অচেনা পর্ব ২
বিয়ে উপলক্ষ্যে মেজ চাচী আমার মুখে গলায় কি জানি লাগিয়ে দিয়েছে। সবুজ সবুজ জেলের মতো কিছু। তারমধ্যে আবার চিনিও আছে।
এখন বাজে রাত নয়টা। রাত আটটার মধ্যে আমাদের বাড়িতে খাওয়া দাওয়া শেষ হয়ে যায়। এরপর যে যার মতো কাজ করে। মেজ চাচী এই পুরো সময়টা রূপ চর্চার পেছনে ব্যয় করেন। আমার বিয়ে উপলক্ষ্যে আমাকেও গত একুশ দিন ধরে চাচী এরমধ্যে ঢুকিয়ে নিয়েছেন। আর সাতদিন পর আমি এসব থেকে মুক্তি পাবো।
আপাতত মুখে স্ক্রাব নামের কিছু একটা দিয়েছি। এইটা মেজচাচী সিঙ্গাপুর থেকে অনলাইনে কিনে এনেছেন আঠারোশো টাকা দিয়ে। স্ক্রাব ঘষাঘষির পর কিছুক্ষণ ব্রেক দিয়ে প্যাক লাগানো হয় মুখে। সেই প্যাকের হলুদ এসেছে ছোটচাচীর গ্রামের বাড়ি থেকে। ওখানকার মাটি নাকি ভালো। দুধের সরটা চাচী নিজ দায়িত্বে দাঁড়িয়ে থেকে আলাদা করেন প্যাকের জন্য। নানা আয়োজন করে বানানো প্যাক রাতে আমি মুখে দিয়ে বসে থাকি। এই প্যাক বানানোর জন্য মেজচাচীর আলাদা ছোট শিলপাটা আর হামানদিস্তা আছে। অর্থাৎ আয়োজনের সীমা নেই।
সামনে আমার দুই চাচাতো বোন আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ওরা যমজ। এখন ক্লাস সেভেনে পড়ছে। ওদের নাম রুনি টুনি। রুনি টুনি আমার বিয়ে নিয়ে বেশ চিন্তিত। তারা ভেবে পাচ্ছে না যে তাদের ভূমিকা কি এই বিয়েতে! বিয়ের শপিং-এ ওদের নিয়ে যাওয়া হয়নি। আলোচনাতেও রাখা হয়নি। এমনকি রুনি টুনির জন্য জামাও মেজচাচী মানে ওদের মা গিয়ে কিনে এনেছে। তারা খুব চিন্তিত যে বিয়েতে তারা কি করবে!
এদিকে আমি চিন্তিত আমার প্রেম নিয়ে। বিয়ের দিন ঘনিয়ে আসছে অথচ কেউ একটা প্রেমপত্র দিলো না জীবনে। আমাদের ক্লাসের তনু যার কুশ্রী চেহারার কারণে ক্লাসে নাম ছিলো কাকতাড়ুয়া তারও এইচএসসির সময় পাশে বসা ছেলের সাথে প্রেম হয়ে গেলো। কলেজে উঠে বয়ফ্রেন্ড আবার বদলে গেলো। অথচ আমার জীবনটা একটা সোজা লাইনের মতো। কোন প্রেম নাই ছেলেদের ঘুরঘুর করা নাই। কিছুই নাই। আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম।
এইসব চিন্তা করতে করতে আমি বারবার রুনি টুনিকে সময় জিজ্ঞেস করছি। পনেরো মিনিট পর স্ক্রাব নামের বস্তুটি ঘষে তোলা হবে। এতক্ষণে কেবল দশ মিনিট হয়েছে। মেজচাচীর মতে আমার ত্বক এটা দিলে মখমলের মতো হয়ে যাবে। কিন্তু প্রতিবার উঠানোর সময় চাচী যে ডলা দেয় তাতে ত্বকের আগে থাকা নরম ভাবও উঠে যাওয়ার উপক্রম হয়।
পনেরো মিনিট পর বস্তুটি তোলা হলো। এখন আমার পনেরো মিনিটের ছুটি। এই সময়টা আমি রুনি টুনিকে নিয়ে ছোট চাচীর ঘরের দিকে গেলাম। ছোট চাচী আমার হলুদের জন্য সবাইকে নাচ শেখাবে। উনি নিজে জীবনেও নাচ শিখেনি বা এই বিষয়ে উনার কোন অভিজ্ঞতা নেই। কিন্তু উনি অনেক হিন্দি সিনেমা ও রিয়েলিটি শো দেখে। চাচী নিজে থেকেই বিয়েতে এই দায়িত্ব নিয়েছে। ম্যাক্সি পরে আশি কেজি ওজনের একজন মহিলা ধেই ধেই করে নাচছে। দৃশ্যটা একেবারেই সুন্দর না। কিন্তু ছোট চাচী এসব নিয়ে তেমন চিন্তিত না। উনি উনার বাটন ফোনে গান ছেড়ে নাচানাচি করছেন। রুনি টুনি ভয়ার্ত গলায় বললো,
“আপা, এই নাচটা আমাদের দুই বোনের জন্য। আমরা কি করবো?”
আমি তাদের দিকে তাকিয়ে কিঞ্চিৎ আশ্বস্ত করার হাসি দিলাম। কিন্তু আমিও বুঝলাম যে বিষয়টা সুবিধার ঠেকছে না।
ছোট চাচীর ঘরে বসে আমি দ্রুত চিন্তা করতে লাগলাম আমার চেনা ছেলেদের সম্পর্কে। আমি প্রায়ই এই কাজটা করি। আশেপাশের ছেলেদের লিস্ট করি মনে মনে। কে আমাকে নিয়ে কি ভাবছে বোঝার চেষ্টা করি। পরে আমার নিজের মনেই তাদেরকে রিজেক্ট করি। বাস্তবে তারা কবে আসছে যাচ্ছে তা আর খেয়াল থাকে না।
আমার লিস্টে আজীবন সবার প্রথমে থাকে শিবলী ভাই। শিবলী ভাই আমার বড় ভাইয়ের বন্ধু। স্কুল, কলেজ, মেডিকেল কলেজ সব একসাথে পড়েছে। প্রায়ই আমাদের বাসায় আসে। ক্লাস সেভেন থেকে আমার ধারণা শিবলী ভাই আমার জন্যই এই বাড়িতে আসে। ক্লান নাইনে পড়তে শিবলী ভাই একবার আমাকে ডেকে মেয়েদের পছন্দ অপছন্দের লম্বা লিস্ট নিলো। আমি লজ্জায় থেমে থেমে সবগুলোর উত্তর দিলাম। সবগুলো সে টুকে নিলো। পরেরদিন ভাইয়া এসে গম্ভীর গলায় বললো,
“তুই নাকি শিবলীকে বলেছিস যে মেয়েদের প্রিয় গাছ ক্যাকটাস?”
আমি খুব ভয়ে ভয়ে মাথা নাড়লাম। শিবলী ভাইয়ের উপর খুবই রাগ লাগলো। এসব ভাইয়াকে বলার কি দরকার ছিলো! এসব তো আমাদের দুইজনের ব্যাপার।
আমার ভয়ার্ত চেহারার দিকে তাকিয়ে ভাইয়া হেসে বললো,
“আরেহ! তুই ভয় কেন পাচ্ছিস? আমি জানি তোর ক্যাকটাস পছন্দ। কিন্তু মিষ্টি তো তোর মতো না। তার পছন্দ অর্কিড। দামী ফুল তো। অর্কিড আবার ফুটেও অনেক দিন পর। এরপর থেকে কেউ তোকে মেয়েদের পছন্দ জিজ্ঞেস করলে তোর বান্ধবীদের পছন্দগুলো বলবি। নিজেরটা না। বুঝলি?”
তেমন কিছু বুঝলাম না। শুধু বুঝলাম শিবলী ভাই এতসব টুকাটুকি করেছে মিষ্টি নামের এক মেয়ের জন্য। এরপরে শিবলী ভাইয়ের জীবনে অনেক মেয়ে এসেছে আবার চলেও গিয়েছে। আমার কেন জানি মনে হয় আমার জন্যই হয়তো কোন মেয়ে টিকে না।
আমার বর্তমান লিস্টে আরও দুইজন আছে। একজন আমার নানার বাড়িতে আশ্রিত থাকে। নাম হলো বজলু।পড়াশোনায় ভালো তাই আমার নানা যত্ন করে রাখে। দেখতে ভালো, কথাবার্তায় মার্জিত। কিন্তু আমার অসহ্য লাগে। এই ছেলে আমার লিস্টে এসেছে দুই মাস হলো। ছেলেটার ইউনিভার্সিটির টিচার হওয়ার সম্ভবনা দেখা যাচ্ছে। তখন থেকে আমার মনে হচ্ছে সে টিচার হয়ে হয়তো আমাকে প্রেমের প্রস্তাব দিবে। আমি একবারেই রিজেক্ট করে দিবো। রিজেক্ট করার জন্য কেন আমি তাকে লিস্টে রেখেছি এই ব্যাপারটা আমি নিজেও জানি না।
লিস্টের শেষে আছে স্পর্শ। ছেলেটা আমাদের বাড়ির সারভেন্ট রুমে ভাড়া থাকে। এই রুমটি বানানো হয়েছিলো বাড়ি থেকে একটু দূরে কাজের লোক থাকার জন্য। কেন যেন আমার বাবা পুরো ঘরে দামী টাইলস, বাথরুমে ভালো ফিটিংস দিয়ে বানিয়েছিলো। আপাতত ব্যাচেলার ভাড়া দেওয়া হয় ওখানে। স্পর্শর নাম ছাড়া আমি কিছুই জানি না। কিন্তু তবুও মনে হয় কোন এক বিকালে আমি বাইরের দোলনায় বসে বই পড়বো। এরপর স্পর্শর সাথে টুকটাক কথা হবে। এভাবেই শুরু হবে গভীর প্রণয়।
ছোট চাচীর ডাকে আমার সম্বিৎ ফিরে এলো। চাচী তার ঘরের বিদেশী বিস্কুটের টিন খুলেছে। বিশেষ বিশেষ দিনে এই টিন খোলা হয়। আজকে কি উপলক্ষ্য কে জানে!
বিস্কুট হাতে নিয়ে আমাকে চলে যেতে হলো। পরবর্তী রূপচর্চার সময় হয়েছে। চাচী ফেসপ্যাক দিয়ে আমাকে বারান্দায় বসিয়ে রেখেছে। বাইরের বাতাসে নাকি অক্সিজেন লাগবে মুখে। এটা নাকি ত্বকের জন্য ভালো। আমার পাশে চাচীও এই সময়টা ফেসপ্যাক লাগিয়ে বসে থাকে। আজকে আমরা বসতেই শিবলী ভাই গেট খুলে আঙ্গিনায় ঢুকলো। এসে সোজা বারান্দার দরজা খুলে মেজচাচীর হাতে কি জানি একটা দিলো। দিয়ে চলতে গেলো দোতলায়। দোতলায় একটাই ঘর। সেখানে বড় ভাইয়া থাকে।
চাচী হাতের জিনিসটা নেড়েচেড়ে বললো, “শিবলী তোর জন্য লিপস্ক্রাব নিয়ে এসেছে।”
আমি একটু নড়েচড়ে বসলাম। বাইরে স্পর্শ একটা গাছের নিচে বসে আবৃত্তি করছে,
“হে দারিদ্র্য! তুমি মোরে করেছো মহান।
তুমি মোরে দানিয়াছ খ্রীষ্টের সম্মান…”
চাচী আমাকে হাত দিয়ে লিপস্ক্রাব ঘষা শেখাতে শেখাতে বললো,
“স্পর্শ যে গরীব তা তো জানতাম না। আচ্ছা ছেলেটা কি খ্রিস্টান নাকি? তুই জানিস কিছু?”
আমি মাথা নাড়লাম। মুখ খোলার উপায় নেই। মাখন চিনি জাতীয় কিছু জিনিস ঠোঁটে ঘষছি। এটার নামও স্ক্রাব। রূপচর্চায় সম্ভবত স্ক্রাব বিপ্লব করেছে। সবদিকে এটার ছড়াছড়ি।
মেজচাচী একাই কথা বলতে থাকলো,
“ছেলেটার নাম শুনে মনে হয় হিন্দু। অবশ্য মুসলমানদের এই নাম আমি শুনেছি।”
মেজচাচী গভীর মন দিয়ে পুরো আবৃত্তিটা শুনলো। এরমধ্যে আমার ফেসপ্যাক তোলা হলো। তুলে গরম পানি দিয়ে মুখ মোছা হলো। তারপর আবার বরফও ঘষলাম।
মাঝে একবার মেজচাচী একবার থমকে গিয়েছিলো। যখন স্পর্শ আবৃত্তি করছিলো,
“ভিক্ষা ঝুলি নিয়া ফের’ দ্বারে দ্বারে ঋষি….” একটু পর আবার চাচী বরফ ঘষাঘষি করতে লাগলো।
আমি গভীর রাত পর্যন্ত স্পর্শ আর শিবলী ভাইয়ের মধ্যে একজনকে মনে আসন দেওয়ার চেষ্টা করলাম। কিন্তু কোনভাবেই সম্ভব হলো না। একসময় ঘুমিয়ে গেলাম।
(চলবে)