শিশিরের আদ্র পর্ব ১০
#Neel
সন্ধ্যায় বাসায় সবাই উপস্থিত। উপস্থিত নেই একজন। সে হলো আদ্র ভাইয়া। আমি বললাম – আচ্ছা দাদি, আজ বিকেল থেকে তো আদ্র ভাইয়াকে দেখলাম না? কোথায় সে?
কথাটা বলতেই সবাই আমার দিকে তাকালো, যেন আমি অসময়ে অসৎ কথা বলে ফেলেছি। সবার সামনে একটা মেকি হাসি দিয়ে বললাম – ঐ দেখতেছিলাম না তো, তাই।
সবাই একসাথে হেসে দিল। যাক বাবা, কি এমন বললাম সবাই হেসে দিল।
বড়রা সবাই গুরুত্বপূর্ণ কথা বলছে। গুরুত্বপূর্ণ কথা মানে বিয়ে । নাহিদ আর নিজাম ভাইয়ার বিয়ে। আদ্র ভাইয়া নাকি ইমার্জেন্সি টিকেট কেটে এব্রোড গেছে। এটা বড় আব্বু জানে। মানে বড় রা সবাই জানতো। উফ্ ,কি নিরালস আমি।১/২ সপ্তাহ পর ফিরবে। ওখানকার কাজ সম্পূর্ণ করে , একবারে ফিরবে ।
মনে মনে খুশি হলাম যাক পিছ থেকে সিসিটিভি ক্যামেরা দূর হয়েছে। আবার একটু খারাপ ও লাগছে, বেচারা পরিবারের সাথে ঠিক মতো সময় ও কাঁটাটে পারল না। আরে তাতে আমার কি? কিন্তু আমি ও তাকে একটু একটু মিস করছি। (এই পাঠকগণ, আমি কিন্তু একটু একটু ই মিস করছি, বেশি নয়)
____
দেখতে দেখতে কেটে গেল এক সপ্তাহ। এক সপ্তাহ আমার কলেজ,ক্লাশ টেস্ট, এগুলো নিয়ে ই কেটে গেল। সামনে ফাইনাল পরীক্ষা। এক,দেড় মাসের মধ্যে ই। যাই হোক, এর মধ্যেই সুখবর ও আছে। নিজাম আর নাহিদ ভাইয়ের বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। নিজাম ভাইয়া তার কলিগ সুরাইয়া আপু কে ই ভালোবাসে। তাই তাদের ভালোবাসা আজ বিয়ে পর্যন্ত গরিয়েছে। বুজলাম না, নিজাম ভাইয়া প্রেম করতে পারে, নাহিদ ভাইয়া কেন করলো না? ও যাই হোক, আমি প্রেম করমু, প্রেম করেই বিয়ে করমু। কি আনন্দ, আকাশে বাতাসে। প্রেমের বাতাস লাগছে মনে….আহা…
নাহিদ ভাইয়ের বিয়ে ঠিক হয়েছে মীর্জা আব্বাস আলী মেয়ের সাথে। মীর্জা বংশ, হুম আমাদের শহরে নামকরা বংশ। তবে আমরা কম কিসে। যাই হোক, এ কয়েক দিনে নাহিদ ভাইয়াকে আমার সুবিধার মনে হচ্ছে না। কেমন যেন চুপ চাপ হয়ে গেছে।
কাল গায়ের হলুদ। কমিউনিটি সেন্টারে বিয়ে হবে। আজ নাকি আদ্র ভাইয়ের আসার কথা। ইতিমধ্যেই বাড়িতে শোরগোল শুরু হয়ে গেছে। আত্মীয় স্বজনদের আনাগোনা।
সবাই ব্যস্ত।
আমি দরজার পাশে চেয়ার পেতে বসে আছি। তবে আমি একা না, নিজাম আর নাহিদ ভাইয়ের একমাত্র মামাতো বোন স্বর্ণালী আপু ও।ভাইয়াদের কাজিন দের মধ্যে এই একমাত্র স্বর্ণালী আপুর সাথে ই আমার দারুন মিলে। দুজনের আড্ডা ও ভালো জমে।
আমায় দ্বারা কাজ টাজ কোন কালে ই হয় না। তাই চুপচাপ বসে অন্যদের কাজ দেখছি, অন্যদের কাজ দেখার মজাই আলাদা। আমি কাজে ডিস্টাব দিতাম, কিন্তু আমার দর্জাল মা বলেছে – কাউকে যদি কাজে ডিস্টাব করি তাহলে এই বাড়ি ভর্তি লোকের সামনে খুন্তি দিয়ে পিটাবে। না বাবা ই, চুপ করে বসে থাকাই এখন বুদ্ধিমানের কাজ।
আশেপাশে দেখছি, এর মধ্যেই একটা গাড়ি আমাদের গেইট দিয়ে প্রবেশ করলো। স্বর্নালি আপু আমাকে টেনে নিয়ে গেল। গাড়ি থেকে যে নামলো, আমি পুরো ই হা হয়ে আছি। শুধু আমি নয় ,আশে পাশের সবাই মনে হয় হা করে তাকিয়ে আছে।
ও বুঝতে পারছেন না তো, গাড়ি থেকে অহনা আপু আর তার পরিবার নামছে। অহনা আপু হচ্ছে আদ্র ভাইয়ের মামাতো বোন। মামাতো বোন না ছাই। আস্ত মিচকা শয়তান একটা মাইয়া(মিচকা শয়তান কেন বলছি, সামনে বুঝতে পারবেন। আয়ান ভাইয়ের বিয়ের সময় প্রথম আর শেষ দেখা, তখন ১২/১৩ বছরের ছিলাম, এর সাথে আমার সেই তুমুল ঝগড়া হয়েছিল। তখন থেকেই এই মেয়েকে আমার সহ্য হয় না)। অহংকারী ও বটে। শর্ট ড্রেসআপ, মেকআপ, সবকিছু তেই আধুনিক। হবে না কেন? ওনি তো এব্রোডে বড় হয়েছে। মানে ,এতবছর আদ্র ভাইয়া তাদের সাথে ই এব্রোডে থেকে পড়শোনা, চিকিৎসা সব করিয়েছেন।ওপস, শান্ত ভাইয়া ও ছিল। ওনারা আসলো,আদ্র ভাইয়া যে আসলো না।
অহনা আপু আমার দিকে একবার তাকাল। এর মধ্যেই মাই চলে আসলো। কত দিন পর ভাই ভাবি, ভাতিজির সাথে দেখা। মাই এর খুশির অন্ত নেই ।এর মধ্যেই আরেকটি গাড়ি এলো। ওটা থেকে আদ্র আর একটা ছেলে বের হলো। ছেলেটি দৌড়ে মাই কে জড়িয়ে ধরলো। ওওও এতোক্ষণে মনে পড়ছে, এটা অহনা আপুর ভাই।
যাইহোক মেলোড্রামা দেখে আমার কি। আদ্র ভাইয়ের দিকে তাকালাম। আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি দিল। বুঝলাম না, সে হাসলো কেন? আমি আদ্র ভাইয়ের দিকে এগিয়ে গেলাম, বললাম – আপনি ইমার্জেন্সি তে এব্রোড গেলেন, আমাকে একবার বললেন না তো?
পিছন থেকে অহনা আপু আমাকে আস্তে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিয়ে , আদ্র ভাইয়ের হাত ধরে বলল – তোমাকে বলবে কেন?কে তুমি? অপদার্থ যত লোক।চলো আদ্র।(বলেই আদ্র ভাইয়া কে হাত টেনে নিয়ে গেল)
খুব কষ্ট হচ্ছে খুব? আমি কি বেশী কিছু বলে ফেললাম? খুব সাদামাটা একটা প্রশ্ন করছি, আদ্র ভাইয়া কি পারতো না এটার জবাব দিতে, তার মামাতো বোন কে দিয়ে অপমান না করালে ও পারতো।
স্বর্নালি আপু হয়তো ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছে। সে আমাকে এসে জরিয়ে ধরলো। বললো – এসব মানুষের কথায় মন খারাপ করতে নেই অশি। তুমি না আমার লক্ষী বোন।
বোন, কথাটা শুনতে ই মুচকি হেসে, চোখের পানি মুছে বললাম- আচ্ছা, আপু আমার, আর কষ্ট পাবো না। চলো।
অন্যদিকে, শিশিরের চোখের আড়ালে, আদ্র অহনার হাত থেকে ঝাড়া দিয়ে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিল। বলল- অহনা, ডোন্ট ক্রস ইউর লিমিট। আর শিশিরের থেকে দূরে থাকবি , শিশিরের সাথে এরকম ব্যাবহার পরবর্তীতে যেন না দেখি।
অহনা – আদ্র তুই এটা বলতে পারলি (ন্যাকা সুরে) আদ্র…
আদ্র অহনার ন্যাকা কান্না দেখে বিরক্ত হয়ে চলে গেলো। আদ্র চলে যেতেই অহনা চোখ মুখ শক্ত করে বিরবির করে বলল – আদ্র, তোর মাথায় সারাক্ষণ কেন শিশির শিশির আর শিশির। ওর মধ্যে এমন কি আছে যা আমার মধ্যে নেই। মানছি, ও সত্যি ই নেচেরাললি সুন্দর। তবে আদ্র আমি ও কম নয়। তোর শিশির কে আমার রাস্তা থেকে নিজ ইচ্ছায় সরতে হবে, না হয় আমি সরিয়ে দিব। তুই আমার। শুধু ই আমার। তুই যেমন সাইকো, আমি ও তোর জন্য সাইকো।
___
বিকেলে, সব ঠিকঠাক, আমরা ছোটরা শপিং করি নাই। তাই বড় বাবা টাকা দিয়েছে, শপিং করার জন্য। আমি,স্বর্নালি আপু রেডি হচ্ছি। কি পরবো বুঝতে পারছি না। অবশেষে স্বর্নালি আপু আমাকে চুজ করে দিল। জিন্স আর টপস। উপরে সাদা ওড়না পেঁচিয়ে, হালকা মেকআপ আর হাল্কা লিপস্টিক, শেষ আমার সাজগোজ। চুলগুলো ছেড়ে দিলাম। ব্যাস হয়ে গেল। স্বর্নালি আপু আমাকে দেখে বলল – আরে অশি, আজ তোকে যে দেখবে ঘায়েল হয়ে যাবে রে। ইশ্ (নিজের কাজল আমার কানে লাগিয়ে) কি সুন্দর লাগছে, মাশাআল্লাহ।
একটু লজ্জা পেলাম। মুচকি হেসে বললাম – কী যে বলো না আপু, তোমাকে ও অনেক সুন্দর লাগছে।
সবাই রেডি হয়ে নিচে ড্রইংরুমে অপেক্ষা করছে। আমি আর স্বর্নালি আপু সবার শেষে উপস্থিত হলাম।
আদ্র শিশিরের দিকে তাকিয়ে আছে। শিশির কে সত্যি ই সুন্দর লাগছে। মাশাআল্লাহ।
অহনা একবার আদ্র আর একবার শিশিরের দিকে তাকাচ্ছে। আর জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে।
সবাই আমার প্রশংসা করছে। ভালো ও লাগছে। একবার আদ্র ভাইয়ার চোখে চোখ পড়তেই সরিয়ে নিলাম।
বাইরে তিনটা গাড়ি রেডি আছে। অনেক এ যাবে। শান্ত ভাইয়া, আদ্র ভাইয়া, স্বর্নালি আপু, সোহাগ ভাইয়া (স্বর্নালি আপুর ভাই), অহনা আপু তার ভাই মীনা আপু, মিন্নাত মিন্নাহ আর আয়ান ভাইয়া, জান্নাত, মহিদ ভাইয়া ও।
সবাই ঠিকঠাক মতো বসে গেছে। শান্ত ভাইয়া,আদ্র ভাইয়া, রোহান (অহনা আপুর ভাই) অহনা আপু এক গাড়িতে।বাকি গাড়িতে বাকিরা। চলে ও গেছে। আমরা ও পিছু পিছু চলছি।আদ্র ভাইয়া ভুরু কুঁচকে তাকালো। আমি শান্ত ভাইয়ার কাধে মাথা রেখে শুয়ে আছি।
অহনা – হেই, অশি। তুমি কি গাড়ি জার্নি করতে পারো না? হাউ ইউজলেজ। গাড়ি জার্নি না করতে পারলে এরকম গাড়িতে উঠবে না। তোমার মতো মেয়েরা…(শান্ত ভাইয়া হুঙ্কার দিয়ে উঠলো)
শান্ত – জাস্ট সাট ইউর মাউথ। আর এক টা সাউন্ড করলে, চরে দাঁত ফেলে দিব। আত্নীয় এর সন্মান টুকু করবো না। কাকে এগুলো বলছো? ও আমার কলিজার টুকরো। আমার বোন। তোমার সাহস দেখে অবাক হই, কি জানো তুমি অনির সম্পর্কে।
আমি অহনা আপুর দিকে তাকিয়ে একটা ভেঙচি কাটলাম। আর শয়তানি হাসি দিলাম। আমি আমার সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনা গুলো শান্ত ভাইয়া কে বলে দিয়েছি। সেই থেকে শান্ত ভাইয়া অহনা গহনা আপুর উপর রেগে আছে। হি হি হি
শিশির যে অহনাকে এগুলো করছে, আদ্রের চোখ এড়ায় নি। মনে মনে আদ্র বলল-তখনকার প্রতিশোধ টা নিয়ে নিলি।যাই হোক এভাবে যে নিবি জানতাম না।
আদ্র হাসলো।
অহনা আপু চুপ হয়ে গেল। কোন কথা বাড়ালো না। অহনা জানে, শান্ত , নামের মতোই অশান্ত। অহনা বুঝতে পারলো, এই মেয়েটি সবার মাথা ব্রেন বশ করে রেখেছ।অবশেষে শপিং মলে এসে পড়লাম।
___
শপিং মলে, সব মেয়েরা হলুদ শাড়ি হলুদের জন্য কিনে নিল। আর ছেলেরা হলুদ পাঞ্জাবী। যে যার মতো শপিং করছে। কিছু পছন্দ হচ্ছে না । কিছুই না। অবশেষে একটা গ্রাউনে চোখ আটকালো। দৌড়ে গিয়ে গ্রাউন টা হাতে নিলাম।
শান্ত মোটে ও অহনাকে পছন্দ করে না। অহনা সম্পর্কে শান্তের ধারনা আছে। অহনা যে খুব একটা শিশির কে পছন্দ করে না, সেটা শান্ত জানে। একই দিকে আদ্র ও এসব বিষয়ের প্রতি অবগত। সে ও শান্তের মতো শিশির আর অহনার উপর নজর রাখছে। কখন যেন লঙ্কা কান্ড বাজিয়ে দেয়। বাপুরা, মেয়েরা প্রচুর শয়তান, এদের মন জিলাপির মতো পেঁচানো ,এদের মনে কখন কার উপর হিংসে জন্মায় বুঝা মুশকিল।
গ্রাউন টা হাতে নিতেই অহনা আপু ও খপ করে আমার হাত ধরে গ্রাউন টা ধরলো। অহনা আপু খুব জোরে হাতটা ধরছে। ব্যাথা পাচ্ছি।
অহনা – গ্রাউন টা ছাড়ো অশি। তোমার মতো মেয়েদের এসব গ্রাউনে মানায় না। আর..(কিছু বলার আগেই, কেউ একজন গ্রাউন টা টেনে নিয়ে গেল দুজনের হাত থেকে)
ব্যাক্তির দিকে তাকাতেই….
চলবে…