রোদ শুভ্রর প্রেমকথন পর্ব ৬৩
লেখনীতে- নৌশিন আহমেদ রোদেলা
বহুদিন পর জীবনের গল্প লিখতে বসলাম। লিখতে বসে বুঝলাম, গল্পের তাল কেটে গিয়েছে। ঝুমঝুম আষাঢ়ে আচমকা বজ্রপাতের মতোই এই সুরচ্ছেদ। কোথায় যেন অদ্ভুত একটা ভয়। কিশোরী মনের মতো চাপা বিষণ্ণতা। এই বিষণ্ণতা সাপটে ধরে আমার গল্প-দোয়াতের কালি। শব্দ এগোয় না। বাক্য বুনতে বুনতেই থমকে যাই। তীব্র আলস্যে অসহায় হয়ে উঠে হৃদয়। এই অসহায় হৃদয়পটেই কালবৈশাখীর ঝড়ের মতো সদর্পে দেখা দেয় এক আত্ম-অহংকারী পুরুষ। সেই পুরুষের উপস্থিতি বর্ষার জলের মতোন ভাসিয়ে নিয়ে যায় আমার যাবতীয় মন খারাপ, গ্লানি, ব্যথা আর চারপাশের ঝিমিয়ে পড়া ব্যস্ততা। কানের কাছে ভেসে উঠে ঝলমলে রবীন্দ্র সংগীত,
‘ হারিয়ে-যাওয়া মনটি আমার
ফিরিয়ে তুমি আনলে আবার।।
ছড়িয়ে-পড়া আশাগুলি
কুড়িয়ে তুমি লও গো তুলি…’
শুভ্র ভাই যেন রবি ঠাকুরের উচ্চারিত সেই ‘তুমি’। যে তুমির আবির্ভাবে চারিদিকে উৎসব হয়। শঙ্খ বাজে। আনন্দ-উৎসবে হিড়িক পড়ে চারিধারে। প্রাণশক্তিতে উচ্ছল হয়ে উঠে প্রতিটি প্রাণ। উনি যেন ছোট্টবেলার জাদুর মতোন। উনার চোখ তুলে তাকানো মানেই চারপাশ সবুজ, পৃথিবী সুন্দর। অথচ সেই উনিই আবার আমার সকল বিষণ্ণতায় এক শুভ্র সীলমোহর।
তখন জানুয়ারি মাস৷ মামাণির যত্নের রান্নাঘরে সুয্যি মামার মিষ্টি রোদ্দুর যেন গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছে। আমি কংক্রিটের কেবিনেটের উপর বেশ পদ্মাসনের মতো বসে আছি। কোলের উপর আচারের বয়াম। পরনের লাল পেরে কালো শাড়ির আঁচলটা মেঝের ইঞ্চিখানেক উপরে ঝুলছে। গায়ের ভেতর জ্বর জ্বর কীটগুলো শিরশির করে ছড়িয়ে পড়ছে। মামানি চুলোয় কড়াই চাপিয়ে ডুবো তেলে বেগুন ভাজছেন। আমি আচারের বয়ামটা কোল থেকে নামিয়ে পা ঝুলিয়ে বসলাম। মামাণি আমার নুপুরের শব্দে একপলক পেছনে ফিরে চাইলেন। তারপর আবারও চুলোয় ব্যস্ত হয়ে বললেন,
‘ তোকে আজ খুব অন্যরকম লাগছে রোদু। মনে হচ্ছে, হুট করে বড়ো হয়ে গিয়েছিস। অনেকটা আগেকার দিনের শহুরে নববধূর মতো।’
আমি দুই হাতে শরীরের ভর ছেড়ে মাথাটা সামনের দিকে এগিয়ে পা দোলালাম। অবাক হয়ে বললাম,
‘ শহুরে নববধূ? এটা কী রকম?’
‘ এই যেমন, বিয়ের সপ্তাহখানেক পরই যে সকল বউরা স্বামীর সাথে শহরের আলাদা বাসায় থাকতে আসে। স্বামী অফিসে গেলে হাতে থাকে অপরিসীম অবসর। শরৎ অথবা বিভূতি অথবা ইংরেজি কোনো নভেল হাতে দুপুরের ভাতঘুম দেওয়ার প্রস্তুতি নেয়। তারপর হঠাৎ দরজার ঘণ্টী শুনে বই ফেলে সদ্য ঘুম ভাঙা চোখে ছুটে যায় দরজা খুলবে বলে। এলো শাড়ি, এলো চুল আর ল্যাপ্টানো কাজলের ঠিক সেরকম বধূ বধূ দেখতে লাগছে তোকে।’
আমি আগ্রহ নিয়ে বললাম,
‘ তোমার কথাগুলো কেমন স্বপ্ন স্বপ্ন লাগছে মামানি। মনে হচ্ছে, আমি তেমনই একটা মেয়েকে চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি। তুমিও তো তেমনই শহুরে বধূ ছিলে তাই না?’
মামানি হাসলেন,
‘ তোর মামুর সাথে যখন আমার বিয়ে হয় তখন আমার বয়স অল্প। তোর মামুও তখন ছাত্র মানুষ। সারাদিন বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়ে রাত জেগে বই পড়ে। বুকসেল্ফ বোঝাই হয়ে ঘরের মেঝেতেও স্তুপ করে রাখা বইয়ের জঞ্জাল। তোর মামুর সাথে থাকতে থাকতে আমারও বই পড়ার নেশা লেগে গেলো। আমাদের বিয়ের প্রায় নয় বছর পর শুভ্র হলো। শুভ্র হওয়ার পরও কত কত দিন বইয়ের মধ্যে ডুবে থেকেছি! শুভ্রর এ নিয়ে কী রাগ!’
আমি অবাক হয়ে বললাম,
‘ ওমা! রাগ হবে কেন? উনি নিজেও তো কত বই পড়েন। বই পড়া কী রাগ করার মতো বিষয়?’
মামানি বেগুন ভাজা শেষে কড়াইয়ে মাছ বসালেন। বললেন,
‘ শুভ্রর ধারণা আমি ওর নামটা হুমায়ুন আহমেদের বই পড়ে ঠিক করেছি। আমি আসলে ওকে নয় হুমায়ুন আহমেদের শুভ্র চরিত্রের মতোই শুদ্ধ চরিত্রের পুত্র চেয়েছিলাম। ব্যাপারটা ওর আত্মসম্মানে লেগেছে। ও যখন সিক্সে পড়ে তখন প্রথম শুভ্র সমগ্র পড়লো। খেয়াল করলাম, সেই বই পড়ার পর থেকে ছেলে খুব গম্ভীর হয়ে আছে। কথা-টথা বলছে না। বিশেষ করে আমার সাথে। একদিন ডেকে শুধালাম, তুই কী কোনো কারণে আমার সাথে রাগ করেছিস, বাবু? মন খারাপ? ও কী বললো জানিস?’
আমি আগ্রহ নিয়ে চেয়ে রইলাম,
‘ কী বললো?’
‘ ও চোখ-মুখ ভয়ানক গম্ভীর করে বললো, আমাকে পৃথিবীতে আনার আগে তোমাদের উচিত ছিলো আমার পারমিশন নেওয়া। কেন তোমরা আমাকে না বলে আনলে? আমি কারো প্রক্সি দিতে এখানে থাকতে রাজি নই। আই হ্যাভ সেল্ফরেসপেক্ট। পারমিশন ছাড়া এনেছো। এখন আমাকে ফিরিয়ে দিয়ে আসো। আমি জন্মাতে চাই না।’
মামানির কথায় শব্দ করে হেসে উঠলাম আমি। হাসতে হাসতে চোখের কোণে পানি জমলো। মামানিও স্নেহের হাসি হাসলেন। চোখে-মুখে প্রশ্রয় ঢেলে বললেন,
‘ এতো পাগল আমার ছেলেটা! ওইটুকু বয়সে বলে, আই হ্যাভ সেল্ফরেসপেক্ট! ভাবা যায়?’
আমার হাসি তখনও থামেনি। মামানিও হেসে ফেললেন। হঠাৎ করেই চোখে-মুখে প্রতিফলিত হলো প্রগাঢ় মায়ার ছাপ। মায়া মায়া কণ্ঠে বললেন,
‘ ও তো বুঝে না, ওর মতো সোনার টুকরো পুত্র পেয়ে ওর ইমোশনাল মায়ের কান্নাই থামতে চায় না। এখনও মাঝরাতে ঘুম ভেঙে ছেলের কথা মনে পড়লে হাউমাউ করে কাঁদতে ইচ্ছে হয়। এতো সুন্দর ছেলে বিধাতা আমায় দিলেন, বিশ্বাস হয় না। ছেলের সারা গায়ে চুমুই চুমুই ভরিয়ে দিতে ইচ্ছে করে। এমন সুন্দর ছেলে তো বিধাতা সবাইকে দেন না!’
মামানির কণ্ঠরুদ্ধ হয়ে এলো কান্নায়। আমি পেছনে থেকে মামানির কণ্ঠের কম্পন টের পেয়ে চুপ করে রইলাম। কেবিনেট থেকে নেমে মামানিকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে কাঁধের উপর চিবুক রাখলাম। প্রসঙ্গ পাল্টাতে বললাম,
‘ তোমার এমন সোনার টুকরো ছেলে তো ঠকে গেলো মামানি। বিদ্যাবুদ্ধিতে স্বয়ংসম্পূর্ণ মেয়ে পেতে পারতে তোমার ছেলের জন্য। একেবারে লস প্রজেক্ট।’
মামানির রুদ্ধ কণ্ঠ সহজ হলো এবার। আঙুলের ডগা দিয়ে চোখের কোণা মুছে মৃদু হাসলেন। বামহাতে আমার গাল ছুঁয়ে আদর করে, খুন্তি হাতে ভাজা মাছগুলো উল্টাতে উল্টাতে খানিকটা কৌতুক নিয়েই বললেন,
‘ হয়তো পারতাম। কিন্তু তাহলে আমার ছেলের সংসারটা ভেসে যেতো, বুঝলি? ওর কপালে আর সংসার জুটতো না।’
মামানির ভবিষ্যদ্বাণী শুনে অবাক হলাম আমি। কাঁধের উপর চিবুক রেখেই মাথা হেলিয়ে মামানির মুখ দেখার চেষ্টা করলাম। কৌতূহল নিয়ে বললাম,
‘ কেন? তোমার ছেলের ওমন রাগচটা স্বভাবের জন্য? পিটিয়ে বউ মেরে ফেলার সম্ভবনা আছে নাকি?’
আমার শেষ কথায় ভয়ের ছাপ পড়তেই হেসে ফেললেন মামানি। কোনো রাখঢাক নেই একেবারে কিশোরীদের মতো খিলখিল হাসি। আমি মুগ্ধ চোখে মামানির দিকে চেয়ে রইলাম। হঠাৎ করেই খেয়াল করলাম, শুভ্র ভাইয়ের চেহারার আদলটা একদম মামানির মতোন হয়েছে। মামানির চিবুকেও ছোট্ট একটা তিল আছে। হাসলে দুজনকে কোথাও একটা একইরকম লাগে। মামানি আমার ভয় আর কৌতূহলে শুষ্ক মুখটির দিকে চেয়ে বললেন,
‘ আমার ছেলেকে এতো ভয়ংকর মনে হয় তোর?’
আমি ঠোঁট উল্টালাম। উদাস কণ্ঠে বললাম,
‘ মনে হওয়ার কী আছে? তোমার ছেলে তো সত্যিই একটা আতঙ্ক।’
মামানি ম্লান হাসলেন,
‘ এইজন্যই তো সংসার না টিকার ভয়।’
আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। উদাস কণ্ঠে বললাম,
‘ হুম, কেই-বা এতো সহ্য করবে বলো?’
আমার গম্ভীর গম্ভীর মুখভঙ্গিতে হেসে ফেললেন মামানি। বললেন,
‘ ওরে আমার পাকা বুড়ি! মুখটা এমন গম্ভীর করে রেখেছিস কেন বল তো? আমার ছেলে বুঝি সবার সাথে এমন করে?’
আমি অসহায় কণ্ঠে বললাম,
‘ আমার সাথে তো করে!’
মামানি এবার অর্থপূর্ণ হাসলেন। আমার চিবুক ধরে কপালে স্নেহের চুমু দিয়ে বললেন,
‘ সে-ই তো! কেবল তোর সাথে করে। আবার সহ্যও কিন্তু কম করে না আমার ছেলে! ‘
আমি উত্তর দিলাম না। মামানি হঠাৎ অন্যমনস্ক হয়ে গেলেন। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
‘ সবার মাঝেই কোথাও না কোথাও কিছু কমতি থেকে যায় রোদু। শুভ্রর সবচেয়ে বড়ো কমতি হলো, ও খুব জলদি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। ছেলেবেলা থেকেই এমন স্বভাব। এক বই ও বারবার পড়তে পারে না, বিরক্ত হয়। ওর সবসময় নতুন কিছু চায়। রিপিটেডলি একই খাবার, একই প্রশ্ন ওর পছন্দ না। শুভ্র মানুষের মাঝেও নতুন কিছু খুঁজে। মেয়েটা খুব সুন্দর কিন্তু তারপর? তারপর তো নতুন কিছু হচ্ছে না! ও আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। বিরক্ত হয়ে যায়। শুভ্র যখন স্কুলে পড়ে তখন ওর প্রথম প্রেম হলো। আমাকে মেয়েটার ছবি দেখিয়ে বললো,
”মেয়েটা আমাদের ক্লাসের সবথেকে সুন্দর মেয়ে আম্মু। একবার তাকালে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। আই গ’না প্রপোজ হার।”
আমি কিছুই বললাম না। এক/দুই সপ্তাহ পর এসে জানালো,
” আমি খুব বিরক্ত হচ্ছি আম্মু। আমার আর মেয়েটার দিকে তাকাতে ইচ্ছে করে না। এমন কেন হয়? সৌন্দর্যের পর কিছু নেই কেন? শুধু সৌন্দর্য বোধহয় প্রেমে পড়ার জন্য এনাফ নয়। ব্যাপারটা খুবই ইরিটেটিং!”
ওর জন্য স্কুল জীবনের এই এক্সপেরিয়েন্সটা খুব বাজে ছিলো। মেয়েটা বোধহয় খুব পাগলামো করেছিলো ব্যাপারটা নিয়ে। আমার মেয়েটার জন্য দুঃখ হয়েছিলো, কিন্তু কিছু করার নেই। আমি আমার ছেলেকে খুব ভালো করে জানি। ও কারো কথা শুনে না। ওকে কোনো কিছু নিয়ে ফোর্স করলে ওর জেদ আরও বেড়ে যায়। ভীষণ কঠিন ব্যবহার করে। ওর যা চায় তাই চায়-ই। আর যা চায় না, তা কোনো অবস্থাতেই চায় না। স্কুলের শেষ দিকের এই অভিজ্ঞতা নিয়ে ও এতোই বিতৃষ্ণ ছিলো যে কলেজ জীবন, বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে এসব সম্পর্কের প্রতি আগ্রহই তৈরি করতে পারেনি। আর যদিও বা আগ্রহ করার চেষ্টা করেছে, দেখা গিয়েছে, দুয়েক দিনের মাঝেই চূড়ান্ত বিরক্ত। রেগেমেগে মাথা গরম। একসময় আমি ভেবেছিলাম, ওর বোধহয় জীবনেও কোনো মেয়ে পছন্দ হবে না। হলেও সপ্তাহখানেকের বেশি টিকতে পারবে না। তোর কী ধারণা? এমন একটা ছেলেকে বিদ্যাবুদ্ধিতে স্বয়ংসম্পূর্ণ মেয়ে দেখে বিয়ে দিলেই ওর পছন্দ হতো? দেখা যেতো, দুইদিনের মাথায় অতিষ্ঠ হয়ে বলছে, আম্মু? এই বউ আমার ভালো লাগছে না। এটা বাদ। আমি আর বিয়ে ফিয়ে করবো না।’
শুভ্র ভাইয়ের গল্প শুনতে শুনতে গালে হাত পড়লো আমার। চোখ কপালে তুলে বললাম,
‘ তোমার ছেলে সত্যিই একটা আতঙ্ক!’
মুখের কথাটা কৌতুক করে বললেও বুকের ভেতর গুম হয়ে থাকা দীর্ঘশ্বাসটা সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো গর্জন তুলে আবারও নেতিয়ে পড়লো হৃদয় পাড়ে। অদ্ভুত এক বিষণ্ণতায় ঢেকে গেলো মন। দীর্ঘ ডিপ্রেশনের অশনি ছায়া দুই হাত মেলে আঁকড়ে ধরলো আমায়। হঠাৎ করেই শক্ত হয়ে গেলো মুখের পেশী। রান্নাঘরের সেল্ফের গায়ে ঠেস দিয়ে পাথরের প্রতিমার মতো স্থির দাঁড়িয়ে রইলাম আমি। দৃষ্টি শূন্য। মামানি আমাকে একদম নিশ্চুপ হয়ে যেতে দেখে চোখ ফিরিয়ে আমার দিকে চাইলেন। আমার নিশ্চুপ মুখ দেখে কী বুঝলেন, কে জানে? আগের কথার রেশ ধরে বললেন,
‘ কিন্তু আজ অনেক বছর হলো আমার ছেলের মুখে অভিযোগ শুনি না। আজ ছয় বছর হতে চললো ওকে আমি বিরক্ত হতে দেখি না। উল্টো আগলে রাখতে শিখে গিয়েছে। ধৈর্য ধরতে শিখে গিয়েছে। রাগের জায়গায় অভিমান করতে শিখেছে। ভয় পেতে শিখেছে। এসব ও শিখেছে একা একা। আমি দেখে অবাক হই, আমার রাগচটা, ভীষণ চুজি ছেলে এখন তার রাগ আয়ত্তে আনার চেষ্টা করে। আমি ছাড়াও পৃথিবীর আরও একটি রমণীর মন খারাপকে সে ভয় পায়। পাত্তা দেয়। তার সকল কথা মেনে নেয় বিনাবাক্যে। অসীম ধৈর্য নিয়ে তার প্রতীক্ষা করে। তুই কী জানিস রমণীটা কে?’
আমি উত্তর না দিয়ে শূন্যদৃষ্টিতে মামানির মুখের দিকে চেয়ে রইলাম। দরজায় ঘন্টী বাজছে। মামানি রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে দরজা খুলতে গেলেন। আমি আগের মতোই ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলাম। মামানির বলা রমণী কে, তা আমি নিশ্চয় জানি। কিন্তু মামানি জানলেন না। কেবল মামানি কেন? এই পৃথিবীর দ্বিতীয় কোনো ব্যক্তিই জানলো না ঠিক এই মুহূর্তে আমার সমস্ত পৃথিবীটা কী রকম দোলে উঠলো। মামানির সান্ত্বনাবাণী আমার হৃদয় ছুঁতে পারলো না। কাল বিষণ্ণতায় ছেঁয়ে গেলো মন। হৃদয়টা ভেঙে টুকরো হলো। এমন মানসিক যন্ত্রণা নিয়ে কী বেঁচে থাকা যায়? এরা কেন আমায় একটুখানি শান্তিতে বাঁচতে দেয় না?
ব্যক্তিগতভাবে আমি খুবই নরম মনের নারী। মৃদু বাতাসের দোলাতেও চমকে চমকে উঠি। প্রচণ্ড কষ্ট পেয়ে এলোমেলো হয়ে যাওয়ার এই আজন্ম ভয় সর্বদা সজাগ রাখে আমার শিরা-উপশিরা। ভালোবাসলে কষ্ট পেতে হয় বলে আমি সহজে ভালোবাসতে পারি না। ভালোবাসা পেয়েও না পাওয়া অপমানজনক বলে, আমি কখনো কাউকে পেতে চাই না। নিজেকে মোড়িয়ে রাখার চেষ্টা করি শক্ত এক খোলসে। যে খোলস ভেঙে কেউ আমায় ভেঙে দেওয়ার মতো শক্তি সঞ্চয় করতে পারবে না।
যার ভেঙে যাওয়ার এতো ভয়! হারিয়ে ফেলার এতো ক্লেশ! সেই আমি এমন এক পুরুষের প্রেমে পড়লাম, যার অনুভূতি ভাসমান। তুলোর মতো উড়ে চলে মুগ্ধতা। কী হবে যদি সেই তুলো উড়ে যায় অন্যত্র? অথবা অন্য কোনো আকাশে? সেই অপমান কী সহ্য হবে আমার? অথবা যদি এমন একটা ভোর আসে, যে ভোরে দীর্ঘ স্বপ্নের মতো ভেঙে যায় সকল ঘোর। সকল মায়ার শেকল মিলিয়ে যায় হাওয়ার মতো। বিরক্ত, শুষ্ক, অসহায় মুখখানা তুলে সে বলে,
‘ আমি আর ভালোবাসতে পারছি না। তোমার ভাগের ভালোবাসা ফুরিয়ে গিয়েছে। এবার আমায় ক্ষমা করো। ছেড়ে দাও, প্লিজ।’
ছেড়ে দেওয়া — বড়ো বিষাদময়। আমি কাউকে ছেড়ে দিতে চাই না বলেই আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করি না। আঁকড়ে ধরার পর আঁকড়ে ধরে রাখতে না পারার মতো ব্যর্থতা কী আর কিছুতে আছে? আমি ব্যর্থ হতে চাই না। আমি মন খারাপ করতে চাই না। এই দীর্ঘ বিষণ্ণতা পেরিয়ে মন খারাপ করতে আমার ভয় হয়। এই মন খারাপে কি ভয়ংকর কষ্ট! আমার জীবনটা যদি নাট্যমঞ্চ হয়, আমি চাই শেষ দৃশ্যে আমার ঠোঁটে সুমধুর আনন্দোগান। যদি হয় উপন্যাস, তবে চাই ভীষণ সুখের সমাপ্তি। সাহিত্য মানে বিষাদ হোক। সাহিত্য মানে বিষণ্ণতা হোক। আমি বিষণ্ণতা চাই না। আমার গল্পে আমি আপ্রাণ সুখী হতে চাই। সেই সুখের স্বপ্ন ভেঙে যাওয়ার ভয় আমার আজন্ম। সেই স্বপ্নটা আমি ধীরে ধীরে তুলে দিচ্ছি শুভ্র ভাইয়ের হাতে। যদি সেই স্বপ্নটা হাত ফসকে পড়ে যায়? সেই স্বপ্নের যত্ন করতে করতে হাঁপিয়ে উঠেন শুভ্র ভাই? মনের ভেতর হাজারও প্রশ্ন নিয়ে অন্যমনস্ক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম আমি। আমার ভাবনার মাঝেই নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন শুভ্র ভাই। বেরিয়ে এসেই এদিক-ওদিক উঁকি দিয়ে বসার ঘরের মাঝ বরাবর দাঁড়ালেন। আমি তখন অন্যমনস্ক হয়ে মামানির অর্ধেক কেটে ফেলে রাখা সবজি কাটছিলাম। শুভ্র ভাই আমাকে রান্না ঘরে দেখেই চোখ-মুখ পাথরের মতো গম্ভীর করে ফেললেন। গম্ভীর স্বরে ডাকলেন,
‘ এই রোদ? এদিকে আয়।’
আমি বিরক্ত চোখে চাইলাম। উদাস কণ্ঠে বললাম,
‘ আমি এখানে কাজ করছি শুভ্র ভাই। এখন যেতে পারবো না।’
শুভ্র ভাই ভয়ানক আশ্চর্য হয়ে বললেন,
‘ ফট করে বলে ফেললি পারবো না! তোর কথা শুনে মনে হচ্ছে, আমি এই পৃথিবীর অতি তুচ্ছ প্রাণী। এই ধরণীতে আমার কথার কোনো দাম নেই। শুধু দাম আছে তোর আর তোর বাপের। এই পৃথিবীতে তোরাই রাজা, মহারাজা। আমরা কীটপতঙ্গ। বুঝলাম শেরপুরের মানুষ, তাই বলে কোনো সিভিলাইজেশ্যন থাকবে না? আশ্চর্য!’
আমি চোখ গরম করে চাইলাম। চাকুটা কেভিনেটের উপর শব্দ করে রেখে দাঁতে দাঁত চেপে বললাম,
‘ কথায় কথায় বাবা আর আমার শহর টেনে আনবেন না, শুভ্র ভাই। আপনারা তো একদম সিভিলাইজেশ্যনের পাহাড় কাঁধে নিয়ে বসে আছেন। কোনো সিভিলাইজড মানুষ অযথা দাঁড়িয়ে থেকে অন্যকে হুকুম দেয় না। আপনার দরকার আপনি কাছে আসুন! আমাকে ডাকছেন কেন?’
শুভ্র ভাই এবার এমন একটা ভাব করলেন যেন এহেন আতঙ্কের কথা তিনি তার এই ছাব্বিশ বছরের জীবনে শোনেননি। তিনি এখনই আতঙ্কে নীল হয়ে হার্ট ফেল পর্যন্ত ঘটিয়ে ফেলতে পারেন। গলার স্বর নামিয়ে বললেন,
‘ এখন সময়, দুপুর একটা বেজে বিশ মিনিট ঊনত্রিশ সেকেন্ড। তুই এই দিনে-দুপুরে এমন চিৎকার করে কেন আমার নাম খারাপ করছিস? আমি একবারও তোকে কাছে আসতে বলেছি? আমি বলেছি, এদিকে আয়। ময়মনসিংহ থেকে জাপান পর্যন্ত প্রত্যেকটা মানুষ জানে শুভ্র খুবই ভালো ছেলে। তুই এমন চিৎকার চেঁচামেচি করে কী প্রমাণ করতে চাস? তোর গলার যে সাউন্ড! উইদআউট মাউথস্পিকার পুরো ময়মনসিংহবাসী জেনে যাবে। এখন যদি আমার বিয়েশাদি না হয়?’
আমি হতাশ চোখে এই আজাইরা কথা বলা পুরুষ মানুষের দিকে চেয়ে রইলাম। বিষণ্ণ মন নিয়ে আর কথা বাড়ানোর শক্তি হলো না। রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসে শান্ত কণ্ঠে বললাম,
‘ আমার গলার সাউন্ডের জন্য আমি বিশেষভাবে দুঃখিত শুভ্র ভাই। আপনি এখন দয়া করে বলুন, আপনি আমায় কেন ডেকেছেন?’
শুভ্র ভাই কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলেন। উনার চেহারার রঙ পাল্টালো। চোখে-মুখে স্পষ্ট দ্বিধা। টি-শার্টের কলার ঠিক করে কিছুটা অপ্রস্তুত কণ্ঠেই শুধালেন,
‘ তুই ঘন্টা কয়েক আগে আমার ঘরে গিয়েছিলি?’
অবশ্যই আমি গিয়েছিলাম। নষ্ট মাথায় অত্যন্ত লজ্জাজনক কাজও করেছি। কিন্তু সে কথা বলে নিজের লজ্জা বাড়ানোর পক্ষপাতী আমি নই। তাছাড়া, ক্ষণকাল আগের আলোচনা আমার শরীরের প্রতিটি গাঁটে গাঁটে ছড়িয়ে দিচ্ছে অদ্ভুত এক দ্বিধা। শুভ্র ভাইকে কী করে বুঝাবো সেই দ্বিধার কথা? উনার কাছে যাওয়া যে কেমন ভয়ঙ্কর সর্বনাশ তা কী উনি জানেন? আজ ভালোবাসছেন কালও যে ভালোবাসাটা এরকমই থাকবে তারই-বা কী নিশ্চয়তা? আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। শুভ্র ভাইয়ের অনুভূতিকে সন্দেহ করা উনার গালে জনসম্মুখে চপেটাঘাতের থেকেও অপমানজনক বলে বোধ হলো। বাবার পর সব থেকে বেশি শ্রদ্ধা করা মানুষটিকে এমন অপমানজনক অপবাদ দিয়ে বুকের ভেতরটা হাহাকার করে উঠলো অসহায়ত্বে। অনুভূতি ও মস্তিষ্কের এই নিষ্ঠুর টানাপোড়েনে শক্ত হয়ে গেলো আমার চাহনি। অপ্রত্যাশিত কঠিন কণ্ঠে শুধালাম,
‘ আমি কেন আপনার ঘরে যাবো, শুভ্র ভাই?’
শুভ্র ভাই থমকালেন। আমার কঠিন মুখের দিকে অবাক চোখে চেয়ে রইলেন। শিশুদের মতো অভিমানী মুখটাতে আষাঢ়ে মেঘ দেখা গেলো। তারপর ধীরে ধীরে কঠিন হয়ে উঠলো চোয়াল,
‘ এমন একটা ভাব করছিস যেন আমার ঘর ভয়াবহ বিশ্রী জায়গা। ওখানে কেউ যায় না। কোনো মানুষ থাকে না, ছাগল থাকে। আর আমি হলাম রামছাগল।’
আমি প্রত্যুত্তরে কঠিন চোখে চেয়ে রইলাম। আমার এই কঠিন চেহারা আত্মসম্মান সচেতন শুভ্র ভাইকে ভয়ানক এক ধাক্কা দিলো। উনি আর একটা কথাও বললেন না। প্রচণ্ড জেদে বসার ঘরের টি-টেবিলে লাথি কষলেন। বেচারা টেবিল লাথি সহ্য করতে না পেরে পিঠের উপর থাকা কাচের ফুলদানিটা ফেলে দিলো মেঝেতে। ঝনঝন শব্দ তুলে ভেঙে গেলো কাচের জার। আমি এক কানে হাত চেপে চোখ বন্ধ করলাম। শুভ্র ভাইয়ের এসব নিয়ে কোনো ভাবাবেগই হলো না। বাড়িতে এক প্রকার একটা ঘূর্ণিঝড় তুলে ফেলে শান্ত হলেন। ঠিক শান্ত না চোখ-মুখ ফুলিয়ে গম্ভীর হয়ে রইলেন। মামানি ছেলের হঠাৎ এমন মেজাজের কারণ ধরতে না পেরে হতভম্ব চোখে চেয়ে রইলেন। চিন্তিত কণ্ঠে শুধালেন,
‘ ওর হঠাৎ কী হলো বল তো? এতো চটে আছে কেন?’
আমি কী উত্তর দিবো বুঝে না পেয়ে চুপ করে রইলাম। শুভ্র ভাই চোখ-মুখ শক্ত করে খাবার টেবিলে রাখা জগ থেকে পানি ঢেলে খেলেন। তারপর পানির জারটাকেও ছুঁড়ে ফেললেন প্রচণ্ড জেদে। পানির জার ভাঙার ঝনঝন শব্দের পর একেবারে নিস্তব্ধ হয়ে গেলো পরিবেশ। প্রতিটি দেওয়ালে দেওয়ালেও থমথমে ভয়। আমি রান্নাঘর থেকে উঁকি দিতেই চোখে পড়লো তার সুশ্রী মুখ। রাগে লাল হয়ে আছে ফর্সা চামড়া৷ মুখের উপর পড়েছে শিশুসুলভ অভিমানের ছায়া। আমি মুগ্ধ চোখে সেদিকে চেয়ে রইলাম। কী আশ্চর্য সুন্দর উনার দুটো চোখ। আমার বুক ভর্তি বিষণ্ণতার হাওয়া ছুটলো, এই অসহ্য সুন্দর মানুষটার গা ভর্তি এতো রাগ কেন? এতো জেদ! এতো বেপরোয়া মানুষটা! আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। পরিবেশটা হালকা করতে গলার স্বর নিচু করে বললাম,
‘ মামানি? এই আগুন গরম মেজাজটাকে সাইডে রাখলে, রূপের আগুনেও কিন্তু তোমার ছেলে সেই! মেয়ে হলে বিশ্ব সুন্দরীর এ্যাওয়ার্ড জিতে যেতে পারতো। আর তুমি হতে বিশ্ব সুন্দরীর মা জননী।’
মামানি হেসে ফেললেন। ফিসফিস করে বললেন,
‘ আর তুই?’
আমিও হাসলাম। ফাজলামো করে বললাম,
‘ তবে আমি অবশ্যই বখাটে হতাম। তোমার অগোচরে সুন্দরী মামাতো বোনকে ডিস্টার্ব করতাম। আসতে-যেতে ডাকতাম। হাত টেনে ধরে বলতাম, এই সুন্দরীইই? কাছে আসো, কথা বলি। আর শুভ্র ভাই চোখ-মুখ লাল করে বলতো, আম্মুকে বলবো কিন্তু? অসভ্য!’
মামানি এবারে শব্দ করে হেসে উঠলেন। হাসতে হাসতে উনার চোখে পানি এসে গেলো। মামানির হাসি দেখে হেসে ফেললাম আমিও। দু’জনকেই এমন খিলখিল করে হাসতে দেখে শুভ্র ভাইয়ের চটে যাওয়া মেজাজ আরও চটে গেলো। দু’জন শেরপুর নিবাসী নগণ্য রমণী তার মতো মহান ব্যক্তির রাগকে পাত্তা দিচ্ছে না! মেনে নেওয়া যায়? শুভ্র ভাই মেনে নিলেন না। যাত্রা পথের মাঝে নিতান্ত দুর্ভাগার মতো পড়ে থাকা টি-টেবিলটাকে আবারও লাথি কষলেন। টেবিলটা এবার দাঁড়িয়ে থাকার শক্তি হারালো। উল্টে পড়ে ভেঙে গেলো টি-টেবিলের গায়ের কাচের জমিন। টেবিল উল্টানোর তীব্র শব্দে আবারও থমথমে হয়ে গেলো পরিবেশ। মামানি হতভম্ব চোখে ছেলের দিকে চেয়ে থেকে ধমকে উঠলেন,
‘ কী হচ্ছেটা কী শুভ্র? ঘরের জিনিসপত্রের প্রতি মায়া লাগে না? বয়স বাড়ছে নাকি কমছে? এসব কোন ধরনের আচরণ?’
শুভ্র ভাই মামানির কথাকে দুই আনা পাত্তাও দিলেন না। নিজের ঘরের দোর দেওয়ার আগে বেপরোয়া কণ্ঠে বললেন,
‘ তোমার জিনিসপত্রের জন্য আমি হাঁটাচলা বন্ধ করে দেবো? পা গুটিয়ে বসে থাকবো? রাখো কেনো এগুলো আমার পায়ের কাছে? আমার পায়ের কাছে যা পড়বে তা তাদের দুর্ভাগ্য। যেমন দুর্ভাগ্য তোমার পাশের জনের। দ্বিতীয়বার আমার সামনে আসলেই ধরে চারতলা থেকে ফেলে দেবো। আমার সাথে ফাইজলামো!’
শুভ্র ভাইয়ের ধমকে বহুদিন পর বাস্তবিক অর্থেই ভয় পেলাম আমি। কণ্ঠ শুকিয়ে এলো। এই তাহলে তার রাগ নিয়ন্ত্রণের নমুনা? রাগ নিয়ন্ত্রণই যদি এমন হয় তাহলে রাগ করলে কী করবে? চার চারে ষোল তলা থেকে ফেলে দিতে চাইবে? ইয়া মা’বুদ, আমার জীবনে কোনো শান্তি নেই কেন? বাবা আমাকে দেখে দেখে এমন ভয়ংকর ছেলের সাথে বিয়ে দিতে রাজি হলো কী করে? আমি নাহয় বাচ্চা। বুঝিনা। প্রেমে পড়ে গিয়েছি। তাই বলে বাবাও এতো বড়ো ভুল করবে? এই লোক তো আমাকে দিনে দশবার করে খুন করে ফেলবে আর বলবে,
‘ সরি রোদপাখি। রেগে গিয়ে খুন করে ফেলেছি, মন খারাপ করো না।’
কলিজার উপর বসে থাকা স্বৈরাচারী রোদু মুখ বাঁকিয়ে বললো,
‘ এহ! শখ কতো! কোনোদিন সরি বলেছিলো এমন ভদ্রভাবে? খুন হয়ে গেছিস তো হয়ে গেছিস আবার সরি বলবে কোন দুঃখে। উপরন্তু বস্তায় ভরে চার তলা থেকে ফেলে দিয়ে বলবে, টাটা।’
স্বৈরাচারী রোদুর কথায় আমি বড়ো অসহায়বোধ করলাম। আমার অসহায়বোধ বাড়িয়ে দিতেই বোধহয় শুভ্র ভাই আরও একটা বেয়াদব মার্কা কাজ করলেন। উনার দরজার পাশে যে বিশাল ফুলের জার ছিলো সেটাকেও এক লাথিতে উল্টে দিয়ে দুনিয়া কাঁপিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলেন। কাচের জারটা ভেঙে টুকরো হলো। মামানি হতাশ চোখে ছেলের দরজার দিকে চেয়ে রইলেন। এতো এতো শব্দে মামু পর্যন্ত ঘর থেকে বেরিয়ে এসে আশ্চর্য হয়ে শুধালেন,
‘ কী ব্যাপার? কী হয়েছে?’
আমি অসহায় মুখে দাঁড়িয়ে রইলাম। মামানি এগিয়ে গিয়ে কাচের টুকরোগুলো জড়ো করতে করতে জবাব দিলেন,
‘ তোমার ছেলের রাগ হয়েছে।’
মামু অবাক হয়ে বললেন,
‘ কেন?’
মামানি গম্ভীর কণ্ঠ এবার থমথমে হলো। ছেলেকে কিছু বলতে না পেরে মামুর উপর চড়াও হলেন। মামুর দিকে চেয়ে ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললেন,
‘ কেন, সেটা আমাকে জিজ্ঞেস করছো কেন? তোমাদের বংশের স্বভাব তুমি জানো না? তোমার ছেলের রাগ করার জন্য কারণ লাগে? আমার স্বভাব তো এমন না। এমন জল্লাদ ছেলে তো আমার পেটে আসার কথা না। এমন বেলেহাজ স্বভাব তোমার বংশের। বাপের বংশই যদি এমন হয় ছেলে তো এমন হবেই। ওর এই রাগের জন্যই ওর সংসার টিকবে না, দেখো। বিয়ের দু’দিনের মাথায় বউ ভেগে যাবে।’
অত্যন্ত বাজে কথা। বাজে কথা শুনে অপ্রস্তুত হতে হয়। আমি আর মামু দু’জনেই যথেষ্ট অপ্রস্তুত হলাম। আমিই সেই ভবিষ্যৎ ভেগে যাওয়া বউ বলেই হয়তো মামু বড়ো অসহায় চোখে আমার দিকে চাইলেন। ভাগ্নীর ভবিষ্যৎ ভেবে তিনি ব্যথিত নাকি ছেলের ভবিষ্যৎ ভেবে আতঙ্কিত বুঝা গেলো না। ভাঁজ করা খবরের কাগজ হাতে গম্ভীর মুখে আবারও শোবার ঘরে ঢুকে গেলেন।
ঘড়ির কাটায় দুপুর নামতেই যাবতীয় আত্মীয়-স্বজনে ভরে গেলো মামুর বসার ঘর। কিন্তু শুভ্র ভাই অপারগ। কেবল একবার বেরিয়ে এসে সকলের সাথে কুশলাদি বিনিময় করে নিজের অসুস্থতার কথা জানিয়ে আবারও ঘরে দোর দিলেন। এমনকি দুপুরে খেতে পর্যন্ত বেরুলেন না। মামানি কয়েকবার চিন্তিতমুখে ছেলের বন্ধ দরজার দিকে তাকালেন কিন্তু একটিবারের জন্যও খেতে ডাকলেন না। আমিও বার দুয়েক দুশ্চিন্তা নিয়ে দরজার দিকে চাইলাম। এতো মানুষের ভীড়ে কী করে যাবো আমি উনার ঘরের দিকে? ফুপ্পি, চাচি কারো চোখে পড়লে কী রকম বিদঘুটে দেখাবে ব্যাপারটা? তাছাড়া বাবা-মায়ের চোখে পড়লেও খুবই অস্বস্তির ব্যাপার হবে। সেই আকস্মিক বিয়ের ঘটনাটা ঘটার পর থেকে মামুদের প্রতি বাবার মন খানিকটা ভার। শুভ্র ভাইয়ের প্রতিও যে তিনি খানিক অসন্তুষ্ট তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। স্বাভাবিকভাবেই আমার মানসিক অসুস্থতার জন্য, আমার সকল অবাধ্যতার জন্য, আমার বদলে যাওয়ার জন্য বাবা খুব সূক্ষ্মভাবে ‘অমতে দেওয়া বিয়েটাকে’ই দায়ী করেন। নেহাৎ বাবা ধার্মিক ব্যক্তি নয়তো তিনি বিয়েটাকে খারিজ করে দিতে পারলেই সন্তুষ্ট হতেন বলে বোধ হয়। তাঁর মনোবাসনা অনেকটা সেরকমই। সুতরাং, আজকাল আমার মামুর বাড়ি আসাটাও তাঁর বিশেষ পছন্দ নয়। আমার কেমন অসহায় লাগলো এবার। এতো জ্বালা-যন্ত্রণা আমার জীবনেই কেন? কেন!
আমার সৌখিন গোষ্ঠী দুপুরের দাওয়াত খেতে এসে রাতের খাবারটা পর্যন্ত গিলে গেলো। বলা বাহুল্য শুভ্র ভাই রাতের খাবার খেতেও বেরুলেন না। চিন্তায় চিন্তায় আমার তখন মরে যাওয়ার জোগাড়। এক পর্যায়ে মামানিকে বলেই ফেললাম,
‘ শুভ্র ভাই খাবে না মামানি? সকাল থেকে না খেয়ে আছেন।’
মামানি ম্লান হেসে বললেন,
‘ একদিন না খেলে মরে যাবে না।’
আমি করুণ চোখে মামানির দিকে চেয়ে রইলাম। এ কেমন কথা হলো? মামানিও কী আমার উপর রাগ করে বসে আছেন? এই পৃথিবীর সকলেই কেবল আমার উপরই রাগ করে কেনো?
এদিকে বাড়ি ফেরার সময় ঘনিয়ে এসেছে৷ শুভ্র ভাই বাসায় আছেন সুতরাং মামুর বাসায় থাকার আবদার করাও আমার জন্য অলিখিতভাবে নিষিদ্ধ। আমি অসহায় চোখে একবার শুভ্র ভাইয়ের বন্ধ দরজার দিকে চাইলাম। চোখের সামনে ভেসে উঠলো উনার শুষ্ক, ফ্যাকাশে মুখ। কী দরকার ছিলো আজই এমন একটা সিনক্রিয়েট করার? মামানি ঠিকই বলেছেন, আমিও উনাকে স্বস্তি দিই না এক মুহূর্ত। এতোদিন পর দেশে এসেছেন, কোথায় একটু হাসিখুশি থাকবেন। মায়ের হাতের খাবার খাবেন! তা না, কী থেকে কী হয়ে গেলো! বুকের ভেতর চাপা অপরাধবোধ নিয়ে বাসায় ফিরলাম আমি। বাসায় ফিরেই তিন ফুপা, চাচ্চু আর বাবা টেলিভিশন ছেড়ে খবর দেখতে বসলেন। টেলিভিশনে তখন দুই রাজনৈতিক নেতার টক শো চলছে। ফুপ্পি, চাচিরাও ডাইনিং টেবিলে বসে গল্প জুড়েছেন। পাশের ঘরে কাজিন মহলের হৈ-হুল্লোড়। কেবল আমার মন খারাপ৷ অসহ্য লাগছে সব কোলাহল। আম্মু বাবা-চাচাদের চা দিতে এসে বললেন,
‘ কাল কিছু আতপ চাল গুঁড়ো করে এনে দিও তো? শুভ্র নাকি সাত তারিখেই চলে যাবে। একমাত্র ভাতিজা আমার অথচ কিচ্ছু দিতে পারি না। ডেকে এনে যে দুটো ভালোমন্দ খাওয়াবো সেই সুযোগও নেই। দুটো দিন শান্তিতে থাকতে পারলো না ছেলেটা। এতো টাকা খরচ করে এক সপ্তাহের ছুটিও হাতে না নিয়ে কেউ আসে?’
ছোট ফুপ্পি আফসোস করে বললেন,
‘ আজকে তো পাঁচ তারিখ চলেই গেলো। দুটো দিনের জন্য এসে ছেলেটা আরও রেনু ভাবির মন উতলা করে দিয়ে গেলো। ছেলের জন্য তো এখন আরও বেশি খারাপ লাগবে।’
আমি বসার ঘরের বারান্দা থেকে নিজের ঘরের দিকে যাচ্ছিলাম। আম্মুর কথাটা শুনে সেখানেই স্তব্ধ হয়ে গেলো পা। শুভ্র ভাই পরশু দিন চলে যাচ্ছেন? এতো তাড়াতাড়ি? অথচ আমি কিছু জানি না, আশ্চর্য! আগামীকালের পর এই ময়মনসিংহ শহরে অথবা এই দেশীয় গন্ডীর কোথাও তার স্পর্শ, তার কণ্ঠ, তার সুবাস থাকবে না ভাবতেই হাহাকার করে উঠলো বুক। আমি অনুভূতিশূন্য পুতুলের মতো নিজের ঘরে গেলাম। মুখখানা প্রস্তরের ন্যায় কঠিন। অথচ বুকের ভেতর বুঝতে পারছি এই প্রস্তরের নিচে কত কত কথা। বুকের ভেতরটা কী রকম শুকিয়ে যাচ্ছে তৃষ্ণায়। পাশের ঘর থেকে ভেসে আসা ভাই-বোনদের হৈ-চৈ, বড়দের গল্পের মহল সবই কেমন ঝাপসা ঠেকছে কানে। সবকিছু ছাপিয়ে চোখের সামনে ভেসে উঠছে শুভ্র ভাইয়ের শুষ্ক, বিষণ্ণ মুখ। আমি সব সময়ই ভেবেছি, শুভ্র ভাই মাত্রই প্রানবন্ত, প্রফুল্ল। এই পৃথিবীর কোনো মন খারাপ তাকে স্পর্শ করতে পারে না। শুভ্র ভাইয়ের কক্ষনো মন খারাপ হয় না। আসলেই কী তাই? মানুষ হয়ে জন্মানোর পরও কী মন খারাপ থেকে রেহাই পাওয়া যায়? তবে আমার কেন মনে হচ্ছে, আজ তার প্রচণ্ড মন খারাপ? আমার সমস্ত বিষণ্ণতা থেকেও প্রকাণ্ড এক মন খারাপ নিয়ে উনি ঘুরে বেড়ান। হাসেন। ছুটে চলেন। সবাই তো চায় তার প্রিয় মানুষ হালকা করে দিক তার মন খারাপের বোঝা। দিনশেষে একটু হাসুক। বুঝুক। অথচ….! আমার চিন্তারা এলোমেলো হয়ে এলো। আমার বিশ বছরের জীবনে এই প্রথম আমি নিজের মন খারাপ ভুলে অন্য আরেকজনের মন খারাপ নিয়ে ভাবলাম। আর ভাবতে ভাবতেই বুঝলাম, প্রিয় কারো মন খারাপের কারণ হওয়ার কাছে পৃথিবীর সকল যন্ত্রণা শিশুতুল্য। আমি বিছানায় বসে পাথরের মতো চেয়ে রইলাম ঘড়ির কাটার দিকে। সেকেন্ডের কাটার সাথে সাথে কাঁপছে আমার হাত-পা। সময়টা কী আজ খুব দ্রুত ছুটছে? শুভ্র ভাই কী সত্যি সত্যি পরশু চলে যাবেন? উনি রাতে খেয়েছেন? জাপানে নিশ্চয় খাওয়া নিয়ে খুব কষ্ট হয়, উনার উচিত না এই দুইদিন মামানির হাতে মন ভরে খাওয়া-দাওয়া করা? আচ্ছা, উনার কী খুব বেশি মন খারাপ? আমার কণ্ঠ শুকিয়ে আসছে। কোনো এক অদ্ভুত কারণে ভীষণ কান্না পাচ্ছে। মামানি কেন একবার আমায় ফোন দিচ্ছেন না? সবাই কেন রেগে আছে আমার ওপর? আমি দুইহাতে মুখ ঢেকে শান্ত হয়ে বসে রইলাম। এই হৈ-হুল্লোড়ে ভরা বাড়ির কেউ বুঝলো না ঠিক তাদের পাশেই কত বড়ো এক ভূমিকম্প হচ্ছে। কেঁপে উঠছে অনুভূতির পাহাড়। এই ভূমিকম্পের কথা আমি কাকে বলবো? আমার তো তেমন কোনো বন্ধু নেই। আমি তো নিজের কথা কাউকে বলতে পারি না। আমার ভাবনার মাঝেই ঘরে এলো আপু। চঞ্চল কণ্ঠে বললো,
‘ এই রোদু গুদগুদু? এভাবে বসে আছিস কেন? চল, চল ও ঘরে চল।’
আমি চোখ তুলে আপুর দিকে চাইতে পারলাম না। মনে হলো, চোখ তুলে চাইলেই কেঁদে ফেলবো আমি। আপু বুঝে ফেলবে, এ বড়ো লজ্জার ব্যাপার। আমি মুখ ঢেকেই বললাম,
‘ মাথাটা খুব ব্যথা করছে আপু। জ্বরটা বোধহয় বাড়বে। আলোটা নিভিয়ে দিয়ে যাও তো।’
আপু আমার দিকে চেয়ে করুণ কণ্ঠে শুধালো,
‘ তোর কী বেশি খারাপ লাগছে?’
আমার কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে এলো কান্নায়। মাথা নেড়ে কোনোরকমে বললাম,
‘ বুঝতে পারছি না। আলোটা নিভিয়ে দিয়ে যাও।’
আপু ক্ষণকাল আমার দিকে চেয়ে থেকে আলো নিভিয়ে নিঃশব্দে বেরিয়ে গেলো। আমি মাথা তুলে আবারও চেয়ে রইলাম ঘড়ির কাটায়। সেকেন্ড গেলো, মিনিট গেলো, ঘন্টা পেরুলো। অচেনা এক ভয়ে ঠাণ্ডা হয়ে এলো আমার হাত-পা। পার্স থেকে শুভ্র ভাইয়ের দেওয়া আংটিটা বের করে হাতের মুঠোয় পুরে বসে রইলাম। আবছা অন্ধকারে ঝলমল করে উঠলো সোনালি অঙ্গুরির উপর সফেদ পাথরগুলি। এটা যে সোনার আংটি এই তথ্যটাও আমি জেনেছি অনেক অনেকদিন পর। নীলাপু আমার হাতে আংটিটা দেখেই মুগ্ধ হয়ে শুধিয়েছিলেন,
‘ কত ভরি দিয়ে বানিয়েছো এই আংটি? কী সুন্দর!’
আমি অবাক হয়ে চেয়ে ছিলাম শুধু। জিজ্ঞেসও করতে পারছিলাম না, ‘ এইটা সোনার! শুভ্র ভাই তো কিছু বললেন না!’ ভয়, আতঙ্ক আর উত্তেজনায় ছটফট প্রাণ নিয়ে শেষমেশ শুভ্র ভাইকে টেলিফোন করলাম আমি। পরিণতি জানা ছিলো, শুভ্র ভাই ফোন ধরবেন না। আমার ভাবনাকে আরও এক ধাপ এগিয়ে দিয়ে শুভ্র ভাইয়ের ফোনে কলই ঢুকলো না। আমার অস্থিরতা আরও বাড়লো এবার। বারবার মনে হচ্ছিলো, শুভ্র ভাইয়ের সাথে বোধহয় আর দেখা হবে না আমার। আগের বারের মতোই এক বুক অভিমান নিয়ে দীর্ঘস্থায়ী এক বিচ্ছেদ হবে। আবারও আমার পৃথিবী ফ্যাকাশে হবে। তারপর অসহ্য যন্ত্রণা, ব্যর্থতা আর ডিপ্রেশন! ডিপ্রেশন! ডিপ্রেশন! আমি বিছানা থেকে উঠে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম। মানসিক টানাপোড়েনের এক পর্যায়ে ভয়াবহ এক সিদ্ধান্ত নিয়ে বসলাম। সময় জ্ঞান ভুলে মামানির নাম্বারে তৎক্ষনাৎ কল করলাম। মামানি ফোন তুলেই অবাক হয়ে শুধালেন,
‘ এতো রাতে ফোন দিলি যে! ঠিক আছিস রোদু?’
আমি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে নিজের সিদ্ধান্ত জানালাম,
‘ আমি ফোন দিলে তুমি একটু নিচে এসে তোমাদের বাসার গেটটা খুলে দিতে পারবে মামানি? আমি তোমাদের বাসায় যাবো।’
মামানি অবাক হয়ে বললেন,
‘ সকাল ছয়টার পর থেকেই তো গেট খোলা থাকে। আমার খুলে দিতে হবে কেন?’
‘ সকালে নয়। আমি এখনই যাবো।’
‘ এখন!’
‘ ঠিক এখন নয়। আরেকটু পর। সবাই ঘুমিয়ে গেলে কোনোভাবে বেরিয়ে যাবো।’
মামানি হঠাৎ কোনো উত্তর দিতে পারলেন না। কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে আচমকা ধমকে উঠলেন,
‘ থাপ্পড় দিয়ে গাল ফাটিয়ে ফেলবো বেয়াদব মেয়ে। খুব সাহস হয়েছে না? কয়টা বাজে জানিস? এই মাঝরাতে একা একটা মেয়ে মানুষ বাড়ি থেকে পালিয়ে আমার বাসায় আসবে। বাড়ির কেউ দেখলে কী হবে ধারণা আছে? তার থেকেও বড়ো কথা এতো রাতে একা রাস্তায় বেরুনোর সাহস কী করে পাস তুই? বেশি আদর দিয়ে এই অবস্থা।’
মামানির থেকে সব সময় প্রশ্রয় পেতে পেতে হঠাৎ এমন ব্যবহারে চমকে উঠলাম আমি। খুব অভিমান হলো। তার থেকেও বেশি হলাম অপমানিত। নিস্তেজ কণ্ঠে বললাম,
‘ সরি।’
মামানি কিছু বলার আগেই ফোন কাটলাম। নিজের এই অধঃপতনে নিজের প্রতিই বিরক্ত হলাম। হাতের ফোনটা মেঝেতে ছুঁড়ে মারতে গিয়েও সামলে নিলাম। নিজের গালে দুই একটা চড় আর দেওয়ালে ডজনখানেক লাথি দিয়ে বারান্দার দেওয়াল ঘেঁষে বসে পড়লাম। আমার আত্মঘাতী মস্তিষ্ক ও সুস্থ মস্তিষ্ক দুইয়ের মাঝে ভয়াবহ এক যুদ্ধ চললো। সেই যুদ্ধের মাঝেই ফোন করলেন মামানি। আমি ফোন উঠালাম৷ একদম স্বাভাবিক কণ্ঠে বললাম,
‘ বলো মামানি।’
মামানি নরম কণ্ঠে বললেন,
‘ মামানির কথায় কষ্ট পেয়েছিস মা? সরি সোনা। মামানির চিন্তা হচ্ছিলো তাই ওমন ধমক দিয়ে ফেলেছি। যার বাচ্চাগুলো এতো পাগল তার ধমক না দিয়ে উপায় আছে?’
আমি প্রত্ত্যুত্তরে চুপ করে রইলাম। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম,
‘ কষ্ট পাইনি মামানি। আমার এখন কথা বলতে ভালো লাগছে না। সকালে কথা বলি?’
মামানি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
‘ তোরা এমন পাগলামো করলে আমি কীভাবে সামলাই বল তো? আমার ছেলেটা সারাটাদিন ধরে কিছু খাচ্ছে না। দরজা খুলছে না। কারো সাথে একটা কথা পর্যন্ত বলছে না। অথচ পরশুদিন তার যাওয়ার টিকেট। আমার কী মন খারাপ হয় না?’
শেষ কথাটা বলতে গিয়ে না চাইতেও রুদ্ধ হয়ে এলো মামানির কণ্ঠস্বর। চারপাশের সকলের এতো এতো কষ্টের কারণ কেবল আমি ভেবেই দমবন্ধ হয়ে এলো। ফিসফিস কণ্ঠে বললাম,
‘ সরি মামানি। তোমাদের সকলের জীবনে একেবারে ভুল করে ঢুকে পড়েছি আমি। এই ভুলটা কী করে শুধরাই বলো তো? তুমি তো সব জানতে তবু এমন একটা বিষ আমায় কেন দিলে? যে বিষ না খেলে দমবন্ধ হয়ে আসে। আর খেয়ে ফেলেও বাঁচা মুশকিল!’
আমার কণ্ঠে এমন ধরনের কথা শুনে হতবাক হয়ে গেলেন মামানি। ব্যস্ত হয়ে বললেন,
‘ দেখো মেয়ের অবস্থা, কাঁদছিস নাকি? আমার ছেলে খুব জ্বালাচ্ছে, না? এদের বংশটাই এমন বুঝলি? এমন একটা লক্ষ্মীমন্ত বউ পাওয়া ওর সাত কপালের ভাগ্য, কোথায় মাথায় তুলে রাখবে। তা না.. এতো জ্বালা-যন্ত্রণা! ওকে আমি ঝাড়ু পেটা করে তোর কাছে পাঠাচ্ছি। কান্নাকাটি, মন খারাপ যা করার ওর সামনে কর। দেখবি ফাইজলামি ছুটে সব একদম স্টিলের মতো সোজা হয়ে গিয়েছে। আর যায় হোক, আমার ছেলে আবার বউয়ের কান্নাকাটি সহ্য করতে পারে না। এটাও এদের বংশের ধারা। কান্নাকাটিই হলো এদের বংশের বউদের সবচেয়ে বড়ো অস্ত্র। নয়তো উপায় নাই।’
মামানির কথার ধরনে হেসে ফেললাম আমি। মামানি কণ্ঠে স্নেহ ঢেলে বললেন,
‘ আমি শুভ্রকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে পাঠাচ্ছি। সব ঠিক করে নিস। মান-অভিমান বেশিদিন ধরে রাখতে নেই মা।’
তারপর একটু থেমে বললেন,
‘ ও তোকে খুব জ্বালায়, জানি। কী যে অত্যাচারী ছেলে পেটে ধরেছি! তবু মা তো, একটা মাত্র ছেলে আমার। ওর শুকনো মুখ দেখলে আত্মাটা কেঁপে উঠে। ওকে খুব বেশি কষ্ট দিস না সোনা। তোর কিচ্ছু করতে হবে না, ওর দিকে চেয়ে একটু হাসিস। তুই ওর দিকে তাকিয়ে একটু হাসলেই খুশি হয়ে যায় ও। আমার অত্যাচারী ছেলেটা হাসিমুখে দেশটা ছাড়ুক। ও এমন শুকনো মুখে প্লেনে উঠলে বুকটা ফেঁটে যাবে আমার।’
আমার বুকের ভেতর গুমরে উঠলো কান্নার এক করুণ সুর। দুই হাতে মুখ ঢেকে উথলে উঠা কান্না থামলাম। তারপর শান্ত হয়ে বসে রইলাম অনেকটাক্ষণ। ধীরে ধীরে বাড়ির সব কটা আলো নিভে গেলো। আপু আর রাফিয়াও আমায় কয়েকবার শুতে আসতে বলে শুতে গেলো। আকাশের বিশাল চাঁদটা ধীরে ধীরে মাথার উপর এসে স্থির হলো। ধোঁয়ার মতো কুন্ডলী পাকালো মাঝরাতের কুয়াশা। বাড়ির প্রতিটি দেওয়ালে দেওয়ালে প্রেতাত্মার মতো ঘুরে বেড়াতে লাগলো ভারী নিঃশ্বাস। কেবল আমি বুকের ভেতর আস্ত একটা প্রেম পুকুর নিয়ে বসে রইলাম। সেই প্রেম পুকুরে প্রেমের বদলে ঢেউ খেলে কেবল অস্থিরতা আর অপেক্ষা। ঘড়িতে যখন প্রায় দেড়টা বাজলো তখন আবারও ফোন করলেন মামানি। ফোনের ওপাশ থেকে ফিসফিস করে বললেন,
‘ এই রোদু? পা টিপেটিপে ছাদে চলে যা তো দ্রুত। শুভ্র তোদের ছাদে অপেক্ষা করছে। ছেলেটার এতো ঢং! আমাকে ফোন করে তোকে জানাতে বলছে। তবু নিজে ফোন করবে না। বাপের মতো ঘাড়ত্যাড়া।’
আমি হেসে ফেললাম। এক মুহূর্তের জন্য মামানিকে খুব কাছের কোনো বন্ধু বলে বোধ হলো। এই মামানিটা ছাড়া আর কোন মা মাঝরাতে স্বীয় ছেলের প্রেমের পাহারাদার হয়ে যায় এতো উচ্ছ্বাস নিয়ে?
আমি খুব সাবধানে শোবার ঘর থেকে বেরিয়ে দরজা খুলে উঠে গেলাম ছাদে। ঘন্টাখানেক আগেই ঘুমিয়েছে, এখনই কারো জেগে উঠার কথা না। তবুও ছাদে উঠেই ভেতর দিয়ে ছিটকানি টানলাম। পেছন ফিরে চাইতেই শুভ্র ভাইকে ছাদের এক কোণায়, প্রাচীরে ঠেস দিয়ে, দুই হাত ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। শুভ্র মানব পাতলা ফিনফিনে এক শুভ্র শার্ট গায়ে, মাথা নুইয়ে, ভদ্র ছেলেটির মতো অপেক্ষা করছেন। শিশুদের মতো অভিমানী মুখ। কপালের উপর ছড়িয়ে আছে অগোছালো চুল। এই মুহূর্তে তার মুখখানা দেখলে যুগী-ঋষিও গলে গিয়ে ভাববেন, আহা! এমন নিষ্পাপ, ভালোভালা পুরুষ মানুষও এই দুনিয়ায় হয়? আমি উনার অভিমানী মুখ খানার দিকে চেয়ে মৃদু হাসলাম। হঠাৎ করেই খেয়াল করলাম আমার মন ভালো হয়ে যাচ্ছে। আমি ইচ্ছে করেই নুপুরে বেশ আওয়াজ তুলে উনার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। অভিমানী পুরুষ একটিবারের জন্যও চোখ তুলে চাইলেন না। আমি হাত বাড়িয়ে উনার অগোছালো চুলগুলো গুছিয়ে দিতে দিতে বললাম,
‘ শীতের কাপড় পরেননি কেন? এই করোনার সময় জ্বরজারিতে পড়লে আপনার ফ্লাইট মিস হয়ে যাবে না?’
অভিমানী পুরুষের আমার কথাটা বোধকরি খুব একটা পছন্দ হলো না। মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে চেয়ে রইলো। আমি হেসে ফেললাম। আমার গায়ের চাদরটা খুলে পা উঁচু করে এই লম্বাচওড়া মানুষটির গায়ে জড়িয়ে দিলাম। উনি খুশি হলেন না, প্রতিবাদও করলেন না। আগের মতোই মুখ ভার করে দাঁড়িয়ে রইলেন। অর্থাৎ, এই শেরপুর নিবাসী রমণীর সাথে তার কোনোরকম কথা থাকতে পারে না। আমি উনার অভিমানী মুখখানার দিকে মুগ্ধ হয়ে চেয়ে রইলাম। মাত্র গুছিয়ে দেওয়া চুলগুলো আবারও এক, দুই করে ঝরে পড়লো উনার কপালের ওপর। মুখের এক পাশে জ্যোৎস্নারা বড়ো আদর দিয়ে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে। যেন সান্ত্বনা দিচ্ছে, তার মতো মহান পুরুষের কী এমন নগণ্য রমণীর আচরণে মন খারাপ করতে আছে? কিন্তু জ্যোৎস্নারা জানে না, এ বড়ো অবাধ্য পুরুষ। এই পৃথিবীর কারো যুক্তিই সে মানে না। তার আছে আপন যুক্তির এক মহা-রাজ্য। আমি ডানহাতটা বাড়িয়ে উনার কাঁটা কাঁটা দাড়িতে ভরা খসখসে গালের উপর হাত রাখলাম। অভিমানী কণ্ঠে বললাম,
‘ আপনি এতো সুন্দর কেন? এতো সুন্দর বর কী আমার সাথে মানায়? না জানি কত মেয়ে রোজ বদনজর দেয়। কাছে আসুন তো, দোয়া পড়ে ফুঁ দিয়ে দিই।’
অভিমানী পুরুষ এবার তার সুন্দর চোখ জোড়া তুলে চাইলেন। তার সেই চাহনিতেই টলমল করে উঠলো হৃদয়। কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে এলো অদ্ভুত এক কান্নায়। সত্যিই, লোকটা এতো সুন্দর কেন! উনি আমায় কাছে টেনে ফিসফিস করে বললেন,
‘ তুই আমায় এতো জ্বালাচ্ছিস কেন?’
আমার চোখজোড়া টলমল করে উঠলো। একটু আগেও ভীষণ কঠিন হয়ে থাকবো ভাবা আমি নিজেকে অবাক করে দিয়েই ফুঁপিয়ে উঠলাম আচমকা। তারপর আষাঢ়ে বৃষ্টির মতো হুহু করে পড়তে লাগলো সে জল। চোখের পাতায় বৃষ্টির তেজ যেন বেড়েই চললো। শুভ্র ভাই আগের মতোই স্থির চেয়ে রইলেন আমার দিকে। কোনো প্রশ্ন করলেন না। থামতে বললেন না। কেবল চেয়ে রইলেন। আমি আলগোছে মাথা রাখলাম তার বুকে। রুদ্ধ কণ্ঠে শুধালাম,
‘ আপনি পরশু চলে যাচ্ছেন?’
শুভ্র ভাই হঠাৎ কোনো উত্তর দিলেন না। একটুক্ষণ চুপ থেকে শুকনো কণ্ঠে বললেন,
‘ হু।’
তারপর আমার মাথার উপর চিবুক রেখে অন্যমনস্ক মনে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। এই পৃথিবীর আর কেউ নয়, কেবল আমরা দু’জন বুঝলাম, এই দীর্ঘশ্বাসে কত যন্ত্রণা! কত কষ্ট! প্রিয় মানুষের থেকে দীর্ঘ বিচ্ছেদে কত ক্লেশ! না চাইতেও ফুঁপিয়ে উঠলাম আমি। উনার উষ্ণ বুকে মুখ লুকিয়ে কান্নায় কান্নায় কেঁপে কেঁপে উঠলো আমার ছোট্ট শরীর৷ উনি উনার গায়ের চাদরটা টেনে আমার মাথা, অর্ধ-শরীর চাদরের নিচে লুকিয়ে নিজের বক্ষবন্দী করলেন। বেশ আয়েশ নিয়ে আলিঙ্গন করে রইলেন অনেক অনেকটাক্ষণ। আমার মাথার উপর স্থায়ীভাবে নিজের চিবুক ঠেকিয়ে চিন্তিত দীর্ঘশ্বাস ফেললেন আবারও। চাদরের গুমোট অন্ধকারে, উনার উষ্ণ বুকের পুরুষালি এক সুবাস নাকে ধাক্কা দিতেই আমার নতুন করে মনে পড়লো, উনার গন্তব্য বহুদূর। কেবল এই শহর নয় এই সমস্ত দেশ পেরিয়ে আরও অনেক অনেকদূর। যতটা দূর হলে হুট করে ছুঁয়ে ফেলা যায় না। পাগলামো করা যায় না। উষ্ণতা পাওয়া যায় না। সুবাস পাওয়া যায় না। কিচ্ছু, কিচ্ছু পাওয়া যায় না। আমার কান্না এবার নতুন মাত্রা ছুলো। হেঁচকি তুলে বললাম,
‘ আপনি কোত্থাও যাবেন না।’
‘ আচ্ছা, যাবো না।’
‘ মিথ্যে কথা! আমি জানি, পরশুই চলে যাবেন আপনি।আপনাকে ছাড়া ময়মনসিংহ শহরটা এতো অন্ধকার ঠেকে! এতো অপরিচিত ঠেকে! এই অপরিচিত ময়মনসিংহে আমার দমবন্ধ হয়ে আসে। আমার যখন অনেক বেশি মন খারাপ হবে তখন তো আপনি আর আসবেন না, না? আমার এতো কষ্ট হচ্ছে!’
শুভ্র ভাই উত্তর না দিয়ে চাদরের উপর দিয়ে হাত বুলিয়ে দিলেন আমার পিঠে। হালকা চুমু দিলেন এলো চুলে। কোনো সান্ত্বনা নয় কেবল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চুপ করে রইলেন। আমি কিছুতেই নিজের কান্না আটকাতে পারলাম না। শুভ্র ভাই আমায় হালকা উঁচু করে পা জোড়া রাখলেন নিজের পায়ের উপর। আমাকে আগের মতোই বক্ষবন্দী করে ধীরে ধীরে হেঁটে বেড়াতে লাগলেন পুরো ছাদ জুড়ে। চিবুকখানা আগের মতোই ঠেকিয়ে রাখলেন মাথার ওপর। প্রায় আধঘন্টা পর কান্নাকাটিতে কিছু ভাঁটা পড়লো আমার। শুভ্র ভাই চাদর সরিয়ে ভেতরে উঁকি দিয়ে বললেন,
‘ এইযে ছকিনার মা? কান্নাকাটি থেমেছে?’
আমার কান্না এবার পুরোপুরি থেমে গেলো। একটু আগের কান্নাকাটির জন্য লজ্জা আর অস্বস্তিতে গাঁট হয়ে গেলো মন। তবুও গরম চোখে চাইলাম,
‘ খবরদার! আমাকে ছকিনার মা ডাকবেন না।’
শুভ্র ভাই উদাস কণ্ঠে বললেন,
‘ তাহলে কী ডাকবো? ইয়াহিয়ার কন্যা মহোদয়া?’
‘ ইয়াহিয়ার কন্যা কেন ডাকবেন? আমার বাবা ইয়াহিয়া?’
‘ অবশ্যই ইয়াহিয়া। তোর বাপ ইয়াহিয়ার থেকেও ধান্দাবাজ। কাবিন নামায় সাক্ষর করে সকল ক্ষমতা আমার কাছে তবু তিনি ক্ষমতা হস্তান্তর করতে রাজি না। কী পরিমাণ চালবাজ চিন্তা করে দেখ!’
আমি হতাশ চোখে চেয়ে রইলাম। এতোক্ষণ মন খারাপ ছিলো, ভালো ছিলো। মনটা ঠিকঠাক হতেই অসহ্য কথাবার্তা শুরু! একটু আগে একজন রমণী তার জন্যে ব্যাকুল হয়ে কান্নাকাটি করছিলো তাতে উনার কোনো মাথাব্যথা নেই। উনার মুখখানা দেখে মনে হচ্ছে, তিনি অত্যন্ত আনন্দিত। আনন্দে আনন্দে ভেসে যাচ্ছেন। আমি উনার বাহুবন্ধন থেকে সরে গিয়ে বিরক্ত কণ্ঠে বললাম,
‘ আপনি এখন বাসায় যান। আমি নিচে যাবো।’
শুভ্র ভাই নিজের চুলের গোঁড়ায় ব্যাক ব্রাশ করতে করতে বললেন,
‘ আচ্ছা, চল।’
উনাকে সিঁড়ি ঘরের দিকে যেতে দেখে আঁৎকে উঠলাম আমি। এক ছুটে উনার সামনে দাঁড়িয়ে বললাম,
‘ চল মানে? আপনি বাসার ভেতরে কোথায় যাচ্ছেন?’
শুভ্র ভাই অবাক হয়ে বললেন,
‘ বাসার ভেতর না গেলে ছাদ থেকে নামবো কী করে? তাছাড়া আমার শ্রদ্ধীয় শ্বশুর মহোদয়ের সাথে দেখা হওয়াটাও তো যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ সাবজেক্ট। আমার যতটুকু ধারণা বুঝলি, ভদ্রলোক আমার মতো মহান ব্যক্তিকে এতো রাতে নিজের বাসায় দেখে নির্ঘাত স্টোক ফোক করে বসবেন। আমি দায়িত্ববান মানুষ। বাকি কাজটুকু আমি করবো। উনার কানের কাছে খুব দায়িত্ব সহকারে জানিয়ে দিয়ে আসবো, ঘটনা ঘটে গিয়েছে। ব্যস! ভদ্রলোক ইন্না-নিল্লাহ, এই পৃথিবী ধান্দাবাজ মুক্ত, আলহামদুলিল্লাহ।’
আমি কড়া চোখে চাইলাম। এই অসভ্য, বেয়াদব লোকটার জন্য এতোক্ষণ এতো কষ্ট হচ্ছিলো ভেবে নিজের গালে দুটো চড় বসাতে ইচ্ছে হলো। দাঁতে দাঁত চেপে বললাম,
‘ খবরদার বাবাকে নিয়ে উল্টাপাল্টা কথা বলবেন না, শুভ্র ভাই।’
‘ উল্টাপাল্টা কথা বললাম কোথায়? আমি তো ভালো কথা বললাম। এই দেশ ও দশের সুবিধার কথা বললাম।’
আমি ভয়ানক বিরক্ত কণ্ঠে বললাম,
‘ আপনার দেশ ও দশের সুবিধার কথা আর শুনতে ইচ্ছে করছে না, শুভ্র ভাই। আমরা জানি, আপনি মহান মানুষ। আপনার বুক ভর্তি দয়া। যেভাবে এসেছেন সেভাবে ফিরে গিয়ে এবার একটু দয়া করুন প্লিজ!’
শুভ্র ভাই অবাক হয়ে বললেন,
‘ আমি তো যেতেই চাচ্ছি। তুই’ই তো আমাকে যেতে দিতে চাচ্ছিস না। এখন সব দোষ আমার, না? যেখানে যত দোষ, খোঁজ কেবল শুভ্রকে খোঁজ?’
‘ উফ! এতো যন্ত্রণা কেন করছেন শুভ্র ভাই? গাছ, দেওয়াল বেয়ে যেভাবে এসেছেন। সেভাবে নেমে যান না! বাসায় অনেক আত্মীয়-স্বজন অযথা একটা ঝামেলা বাঁধবে।’
‘ বললেই হলো, গাছ-দেওয়াল বেয়ে চলে যাবো? গাছ-দেওয়াল বেয়ে নামতে গিয়ে যদি আমার হাত-পা ভেঙে টেঙে যায়? তখন কী হবে? আমার বউকে তো সবাই ভাঙা শুভ্রর বউ বলে ডাকবে। তখন তার মন খারাপ হয়ে যাবে না?’
এই পর্যায়ে সকল ধৈর্য নিঃশেষ হয়ে গেলো আমার। ক্লান্ত কণ্ঠে বললাম,
‘ এতোই যখন হাত-পা ভাঙার ভয় তাহলে উঠলেন কী করে? আপনার হাত-পা তো সব ঠিকঠাকই দেখাচ্ছে!’
শুভ্র ভাই অবাক হয়ে বললেন,
‘ হাত-পা ঠিকঠাক দেখাচ্ছে মানে কী? তুই কী চাইছিলি আমার হাত-পা ভেঙে যাক? কী সাংঘাতিক মহিলা তুই! ধোঁকা দিয়ে বোকা বানানো না? আম্মু তো খুব বলছিলো, যা শুভ্র যা। আমার পুত্রবধূ তোকে আদর করার জন্য ব্যাকুল হয়ে আছে। তাকে একটু দর্শন দিয়ে আয়। কিন্তু এখানে তো দেখি প্রেক্ষাপটই আলাদা! এতোবড়ো ছলনা!’
আমি হতাশ চোখে শুভ্র ভাইয়ের দিকে চেয়ে রইলাম। এই লোকের সাথে কথা চালানোর ন্যূনতম ধৈর্য শক্তি আমার আর অবিশিষ্ট নাই। যেখানে ইচ্ছে চলে যাক। ইচ্ছে হলে, মরে যাক। শুভ্র ভাইকে কোনো যুক্তিতর্ক দিয়েই শেষ পর্যন্ত পরাস্ত করা গেলো না। উনি যখন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তখন উনি সিঁড়ি দিয়েই নামবেন। তাতে বাকি পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যায়, যাক। শুভ্র ভাই আমার দিকে চেয়ে অত্যন্ত গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,
‘ আমাকে গেটের চাবি এনে দে। আমি চুপচাপ গেট খুলে বেরিয়ে যাবো। তালা-চাবি গেটের পাশে রেখে যাবো তুই একটু পর গিয়ে তালা লাগিয়ে চলে আসবি। ব্যস, কাহিনি খতম। আমার গল্প ফুরালো, নটে গাছটি মুড়ালো। নটে গাছ যদি না মুড়ায় তবুও কোনো সমস্যা নেই। নটে গাছ মুড়ানোরও একটা ব্যবস্থা আছে। নটে গাছ মুড়ানোর জন্য আমাকে তরতর করে নিচে নেমে যেতে হবে। তোর বাপকে গিয়ে সহৃদয় চিত্তে সাজেশন দিতে হবে, তার ছোট কন্যা দিন দিন যে পরিমাণ বেয়াদব হচ্ছে, তাতে কেয়ামত সন্নিকটে। মাঝ রাত্তিরে বাড়ির ছাদে ভূতের মতো ঘুরেফিরে অসামাজিক কাজকর্ম করছে। সবই ধর্মবিরুদ্ধ কর্মকাণ্ড। তাঁর মতো ধার্মিক ব্যক্তির অতি অবশ্যই এসব শুনে টুপ করে অট্যাক ফ্যাটাক করে ফেলা উচিত।’
আমি শক্ত কণ্ঠে বললাম,
‘ আমি অসামাজিক কাজকর্ম করছি?’
‘ অবশ্যই! নয়তো আমি এখানে কী করছি?’
একটা মানুষ এই পরিমাণ বিরক্তিকর কী করে হতে পারে, বুঝে না পেয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। হতাশ চোখে চেয়ে থেকে চুপচাপ নিচে নেমে এলাম। কলিজা হাতে নিয়ে গেটের চাবি উনার হাত পর্যন্ত পৌঁছে দিলাম। উনি নিঃশব্দে নিচে নেমে গেট খুলে বেরিয়ে গেলেন। আমি তখন সিঁড়ির গোঁড়ায় দাঁড়িয়ে আতঙ্কে কাঁপছি। কেউ যদি আড়াল থেকেও টের পায় তবে কাল সকালে আমার কী হবে ভাবতেই ঘাম ছুটে যাচ্ছে। এজন্যই কবি বলেছেন, পিরিতির জ্বালা বড়ো জ্বালা৷ এই জ্বালাতে জ্বলিও না। না জ্বলে উপায় নেই। শুভ্র ভাই পৃথিবীতে বর্তমান আছেন আর আমি জ্বলছি না তা শ্রদ্ধেয় শুভ্র ভাইয়ের মনঃ পুত হওয়া কথা না। উনার ক্ষমতা থাকলে পুরো একটা আগ্নেয়গিরি আমার মাথার উপর ছেড়ে দিয়ে সামাজিক দায়-দায়িত্ব পালনের দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করে ফেলবেন৷ আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। শুভ্র ভাই বেরিয়ে যাওয়ার দশ-পনেরো মিনিট পর ধীর পায়ে নেমে গেলাম নিচে। শুভ্র ভাই যাওয়ার সময় বিশেষ সতর্কতা স্বরূপ সিঁড়ি, আঙিনা সব জায়গার আলো নিভিয়ে দিয়ে গিয়েছেন। বিদ্যুতিক আলোহীন আঙিনা জ্যোৎস্নার আলোয় কেমন মায়া মায়া দেখাচ্ছে। আমি পা টিপে টিপে গেটের কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। শুভ্র ভাই যথারীতি তালা-চাবি গেটের পাশে ফেলে রেখে গিয়েছেন। আমি নিচু হয়ে তালা-চাবি উঠাতে নিতেই জ্যোৎস্নার আলোয় চোখে বাধলো ইট চাপা দেওয়া সাদা কাগজের টুকরো। আমি ভ্রু কুঁচকে তালা-চাবির সাথে সাথে কাগজের টুকরোটাও তুললাম। জ্যোৎস্নার ম্লান আলোয় কাগজের লেখা স্পষ্ট পড়া যাবে না জেনেও আদৌ কাগজে কিছু লেখা আছে কি-না জানতে, বড়ো আগ্রহ নিয়ে কাগজটা মেলে ধরলাম। কাগজের প্রতি অত্যধিক মনোযোগ দেওয়ায় লোহার গেইটটার ধীরে ধীরে খোলে যাওয়া আমার দৃষ্টিগোচর হলো না। যতক্ষণে দৃষ্টিগোচর হলো ততক্ষণে বাইরে থেকে একটা অদৃশ্য হাত চেপে ধরেছে আমার বাহু। আমি চমকে উঠলাম। প্রচণ্ড ভয়ে চিৎকার দেওয়ার আগেই চাপা কণ্ঠে ধমক এলো,
‘ এই চুপ! আমি।’
আমি ভয়ার্ত চোখে চাইলাম। শুভ্র ভাই আমার বাহু টেনে গেইটের বাইরে এনে হাত থেকে ছিনিয়ে নিলেন তালা-চাবি। আমাকে অবাক করে দিয়ে তালা-চাবিটা গেইটের ওপাশে ঘাসের উপর ছুঁড়ে দিয়ে আমার হাত চেপে ধরে বললেন,
‘ চল।’
আমি বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ়ের ন্যায় দাঁড়িয়ে রইলাম। স্তব্ধ চোখে খানিকক্ষণ চেয়ে থেকে বললাম,
‘ চল মানে! কোথায় যাবো?’
শুভ্র ভাই ততক্ষণে আমাকে টেনে সরিয়ে নিয়েছেন আমাদের বাড়ির সম্মুখ থেকে। পাত্তাহীন কণ্ঠে বললেন,
‘ কোথায় আবার? আমাদের বাড়ি!’
আমি বিস্মিত চোখে চাইলাম। হাত ছাড়ানোর বৃথা চেষ্টা করে চাপা আর্তনাদ করে উঠলাম,
‘ কিহ! মাথা খারাপ? বাসায় কেউ জানলে খুন করে ফেলবে আমায়। ইয়া মা’বুদ! হাত ছাড়ুন!’
শুভ্র ভাই ছাড়লেন না। আমার এতো অনুনয় বিনয় উনার কাছে দুই আনার পাত্তাও পেলো না। বরং আমাকে আরও একটা চমক দিতে মুঠোফোন বের করে কাউকে ফোন লাগালেন। কয়েক মিনিট অপেক্ষা করে ওপাশে রিসিভার উঠাতেই বললেন,
‘ হ্যালো রাহাত ভাই? ঘুম ভাঙালাম? ভাই, তোমার বোন আমার সাথে। কোথাও যাচ্ছি না। বাড়ির সামনের রাস্তায় কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে আমাদের বাসায় চলে যাবো। প্লিজ মেইক শিওর, কেউ যেন কয়েকঘন্টার মাঝে ওর খোঁজ না করে। আর গেইটে তালাটা লাগিয়ে দিও ভাই। তালা-চাবি পাশে ফেলে এসেছি।’
আমি স্তব্ধ চোখে চেয়ে রইলাম। এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো, আমি এক্ষুনি হার্ট অ্যাটাক করে মরে যাবো। আমার এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকার আর কোনো অধিকার নাই। এক্ষুনি না মরলেও একমাত্র এই লোকের দেওয়া শকে শকেই একদিন পরলোকগমন করতে হবে আমায়। উনার এতো অত্যাচার সহ্য করেও যে এখনও বেঁচে আছি তাই মহান সৃষ্টিকর্তার সদয় কৃপা। নয়তো আমার আসলে বেঁচে থাকার কথা না। আমার মুখখানা মুহূর্তেই কাঁদো কাঁদো হয়ে গেলো। ইচ্ছে করলো, রাস্তায় হাত-পা ছড়িয়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠি। এই মধ্যরাতে, আমি এক পুরুষ মানুষের সাথে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছি। আর উনি দায়িত্ব নিয়ে তা আমারই বড়ো ভাইকে জানাচ্ছেন, সিরিয়াসলি! এরপরও এই চাঁদ মুখ নিয়ে বেঁচে থাকা উচিত? চিন্তায় চিন্তায় আমার মাথা-টাথা ঘুরে যাচ্ছে। এই লোকের যন্ত্রণায় আমার জীবন এখানেই শ্যাষ! সমাপ্ত। আমি শুভ্র ভাইয়ের দিকে চেয়ে কঠিন কণ্ঠে বললাম,
‘ আমার প্রতি আপনার বিন্দুমাত্র মায়া-মহব্বত নেই, না? খবরদার! আমার পিছু পিছু আসবেন না। আমার যেদিকে দু’চোখ যায় চলে যাবো। আপনি একটা অসহ্য। আপনার মতো অসহ্য মানুষকে সহ্য করা আমার পক্ষে সম্ভব না। না মানে, না।’
আমার হুমকি ধামকি শুভ্র ভাইকে বিন্দুমাত্রও বিচলিত করতে পারলো না। তার মুখ দেখে মনে হচ্ছে, এমন একটা কাণ্ড করতে পেরে সে অত্যন্ত আনন্দিত। আনন্দে আনন্দে পারলে এখনই নৃত্য করে। আমি চোখদুটো বন্ধ করে বহু কষ্টে নিজের রাগ সংবরণ করলাম। একটু আগের ঘটনা আর কাল আমার সাথে কী ঘটতে পারে, তার বৃত্তান্ত কল্পনা করে অসহায় হয়ে গেলো হৃদয়। কাঁদো কাঁদো মুখখানা নিয়ে শুভ্র ভাইকে রেখেই এগিয়ে গেলাম। শুভ্র ভাই নিরুত্তাপ। দ্রুত হেঁটে উদাস মুখে আমার পাশে পাশে হাঁটতে লাগলেন। আমার বাড়ির সীমানা পেরিয়ে বেশ খানিকটা দূরে চলে আসতেই গায়ের সাথে গা লাগিয়ে হাঁটতে লাগলেন। অযথা আমাকে জ্বালানোর চেষ্টা! আমি কঠিন চোখে চাইলাম। শুভ্র ভাই আমার কঠিন দৃষ্টিকে পাত্তা না দিয়ে গলা খোলে গান ধরলেন,
‘ নামি চলো আজ পথে
হাত রাখো এই হাতে
দু’জনে চলো যাই বহুদূর…
আমার গিটারের সুরে
দোলা লাগে তোমার নূপুরে
উত্তাল ঢেউ তোলে, দোলে হৃদয়-সমুদ্দুর…
তোমার জুলিয়েট হাসি হেসে
ডাকো একবার ভালোবেসে
আমি তোমার চোখে তাকাব, পলক পড়বে না
আজ আমার প্রেমিক শরীরে
তোমার হাওয়ায় উড়ছি ফুরফুরে
প্রেম আর পাগলামি, তাকে লুকাব না
লোকে পাগল বলুক, মাতাল বলুক
আমি তোমার পিছু ছাড়ব না….’
আকাশে তখন পূর্ণচন্দ্র। লজ্জায় বার বার মুখ ঢেকে ফেলছে মেঘের আঁচলে। দুধ সাদা জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে চরাচর। মাঝ রাতের হিমেল হাওয়ায় উড়ে যাচ্ছে চুল। ওড়নার আঁচল। আমি মুগ্ধ চোখে চেয়ে আছি রূপকুমারী চাঁদের দিকে। অনুভব করছি, ঠিক একই রকম মুগ্ধতা নিয়ে কেউ একজন চেয়ে আছে আমার মুখপানে। তার শ্যামবতীর শ্যামরূপ আর নেই। কোনো এক দৈব বলে বহুদিন হলো ফরসা হয়ে গিয়েছে গায়ের ত্বক। কয়েক মাসের চূড়ান্ত অবহেলায় ফরসাটে মুখের উপর পড়েছে ব্রুণের গাঢ় দাগ। চুল হয়েছে রুক্ষ। চোখদুটোতে রাজ্যের উদাসীন্য। অথচ তার প্রেমিক চোখ অভিযোগহীন। মুগ্ধ। তার শ্যামাঙ্গীর গৌড়বর্ণে তার অভিযোগ নেই। প্রেয়সীর উদাসীন্যে অভিযোগ নেই। অভিযোগ নেই ব্রুণে ঢাকা মুখটির প্রতিও। সে যেন চির মুগ্ধ পুরুষ। মুগ্ধতা তার চোখের তারায়। তার দৃঢ় মুগ্ধ দৃষ্টিতে লজ্জা পায় চাঁদ। মিটিমিটি হাসে জোনাকিদের আলো।কেবল আমি স্থির চেয়ে থাকি আকাশের দিকে। পাশে ফিরে চাই না। প্রাণ ভরে শ্বাস নেই। রূপসী চাঁদকে চুপিচুপি শুধাই,
‘ বলো তো রূপসী চন্দ্রিমা? কে বেশি সুন্দর? কে বেশি গর্বিত? তুমি না আমি? তোমাকে এই সমস্ত বসুমতী সুন্দর দেখে। আর আমায় দেখে এক বেপরোয়া পুরুষ। যার চোখ দুটোতে মস্ত দুটো ঝিল আছে। সেই ঝিলের জলে নিজেকে আমি তোমার থেকেও সুন্দর দেখি। তোমার মুগ্ধতা কেটে যায় ভোর হলেই। তার মুগ্ধতা বিস্তৃত হয় অম্লান দিবারাত্রি।’
রোদ শুভ্রর প্রেমকথন সম্পূর্ণ গল্পের লিংক
https://kobitor.com/rodsuvro/
[ প্রায় আট হাজার শব্দের একটি পর্ব। সাধারণ গল্পের চার পর্বের সম পরিমাণ। বিশাল মেহনত হয়েছে গোটা পর্বটা লিখতে সুতরাং একটু সাড়াশব্দ করে যাবেন। ভালোবাসা ]