দরজার সামনে থেকে দাঁড়িয়ে বলে উঠলাম-আমি তোমাদের ছেলে কে বিয়ে করতে পারবো না বড় বাবাই,মাই।
আমার কথা শুনে বাড়ির ছোট বড় সবাই চমকে তাকালো। দরজা থেকে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করলাম।আদ্র , শান্ত , নাহিদ, নিজাম ভাইয়া নেই। বাকিরা সবাই আছে।
মাই – এরকম কথা কেন বলেছিছ অশি মা আমার। আদ্র তোকে খুব ভালোবাসে। খুব ই। তাছাড়া তোদের বিয়ে সেই ছোটবেলা থেকেই পাকাপাকি আছে। তোর মা বাবা আমাকে কথা দিয়েছে।
আমার বিয়ে, তাও আবার আমার মত ছাড়া। কেন? আমি মেয়ে বলে। তাছাড়া সবাই নিজেদের মত আমার উপরে চাপিয়ে দিচ্ছো কেন? ছোট বেলায় কি হয়েছে, না হয়েছে আমি জানি না। তবে আমি আদ্র ভাইয়া কে বিয়ে করবো না। আমি..(ঠাস করে একটা চড় পড়লো গালে)
চরের তাল সইতে না পেরে সেখানে ই পড়ে গেলাম। কে চর দিল, মাথা উঠিয়ে দেখতেই, যেন নিজের পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গেল। চর দেওয়া ব্যক্তিটি আর কেউ নয় আমার মা। আমার গায়ে যে আজ পর্যন্ত টোকা ও দেয় নি, সে আমাকে মারলো। সাথে সাথে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। অস্ফুট স্বরে বলে উঠলাম -মা তুমি? আমাকে মারলে?
চোখ থেকে অশ্রু ঝরে পড়লো। এই অশ্রু এতো বেয়াদব হয়েছিস কেন? ঝরছে তো ঝরছে ই। থামবার নাম নেই।
মা – খুব বড় হয়ে গেছিস।বড় দের মধ্যে কথা বলিস। তোর মতামত কেউ জানতে চাইছে? তোকে আদ্র কে ই বিয়ে করতে হবে । আমি একবার নয় তিন তিন বার কথা দিয়েছি , তোর দাদির মৃত্যুর আগে ও তাকে ও একই কথা দিয়েছি।আর আদ্রের কী নেই, বড় নামকরা হার্ট সার্জেন্ট, দেখতে ও লাখে একজন আর সবচেয়ে বড় কথা হলো তুই আমাদের মেয়ে আমাদের কাছে ই থাকবি। একটা মা হয়ে এর থেকে সুখের আনন্দের কী হতে পারে?
চোখের পানি মুছে উঠে দাঁড়ালাম। বললাম – আদ্র, আদ্র আর আদ্র। এতো আদ্রের নাম কেন ফুটে এই বাড়ির প্রত্যেকটি লোকের মাঝে । সে যা ই হয়ে থাক না কেন, আমি তাকে বিয়ে করবো না মানে করবোই না।আমি এখন আর ছোট নেই, শুনেছ তোমরা(চিৎকার করে)।১৮ বছর হয়ে গেছে আমার। তাই জোর জবরদস্তি করে আমার সাথে পেরে উঠবে না। আমি এই আদ্র কে কখনো বিয়ে করবো না। ও একটা সাইকো। সাইকো, পাগল এরকম মানুষ কে কেন আমি বিয়ে করবো?যে স্বচ্ছায় খুন করতে ও দুবার ভাবে না । আমার লাইফটা নিজ হাতে আমি নষ্ট হতে দেব না।
বাবা চিৎকার করে উঠলো বলল -অশি (রাগী চোখে তাকালো) এ কোন ধরনের ব্যবহার। মুখ সামলে কথা বল। কোথায় কী বলছো তোমার হুঁশ নেই। আদরে আদরে বেয়াদব হয়েছিস। আমাদের মুখের উপর কথা, এত বড় সাহস কে দিয়েছে তোকে। আমাদের কথা মানতে হবে তোকে, তোকে আদ্র কে বিয়ে করতেই….
উচ্চস্বরে হাসতে লাগলাম। বেয়াদব আমি তাইতো। তাহলে বেয়াদব ই আমি। শুনে রাখ তোমরা , আমাকে যদি জোর জবরদস্তি করেছো এই বিয়ে নিয়ে , আমি নিজেকে শেষ করতে দুবার ও ভাব্বো না। শেষ করে ফেলব নিজেকে।
(বলেই দৌড়ে উপরে চলে আসলাম, নিজের রুমে এসে দরজা বন্ধ করে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করলাম)
শিশির যেতেই বড়দের মাথায় হাত। এ কি হচ্ছে তাদের পরিবার এ। সেদিন কিডনাপ এর পর থেকে ই শিশির পাল্টে গেছে। অনেক টা। দুষ্টুমি কমিয়ে দিয়েছে। চকলেট কম খায়, আর বড় কথা আদ্রের সামনাসামনি ও থাকে না, বাড়িতে ই থাকে না, মামা বাড়ি থেকে পড়াশোনা করে ।হুট করে এতোটা চেঞ্জ কেউ মানতে পারছে না।
কাঁদছি, নিজেকে থামিয়ে রাখতে না পেরে দৌড়ে ওয়াসরুমে চলে গেলাম। নিজের উপর ঝর্নার পানি ছেড়ে দিলাম। চাই না তাকে চাই না।যে খুন করতে পারে, তাকে চাই না আমার। আমি তো তাকে ভালোবাসি, তবুও চাই না আমার!!(চিৎকার করে কেঁদে উঠলাম)
একটা শীত কেটে গেছে। মানে একটা বছর কেটে গেছে। আবার ও শীত এসে পড়েছে। উষ্ণ আদ্র, শিশির রঙের মেলা আবার ও বসেছে। কিন্তু আমি শিশিরের মনে আদ্রের রঙের ছোঁয়া তো ঠিকই লেগেছে কিন্তু শিশির আদ্রের মেলা বসে নি।
সেদিন আদ্র ভাইয়ের ডায়েরিতে আমি তার মনের কথা, কষ্টের কথা জানতে পারি। এটা ও জানতে পারি আন্ডার ওয়ার্ল্ড এ মাফিয়া ও সে।সে নিজ ইচ্ছায় সেখানে জরিয়ে পরেছে। এই পর্যন্ত তার খুনের হিসাব নেই। সে নিজ হাতেই ২টা খুন করছে। কথায় আছে না, বিষ তো বিষ ই ।সেটা একটু হোক, না কেন।খুন তো খুন ই , সে একটা করুক আর ১০ টা।
সেদিন আদ্র ভাইয়া অনেক ডেকেছিল। আমি পিছু ফিরে চাই নি। না বলেছি মনের কথা। কেন আদ্র ভাইয়া কেন? আমার জীবনে এলে? (ডুকরে কেঁদে উঠলাম)এলে তো এলে আমাকে কেন তোমার প্রনয়ের সাথে দেখা করালে। আমি অবুঝ ছিলাম,ভালো ছিলাম। এই প্রনয়ের দহনে আমি দিন দিন শেষ হয়ে যাচ্ছি। মন তোমাকে চায়, মস্তিষ্ক তোমার থেকে দূরে থাকতে বলে। আর পারছি না আমি। সত্যি ই পারছি না।
১ টা বছর নয়, যেন ১ শতাব্দী। আমি তোমার থেকে দূরে থাকার জন্য মামার বাড়িতে পড়াশোনা করেছি। যেন তোমাকে ভুলে যেতে পারি। পড়াশোনায় এতো মনোযোগ দিয়েছি, যাতে তোমায় ভুলতে পারি। দিন হলে এটায় ওটায় ব্যস্ত থাকতাম। কিন্তু রাত? ঐ রাতেই যে প্রতিটা দ্বগ্নে আগুনে দগ্ধ হতাম। দূর্বল হয়ে গেছি আরোও। এখন হয়তো মৃত্যু ই আমাকে তোমার থেকে দূর করতে পারে।
তুমি যতবার আমার সামনে আসো, তোমার ঐ মলিন চেহারা, চোখ দুটো আমার মনকে তোমার প্রতি আরো দূর্বল করে দিত। আমি দূর্বল অনেক দূর্বল।তাই তো তোমার থেকে দূরে সরে যেতে চাই আরোও। বেঁচে থাকলে তোমার সাথে অন্যকেউ কে সহ্য করতে পারবো না আর তোমার কাছে ও আমি আমার বিবেকের জন্য আসতে পারবো না।জানো আদ্র ভাইয়া আমি তাইতো নিজের বাড়িতে আসা বন্ধ করে দিয়েছি। এই বাড়িতে আসলেই আমার তোমাকে দেখতে মন চায়, তোমার কাছে আসতে মন চায় ।তোমার রঙ্গে নিজেকে রাঙাতে মন চায়। তোমার উষ্ণ ছোঁয়া পেতে মন চায়।
আদ্র শান্ত একসাথে ই বাড়িতে এলো। বাড়ির বড়দের চিন্তিত দেখাচ্ছে। সবাই গম্ভীর।
আদ্র – হে, তোমরা গোল মিটিং এ মুখ গম্ভীর হয়ে বসে আছো কেন? সামথিং ফিসি?
আদ্রের কথায় যেন বড়দের মাঝে বম ফুটলো। ঘন্টা দুই হবে শিশির ওগুলো বলার পর থেকে কেউ কোথাও যায় নি। ওটা নিয়ে ই কথা বলছিল।
মেজ মা – আদ্র,যাক তুই এসেছিস। ভালোই হয়েছে। আমরা তোর সম্পর্কে ও কথা বলছিলাম।বাজান একটা কথা বলি?
আদ্র – পারমিশন নিচ্ছ কেন?(সোফায় বসে) বলে ফেল।
মেজ মা- বাবা, মানছি শিশির সুন্দর। সুন্দর মনের ও অধীকারি।ওর মতো মেয়ে ই হয় না। তবুও, পৃথিবীতে তো মেয়ের অভাব নেই, তুই চাইলে তোর জন্য শিশির থেকে ও সুন্দর….(আদ্র হাতের ইশারায় থামতে বলল)
আদ্র – আর বলো না। আমি সহ্য করতে পারছি না। এমনিতেই ওর ইগনোর আমি আর নিতে পারছি না। ১৮ বছর হওয়ার জন্যে অপেক্ষা করেছি, ওকে আমার রূপ এখনো দেখাই নি। তবে এবার সময় এসেছে।শুন তোমরা, এই আদ্র যতদিন বেঁচে আছে , থাকবে ততদিন শিশিরের নাম ঝপবে।আর শিশির কে ও আমার হতেই হবে।
এর মধ্যেই মিনা দৌড়ে এলো। বলল – আব্বা, অশি সেই যে এসেছে, আপনাদের সাথে রাগ করে রুমে ঢুকেছে, আমি এতো ডাকলাম দরজা খুলছে না। ওর রুমের ভেতর থেকে পানির শব্দ শোনা যাচ্ছে। কিন্তু ওর সাড়াশব্দ নেই।
কথাটা শুনতেই আদ্র দৌড়ে উপরে যেতে লাগলো। আদ্রের পিছু পিছু শান্ত ও। বাকিরা সবাই। আদ্র, শান্ত মিনিট পাঁচেক ধরে শিশির কে ডাকছে ই ডাকছে। শিশির এর কোন সাড়াশব্দ নেই।
আদ্র – শান্ত, বুঝছিস তো কী করতে হবে?
শান্ত মাথা নাড়িয়ে হ্যা বললো। দুজনই একসাথে দরজা টা ভেঙে ফেলল। পুরো রুমে শিশির কে পেল না। অবশেষে আদ্র ওয়াসরুম এ শিশির কে জ্ঞান হারানো অবস্থায় পেল।
আদ্র আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে। যেন কেউ তার থেকে খুব কাছের জিনিস ছিনিয়ে নিয়েছে। আদ্র শিশির কে ধরে বলছে – এই শিশির উঠ।উঠ না? আমি,দেখ তোর আদ্র তোর কাছে এসেছে।এই শিশির, প্রিয়তমা উঠ না? আমার নিঃশ্বাস তো চলছে তবে তুই কেন চুপ হয়ে আছোস। আমি জেগে আছি মানে তুই ও জেগে থাকবি। এটাই আদ্র শিশিরের কথা।উঠ।
শিশির কে বেডে শুইয়ে দেওয়া হয়েছে। আদ্রকে শান্ত বুঝাইছে। আদ্র নিজেকে শক্ত করে শিশিরের চিকিৎসা করলো। শিশির এখন গভীর ঘুমে। আদ্র সবাইকে পাঠিয়ে দিয়েছে রুম থেকে। সে নাকি শিশিরের খেয়াল রাখবে।
আদ্র শিশিরের কপালে উষ্ণ একটি পরশ দিল। কয়েক ঘণ্টা ই শিশিরের শরীর নেতিয়ে পড়েছে। আদ্র শিশিরের হাতটা ধরে হাতে পরশ এঁকে দিয়ে বলল-কেন আমার থেকে দূরে সরে যেতে চাস। কি নেই আমার। তোকে ছাড়া আমি ভালো থাকব না, ভালো নেই আমি। শিশির আমাকে নিয়ে যত অভিযোগ আমাকে খুলে বল না? আমি সব ঠিক করে দিব ,সব। আমাকে ছেড়ে যাস না। আমার মায়ের মতো আমাকে ছেড়ে যাস না। আমি বাঁচাতে পারব না রে।(বলেই কান্নায় ভেঙে পড়ে)
ছেলেদের নাকি কান্না করতে নেই। ছেলেরা নাকি কান্না করতে জানে না। কে বলেছে ছেলেরা কান্না করতে জানে না। একটু খোঁজ নিয়ে দেখা উচিত প্রতি রাতে শত প্রেমিক ছেলে কান্না করে বালিশ বেজায়।
___
সকাল এ হুঁশ ফিরতেই দেখি আমি বিছানায় শুয়ে আছি। হাতটা ধরে আছে, পাশে তাকিয়ে দেখলাম আদ্র ভাইয়া আমার হাতের উপর ঘুমিয়ে আছে। একটা চেয়ার টেনে বসে আমার হাত টা ধরে ঘুমিয়ে আছে। এই শীতে সে এভাবে, বুকটা কেঁপে উঠলো, সাথে সাথে ই অশ্রু ঝরে পড়লো। হাত টা টেনে নিয়ে উঠে বসতেই আদ্র ভাইয়ের ঘুম ভেঙ্গে গেল। চোখ দুটো লাল। মনে হয় সারারাত ঘুমোতে পারে নাই,না হয় কান্না করছে।
আদ্র ভাইয়ের চোখ থেকে চোখ সরিয়ে নিলাম। বিছানা থেকে নামতেই আদ্র ভাইয়া বলল….
চলবে..
শিশিরের আদ্র সিজন ২ পর্ব ১
#Neel