অচেনা পর্ব ৯
প্রচন্ড গরমে একটা পার্কে বসে আছি। সকাল থেকে দুইবার বমি করেছি। বাবা আমাকে পাঠাতে চাচ্ছিলো না। ফুপু আর মা জোর করে পাঠালো। স্পর্শ, চামেলি আর লুবনা এসেছে আমার সাথে। আসার আগে আমাকে আস্তে আস্তে গুছিয়ে সবকিছু ফুপু বলেছে। মূল ঘটনা হলো গতকাল ছেলের বাসায় গিয়ে ছেলের সাথে কথা বলতে গিয়ে জানতে পারে যে পাত্রকে বিয়ের খবর এখনো জানানো হয়নি। সে জানতে পারে আমাদের বাসার লোকজন যাবার পর। জানার পর বাসায় বেশ রাগারাগি শুরু হয়ে যায়। ফুপু বিস্মিত হয়ে বললো,
“ছেলের বাসায় প্রতিটি সদস্য জানে বিয়ের খবর। ছেলের তিন চাচা, চারজন খালা এসেছে। বাসায় বাবুর্চি ডেকে রান্না করছে। অথচ ছেলেকে বলেনি। ছেলের মা বললো যে উনার সময় হয়ে উঠেনি।”
সবার সামনে দিয়ে ছেলে বাড়ি ছেড়ে চলে যায়। পরে ছেলের বাবা আর চাচাতো ভাই গিয়ে মানিয়ে নিয়ে আসে। ছেলে আমাদের বাসার সবার সামনে এসে বলে যে সে বিয়ে করতে আগ্রহী না। পরে ছেলের বাবা বুঝিয়ে শুনিয়ে রাজি করায় যে আজকে একবার কথা বলবে। মেয়ে পছন্দ হলে বিয়ে দিবে। ফুপু খুব আস্তে আস্তে কথাগুলো বললো। উনার স্তম্ভিত ভাব এখনো কাটেনি।
ফুপুরা থাকার পুরো সময় ছেলের মা কেঁদেছে। কেঁদে কেঁদে বলেছে,
“বাবুকে কে যে জাদু করলো। সারাজীবন যা বলেছি তাই শুনেছে। আজকে যে কি হলো!”
আমার বাবা তখনই চলে আসতে চাচ্ছিলো। ছেলের বাবার জোরাজুরিতে ঠিক হয়েছে যে একবার অন্তত দেখা করুক।
এই পার্কে দেখা করার বিষয়টা স্পর্শ ঠিক করেছে। জায়গাটা নিরিবিলি। কিন্তু পার্কের বেঞ্চগুলো গাছ থেকে দূরে। আমি বেঞ্চে বসে আমিনুলের চেহারাটা মনে করার চেষ্টা করছি। ছবি দেখেছি কিন্তু কেন জানি মাথাটা ফাঁকা লাগছে। হঠাৎ করে আমার নাম শুনে পেছন ফিরে তাকালাম।
“আপনার নাম রাবেয়া?”
আমার সামনে আমিনুল দাঁড়িয়ে আছে। খুব একটা লম্বা না কিন্তু খাটোও না। কমলা নীল স্ট্রাইপ একটা গেঞ্জি পরে আছে। অবশ্য এখন আর গেঞ্জি বলে না। টি-শার্ট বলে। আমি বললাম,
“জ্বি।”
“আপনি কথা না বলে একটা ছেলের সাথে বিয়ে করে নিচ্ছিলেন? একবার ফোন করার কথা মনে হয়নি?”
আমি থতমত খেয়ে গেলাম। খুব আস্তে বললাম,
“আমাদের বাসাতে এরকমই হয়।”
“শুনেন আমার সাথে এরকম হবে না। আমি বিশ্বাসই করতে পারছি না আমার মায়ের কান্ড। আপনি একবারও ছবি দেখতে চাওয়ার কথা মনে করেননি?”
“আপনার তো ফেসবুক নেই?”
“ফেসবুক কেন থাকবে না? আর ছবি তো প্রিন্ট ভারশনেও দেখা যায়।মোবাইলেও দেখতে পারতেন।”
“না মানে আপনার খালারা বাবাকে বলেছে যে আপনার ছবিগুলো হারিয়ে গিয়েছে।”
আমিনুল রেগে অন্যদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললো,
“মা, ছোট থেকেই আমাকে নিজের সম্পত্তি মনে করে। মায়ের আর বাচ্চা হয়নি তাই খালা চাচীরাও মাকে সাপোর্ট করতো। আমিও নিরুপায় ছিলাম। মাকে অবশ্য অসম্ভব ভালোবাসি। কিন্তু কোনভাবেই এই বিয়ে আমার পক্ষে করা সম্ভব না।”
আমার পায়ের তল থেকে মাটি সরে যাচ্ছে। আমিনুল হঠাৎ আমার হাতে ফোনের দিকে তাকিয়ে বললো,
“আপনার স্মার্ট ফোন নেই? শুধু বাটন ফোন?”
“হ্যাঁ।”
আমিনুল চোখ কপালে তুলে বললো,
“আমি বিশ্বাসই করতে পারছি না যে আপনার সাথে মা আমার বিয়ে ঠিক করেছে।”
আমি নিজেও এই পুরো ব্যাপারটা বিশ্বাস করতে পারছি না। বাবা চাচারা সব আত্মীয়র সাথে কথা বললো। ফুপা ছেলের চরিত্রর খবর নিলো। সব ঠিক ছিলো। আমার বাবা বা ফুপুর যেভাবে বিয়ে হয়েছিলো সব সেভাবেই এগোচ্ছিলো। এখন কি হলো এটা!
আমি আস্তে করে বললাম,
“আমাদের আসলে সব ঠিক হয়ে গিয়েছে। হলুদ হয়ে গেলো। বিয়ের খাবারের বাজার করা আছে।”
এবার আমিনুল সামান্য চিবিয়ে বললো,
“তা কি হয়ে গিয়েছে? কি হলুদ করলেন কিছুই জানলাম না। বিয়ের খাবারের বাজার কেউ বাসায় করে? আপনাদের আসলে বিদেশে থাকা ছেলে শুনে হুশ নাই। মেয়েকে কোনভাবে পার করতে চায়। শুনেন এরকম মেয়ের ফ্যামিলি কানাডাতে দেখা যায়। ছেলেকে ভুজুংভাজুং বুঝিয়ে বিয়ে দিয়ে মেয়ে পাঠায়। পরে দেখা যায় মেয়ের না আছে ইংরেজি জ্ঞান না আছে সমাজে বাস করার যোগ্যতা। আমি এত সহজ না। ফাতরামি অন্য কোথাও গিয়ে দেখান।”
এবার আমিনুল চলে যেতে উদ্যত হলো। হয়েই পেছন ফিরে বললো,
“আমার মা তো বোকাসোকা দেখে যে কোন মেয়েকেই বউ বানাতে চেয়েছে। আপনাদের চালু ফ্যামিলি তার সুযোগ নিচ্ছেন। আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি একটা পরিবার এভাবে কি করে মেয়েকে পার করে।”
আমার ইচ্ছা করলো আমিনুলকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেই। তার গায়ে কাদা বালি লাগিয়ে দেই। পানি ঢেলে দেই। কিন্তু কিছুই করলাম না। সে তার মতো চলে গেলো। আমি বাসায় ফিরে আসলাম। বাসায় ঢুকতেই দেখি আমিনুলের মা বসে আছে। আমি কোন কথা না বলে কাপড় বদলাতে চলে গেলাম। তিনটা মাত্র ভালো জামা আমার। এসব বেশিক্ষণ পরে নষ্ট করার মানে নেই।
আমিনুলের মা অনেকক্ষণ বসে থাকলো। উনি খুবই স্বাভাবিকভাবে বলতে থাকলো যে এসব কিছুই না। হঠাৎ করে ছেলের মাথা গরম হয়ে গিয়েছিলো। তাছাড়া আমার মতো শান্ত মেয়ে ঠিকই ওকে সোজা করতে পারবো। গরীব ঘরের মেয়েরা কত ভালো হয় এর উদাহরণ উনি দিতে লাগলেন। ফুপু আর ছোট চাচী উনার সামনে বসে আছে। মেজচাচীর সাড়াশব্দ পাচ্ছি না। মা হাটুর ব্যথায় শুনে আছেন। সবাই বেশ বিরক্ত। কিন্তু আমিনুলের মা যাওয়ার নাম নিচ্ছেন না। উনি বারবার একই কথা বলছেন,
“রাবেয়াকে দুই ঘন্টার জন্য নিয়ে যাই। আমি ওকে সামনে বসিয়ে বোঝাবো। এরপর বিয়ে পড়িয়ে দিবো।”
ফুপু আর ছোট চাচী বিরক্ত হয়ে না বলে আর উনি কথা ঘুরিয়ে দেন। আমার ঘর থেকে সব শোনা যাচ্ছে। আমার হাত কেন জানি খুব জ্বলছে। যেই হাতে মেহেদি দেওয়া সেই হাতটা জ্বলেই যাচ্ছে। হঠাৎ করে হন্তদন্ত হয়ে লুবনা আর চামেলি ঢুকলো। ঢুকেই চামেলি বললো,
“শোন স্পর্শ একটা ভালো বুদ্ধি দিয়েছে। তোকে কিছু করতে হবে না। তুই শুধু আমিনুলের মায়ের ঠিক পাশে গিয়ে বসবি। এরপর লুবনা যা বলবে তুই শুধু অবাক হবি না।”
তারপর হাক ছেড়ে বাসার সব বাচ্চাকে ডেকে বললো,
“কি করতে হবে মনে আছে?”
ওরা খুবই খুশিমনে মাথা নাড়লো। রুমকি আর রুনি টুনির চেহারা দেখে মনে হচ্ছে আনন্দে ওরা ফেটে পড়বে।
আমি গিয়ে আমিনুলের মায়ের পাশে বসলাম। ছোটচাচী আর ফুপু অবাক হয়ে আমার দিকে তাকালো। শুধু আমিনুলের মা খুশি হয়ে বললো,
“এই তো আমার মা চলে এসেছে। মা আমিনুল কি সুন্দর না দেখতে? চলো তুমি আমার সাথে। তোমাকে ছাড়া কাউকে বিয়ে করতে দিবো না আমার ছেলেকে। আমি ওয়াদা করছি…..।”
উনি কথা শেষ করতে পারলেন না। তার আগেই লুবনা বললো,
“রাবেয়া, বটিটা কি এখানে আনবো?”
আমিনুলের মা স্তম্ভিত হয়ে লুবনার দিকে তাকালেন। আমি বহু কষ্টে অবাক হওয়াটা থামিয়ে রাখলাম।
এবার রুনি বললো,
“আপা তুমি কি কাটবে?”
আমি কিছু বলার আগেই লুবনা খুব এড়ানোর ভঙ্গিতে বললো,
“আম কাটবে। তোমরা যাও তো।”
এবার টুনি বললো,
“আম তো বাসায় নাই আপা।”
এবার রুমকি বললো,
“কাঁচা আমও তো নেই।”
আবার এড়ানোর ভঙ্গিতে বললো লুবনা বললো,
“পেপে কাটবো তাহলে। তোমরা যাও তো।”
বলেই আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
“বটি না এনে শিলপাটার পাটা দিয়ে বাড়ি দিলেও কিন্তু হয়। তুই কি বলিস?”
তড়িৎ গতিতে আমিনুলের মা দাঁড়িয়ে গেলেন। বললেন যে বাসায় একটু কাজ আছে। লুবনা গিয়ে উনাকে ধরে বললো,
“আন্টি একটু বসেন। রাবেয়া আপনার জন্য আম কাটতে চাচ্ছে।”
সাথে সাথে রুমকি বলে উঠলো,
“আপা বাসায় তো আম নেই।”
লুবনা ব্যস্ত ভঙ্গিতে বললো,
“চুপ থাক তো। আন্টি আপনি বসেন। পেপে খেয়ে যান।”
এবার হঠাৎ করে দেখি রুমকি, রুনি, টুনি দম ফাটানো হাসি দিয়ে দৌড়ে ঘরের পেছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে গেলো। ওদের হাসিতে আমিনুলের মায়ের চেহারা ভয়ে লাল নীল হতে লাগলো। উনি ঝটকা মেরে লুবনার হাত ছাড়িয়ে জোরে হেটে বের হয়ে গেলেন। ছোট চাচা সেইসময় বাইরে থেকে আসছিলো। উনি আমার প্রাক্তন হবু শাশুড়ির ধাক্কায় পড়ে গেলেন। বাড়িতে বেশ হাসাহাসির রোল পড়ে গেলো।
(চলবে)