#japanKahini জাপানের বৃদ্ধাশ্রম
পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশিদিন বাঁচে কোন দেশের মানুষ?
আবার জিগায়। জাপান। মহিলাদের গড় আয়ু ৮৭ বছর, পুরুষ দের ৮২। কিন্তু এটা কি গর্ব করার জিনিস? জানিনা। চিন্তা করতেই মাথা ব্যথা শুরু হলো।
১৯৮৮ সাল। জাপানের এক স্কুল শিক্ষকের সাথে কথা। জাপানি সরকার দ্রব্যমূল্যের উপর ৩% কর বসাতে যাচ্ছেন। ওনার এটা পছন্দ না। অপছন্দের কারণ টা বুঝালেন এভাবে –
একটা কাগজে কলসির মত একটা ছবি আঁকলেন। বললেন এটা জাপানের জনসংখ্যা পিরমিড। নীচের আর উপরের অংশ সরু আর পেট খানা মোটা – মানে হল শিশু আর বৃদ্ধের সংখ্যা কম আর যুবকদের সংখ্যা বেশি। যুবকরা উপার্জন করছে, বৃদ্ধ ও শিশুরা ভোগ করছে।
২৫ বছর পর এই জনসংখ্যা পিরমিডের কলসিটা হবে উল্টো। বুড়োদের সংখ্যা হবে বেশি। কাজ করার লোক হবে কম, খাওয়ার লোক বেশী। দেশ অর্থনৈতিক সমস্যায় পড়বে। এখন থেকে ৩% কর জমিয়ে রেখে ২৫ বছর পর কাজে লাগানো হবে। এই হচ্ছে সরকারের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। ওনার ধারনা, এই টাকা সরকার অন্যত্র ব্যয় করবে।
১৯৮৯ সাল থেকে কর তোলা শুরু হলো। বছরে এই ট্যাক্স থেকে আয় হয় ১০ ট্রিলিয়ন টাকা।
২৫ বছর কাটলো। তখনকার ৪০ বছরের যুবক এখন ৬৫। বৃদ্ধের খাতায় নাম লিখাচ্ছেন। ইতিমধ্যে সরকার ও লোভী হয়ে উঠলেন। ধাপে ধাপে কর বাড়ালেন। ৯৭ সালে ৫%, ২০১৪ সালে ৮%। এখন ১০%। স্কুল শিক্ষকের ভবিষ্যৎবাণী ঠিক ছিল। সরকার অন্যত্র খরচ করা শুরু করেছেন।
২৫ বছরে আর কি কি বুঝলাম? চোখের সামনে জনসংখ্যার পরিবর্তনটা দেখলাম। কতগুলো আচানক ব্যাপার ও চোখে পড়লো।
(১) হু হু করে কমলো তরুণ জনসংখ্যা
জাপানি এক ছাত্রের সাথে গল্প করছিলাম। আমাদের দুজনের মিল হলো দুজনেই গ্রাম থেকে এসেছি। অমিলটা হলো- আমি মোটামুটি সব খেলাধুলাই জানি। সে জানে শুধু টেবিল টেনিস। কাহিনি কি ?
প্রাইমারি থেকে জুনিয়র হাই স্কুল পর্যন্ত তার ক্লাসে ছাত্র সংখ্যা ছিল সব মিলে এক। শিক্ষকের সংখ্যা ও এক। খেলাধুলার ক্লাসে একটা খেলাই দুনপ্রিয় (দুজনের প্রিয়) ছিল সেটা হলো – টেবিল টেনিস।
এধরনের ছাত্র বিহীন স্কুল সরকার কতদিন চালাবেন? কত আর ভর্তুকি দিবেন? ঠুস ঠাস করে প্রাইমারি স্কুল, হাই স্কুল গুলো বন্ধ হওয়া শুরু হল ।
জাপানে মানুষের বাচ্চার চেয়ে পোষা কুকুরের সংখ্যা বেশী। কুকুরের সংখ্যা হলো ২০মিলিয়ন আর ০-১৫ বছরের শিশুর সংখ্যা ১৫মিলিয়ন। লাও ঠেলা।
সরকার এখন জনসংখ্যা বাড়াতে চাচ্ছেন।
একটা করে সন্তান দে
৪ লাখ টাকা গুনে নে
জ্বি, প্রতি বাচ্চার জন্য সরকার ৪ লাখ টাকা করে অফার করছেন। বাচ্চাদের শিক্ষা চিকিৎসা সবই ফ্রি করে দিয়েছেন। তারপর ও উর্বর দম্পতিদের মন গলাতে পারছেননা। সোশ্যাল ইন্টারকোর্স বাড়ানোর জন্য সাপ্তাহিক ছুটি একদিনের জায়গায় দুইদিন করলেন, ওভারটাইম কে ডিসকারেজ করলেন। শনিবার রাতে টিভিতে প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য স্পেশাল প্রোগ্রাম ও বানালেন। তেমন ফলাফল এলোনা। আজকাল যুবকরা বিয়ে করতেই রাজি হচ্ছেন না। ৩০ এর উর্ধে অবিবাহিত মহিলাদের সংখ্যা কত জানেন? সমীক্ষা বলছে, ৩০-৩৪ বছর বয়সের অবিবাহিত মহিলার সংখ্যা ৪৭% । এর মধ্যে আমাদের ফুকুওকা শহর সবার উপরে।
জাপান সরকার এ ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারের সাহায্য কামনা করতে পারেন। আমরা জনসংখ্যা কমাতে চাই, ওনারা বাড়াতে চান। উইন উইন সিচুয়েশন। ডিমান্ড এন্ড সাপ্লাই।
পৃথিবীর গোটা-বিশেক দেশের গ্রাম/ছোট শহর দেখার সুযোগ হয়েছিল। স্কটল্যান্ড, জার্মানি, ইতালি, নেদারল্যান্ডস এর গ্রাম/উপশহর গুলো দেখেছি। জনসংখ্যার অভাবে উপশহরগুলো কেমন যেন প্রাণহীন, মৃতপ্রায়। নো মানুষ, নো ইকনমিক এক্টিভিটি। বুঝতেই পারছেন জাপান সরকার কেন স্কিল্ড বিদেশি আমদানি করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছেন। বাংলাদেশের জন্য হতে পারে একটা বিরাট বিজনেস চান্স। ইতিমধ্যে মিয়ানমার, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম, ফিলিপিনোরা এই চান্সটুকু কাজে লাগানোর জন্য উঠে পড়ে লেগেছেন। বড় টার্গেট জাপানের বৃদ্ধ জনগোষ্ঠী। এদের টাকা আছে। উদ্দেশ্য হলো এই বৃদ্ধদের জন্য নূতন সার্ভিস ক্রিয়েট করে নূতন ব্যবসা ডিজাইন করা। অন্যতম হচ্ছে হোম-কেয়ার।
(২) বৃদ্ধদের একা থাকা
১৯৯৮ সালের কথা। পি,এইচ,ডি-র ছাত্র তখন। ইন্টারনেট ট্রাফিক এনালাইসিস নিয়ে কাজ করছি। ক্যাম্পাস থেকে ১৪ কিমি দুরে এক ডাটা সেন্টার থেকে নেটওয়ার্ক ট্রাফিক ডাটা নিয়ে আসতে হতো। একদিন আধা কিলো ডাটা (৫০ গ্রাম x ১০ টা সিডি) নিয়ে ক্যাম্পাসে ফিরছি। অগাস্ট মাস দুপুর বেলা। প্রচণ্ড গরম। গাড়িতে এ,সি নেই। গান গাইতে গাইতে গাড়ি চালাচ্ছি। দেখি, এক বুড়ি রাস্তার পাশে হাত তুলে দাঁড়িয়ে আছেন। দেখলাম, কিন্তু থামলাম না। জাপানে সাধারণত কেউ লিফট চায়না। বড়ই বিরল। কৌতূহল কমাতে না পারে ইউ-টার্ণ করলাম। ওনার পাশে গাড়ি থামাতেই উনি দরজা খুলে পিছনের সিটে বসলেন। একটা হাসপাতালের নাম বললেন। চিনলাম। আমাদের ক্যাম্পাসের পাশেই।
গাড়ি চলছে। উনি ও কথা বলছেন না। আমি ও না। এই নিস্তব্দতা টা দারুণ পীড়াদায়ক। উনি নির্ঘাত আমাকে ট্যাক্সি ড্রাইভার ভাবছেন। এই ভুল ভাবনাটা দুর করার জন্য হলেও কথা বলাটা দরকার। আমিই শুরু করলাম।
আতসুই দেস নে (খুব গরম তাই না? )। বিদেশে কথা শুরু করার জন্য আবহাওয়া একটা চমৎকার টপিক।
বুড়ি কথা বললো না। মেজাজ টা খারাপ হলো। এবার আমার চুপ থাকার পালা। একটু পর উনিই কথা তুললেন।
-কোনদিকে যাচ্ছ?
কাতাহিরা ক্যাম্পাস। আপনার হাসপাতালের পাশেই।
-কোত্থেকে এসেছ? মেক্সিকো?
নাহ, বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ শুনেই সে আর এক বাংলাদেশি ছেলের গল্প বললো যে তাকে সেন্দাই স্টেশনে সিঁড়ি নামতে সাহায্য করেছিলেন। নাম বলতে পারলেন না কিন্তু অত্যন্ত কৃতজ্ঞতার সাথে বাংলাদেশের নাম বললেন। গর্বে বুকটা ভরে গেল। স্যালুট মাই কান্ট্রিম্যান।
– তোমার দেশের সব ছেলেই কি দয়ালু নাকি?
জ্বি। আসলে পৃথিবীর সব ছেলেরাই দয়ালু।
আমি মিররে দেখলাম, উনি মুচকি হাসলেন। একটু সহজ ও হলেন।
তবে জাপানের সাথে একটু তফাৎ আছে। মেয়েদের প্রতি বেশি দয়ালু বলতে পারেন। পুরুষ মহিলা একসঙ্গে হাঁটলে ভারি লাগেজটা সাধারণত পুরুষটা বহন করে। বাসে ট্রেনে মহিলা দেখলে সাধারণত পুরুষরা সিট ছেড়ে দেয়। শুধু কি তাই? গত ৮ বছর পুরো দেশের শাসনভার আমরা মহিলাদের উপর ছেড়ে দিয়েছি। এসব ক্ষেত্রে বাংলাদেশে আমরা জেন্ডার-ইকুয়ালিটি দেখিনা। উই রেস্পেক্ট মহিলা, ওনাদের উচ্চাসনে রাখি।
আবারো হাসলেন। বৃদ্ধ আর শিশুদের হাসি সবচেয়ে সুন্দর হয়। তবে এই হাসি বের করে নিতে হয়।
বেশিক্ষণ কথা হলোনা। এর মধ্যে ওনার হাসপাতালে পৌঁছলাম। বাকি কথায় যা বুঝলাম – উনি রেগুলার চেক আপ করতে হাসপাতালে যান। বাড়িতে একা থাকেন। ছেলে মেয়েরা থাকে টোকিওতে। রেগুলার চেক আপ বলতে কিছু না। হাসপাতালে গেলে আরও কয়েকজনের সাথে দেখা হয়। নতুন বন্ধু ও তৈরি হয়। একাকিত্ব ভাল্লাগেনা। বৃদ্ধাশ্রম শব্দটা পছন্দ করেননা।
বর্তমানে বৃদ্ধ জনসংখ্যার ৮% লোক একা থাকেন। সামাজিক জীব, সমাজে না থেকে একা থাকবেন, এটাও এক সামাজিক সমস্যা। খাবার সরঞ্জাম কেনার টাকা আছে, রাঁধতে পারছেন না। গাড়ি আছে, চালাতে পারছেন না। ব্যাঙ্কে টাকা আছে, ফিনান্সিয়াল ম্যানেজমেন্ট করতে পারছেন না। সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও না খেয়ে মরছেন, এমন সংখ্যা ও কম নয়। বড় কথা একজন মানুষ মারা গেলে তা টের পাওয়ার ও লোক নেই।
মরার আগে শেষ কথাটুকু কাউকে বলে যাবেন সেটা শোনার লোক নেই। ফাঁসির আসামিকে ঝুলানোর আগে শেষ খাবার খাওয়ার, শেষ সাক্ষাত করার, শেষ কথা বলার সুযোগ দেয়া হয়।
একা একা মরার কষ্ট আমাদের জানার উপায় নেই । এই হল এইজিং সোসাইটির হাল। ডেনমার্ক, সুইডেনের মত দেশে বুড়ো লোক নিজ এপার্টমেন্টে মরে পড়ে থাকার ৬ মাস, ৩ বছর পর টের পেয়েছেন এমন ঘটনা ও আছে। আমরা ও শীঘ্রই এইজিং সোসাইটিতে পা দিতে যাচ্ছি। এই সমাজ রি-ডিজাইন করার দায়িত্ব আমাদের।
জাপানিরা টেক প্রিয় জাতি। কয়েকটি কোম্পানি গবেষণায় নেমে গেল- কিভাবে অসুস্থ রোগীকে কে রিমোট থেকে আর্লি ডিটেক্ট করা যায়।
প্যানাসনিক তাদের থার্মফ্লাক্সে একটা সেন্সর আর ইন্টারনেট কানেক্টিভিটি দিয়ে দিলেন। আইডিয়াটা হলো – জাপানি বৃদ্ধরা ঘন ঘন গ্রিন চা খায়। চা খাওয়ার জন্য গরম পানি লাগবে। থার্মফ্লাস্কে পাফ করতে গেলেই সিগনাল চলে যাবে ইন্টারনেটে। একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সিগনাল না পেলে এলার্ট চলে যাবে তার রিমোট ডাক্তার, আর পরিবার সদস্যের কাছে। নিয়মিত সিগন্যাল পেলে ধরে নেবে বুড়ো সুস্থ আছেন।
টোটো কোম্পানি টয়লেটের ফ্লাশ এ বসিয়ে দিলেন সেন্সর। একই উপায়ে রিমোট থেকে মনিটর করা সম্ভব। সুস্থ থাকলে টয়লেট ফ্লাশ করবেনই।
কেউ কেউ ভিডিও ক্যামেরার আইডিয়া ও দিলেন। প্রাইভেসি নিয়ে কথা উঠল। এই আইডিয়া বেশিদুর এগুলো না।
(৩) মরতেই যখন হবে, মরবেন কিভাবে
হুমায়ুন আহমেদের একটা নাটকের কথা মনে আছে? “একা একা”? । সম্ভবত ৮৬ সালের। দাদাজান “আবুল হায়াত” মারা যাবেন। কি এক পারিবারিক প্রস্তুতি। একান্নবর্তী পরিবার। ছেলে, বউ নাতি পুতি একবাড়িতেই আছেন। মেয়েদের শ্বশুরবাড়ি থেকে ডেকে আনা হয়েছে। মাদ্রাসার ছাত্ররা এসে কোরআন পড়ছেন। ছেলেমেয়েরা যার যার দায়িত্ব পালন করছেন। পাশের বাড়ির নিম্নবিত্ত পরিবারের বিনু “সুবর্না মুস্তাফা” একজন হোমকেয়ারের দায়িত্ব পালন করছেন। কি এক সাস্টেইনেবল সামাজিক দৃশ্য।
আপনি কীভাবে মরতে চান?
ভারতে হিন্দু ধর্মে বুড়োরা শেষ দিন গুলো পুণ্যস্থান বেনারসে কাটাতে পছন্দ করতেন। মৃত্যুর দিন গুনতে গুনতে শ্মশান। পাপুয়া নিউগিনিয়াতে একসময় এমন দৃশ্য ও ছিল। আপনি জীবনে পুণ্য কাজ করে থাকলে বৃদ্ধ হওয়ার সাথে সাথে আপনাকে কেটে কুচি কুচি করে কমিউনিটির সবাই মিলে খেয়ে পুণ্যের ভাগ নিবে।
আমি এখন যেখানে থাকি এটা ফুকুওকা শহরের পশ্চিমে একটা ছোট পেনিন্সুলা (উপদ্বীপ)। তিন দিকেই সমুদ্র। সমুদ্র ঘিরে রিসোর্ট হোটেল তৈরি করাটাই স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু তৈরি হচ্ছে হাসপাতাল। নামে হাসপাতাল, কাজে বৃদ্ধাশ্রম। বৃদ্ধাশ্রম শব্দটা পছন্দ না বলে নাম দিয়েছেন হোটেল। বুড়োরা শেষ দিন গুলো এখানে থাকতে আসেন। বৃদ্ধাশ্রম থুক্কু হোটেল কর্তৃপক্ষ ওনাদের জন্য সকাল বিকাল শরীর চর্চা, মেডিক্যাল চেকআপ, বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে খাওয়ার ট্যুর, আশেপাশে প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখার ট্যুর আয়োজন করেন।
বিকালে সবাই মিলে চা খেতে খেতে সূর্যাস্ত দেখেন। সকালে দেখেন সূর্যোদয়। সমুদ্রের ওপার কল্পনা করতে করতে একদিন জীবনের ওপারে চলে যান।