না খেয়ে খেয়ে টাকা বাঁচিয়েছি হয়তো। হোস্টেলের অনেকেই মাস শেষ না হতেই বাড়িতে টাকা চেয়ে চিঠি লিখত। আমি লিখতাম, এখনো হাতে যথেষ্ট টাকা আছে। ছুটির দিনে মিরপুর যেতাম। মামা-খালার বাসায়। আজিমপুর থেকে মিরপুর। নীলক্ষেত থেকে গাবতলির বাসে চড়তাম। টেকনিক্যাল নেমে রিক্সা নিতাম। এতে খরচ কম হতো। অবসরে অনেকেই যখন প্রেমিকের হাত ধরে টিএসসিতে ঘুরতে যেত, কিংবা পথের ধারে দাঁড়িয়ে ফুচকা খেতো, আমি তখন বাবা-মা’র উপর চাপ কমাতে টিউশনি করতাম।
বিয়ের পর জামাইর সঙ্গে যখন আমেরিকায় এলাম, যেন অথৈ সাগরে এসে পড়লাম। কুল নাই, কিনার নাই। দুইজনেই কাজে নেমে গেলাম। আমি দিনে, সে রাতে। টানা ৩২/৩৩ ঘণ্টা কারো সঙ্গে কারো দেখা হয় না। সুখদুঃখের গল্প হয় না। কিন্তু দেশে বাবা-মাকে আমরা আমাদের ভালো থাকার গল্প শোনাতাম। এক জন্মদিনে জামাই বিখ্যাত শপিং মল মেসিজে নিয়ে গেলো। মেকাপ আর্টিস্টের সঙ্গে পরামর্শ করে আমার ত্বক উপযোগী কসমেটিকস কিনে দিলো। ল্যানকম ব্রান্ড। ম্যালা দাম! মনে মনে হিসেব করি বাংলাদেশি টাকায় কত টাকা! বড় বিলাসিতা মনে হলো। বললাম, আমার সাজতে ভালো লাগে না। কেনো জানি আজ অব্দি তা ব্যবহার করা হয়নি। আরেকবার আমার গান শোনার শখ দেখে ছোট্ট একটি রূপালি রঙের জাপানিজ টেপ রেকর্ডার দেখছিলেন দোকানে। দাম ৫০০ ডলার। আমি কাচুমাচু করে বললাম, আমার তো গান শোনার সময় নাই। কেউ শুনলো না আমার কথা। কিনলেন। সেই রেকর্ডারে গান শুনতে শুনতে ভাবি, খামোখা এতগুলো টাকা নষ্ট করলো! এরচেয়ে এই টাকাটা দেশে গরীব কাউকে দিলে কত উপকার হতো। এমন অজস্র উদাহরণ লিখলে শেষ হবে না। আমি যে পরিবারে বেড়ে উঠেছি, সেখানে আসলে অল্পতে সন্তুষ্ট থাকার অভ্যাসটা তৈরি হয়ে গিয়েছে। তাই চাহিদাগুলোও নিতান্তই প্রয়োজনের মাঝে সীমাবদ্ধ রয়ে গেছে।
## আমাদের গেছে যে দিন, একেবারেই কি গেছে !
রিমি রুম্মান
নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র