মায়ের সাথে একটা সকাল
আম্মাকে নিয়ে ভয়ংকর এক স্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙ্গে গেল। ঘড়িতে রাত চারটা। দ্রুত উঠে আম্মার ঘরে গিয়ে দেখি আম্মা নামাজের জন্য উঠেছেন। এলোমেলো পা ফেলছেন দেখে হাত বাড়িয়ে আম্মাকে ধরলাম।আম্মা ওজু করে নামাজে দাঁড়ালেন। এখনও মাশাআল্লাহ দাঁড়িয়ে নামাজ পড়েন। আমি ওজু করে নামাজ পড়ে ডায়নিং টেবিলে বসলাম। আম্মা এসে পাশে বসে বললেন, তোর জন্য চা বানাই।
হাত কাঁপছে, ঠিক মতো দাঁড়াতে পারে না তবু আম্মার হাতের চায়ের মায়া ছাড়তে পারলাম না। চা বানিয়ে হাতে করে কতো গুলো বিস্কিট এনে দিলেন। আম্মার সাথে চা খেতে খেতে চোখ ভিজে গেল।
ছোট বড় সবাইকে নামাজ পড়তে ডেকে দিয়ে কোরআন পড়তে বসলেন। আমি পাশে বসে থেকে আম্মার পড়া শুনলাম। একপারা কোরআন পড়ে তারপর আমার সাথে নানা ধরনের আমল নিয়ে গল্প করলেন।
ততক্ষণে বাইরে সকালের আলো ফুটতে শুরু করেছে। দরজা খুলে বাইরে এলেন আমাকে নিয়ে। শিউলি গাছটার কাছে গিয়ে আদর করে বললেন গাছটা এত ভালো, কতো ফুল ফুটেছে দেখ। গতবার বাড়ি আসার সময় আমি আম্মার জন্য এনে ছিলাম ঢাকা থেকে।
হাঁটতে হাঁটতে পুকুরের পশ্চিম পাশে নিয়ে গেলেন। সেখানে আমি কিভাবে বাড়ি করবো বুঝিয়ে দিলেন। জলপাই গাছ কামরাঙা গাছ দেখিয়ে বললেন এদের গোড়ায় মাটি দিতে হবে।
নতুন একটা পেয়ারা গাছ দেখিয়ে বললেন এটা খুব ভালো জাতের হবে। রান্না ঘরের কাছে এসে খুশি আপাকে বললেন জাকিয়া চলে যাবে, ওর জন্য ভাপা পিঠা বানা। আমাকে নিয়ে আবার হাঁটতে শুরু করলেন। মহিলা মাদ্রাসার ভিতরে ঢুকতেই প্রিন্সিপালের বৌ ছুটে এসে জড়িয়ে ধরলেন আম্মাকে। মহিলাকে কিছু টাকা দিলেন।
এবার ঢাকা থেকে বাগান বিলাসের ডাল থেকে গাছ বানিয়ে নিয়ে গিয়েছিলাম, সেটা কোথায় লাগাবো দেখিয়ে দিলেন। গাছ দুটো আম্মার সাথে লাগালাম। এবার এসে দেখি গরম ভাত রান্না হয়েছে, আম্মা কাছে বসিয়ে আমার আর জায়িমের প্লেটে তুলে দিলেন মুরগির মাংস দিয়ে গরম ভাত।
আম্মার সাথে খেতে বসে কতটা নষ্টালজিক হয়েছিলাম বোঝাতে পারবো না।
এরপর আম্মা আমাকে নিয়ে পুকুর পাড়ে চেয়ার নিয়ে বসলেন। জায়িমকে বললেন যাও পুকুর থেকে বড়শি দিয়ে দিয়ে মাছ ধরো। আম্মা বসে বসে দেখলেন জায়িম অনেক মাছ ধরলো।
জায়িম মাছ ধরছে খালি বড়শি দিয়ে। টোপ ছাড়া মাছ ধরা যায় জানতাম না। আম্মা হাসছে। আমি আমার মায়ের হাসি মুখের দিকে তাকিয়ে আছি।
এতক্ষণে খুশি আপা পিঠার গুঁড়া রেডি করে ফেলেছে, বুবু নারিকেল কুরিয়ে গুড় দিয়ে পিঠা সাজিয়ে দিয়েছে, রাশু আপা চুলায় ভাপে পিঠা সিদ্ধ করে প্লেটে তুলে আমার দিকে বাড়িয়ে দিল, আম্মা আমাকে পাশে বসালেন। বললেন খেয়ে দেখ গরম গরম। খুব মজা। আর কবে বানিয়ে খাওয়াবো!
আমার সামনে বসে খা। আবার সেই চোখ ভিজে উঠলো।
আজ কেন এতো কান্না আসছে বলতে পারবো না।
দেখতে দেখতে ফিরে আসার সময় হয়ে গেল। আম্মা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে হতাশ হয়ে বললেন তোর যাওয়ার সময় হয়ে গেল তাইনা?
একবার আস্তে করে বললেন আজকের দিনটা থেকে যা!
বললাম আম্মা আমার স্কুল খোলা।
আম্মাকে হতাশ করে রওনা দিলাম ঢাকার দিকে। যতদুর দেখা যায় পিছে ফিরে ফিরে তাকাতে থাকি। যদি আর এক পলক দেখা যায় ঐ প্রিয় মুখখানি।
গত বৃহস্পতিবার রাতে আম্মাকে চমকে দিতে না বলেই হাজির হয়ে ছিলাম বাড়িতে। রাত তখন দশটা। আম্মা ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। আমি বাসার নিচে গিয়ে চিৎকার করে আম্মা বলে ডাকতেই আম্মা দোতলার সিঁড়ি বেয়ে নামতে লাগলেন।হাতটা বাড়িয়ে দিয়েছেন আমার দিকে। দৌড়ে গিয়ে হাতটা ধরলাম দেখি হাত কাঁপছে দুর্বলতার জন্য।
সেই আধো আলো আধো অন্ধকারে আম্মার মুখে যে অলৌকিক আনন্দ ধারা দেখে ছিলাম আজ ফিরে আসার মুহুর্তে সেই মুখখানিতে বিষাদের ছায়া দেখে বুকটা হু হু করে উঠলো