শুক্রবারের বিকেল (ছোট গল্প)
লেখনীতে- নৌশিন আহমেদ রোদেলা
গল্পটা এক শুক্রবার বিকেলের। তখন বোধহয় বসন্ত। অথচ দিন-রাত এক করে বর্ষা নামছে আমার ঘরের দোরগোড়ায়। সপ্তাহ দুই এই সাজানো গোছানো অলীক পৃথিবী থেকে ডুব দিয়ে মাত্রই হলে ফিরেছি। ঝমঝমিয়ে পড়া বৃষ্টিতে মাথার চুল, কুর্তি ভিজে একাকার। ঘরে ঢুকেই দেখলাম, টেবিলের উপর স্তুপ হয়ে পড়ে আছে বড়ো খালার একের পর এক আলটিমেটাম। আমি যখন হঠাৎ হঠাৎ নিরুদ্দেশ হই; টেলিফোনখানা হয়ে পড়ে অকেজো। বড়ো খালা তখন আধুনিক যন্ত্র ফেলে চিঠি লিখে পাঠান। ঘরের তালা খুলে সেই সকল চিঠি আমার ঘরে চালান করে দেন আমাদের হল ম্যানেজার। আমি চুল-মাথা ঝেড়ে টেবিলের দিকে তাকালাম। কমছে কম সাত সাতখানা চিঠি জমে আছে ওখানে। পেটের ভেতর ছুটন্ত ছুঁচো নিয়ে আর যায় হোক চিঠি পড়া যাবে না।
খুব যে ইচ্ছে আছে তেমনটাও নয়। আমরা প্রায় সকলেই জানি, বড়ো খালার মাথায় একটা ভূত আছে। সময়ে সময়ে আমাদের মধ্য থেকে কেউ কেউ সেই ভূতের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়াই৷ আমার ধারণা, ভূত মহাশয়ের এইবারের মাথাব্যথাটা স্বয়ং আমি। খুব জলদিই এই মাথাব্যথার অপসারণ করা না গেলে বড়ো খালা বাস ধরে চলে আসতে পারেন আমার হলে। বড়োই বিপদজনক মহিলা। টেবিলের এক কোণায় অকেজো হয়ে পড়া থাকা টেলিফোনটা ঠিকঠাক করে বড়ো খালাকে তৎক্ষনাৎ টেলিফোন করলাম। সাত সাতখানা চিঠিতে আমার জন্য কী রকম বিপদসংকেত ঝুলছে সে বিষয়ে একটা সাময়িক ধারণা থাকা প্রয়োজন। বড়ো খালা ফোন ধরেই ভোঁতা কণ্ঠে জানালেন, আমার বিয়ের চিন্তায় তার শ্বাসকষ্টের অবস্থা ভয়াবহ। তিনি দম নিতে পারছেন না। বুক ধরফর করছে। মনে হয়, বেশিক্ষণ বাঁচবেন না। আমি চিন্তিত কণ্ঠে বললাম,
‘ তোমার অবস্থা তো তাহলে খুবই খারাপ খালামণি। বিয়েশাদি একটা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। তোমার যা অবস্থা! কবুল বলা পর্যন্ত টিকে থাকতে পারবে বলে তো মনে হচ্ছে না। তার থেকে বরং চলো তোমায় হাসপাতালে ভর্তি করে দিই।’
বড়ো খালা বললেন,
‘ বিয়ে পর্যন্ত যেতে হবে না। তোর খালু তোর জন্য খুব ভালো একটা পাত্র দেখেছেন। পাত্র সরকারি কলেজের শিক্ষক। তিন নম্বর চিঠিতে পাত্রের বিস্তারিত সিভি দেওয়া আছে। তুই আজ বিকেলে তার সাথে দেখা করলেই ব্যাপারটা মিটে যায়।’
আমি আনন্দিত কণ্ঠে বললাম,
‘ কেন দেখা করবো না? অবশ্যই দেখা করবো। তুমি সরকারি কলেজের শিক্ষককে আনন্দমোহনের সামনে চলে আসতে বলো। শিক্ষকের সাথে সকল কথা হবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সামনে।’
বড়ো খালা ধমক দিয়ে বললেন,
‘ আমার সাথে মশকরা করার চেষ্টা করবি না, কৈশি। আমার শ্বাসকষ্টের অবস্থা খুবই বিপদজনক অবস্থায় আছে, এইটা তোর মশকরা শোনার সময় না।’
‘ মশকরা কোথায় করলাম খালামণি? আমি সিরিয়াস।’
বড়ো খালা রাগে গনগনে কণ্ঠে বললেন,
‘ পাত্র আনন্দমোহনের সামনে আসবে, এটা তোর সিরিয়াস কথা? আনন্দমোহন এসে করবেটা কী? মাঠে বসে ঘাস চিবুবে? আনন্দমোহন কী পাত্র-পাত্রীর দেখা হওয়ার মতো জায়গা?’
আমি গম্ভীর কণ্ঠে বললাম,
‘ আমার সাথে দেখা করতে হলে এখানেই আসতে হবে খালামণি। আমি সেজেগুজে সং সেজে কোনো ফাইভস্টার হোটেলে যেতে পারবো না। দু:খিত।’
বড়ো খালা কণ্ঠস্বর সপ্তাকাশে তুলে বললেন,
‘ এমনভাবে বলছিস যেন কোন ক্যাডার ফ্যাডার হয়ে বসে আছিস! পাত্র তোর মতো ক্যাডারের সাথে দেখা না করতে পারলে মরে যাবে। শোন কৈশি, এতো ঢং দেখাইস না। তোর মতো জ্বিনে ধরা মেয়ের বিয়ে এতো সহজ ব্যাপার না। তোর খালু কত কষ্ট করে এই সমন্ধটা এতোদূর এনেছে। যদিও পাত্রপক্ষের কাছে তোর জ্বিনে ধরার ব্যাপারটা গোপন করা হয়েছে। যে মেয়ে মন চাইলেই দশ-পনেরো দিনের জন্য উধাও হয়ে যায় তাকে জেনেশুনে কেউ বিয়ে করতে চাইবে? কোনো রিকশাওয়ালাও তো বিয়ে করতে চাইবে না। তারওপর তোর হাইডটাও একটু কম। পড়াশোনাও করছিস ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি থেকে। তোর বাপের আহামরি সম্পদও নাই। চিন্তা করে দেখ, কেমন রিস্ক পজিশনে আছিস!’
আমি ম্লান হাসলাম। ফিসফিস করে বললাম,
‘ আমার রিস্ক পজিশন নিয়ে তো আমার কোনো চিন্তা নেই খালামণি। আমি তো কখনোই বিয়ে করতে চাইনি, চাই না, চাইবো না। কেন অযথা জোর জবরদস্তি করে আমার শান্তি বিনষ্ট করছো? বিয়ে ছাড়া কী জীবন হয় না?’
বড়ো খালা বিরক্ত কণ্ঠে বললেন,
‘ কী মিনমিন করিস? জোরে কথা বল!’
আমি ধীর অথচ দৃঢ় কণ্ঠে বললাম,
‘ তোমার পাত্রকে আনন্দমোহন চলে আসতে বলো তো! আমি এক্ষুণি দৌঁড়ে গিয়ে মুক্তিমঞ্চের সামনে বসে পড়ছি। ভদ্রলোকের সাথে দেখা করতে আমি বিশেষ আগ্রহী।’
বড়ো খালা একটু ভেবে বললেন,
‘ আচ্ছা, বেশ! ঠিক পাঁচটায় তুই আনন্দমোহনের সামনে থাকবি। আমি তোর খালুকে ওই রকমই বলছি। তোর খালু আবার জানাবে পাত্রের মামাকে৷ শোন কৈশি, ছেলে এলে দুজনে মিলে রিকশা নিয়ে ভালো একটা রেস্টুরেন্টে গিয়ে বসবি। তাকে নিয়ে আবার ঘাসের উপর পা ছড়িয়ে বসে যাস না। তোর তো বিশ্বাস নেই। যা ইচ্ছে হয় করে ফেলতে পারিস।’
আমি হাসলাম। কল কেটে মোবাইল টেলিফোন থেকে খালামণিদের সম্ভাব্য সকল নম্বর ব্লক লিস্টে ফেলে লম্বা একটা গোসলের প্রস্তুতি নিলাম। হলের জলের লাইনে আজকাল খুব সমস্যা হচ্ছে। দুপুর হলেই গোসলের পানি পাওয়া যায় না। আজ পাওয়া গেলো। হলের মেন্যুতে আজ পাতলা খিচুড়ি আর আলু ভাজির ব্যবস্থা। আসমান থেকে ঝমঝমিয়ে জল গড়াচ্ছে। ইলেকট্রিসিটি নেই। হলের ডাইনিং ডুবে আছে আধো আধো অন্ধকারে। খিচুড়ির সুবাসের সাথে ভিজে মাটির সোঁদা গন্ধে ভরে গিয়েছে চারপাশ। আমি এক গ্রাস খিচুড়ি মুখে দিয়েই চমকে উঠলাম। হলের খাবার সাধারণত ভালো হয় না, আজ এতো চমৎকার কী করে হলো? অবিকল মায়ের হাতের রান্না। পরিবেশটাও তো পরিচিত। ঠিক পরিবেশ নয়। এই যে এই গন্ধটা! এই গন্ধটা এক লহমায় আমায় টেনে নিয়ে গেলো ছেলেবেলার বর্ষায়। গ্রাম্য মেটে পথ। আধো অন্ধকার ঘর। খাটের উপর বাবু হয়ে বসে থাকা আমি। মাটির মেঝে ভিজে উঠেছে জলে। মা ভেজা ভেজা গায়েই রান্নাবান্না করছেন। চুলোয় তখন মচমচে আলু ভাজা। আহা, শৈশবের স্মৃতিগুলো এতো সুখ সুখ দু:খ কেনো হয়? তখন, সেই ছোট্ট আমি কী কখনো বুঝতে পেরেছিলাম, বড়ো হয়ে সেই আমিটাই এতো প্রিয় হবে? মানুষ আসলে কিচ্ছু বুঝতে পারে না। বুঝতে পারলে নিজের জীবন রেখে অপরের জীবন নিয়ে অতো চিন্তা করার সুযোগ পেতো বলে মনে হয় না। এই যেমন আমার স্বস্তির জীবন দেখে বড়ো খালার শ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। জীবন ক্রমশ ফুরিয়ে আসছে, এই সেকেন্ডটা আর ফিরবে না — এই সত্যটা নিজের মনে সত্যি সত্যি উপলব্ধি করলে, বড়ো খালার এতো সহজে শ্বাস বন্ধ হতো না। শ্বাস হতো ফুরফুরে। খাওয়া শেষে তরতর করে তিন তলায় উঠে গেলাম আমি। হলের ছারপোকায় খাওয়া শক্ত বিছানায় হাত-পা ছড়িয়ে দিয়ে নির্নিমেষ চেয়ে রইলাম রঙ-চুন খসে পড়া ছাদের দিকে। সেদিকে চেয়ে থাকতে থাকতেই পৃথিবীর মানুষদের জন্য বড়ো মায়া হলো, আহা! এতো সুন্দর জীবনটা তারা ঠিক উপভোগ করতে পারলো না। সবাই বড়ো খালার মতো শ্বাসের রোগী হয়ে পড়ে রইলো। তাদেরকে সুপ্ত সেই অক্সিজেনের খোঁজ কে দিবে? অক্সিজেন কী কেউ খুঁজে দেয়? তারা জানে না, নিজের অক্সিজেন খুঁজে নিতে হয় নিজেকে।
২
চিন্তার কলে চাবি দিয়ে কখন যে চোখ লেগে এসেছিলো, বলতে পারি না। শুধু এটুকু বলতে পারি, অপরাহ্ণের তন্দ্রায় ঘুমের মাসি-পিসি আজ বড়ো নির্ঝঞ্ঝাট এক স্বপ্ন গেঁথেছিলেন। পাহাড়ি ঝরনার মতো কলকলে সেই স্বপ্ন মাত্রই একটা ক্লাইম্যাক্সে ঢুকছিলো। এমন সময় কানের কাছে সহসা বেজে উঠা অসহ্য বজ্রনির্ঘোষের শব্দে প্রথমে কিছু বুঝে উঠতে পারিনি। পরে বুঝলাম, ঘুমের দুশমন টেলিফোনটা বাজছে। কেবল এই একটা কারণে মোবাইল টেলিফোন ক্যারি করা বড়ো অসহ্য ঠেকে। ঘুমন্ত শরীরটাকে কোনোরকম টেনে তুলে টেলিফোনটা কানে নিতেই ওপাশ থেকে ভেসে এলো গমগমে এক অপরিচিত কণ্ঠ,
‘ মিস কৈশি বলছেন? আমি ইফতি মাহমুদ। আনন্দমোহনের সামনে অপেক্ষা করছি। আপনি কোথায়?’
আমার ভ্রু কুঁচকে গেলো৷ ঘুমন্ত মস্তিষ্ক তখনও পুরোপুরি জেগে উঠতে পারেনি। ইফতি মাহমুদ নামে কেউ আমার জন্যে কেন আনন্দমোহনের সামনে অপেক্ষা করবে, সে বিষয়ে মস্তিষ্ক সহসা কোনো তথ্য দিতে পারলো না। যখন বুঝতে পারলাম, তখন আর অপেক্ষা করা চলে না৷ বিনীত কণ্ঠে বললাম,
‘ ইফতি মাহমুদ সাহেব? আপনি কী আর পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করতে পারবেন? আমি আসছি।’
ইফতি মাহমুদ সাহেব অপেক্ষা করলেন। আমি বিছানা ছেড়ে চোখে-মুখে পানি ছিটিয়ে দুমড়ে-মুচড়ে যাওয়া কুর্তি পাল্টালাম। ভেজা চুলগুলো মাথার উপর চুড়োখোঁপা করে বেরিয়ে এলাম হল থেকে। শুক্রবারের গোধূলি বিকেল। টিপটিপ বৃষ্টি আর ঠাণ্ডা হাওয়া মাথায় নিয়েই জোড়ায় জোড়ায় বেরিয়ে এসেছে প্রেমী যুগল। গিটার কাঁধে বন্ধুরা। আমি কাদা-জল বাঁচিয়ে আনন্দমোহনের সামনে এসে দাঁড়ালাম। ভদ্রলোককে টেলিফোন করে শুধালাম,
‘ আপনাকে কী করে চিনবো?’
ভদ্রলোক বললেন,
‘ আমি ফুড কোর্টের সামনে বসে আছি। ব্লু শার্ট। হাতে চায়ের ভাঁড়। আপনি কোথায়?’
আমি উত্তর দিলাম না। ক্যাম্পাসের সামনে একটা নতুন ফুড কোর্ট হয়েছে, সেদিকে তাকালাম। একটা ব্লু শার্টের ভদ্রলোক দেখা যাচ্ছে বটে। বৃষ্টিতে কাঠের বেঞ্চিগুলো ভিজে জবজবে হয়ে আছে। আমি পরোয়া করলাম না। ধপ করে ইফতি সাহেবের সামনের বেঞ্চিটাতে বসে পড়ে শুধালাম,
‘ ইফতি সাহেব, কেমন আছেন?’
ভদ্রলোক আমাকে বোধহয় খুব সহজভাবে নিলেন না। চোখে-মুখে থমথমে বিরক্তি থাকলেও কণ্ঠে প্রকাশ করলেন না। শুধালেন,
‘ আপনি নিশ্চয় এখান থেকে খুব দূরে থাকেন? বৃষ্টিতে আটকে পড়েছিলেন? পাঁচটায় আসার কথা, ছয়টা বেজে গিয়েছে।’
আমি হাসলাম। নিজের জন্য চা অর্ডার করে ডানদিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে বললাম,
‘ উঁহু। ওইযে দেখছেন ছাত্রী হল? আমি ওখানেই থাকি।’
‘ তাহলে এতো দেরী হলো যে?’
আমি ইফতি সাহেবের দিকে তাকালাম। নির্মল হেসে বললাম,
‘ সত্যটা জানলে, আপনি প্রচণ্ড রেগে যেতে পারেন। বাট দ্য ভেরি ট্রুথ ইজ, আমি আপনার সাথে দেখা করবো না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম।’
ইফতি সাহেব তার ধনুকাকৃতি ভ্রু জোড়ায় ভাঁজ ফেলে নিশ্চুপ চেয়ে রইলেন। আমি নিজে থেকেই বললাম,
‘ ইফতি সাহেব, রাগ করবেন না। আমি প্রায় একশো ভাগ নিশ্চিত আমার সাথে আপনার বিয়েটা হবে না। বিয়েটা যদি না হয় তবে অযথা দেখা করার কী কোনো যুক্তি আছে বলুন?’
ভদ্রলোকের ভ্রু জোড়া তখনও কুঞ্চিত। ডান ভ্রুটা আলগোছে উঁচু করে শুধালেন,
‘ আপনি কী করে শতভাগ নিশ্চিত হলেন বিয়েটা হবে না?’
‘ উত্তরটা সহজ, পুরুষ মানুষ বিয়ে করার জন্য যেরকম মেয়ে পছন্দ করে আমি তেমন নই।’
ভদ্রলোকের কণ্ঠ তখন আরও গম্ভীর, আরও শক্ত,
‘ পুরুষ মানুষ বিয়ের জন্য কেমন মেয়ে পছন্দ করেন বলে আপনার ধারণা?’
আমার উত্তর তৈরিই ছিলো। বললাম,
‘ দারুণ রূপবতী, অল্প বয়সী এবং যে মেয়ের বাবার আছে স্বর্ণ ঝলকানো রাজত্ব। তবে আপনার ক্ষেত্রে মনে হয় কিছুটা ভিন্ন। আমি আসার আগে আপনার সিভিটা দেখেছি। আপনি বোধহয় ক্যারিয়ারের প্রতি ফোকাসড কোনো রূপবতীকে খুঁজছেন। যার ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড চমৎকার, এডুকেশন কোয়ালিফিকেশন চমৎকার, রূপ চমৎকার। সর্বোপরি চমৎকার একটি মেয়ে। আমি কোনো চমৎকার মেয়ে নই। আমার ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ডেও চমৎকার কোনো ব্যাপার নেই। আর আমার নিজেরও চমৎকার কোনো পুরুষ পছন্দ না। অতএব…’
‘ তাহলে এলেন কেন? হঠাৎ সিদ্ধান্ত বদলে যাওয়ার কারণ?’
আমি টের পেলাম ভদ্রলোকের কণ্ঠে তীব্র অসহিষ্ণু, বিরক্তি। একটা সাধারণ মেয়ের জন্য এতো অপেক্ষা তার মর্মবেদনা বাড়িয়ে দিচ্ছে। অথবা হতে পারে, এই সাক্ষাৎ বড়ো অনিচ্ছার সাক্ষাৎ। অনিচ্ছার ক্ষুরধারে এই অহেতুক অপেক্ষা তাকে আরও অপ্রসন্ন করে তুলছে। আমি ভদ্রলোকের অপ্রসন্ন চেহারার দিকে চেয়ে বললাম,
‘ সিদ্ধান্ত বদলে যাওয়ার কারণটা কিছু অদ্ভুত। আপনি কতদূর বুঝতে পারবেন, বুঝতে পারছি না। তবু বলছি, আমার ধারণা, আপনার সাথে আমার খুব কো-ইন্সিডেন্টলি একটা কো-ইন্সিডেন্ট ঘটে গিয়েছে। ব্যাপারটা কতদূর চমক দিতে পারে তা পরখ করতেই আসা।’
ভদ্রলোকের ভ্রুর কুঞ্চন ততক্ষণে আরও তীব্র হয়েছে। কপালে চিন্তা নাকি বিরক্তির বলিরেখা বুঝা গেলো না। বড়ো বিতৃষ্ণা নিয়ে শুধালেন,
‘ কী রকম কো-ইন্সিডেন্স?’
আমি হঠাৎ করেই কোনো উত্তর দিলাম না। চায়ের ভাঁড়ে চুমুক দিতে দিতে কথাগুলো গুছিয়ে নিলাম। সেকেন্ড কয়েক নিশ্চুপ থেকে বললাম,
‘ ইফতি সাহেব, বিষয়টা আপনার কাছে কিছু গোলমেলে ঠেকতে পারে অথবা অদ্ভুত। বিষয়টা হলো, আমার লেখা একটা উপন্যাসের প্রধান চরিত্রের নাম আপনার নামের সাথে হুবহু মিলে যায়। যাকে নিয়ে কথা হচ্ছে সে আমার লেখা সব থেকে আলোচিত চরিত্র। আপনি নিশ্চয় ভাবছেন, একটা নামের জন্য এতো লম্ফঝম্প কেন? একই নাম কতজনের হতে পারে। মিলে যাওয়া আশ্চর্যের কিছু নয়। কিন্তু আপনি নিশ্চয় জানেন, আপনার নিকনেইমটা একটু অন্যরকম। সচরাচর দেখা যায় না। নিকনেইমসহ মিলিয়ে মিলিয়ে গোটা নামটা মিলে যাওয়া দারুণ একটা কো-ইন্সিডেন্স না? এই পর্যন্তও ঠিক ছিলো। আপনি আমাকে টেলিফোন করার পরের মুহূর্তেও আমি ভেবেছিলাম, আমি আপনার সাথে দেখা করবো না। কিন্তু কৌতুহলবশত আপনার সিভিটা দেখার পর মনে হলো, এই ছোট্ট জীবনে ছোটখাটো কো-ইন্সিডেন্সগুলোকে পাত্তা দেওয়া যেতেই পারে। আমাদের জন্মানোটাও তো এক ধরনের কো-ইন্সিডেন্স। কাকতালীয়ভাবে জন্মে গিয়েছি, না জন্মাতেও তো পারতাম? আর জন্মেছি বলেই নতুন কতো কিছু ঘটে যাচ্ছে। এমনও হতে পারে, এই ছোট্ট কো-ইন্সিডেন্সকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে দারুণ কোনো অভিজ্ঞতা হয়ে গেলো? আমি আসলে দেখতে এসেছিলাম, একই নামের মানুষের মাঝে একই রকম কোনো আচরণ খুঁজে পাওয়া যায় কি-না! অথবা বলতে পারেন, কল্পনা কতটুকু বাস্তব রূপে আসতে পারে সেই বিষয়ে একটা পরীক্ষা।’
ভদ্রলোক খানিকক্ষণ সন্দেহী চোখে চেয়ে রইলেন।সন্দিহান কণ্ঠে শুধালেন,
‘ আপনি লেখালেখি করেন? ইউ আর আ রাইটার?’
আমি উত্তরে হাসলাম,
‘ লোকে বলে, এই বুভুক্ষুর দেশে কাকের থেকেও লেখকের সংখ্যা বেশি। ইন দ্যাট কেস, আমাদের দেশে লেখক হয়ে যাওয়া খুব অবাক হওয়ার মতো কিছু নয়। কিন্তু ইফতি সাহেব, আমার মনে হচ্ছে আপনি আমার কথাটা বিশ্বাস করছেন না।’
ভদ্রলোক উত্তর দিলেন না। আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। কিছুক্ষণ মেঘলা আকাশের দিকে উদাস চোখে চেয়ে থেকে অন্যমনস্ক কণ্ঠে বললাম,
‘ ইফতি সাহেব, আমি সচরাচর আমার লেখালেখি বিষয়ে কোনো আলোচনা পছন্দ করি না। কাউকে নিজের লেখা পড়তে সাজেস্ট করি না। কিন্তু এই প্রথম আপনাকে সাজেস্ট করতে ইচ্ছে হচ্ছে। এখানে আসার আগেও ভেবেছিলাম, এখানে আসার পেছনের কারণটা আপনাকে জানাবো না। কিন্তু আপনাকে দেখার পর মনে হলো, আপনাকে অবশ্যই জানানো উচিত। আপনার অবশ্যই আমার একটা নির্দিষ্ট বই পড়ে দেখা উচিত। সোশ্যাল মিডিয়ায় আমার একটা ফ্যান ক্লাব আছে। তারা আপনাকে দেখলে কিছুটা চমকাতো। আমার ধারণা, বইটা পড়লে আপনিও কিছুটা চমকাবেন। কেন চমকাবেন, সে উত্তর আমি আপনাকে দিবো না। সেটা আপনার হোমওয়ার্ক। হোমওয়ার্ক করতেই হবে এমন কোনো নিয়ম নেই, স্কিপ করার সুযোগ আছে।’
ভদ্রলোক কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে বিড়বিড় করে শুধালেন,
‘ ইজ ইট?’
আমি জবাবে মৃদু হাসলাম। ভদ্রলোক হাঁপ ছাড়া কণ্ঠে বললেন,
‘ বেশ! আমি হোমওয়ার্কটা করছি। কী যেন নাম বললেন আপনার বইয়ের? আপনার কাছে কপি হবে?’
আমার হাতে তখন নতুন চায়ের ভাঁড়। আমি চায়ের ভাঁড়ে চুমুক দিয়ে তার দিকে তাকালাম,
‘ হবে। নিশ্চয় হবে৷ কিন্তু আপনাকে দেওয়া যাবে না।’
ভদ্রলোক আশ্চর্য হয়ে বললেন,
‘ কেন!’
আমি হাসলাম। খাবারের দোকান থেকে একটা টিস্যু নিয়ে তাতে বইয়ের নাম লিখতে লিখতে বললাম,
‘ কিনে পড়ুন প্রফেসর। একটা বই কেনার মতো পয়সা নিশ্চয় হবে মাস্টারমশাইয়ের কাছে? এই সুযোগে যদি আমার মতো গরীব লেখকের একটা বই বিক্রি হয়, তবে কী ক্ষতি বলুন? বিজনেস ট্রিকস্, ইউ নো?’
টিস্যুটা ভদ্রলোকের দিকে এগিয়ে দিয়ে চোখ টিপলাম আমি। আলোচনার এই পর্যায়ে এসে ভদ্রলোক হাসলেন।টিস্যুতে লেখা বইটার নাম দেখে ভ্রু কুঁচকে শুধালেন,
‘ লেখকের নামের সাথে যে আপনার নাম মিলছে না কৌশি?’
আমি একটু এগিয়ে এসে, কণ্ঠ নিচু করে, প্রায় ফিসফিসিয়ে বললাম,
‘ ছদ্মনামে লিখি। কী করে মিলবে বলুন?’
‘ তাহলে এটা যে আপনার লেখা তার প্রমাণ পাবো কী করে?’
ভদ্রলোকের প্রশ্নে হো হো করে হেসে উঠলাম আমি। আশেপাশের কয়েক জোড়া চোখ ঝট করে একবার এদিকে চেয়েই চোখ ফিরিয়ে নিলো। আমি ফিসফিসিয়ে বললাম,
‘ এতো সন্দেহ করলে চলে, প্রফেসর? শিক্ষকদের হতে হয় সরল বিশ্বাসী। লেখক পরিচিতিতে আমার খুব সুন্দর একটা ছবি দেওয়া আছে। আপনি বরং আমার চেহারাটা মুখস্থ করে নিন, তাহলেই হবে।’
ভদ্রলোক টিস্যুটা পকেটে পুরে উঠে দাঁড়ালেন। বিদায় সম্ভাষণ জানিয়ে বললেন,
‘ আপনার হোমওয়ার্কের ফলাফল আপনাকে নিশ্চয় জানাবো কৈশি। আজ তবে আসি।’
আমার হাতে তখন তিন নম্বর চায়ের ভাঁড়। চারদিকে চায়ের ম ম সুবাস। সেই মিষ্ট ঠোঁটে ঝুলিয়ে মৃদু মাথা দোলালাম। আমি জানি, ভদ্রলোক হোমওয়ার্কটা করবেন না। এই প্রতিশ্রুতিটুকু কেবল সময় হয়ে আটকে থাকবে অতীতে। এই মায়ার শহরের হাওয়ায়, রাস্তার মোড়ে, কাঠের বেঞ্চিতে, টং দোকানে, শ্যাওলা পড়া ছাদের কোণে যেমন আটকে আছে সহস্র আদরমাখা প্রতিশ্রুতিরা; ঠিক তেমনভাবে আটকে থাকবে সহস্র সহস্র বছর। প্রেতাত্মার মতো দীর্ঘশ্বাস ফেলতে ফেলতে দেখবে অজস্র মৃত্যু। অজস্র ঐতিহাসিক প্রত্যাখান। ভদ্রলোক একটা রিকশা ধরে মিলিয়ে গেলেন রাস্তার মোড়ে। আমি তখনও বেঞ্চিতে বসে আছি। থেমে থাকা ঝিরিঝিরি বৃষ্টিটা আচমকা সদলবলে নেমে এসেছে। চারপাশে ছুটোছুটি। দূরে তিন-চারটে মেয়ে খুব আনন্দ নিয়ে বৃষ্টিবিলাস করছে। জীবনের এই সৌন্দর্যে আমার চোখ ভরে আসছে। যেমন বৃষ্টির জলে ভরে আসছে আমার চায়ের ভাঁড়!
৩
ক্যালেন্ডারের পাতায় বসন্ত তখন ফুরিয়ে এসেছে। চতুর্থ বর্ষের পরীক্ষা শেষ; এইবার ডুব দেওয়ার পালা। টেবিলের উপর স্তুপাকার বই আর এক কাপ ধোঁয়া উঠা চা নিয়ে বইয়ের ফর্দ করছিলাম। কোন বইটা পড়া হয়েছে, কোন বইটা পড়া হয়নি, কোনটা পড়া হবে আর কোনটা এখনও কেনা বাকি তার এক সুবিশাল লিস্ট। বিকেল হলে আধঘন্টার জন্য বেরিয়ে কিছু বই কিনে আনতে হবে। কিছু বই নীলক্ষেত থেকে পুরাতন দামে নিবো বলে লিস্ট করে রেখেছি। আসার সময় কিনে আনতে হবে দুই প্যাকেট চা পাতা। এ-ই আমার এক মাসের মজুদ। তারপর ডুব দিবো অতল এক ভুবনে। সেই ভুবনে কেবল আমার বাস; নিষিদ্ধ সকল আধুনিক যন্ত্র, আধুনিক মানুষ, আধুনিক দায়িত্ব। কিন্তু তার আগে হতচ্ছাড়া মোবাইলটার একটা ব্যবস্থা করতে হবে। এ বড়ো যন্ত্রণার যন্ত্র। আমি চকচকে চোখে আধুনিক ডিভাইসটা হাতে নিয়ে মাত্রই অনির্দিষ্ট কালের জন্যে পাওয়ার বাটন অফ করবো; এমন সময় ঘটে গেলো এক অঘটন। আমি সাধারণত ঘটন-অঘটনকে তেমন একটা পরোয়া করি না। আজ পরোয়া করতে হলো। কেন করতে হলো, সে প্রশ্ন পাঠকদের মনে উদয় হতে পারে। কিন্তু প্রিয় পাঠক, ব্যর্থতা আমার, প্রশ্নের বিপরীতে উত্তরটা আমার জানা নেই। সময়ের চোরাবালি থেকে লিলুয়া হাওয়ার মতোন ভেসে আসে কতো ঘটন-অঘটন। ভেসে আসে কত স্বর। আহ্বান দেয় বহুদূর থেকে। সে আহ্বান না শুনলেও চলে, তবু আমরা শুনি। সে আহ্বানে না থামলেও চলে, তবু আমরা থামি। আমিও থামলাম। ‘পাওয়ার অফ’ বোতামটা টিপে দেওয়ার আধ সেকেন্ড পূর্বে হোয়াটসঅ্যাপ থেকে আসা নোটিফিকেশনটা আমাকে থামিয়ে দিলো। নোটিফিকেশনটা আমায় জানালো কেউ একজন রূঢ়ভাবে জানাতে চাইছে,
‘আপনার বইটা আমার ভালো লাগেনি।’
আমি হোঁচট খেলাম। প্রথমবারের মতো আমার অতল ভুবনের দরজাটা আমারই মুখের উপর আওয়াজ তুলে বন্ধ হয়ে গেলো; ভেতরে ঢুকতে পারলাম না। ফিরে এলাম হোয়াটসঅ্যাপে। প্রথমে ব্যাপারটা ধরতে না পারলেও পরবর্তীতে বুঝলাম, কল্পনার চরিত্র নয়; সত্যিকারের ইফতি মাহমুদ বার্তা পাঠিয়েছেন। তিনশো পৃষ্ঠার বই শেষ করতে তবে তার মাস গড়িয়ে গেলো? আহ্! সাচ আ ব্যাড রিডার! আমি উত্তর দিলাম,
‘ মুখের উপর এমন রূঢ় মন্তব্য! ইশ, এতো খারাপ লিখি!’
ইফতি উত্তর দিলো,
‘ খারাপ লিখেন বলিনি তো! আপনার লেখা বেশ ঝরঝরে, সে নিয়ে আমার কোনো অভিযোগ নেই। কিন্তু চরিত্রের মধ্যে গুণের আতিশয্য ভালো লাগেনি। ইফতিকে আপনি মহাপুরুষ পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছেন। মানুষ কখনো অতো নিঁখুত হয় না।’
আমি বললাম,
‘ আপনি জানেন, মহাকাব্যে নায়ককে হতে হয় সর্বগুণে বিশেষায়িত। নায়কের প্রধান ধর্মই হলো, তাকে হতে হবে অনন্য।’
‘ কিন্তু আপনি তো মহাকাব্য লিখছেন না গ্রন্থকার। আপনি লিখছেন উপন্যাস।’
‘ বেশ! মেনে নিলাম। পাঠক হিসেবে আপনার আলাদা পারসেপশন থাকতেই পারে। আই এপ্রিশিয়েট ইট। কিন্তু ইফতি চরিত্রের মূল আকর্ষণই হলো, তার পার্ফেকশন। তাকে পার্ফেক্ট হতেই হতো ইফতি সাহেব। হি হ্যাড টু বি!’
‘ আপনার দৃষ্টিতে দেখলে হয়তো তাই। তবে আবেগের বাড়াবাড়ি ব্যক্তিগতভাবে বড়ো বিরক্ত লাগে আমার। কিন্তু স্বীকার করছি, আপনার লেখার গাঁথুনি চমৎকার।’
আমাদের কথা চললো। আমাদের কথা চললো বিরতিহীন রেলগাড়ীর মতো। পুরোটা সময় ইফতি কী দারুণভাবে নিজেকে আড়াল করে রাখলো। তবু আমি জেনে গেলাম, ইফতি কখনোই খারাপ পাঠক নয়। কী চমৎকারভাবে সে আমার বইটা পড়েছে। খুঁটিনাটি, বিস্তারিত। নিজের খারাপ লাগাগুলোর সাথে সাথে মনে রেখেছে কোথায় কোথায় লেখক হিসেবে আমি উচ্ছ্বসিত প্রশংসার দাবি রাখি। আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম,
‘ আপনার হোমওয়ার্কের কী হলো? চমকানোর মতো কিছু খুঁজে পেয়েছেন?’
ইফতি উত্তরটা দিতে একটু সময় নিলেন। অনেকক্ষণ পর কেবল লিখলেন,
‘ আই শ্যুড এপ্রিশিয়েট ইউর ইনসাইট, গ্রন্থকার। এগেইন এন্ড এগেইন।’
আমাদের কথা সেদিনের জন্য সেখানেই থেমে গেলো। আমি মোবাইল বন্ধ করে ডুব দিলাম এক মাসের জন্যে। মাস খানেক পর ফিরে এলাম একটা হোয়াটসঅ্যাপ স্টোরি নিয়ে। একটা পুরাতন ইংরেজি নোবেলের অরিজিনাল কপি খুঁজছিলাম। কোথায় পাওয়া যেতে পারে সে নিয়েই সাজেশন। ইফতি সেখানে উত্তর দিলো। আমি তার উত্তর দেখলাম দুইদিন পর। সে লিখেছে,
‘ অনলাইন শপগুলোতে না পেলে ঢাকার নীলক্ষেতে খুঁজে দেখতে পারেন। আমি অবশ্য নীলক্ষেতে পাইনি। এক বন্ধুর মারফত সরাসরি দেশের বাইরে থেকেই আনিয়ে নিয়েছিলাম।’
আমি তার উত্তরে স্যাড রিয়াকশন দিয়ে প্রচন্ড হতাশা নিয়ে লিখলাম,
‘ ওহ!’
ইফতি শুধালো,
‘ আপনি কী সংগ্রহের জন্য খুঁজছেন? নাকি পড়ার জন্য?’
আমি বললাম,
‘ দুটোই। কিন্তু পাচ্ছিই আর কই!’
ইফতি প্রস্তাব দিলো,
‘ আপনি পড়তে চাইলে আমার থেকে নিয়ে পড়তে পারেন। আমার কাছে সম্পূর্ণ সিরিজই আছে। কিন্তু পড়ে ফেরত দেওয়া বাধ্যতামূলক, গ্রন্থকার।’
ইফতির প্রস্তাবে যেন আকাশে উড়ে গেলাম আমি। অরিজিনাল প্রিন্টগুলোর যা দাম! এগুলো একবারে সংগ্রহ করে পড়তে গেলে যৌবন ঢলে যাবে সন্ধ্যায়। আমি উচ্ছ্বসিত হয়ে তাকে ধন্যবাদ জানালাম। আমাদের কথা গড়াতে লাগলো বেলা গড়ানোর মতো। আজ এইখানে দাঁড়িয়ে অতীত দেখলে মনে হয়, সেই আলাপচারিতায় যেন অন্যরকম এক সুবাস ছিলো। কেমন ছুটি ছুটি সুবাস। ছেলেবেলায় দশটা বাজতেই যেমন চারপাশে শুক্রবার শুক্রবার গন্ধ ছড়াতো? ঠিক সেরকম।
বই নিয়ে, লেখালেখি নিয়ে, দর্শন নিয়ে, চিত্রকর্ম থেকে মিথোলজি নিয়ে কথা হতো আমাদের। এমনকি ময়মনসিংহের বৃষ্টি, রাস্তা, স্টেশন রোড- গাঙিনাপাড়ের ছিনতাইয়ের ভয়াবহতা পর্যন্ত হয়ে উঠলো আলোচনার বিষয়। কেন এতো কথা হলো? কীভাবে হলো? সে কথা বলতে পারি না। কেবল বলতে পারি, আমাদের নিরন্তর কথা চললো। রোজকার রুটিনের ফাঁকফোকরে ইফতি আর আমার কথা হওয়াটা যেন একটা স্থায়ী আসন পেতে বেশ আরাম করে বসে পড়লো। নতুন কোনো বই পড়লেই তা নিয়ে দু’জনের মাঝে উঠে যেতে লাগলো তুমুল আলোচনা-সমালোচনার ঝড়। ইফতি আমাকে পরিচয় করালো ইংরেজি ক্লাসিক্যাল সাহিত্যের সাথে। আর আমি তাকে জানালাম ক্লাসিক ও রোমান্টিক বাংলা সাহিত্য। তার সাথে পরিচয় হওয়ার পরই আমি চার্লস ডিকেন্স, পাওলো কোয়ালহো, আলেকজেন্ডার দ্যুমা, হেনরি রাইডার হ্যাগার্ডের মতো লেখকদের দারুণ দারুণ লেখাগুলোর খোঁজ পেলাম। স্বাদ পেলাম নতুন এক সাহিত্য জগতের।
তারপর মাসখানেক পরের কথা। একদিন বিকেলে হঠাৎ আমার টেলিফোন বাজলো। রিসিভার তুলতেই ওপাশ থেকে ভেসে এলো ইফতির কণ্ঠস্বর। আমাকে অবাক করে দিয়ে বললো,
‘ আপনি যে বইগুলো চেয়েছিলেন সেগুলোর মধ্য থেকে তিনটে বইসহ আমি দাঁড়িয়ে আছি আপনার হলের সামনে। জলদি নিচে নামুন, গ্রন্থকার।’
আমি চট করে ক্যালেন্ডারের দিকে চাইলাম। ইফতির পোস্টিং কিশোরগঞ্জ৷ মাসের দুটো শুক্রবার সে বাড়ি আসে ছুটি কাটাতে। তবে কী আজ শুক্রবার বিকেল? আমি হলের ফটক পেরিয়ে বেরিয়ে আসতেই এক ঝাঁক হলুদ আগুন মাথায় নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা পলাশ গাছটার নিচে অলস ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম ইফতিকে। সেই সন্ধ্যার পর এই আমাদের প্রথম দেখা। ইফতি আমাকে দেখেই এগিয়ে এলো। সুন্দর হেসে বললো,
‘ চলুন, হাঁটি।’
আমরা হাঁটলাম। পেয়ালার পর পেয়ালা চা খেলাম। ইফতি যে বই তিনটে এনেছিলো; তা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়ে দেশ, রাজনীতি, দর্শন, ফার্স্টফুড, চা কত রকমের হতে পারে এইসব আলোচনা চলতে চলতে রাত্রির আটটা বেজে গেলো। ইফতি ফিরে গেলো রাত নয়টার পর৷ তারপর থেকে আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ বার্তা সীমিত হয়ে, দেখা হওয়ার মাত্রা বেড়ে গেলো। ইফতির বাড়ি ফেরার সময়টা মাস থেকে নেমে সপ্তাহে এসে ঠেকলো। আর প্রতি শুক্রবার বিকেল ঠিক চারটেতে আমাদের দেখা হওয়াটা যেন অনিবার্য সত্য হয়ে গেলো।
আমি আর ইফতি চষে বেড়াতে লাগলাম ময়মনসিংহের অলি-গলি, সর্বত্র। টাউন হল, কলেজ রোড, গাঙিনাপাড়, সার্কিট হাউস, জয়নুল আবেদীন, ব্রহ্মপুত্র নদ, প্রেস ক্লাব, এগ্রিকালচারের রেলপথ সর্বত্র ছড়িয়ে পড়লো আমাদের কথা ফুলের রাশি। কোনো কোনোদিন চারটে থেকে রাত আটটা পর্যন্ত আমরা কেবল হেঁটে বেড়াতাম। কোনো কোনোদিন ধোঁয়া উঠা চায়ের পেয়ালাতেই জমে উঠতো আড্ডা। একের পর এক পেয়ালা ফাঁকা হতেই গল্পের মোড় বদলে উঠে আসতো জীবনানন্দ, বিষ্ণু রায়, রবীন্দ্রনাথ। চারটে থেকে শুরু করে রাত আটটা পর্যন্ত বিরতিহীন আড্ডা। বিরতিহীন চায়ের পেয়ালা। শুধু আমরা নই ; হলের দারোয়ান, হল ম্যানেজার, মোড়ের রিকশাওয়ালা, টং দোকানের মামা, ফুসকা বেঁচে যে হ্যাংলা করে ছেলেটা– সকলেরই মুখস্থ হয়ে গেলো রোজ শুক্রবার ঠিক বিকেল চারটায় আমাদের টাইমটেবল। কোনো বিকেলে হঠাৎ ইফতির কাজ পড়ে গেলে তারা বড়ো আশ্চর্য হয়ে শুধাতো,
‘ আজ ভাইয়া আসেননি, আপু?’
আমি একা বসে চায়ে চুমুক দিতাম আর চেয়ে দেখতাম তাদের চোখের অকৃত্রিম মুগ্ধতা। অথচ, তখনও আমরা জানি না, ঠিক কী আমাদের সম্পর্কের সমীকরণ? আমাদের সম্পর্কের নাম কী? কী বলা যায় একে? তারপর একদিন হঠাৎ করেই আপনি থেকে তুমিতে নেমে এলাম আমরা। বুঝলাম, আমাদের সম্পর্কের একটা নাম হলো। আমরা এবার বন্ধু হলাম। সত্যিই বড়ো ভালো বন্ধু হয়েছিলাম আমরা৷ একে অপরের সম্বন্ধে একটা মানদণ্ডও তৈরি হয়ে গিয়েছিলো। নিজের মনের সকল বাষ্প বিনা দ্বিধায় উড়িয়ে ফেলতে পারতাম অপরের রোদ্দুরমাখা দুপুরটায়। ইফতি বরাবরই আত্ম-গম্ভীর মানুষ আর আমারও পরিচিত জগতের সাথে দেওয়াল রেখে চলা অভ্যাস। নিজেদের কথা বলার মতো বিশ্বস্ত মানুষ আমরা দীর্ঘ জীবনটাতে কক্ষনো পাইনি অথবা হতে পারে আমরা নিজে থেকেই কাউকে বিশ্বাস করতে চাইনি। সেই আগলটা, সেই না-বলার দেওয়ালটা এবার উবে গেলো আপনা-আপনি। বিনা কারণে জাজ হওয়ার ভয়, কথাগুলো আপন মর্যাদা পাবে না, কারো কাছে ঠিক বোধগম্য হবে না অথবা হতে পারে এই সকল কথা বলার মতো যোগ্য মানুষ নেই — এই ভাবনাগুলো সরে গিয়ে আমাদের কথাগুলো হয়ে গেলো উন্মুক্ত।
আমরা দু’জনেই তখন বয়ঃপ্রাপ্ত; পরিবারের বিবাহ সংকটে পিষ্ট। আমার ব্যাপারটা যদিও সহজ ছিলো। আমি চাইলেই ডুব দিতে পারতাম; হারিয়ে যেতাম কিছুদিনের জন্যে। কিন্তু ইফতির জন্য ব্যাপারটা হয়ে পড়লো খুব কঠিন। এক শুক্রবার বিকেলে সে এলো মুখ ফুলিয়ে। আমাকে দেখেই বললো,
‘ মানুষের আক্কেলজ্ঞান দিন দিন কী রকম লোপ পাচ্ছে জানো?’
আমি মাথা নেড়ে জানালাম, এই বিষয়ে আমার কোনো অভিজ্ঞতা নেই। ইফতি চোখ জোড়ায় কৃষ্ণাভ ছায়া নিয়ে বললো,
‘ আমার এক বন্ধু তার বোনের সাথে আমার বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে, এই পর্যন্ত ঠিক ছিলো। কিন্তু তুমি জানো তার বোনের বয়স? মেয়েটা মাত্র ক্লাস এইটে পড়ে। চিন্তা করে দেখো, এই ছেলে আমার বন্ধু হয়ে কী করে এমন বাচ্চা মেয়ের প্রস্তাব দিতে পারে আমার কাছে? একটু কম বয়েসে বিয়ে করলে আমার ছেলে-মেয়ের বয়েসই তো প্রায় এই মেয়ের সমান হয়ে যেতো। এরা আমাকে ভাবেটা কী, আশ্চর্য!’
আমরা তখন জয়নুল আবেদীনের ভেতরের রাস্তা ধরে হাঁটছি। চারপাশে ধীরে ধীরে নেমে আসছে সন্ধ্যা। এই সন্ধ্যার মুখে ইফতির এমন ক্ষোভের কথা শুনে হো হো করে হেসে উঠলাম আমি। হাসতে হাসতে আমার চোখে জল চলে এলো। শান বাঁধানো বেঞ্চিতে বসে পড়ে বললাম,
‘ তুমি একটা ছাগল ইফতি। ইউ শ্যুড নো, কচি বয়সের মেয়েদের বিয়ে করার মজাই ভিন্ন।’
ইফতি তখন আমার সামনে দাঁড়িয়ে, চিরাচরিত নিয়মে ভ্রু জোড়া কুঁচকে ফেলে বললো,
‘ তোমার কথার ধরণ শুনে মনে হচ্ছে, তোমার অভিজ্ঞতা সুদূরপ্রসারী? কয়টা কচি মেয়ে বিয়ে করেছ এ পর্যন্ত? এতোই যখন মজা তখন তুমিই বিয়ে করে ফেলো একটা ক্লাস এইটের কচি ছেলে দেখে। আমার স্টুডেন্টদের ছোট ভাই-টাই পেলেও পেয়ে যেতে পারো।’
আমার প্রাণখোলা হাসি বাঁধনহারা হলো এবার। কলমির নরম ডগার মতো নুইয়ে পড়লাম শান বাঁধানো বেঞ্চির উপর। আশপাশ থেকে উৎসুক মানুষ বার কয়েক দৃষ্টি তুলে চাইলোও। আমার আর ইফতির সেদিকে পরোয়া নেই। ইফতি বিরক্ত হয়ে বললো,
‘ খেঁক খেঁক করে হাসবা না তো। বিয়ে যে কী একটা কঠিন জিনিস! ছোটবেলার মতো অপু, দশ, বিশ করে একটা মেয়ে পছন্দ করে বিয়ে করে ফেলা গেলে সুবিধা হতো।’
আমার থেমে আসা হাসি আবারও হো হো পর্যায়ে ফিরে গেলো। ইফতিকে বললাম,
‘ তোমার আসলে কেমন মেয়ে পছন্দ তাই বলো!’
ইফতি মুখখানা অসহায় করে ফেলে বললো,
‘ কেমন মেয়ে পছন্দ তা তো বুঝতে পারছি না। মেয়ে কী কোনো জিনিস? কীভাবে বুঝবো কেমন পছন্দ?’
আমি ইফতির দিকে তাকালাম। এ ছেলে বড়ো বেশি চুজি। প্রত্যেকবার তার পাত্রী সম্বন্ধীয় অদ্ভুত অদ্ভুত যন্ত্রণার কথা মনে পড়ে। কখনো এসে বলবে, ‘এই কৈশি, মেয়েটা এতো লাজুক! তার লজ্জা দেখে আমারই কেমন লজ্জা লাগছিলো। এতো লজ্জা পাওয়া মেয়ে বিয়ে করা তো যন্ত্রণার!’ আবার কখনো এসে বলবে, ‘ মেয়েটা প্রচন্ড ফাস্ট। আমার সামনে বসেই বারবার ফোনের ভেতর উঁকিঝুঁকি দিচ্ছিলো। কথায় কোনো কনসেনট্রেশান নেই। কেউ কথা বললে তো আমাদের একটু মনোযোগ দিয়ে শোনার চেষ্টা করা উচিত, তাই না? এমন হলে কীভাবে চলবে?’ আমি বললাম,
‘ মেয়েগুলো যথেষ্ট রূপবতী কিনা সেটা বলো? লাজুক, ফাস্ট, ফোনে উঁকিঝুঁকি দেওয়া বড়ো কোনো বিষয় নয়। তোমার কাজ চললেই হলো।’
ইফতি কটমট করে চাইলো। ধমক দিয়ে বললো,
‘ হোয়াট ডু ইউ মিন, আমার কাজ চললেই হলো? একটি বুদ্ধিদীপ্ত আলোচনা যৌন সম্ভোগের থেকেও আরামদায়ক। সেক্ষেত্রে রূপসী অথচ নির্বোধ স্ত্রী দিয়ে আমি করবোটা কী বলো? নির্বোধ মানুষ আমার একদমই সহ্য হয় না। দেখলেই মেজাজ খারাপ হয়ে যায়।’
আমি অবাক হয়ে বললাম,
‘ ও মাই গড, ইফতি! তুমি কী কোনোভাবে স্যাপিও? স্যাপিওসেক্সুয়াল পারসন?’
ইফতি আমার দিকে চাইলো। ধনুকাকৃতি ভ্রু জোড়ায় ভাঁজ ফেলে বেশ সময় নিয়ে ভাবলো। অন্যমনস্ক কণ্ঠে বললো,
‘ স্যাপিও? হু, হতেও পারে।’
তারপর আবার কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললো,
‘ এই কৈশি? এভাবে তো ভেবে দেখিনি। আমি স্যাপিও হলে তো ভয়াবহ সমস্যা। এবার তো আমার বিবাহ সংকট আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পৌঁছে যাবে বলে মনে হচ্ছে। আমার বোধহয় আর কোনোদিন বিয়ে করা হবে না।’
আমি আবারও দমফাটা হাসিতে ফেঁটে পড়লাম। ইফতি আমার পাশে পাংশুটে মুখ করে দাঁড়িয়ে রইলো। বর্তমানে, বিয়ে তার জীবনে সব থেকে বড়ো সমস্যা। সে ব্যাপারটা নিয়ে খুব সিরিয়াস রকম চিন্তিত।
৪
ইফতি আর আমার বন্ধুত্ব তখন বছর পেরিয়েছে। বর্ষা মৌসুম। আমার মাস্টার্স পরীক্ষা শেষ। হঠাৎ মাথায় এক ঝাঁক আষাঢ় নিয়ে ভাইজান এসে হাজির৷ কোনোরকম সংবাদ ছাড়া তার এই আগমনে আমি কিছু অবাক হলাম। ভাইজান আমাকে জানালেন,
‘ঘটনা অপেক্ষা করে থাকার মতো নয়। একটা বিয়ের কথা চলছে বাসায়। আমি যেন বাবার মানসম্মানের কথা চিন্তা করে হলেও আগামী সপ্তাহে বাসায় যাই। দেখতে এলেই তো আর বিয়ে হয়ে যাচ্ছে না? পাত্রপক্ষ দেখে যাক। বিয়ে করবো কী করবো না সে পরের বিষয়।’
আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে তাকে আশ্বস্ত করলাম,
‘বাড়ি আমি ফিরছি। দুশ্চিন্তা করার কোনো কারণ নেই।’
ভাইজান আমার হাতে পাত্রের সিভি ধরিয়ে দিয়ে ওয়েটিং রুম থেকেই বিদেয় নিলেন। আমি ঘরে ফিরে সিভি দেখতে বসেই বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে গেলাম। আবার সেই ইফতি! কী আশ্চর্য! মেজাজ আমার তখন ভয়ঙ্কর খারাপ। এই ইফতির পরিবারে নিশ্চয় কোনো মাথা পাগল বড়ো মামা আছেন? নয়তো এমন আকামগুলো করে কে, আশ্চর্য! তিনদিন বাদে, শুক্রবার বিকেলে ইফতির সাথে দেখা হতেই কটমট করে চাইলাম আমি। ধমক দিয়ে বললাম,
‘ তোমার ফ্যামিলিতে কোনো মাথা পাগল বড়ো মামা আছে কি-না বলো!’
ইফতি অবাক হয়ে বললো,
‘ এতো তেতে আছো কেনো?ঘটনা কী?’
‘ তোমাদের বাড়ি থেকে সিভি এসেছে আমার বাবার হাতে। তারা পরের সপ্তাহে আমাকে দেখতে আসছে। আর তুমি একটা ছাগল; তুমি কিছুই জানো না।’
ইফতি হঠাৎ করেই গম্ভীর হয়ে গেলো। চোখ-মুখ শক্ত করে আমার দিকে চেয়ে থেকে বললো,
‘ চলো হাঁটি।’
আমি মুখ ভার করে হাঁটছি। মন-মেজাজ অসম্ভব রকম খারাপ। ইফতির দিকে চেয়ে শাসিয়ে উঠে বললাম,
‘ আমার যদি তোমার সামনে সেজেগুজে, সং সেজে যেতে হয় আমি কিন্তু তোমার মাথা ফাটিয়ে ফেলবো ইফতি।’
ইফতি প্রত্যুত্তরে কিছু বললো না। কিছুক্ষণ চুপচাপ, উদ্দেশ্যহীন হাঁটার পর আমার মাথা ঠান্ডা হলো। ইফতি যেন সেই অপেক্ষাতেই ছিলো। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ডাকলো,
‘ কৈশি?’
আমি সাড়া দিলাম,
‘ হু?’
‘ তুমি জানো কৈশি? সকালের নিউজ পেপার পড়তে পড়তে হঠাৎ কোথাও ময়মনসিংহের নাম দেখলে আমার তোমার কথা মনে পড়ে যায়। বইয়ের পাতায়, দেওয়ালের পোস্টারে, টেলিভিশনের এডভারটাইজমেন্টে এমনকি বাসের কন্ট্রাক্টর ‘ময়মনসিংহ’ বলে চেঁচিয়ে উঠলেও আমার তোমার কথা মনে পড়ে যায়। আমার কাছে ময়মনসিংহ মানে তুমি হয়ে গিয়েছো কৈশি। এই ছুটির বিকেলগুলোর মতো আমি তোমাকে নিয়ে গোটা দেশ ঘুরতে চাই। তারপর পুরো পৃথিবী। আমি চাই, পৃথিবীর যেকোনো কোণে দাঁড়িয়ে ‘বাংলাদেশ’ শব্দটা শুনতেই আমার তোমার কথা মনে পড়ে যাক। জীবনের এতো প্রতিযোগিতা, হারজিত, টিকে থাকার লড়াইয়ে হয়রান হয়ে কোথাও ‘জীবন’ শব্দটা শুনলেই মনে পড়ে যাক আমার একটা দেশ আছে। একটা শহর আছে। কিছু রোদ মরা বিকেল আছে। আর আছে একটা কৈশি। যার গায়ে শুক্রবারের বিকেলের মতোন সুবাস আছে।’
আমি আচমকা দাঁড়িয়ে পড়লাম। বিরক্ত কণ্ঠে বললাম,
‘ ইফতি! আর ইউ প্রপোজিং মি?’
ইফতি মুখ ভার করে বললো,
‘ দেখো কৈশি, আমার কিন্তু ছ্যাঁকা খাওয়ার বয়স নেই। ওরকম কিছু চিন্তাও করবে না।’
‘ আমি তোমাকে আগেই বলেছিলাম, আমার এইসব বিয়ে-শাদিতে মন নেই। আমি বিয়ে করবো না।’
‘ তো কী করবে? প্রতি বিকেলে একা একা ফড়িং-এর মতো উড়ে বেড়াবে? মন চাইলেই অন্য ভুবনে হারিয়ে যাবে? আনন্দ-উৎসব করবে? আর আমি বেকুব বিয়ে করে জীবন ধ্বংস করে ফেলবো? অসম্ভব, তোমার এতো সুখ তো আমার সহ্য হবে না কৈশি। বিয়ে তোমাকে করতেই হবে।’
আমি অবাক চোখে চাইলাম। হতাশ কণ্ঠে বললাম,
‘ কত বড়ো পাপী! হিংসুটে পুরুষ মানুষ! এই তুমি আমার বন্ধু?’
ইফতি চোখে-মুখে একটা ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে কাঁধ ঝাঁকালো। বললো,
‘ এটাকে হিংসা বলে না, গ্রন্থকার। এটাকে বলে নিজের জন্য ভাবা। আমি কেবল নিজের জন্য ভাবছি। আমি অন্য মেয়েকে বিয়ে করে ঘরে কুঁজো হয়ে থাকবো আর তুমি ফড়িং এর মতো উড়বে। এটা আমার সহ্য হবে কেন বলো?’
‘ তাহলে তুমিও করো না বিয়ে। কে জোর করছে?’
ইফতি চোখ বড়ো বড়ো করে তাকালো,
‘ কে জোর করছে! আমার পুরো গোষ্ঠী রীতিমতো ছুরি-চাকু নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দেখো কৈশি, আমি কল্পনা করে দেখে ফেলেছি। তোমাকে ছাড়া অন্য কাউকে নিয়ে বিকেল হাঁটা আমার হবে না৷ অন্য একটা মেয়ের সাথে আমি কী নিয়ে গল্প করবো? ভাবতেই তো বিরক্ত লাগছে। তাছাড়া, আমার দুঃস্বপ্ন দেখলেও তোমাকে বলা অভ্যাস। প্রতি শুক্রবার, বউ আমাকে তোমার কাছে আসতে দিবে? উফ, কৈশি! রাজি হয়ে যাও তো দ্রুত। আজাইরা যন্ত্রণা ভাল্লাগছে না। আর কেমন বন্ধু তুমি? বন্ধুর জন্য সিম্পল একটা বিয়ে করে ফেলতে পারছো না? এতো নিষ্ঠুর তুমি! এই তোমার বন্ধুত্ব? আমি হলে তো বলার আগেই রাজি হয়ে যেতাম।’
আমাদের ঝগড়া চললো রকেটের গতিতে। আমি চোখ ছোট ছোট করে বললাম,
‘ এমনভাবে বলছো যেন বিয়ে নয় নতুন একটা বই চাইছো। বই হলে দিয়ে দিতাম কিন্তু বিয়ে!’
ইফতি নির্লিপ্ত কণ্ঠে বললো,
‘ তো? বিয়ে করা তো বই দেওয়ার থেকেও সহজ। বই দিলে দিতে হবে স্বত্ব ত্যাগ করে; বিপরীতে কিছু পাবে না। কিন্তু বিয়ে করলে তৎক্ষনাৎ একটা ত্রিশ বছরের ব্যক্তিগত পুরুষ পেয়ে যাবে। সেই পুরুষের একটা বিশাল লাইব্রেরি থাকতে পারে। দারুণ সেন্স অব হিউমার থাকতে পারে। বুক ভরা ভালোবাসা থাকতে পারে। কত লাভ!’
ইফতির কথায় হেসে ফেললাম আমি। ঠোঁটে মধুর হাসি নিয়ে বললাম,
‘ তাই! তাহলে বলো, তোমার এক্সক্লোসিভ বুক কালেকশনের সকল মালিকানা আমার।’
ইফতি চোখ বড়ো বড়ো করে চাইলো। কপট বিস্ময় নিয়ে বললো,
‘ কতবড়ো ধান্ধাবাজ তুমি কৈশি! আমি কিন্তু ভুলিনি তুমি আমার থেকে সাতটা বই মেরে দিয়েছো। আমি লিস্ট করে রেখেছি।’
আমি অবাক হয়ে বললাম,
‘ আমি তোমার জন্য সন্ন্যাস ধর্ম ছেড়ে সংসার ধর্মে নিজের জীবন বাজি রাখতে চলেছি। আর তুমি সাতটা বইয়ের কথা ভুলতে পারছো না? আশ্চর্য ইফতি!’
ইফতি প্রত্যুত্তরে কিছু বললো না, মৃদু হাসলো মাত্র। আমাদের ঝগড়া, কথা-কাটাকাটি বন্ধ হয়ে গেলো ঝোপ করেই৷ দু’জনেই হাঁটতে হাঁটতে নদীর পাড়ে গিয়ে বসলাম। নিশ্চুপ চেয়ে থেকে তেজস্বী সূর্যকে নদীর বুকে মুখ লুকাতে দেখলাম। নদীর টলটলে জলে পা ভিজিয়ে চেয়ে রইলাম বাহারি নৌকোর পালে। বাহারি প্রেমিযুগলে। ঘন্টার পর ঘন্টা পেরুলো। কারো মুখে কোনো কথা ফুটলো না। বিরক্তি এলো না। অস্বস্তি হলো না। চারপাশ থেকে পরিপূর্ণতার হাওয়া বুক বেয়ে জলস্রোত তুলতেই উপলব্ধি করলাম, ‘ জীবনে আসলেই একটা মানুষ প্রয়োজন। যার কাছে নির্দ্বিধায় সকাল হওয়া যাবে। মন চাইলেই ঝোপ করে হয়ে যাওয়া যাবে বিষণ্ণ সন্ধ্যা অথবা রৌদ্রজ্জ্বল প্রখর দুপুর।’ ইফতি আর আমি দু’জনেই একই আকাশের দিকে আলস্যহীন চেয়ে রইলাম ঘন্টার পর ঘন্টা। ক্লান্ত চিল উড়ে গেলো। আশেপাশের কোনো এক ঝোঁপে ঢেকে উঠলো জোনাকের দল। আকাশের কোণে নামলো সন্ধ্যা। ইফতি সেই সন্ধ্যার দিকে চেয়ে থেকেই শুধালো,
‘ কৈশি? ক্যান আই কনফেস ইউ সামথিং, কৈশি?’
‘ হু, বলো।’
‘ আমি যখন তোমাকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, তখন ভেবেছিলাম ভালোবাসা না থাকলেও চলবে। আমাদের এই সুন্দর বন্ধুত্বকে পুঁজি করেই আমরা কাটিয়ে দিতে পারবো চমৎকার এক দাম্পত্য জীবন। কিন্তু ঘন্টাখানেক আগে। তোমাকে বিয়ের কথাটা বলার পর… আমার সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে কৈশি। আমার মনে হচ্ছে, আমি তোমাকে প্রচন্ড ভালোবাসি। তুমি আমাকে ছেড়ে গেলে আমি বোধহয় মরে যেতাম। আমার মনে হচ্ছে, তুমি আমার কাছে শুক্রবার বিকেলের থেকেও প্রিয়। আমি তোমাকে শুক্রবার বিকেলের থেকেও বেশি ভালোবাসি। অনেক বেশি। এতো ভালো বোধহয় আমি আর কখনো কাউকে বাসতে পারিনি।’
আমি শূন্যদৃষ্টিতে আকাশের দিকে চেয়ে ছিলাম। এবার ঘাড় ফিরিয়ে ইফতির দিকে চাইলাম। ধীরে ধীরে আমার চোখের কোণে জল জমতে লাগলো। আমি আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করলাম, আকাশ থেকে যেমন সন্ধ্যা ঝরছে ঠিক তেমনই হৃদয়ের নদী তটে শিরশির করে ঝরে পড়ছে নতুন এক অনুভূতি। হাজারও ভালোবাসার গল্প লেখা আমি হঠাৎ ঠাহর করে উঠতে পারলাম না, ‘ এর নামই কী ভালোবাসা? নাকি ছুটির মতো সুবাস ছড়ানো এ এক শুক্রবারের বিকেল?’
সমাপ্ত…
[ যারা আমার জন্য এক বুক অভিমান নিয়ে অপেক্ষা করছে তাদের জন্য। আমিও তোমাদের শুক্রবারের বিকেলের মতো ভালোবাসি। ভালোবাসা
ও হ্যাঁ, গল্প পড়লে মন্তব্য কিন্তু কাম্য। পেইজের রিচের যা অবস্থা! ]