কনে বদল পর্ব ১৩
“এ সব তুমি কি বলছ! কী হয়েছে বলো তো শুনি?”
“চারু হল ছেড়ে কোথায় যেন চলে গেছে! “
“কী বলো! কোথায় গেছে? “
“তা তো ওরা জানে না। কাউকে নাকি কিছু বলেনি।”
“মেয়েটা এমন কেন করছে? “
“হয়ত অভিমান করে। আমরা ওকে বুঝতে পারিনি বলে।”
“তুমি এত ভেবো না তো। সব ঠিক হয়ে যাবে। ও আমাদের ছাড়া থাকতেই পারবে না।”
তা-ই যেন হয় আনু।
“তুমি যাও গা ধুয়ে এসো।”
আমজাদ সাহেব মারা গেছেন তা আনোয়ারা বুঝতে পারল সকালে। প্রতিদিন আনোয়ারা ঘুম থেকে উঠে সাতটার দিকে। আমজাদ সাহেব ছয়টার দিকে উঠে ফজর নামাজ পড়ে হাঁটতে বের হন। তিনি ফিরে আসতে আসতে আটটা বেজে যায়। আনোয়ারা ঘুম থেকে উঠে ঘর-দর ঝাড়ু দিয়ে চুলায় চা বসান। মানুষটার সকালে চা খাওয়ার অভ্যাস।
আজ আনোয়ারার ঘুম ভেঙেছে আটটায়। তিনি দেখলেন আমজাদ সাহেব তখনো শুয়ে আছেন, ভেবেছিলেন ক্লান্ত হয়ে শুয়ে আছে। তিনি ঘর ঝাড়ু দিয়েছেন, চুলায় চা বসিয়ে মানুষটা কে ডাকতে এসেছেন সময় তখন নয়টা বাজে। শরীরে হাত দিয়ে দেখলেন হিম শীতল হয়ে আছে। তার বুকের মাঝে কেমন করে ওঠল! তিনি জোরে ধাক্কা মারলেন আমাজাদ নড়লেন না। তিনি বুঝলেন সব শেষ হয়ে গেছে!
মানুষটা তারপাশে শুয়ে শুয়ে কষ্ট পেয়েছেন! মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করেছেন! শেষ সময় নিশ্চই তার পানি পিপাসা লেগেছিল? একটু পানির জন্য আনু আনু করে চিৎকার করছেন! সে মরার মতো পাশে ঘুমিয়েছেন কিছুই টের পাননি!
আনোয়ারা পাথরের মতো বসে আছেন। তার ভিতরটা কেমন শুন্য হয়ে গেছে! চোখগুলো স্থির হয়ে আছে! একদৃষ্টিতে চেয়ে আছেন মৃত্যু মানুষটার দিকে। ধপাস করে বসে পড়ার সময় হয়ত চিৎকার করেছিলেন, আওয়াজ পেয়ে নায়লা ছুটে এসেছে।
ছোটো নায়লা কী করবে বুঝতে না পেরে পাশের বাড়ির মন্জু কে ডেকে এনেছে। মন্জু এসে দেখল আমজাদ সাহেব মারা গেছেন। আনোয়ারার অবস্থা খুব একটা ভালো না।
মন্জু বুদ্ধিমান ছেলে, এস সি সি পাশ করে কলেজে ভর্তি হয়েছে। সে আমজাদ সাহেবের মোবাইলটা নিয়ে প্রথমে চারুর নাম্বারে কল দিলো। নাম্বারটা বন্ধ! নীরুর নাম্বারে কল দিলো এই নাম্বারটাও বন্ধ! এছাড়া কাউ কে সে চিনে না। দুই নাম্বারে মেসেজ পাঠাল। খুব জরুরি দেখা মাত্র কল দিন। মোবাইলটা নিজের কাছে রেখে দিলো।
আশপাশের মানুষ খবর পেয়ে ছুটে এসেছেন। কয়েকজন মহিলা আনোয়ারা কে ঘিরে বসে সান্ত্বনা দিচ্ছে। মানুষ মারা গেলে তার দাফনের ব্যবস্থা করতে হবে। গোসল করাতে হবে, কবর কোথায় দিবে তা ঠিক করতে হবে। কাফনের কাপড় আনতে হবে। গোসল করানোর জন্য বড়ই পাতা সংগ্রহ করা কাজ কম নয়। লাশ বেশি সময় ফেলে রাখা যাবে না। লাশের নাকি কষ্ট হয়!
আত্মীয় স্বজনদের খবর দিতে হবে। বাড়িতে কোনো ছেলে নাই। দুটি মেয়ে আছে ওরা কেউ বাড়িতে নাই। আনোয়ারা কথা বলার মতো অবস্থায় নাই।
মন্জুুর বাবা আক্কাস আলী আমজাদ সাহেবের বন্ধু মানুষ। তিনিই সব কিছুর আয়োজন করছেন। প্রথমে নীরুর শশুর বাড়িতে একটা খবর দিতে হবে। এ ছাড়া তেমন কোনো আত্মীয় আমজাদের নেই! দূর সম্পর্কের যারা আছে তারা সবাই গ্রামে থাকে। সেখানে খবর পাঠানোটা কঠিন!
রায়হানের মামা ইলিয়াস সাহেব কে খবর দেয়া হয়েছে। তিনি নাহার বেগমকে জানিয়েছেন। তারা রওয়ানা দিয়েছেন। রায়হানকে খবর দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
———–
গতকাল থেকে নীরুর মনটা খুব একটা ভালো যাচ্ছে না। সাধুর কথা, জুতা হারানো সব মিলিয়ে কেমন একটু অফ মুডে আছে! নীলা আপা আর লিটন ভাইয়ের পরিকল্পনা ছেঁড়া দ্বিপে পায়ে হেঁটে যাবেন। খুব ভোরে উঠে আমরা রওয়ানা দিলাম।
সেইন্ট মার্টিনের মাঝে গ্রাম আছে গ্রামের মধ্যে দিয়ে। হাঁটতে খুব ভালো লাগছে। গ্রামের মাঝামাঝি একটা জায়গায় তরমুজ ক্ষেত পেলাম। নীলা আপু তরমুজ ক্ষেত দেখেই বললেন, “তরমুজ খাব।”
একজন কৃষক দেখতে পেয়ে জিজ্ঞেস করলাম,”ভাই তরমুজ বিক্রি হবে?”
“হ্যাঁ, “
সে ক্ষেত থেকে পাঁকা তরমুজ তুলে কাঁচি দিয়ে চারভাগ করে কেটে দিলো। আঃ! তরমুজ দেখতে টুকটুকে লাল, স্বাদও খুব মিষ্টি!
নীরুর ঠোঁট লাল হয়ে গেছে তরমুজের রংয়ে। একটু দুষ্টামি করতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু নীলু আপা আর লীটন ভাই থাকায় করতে পারছি না!
লীটন ভাই কৃষক কে জিজ্ঞেস করল, “আপনার নাম কী?”
“জে, কালাম।”
“কত বছর ধরে থাকেন এখানে?”
“পনেরো বছর হবে।”
এ সময় একটা ছোটো এল মনে হয় কালামের ছেলে হবে। আমাদের বলল, “স্যার ডাব খাবেন?” গাছের দিকে আঙুল দিয়ে ইশারা করল। গাছ থেকে পেরে ডাব খাওয়ার মজাই আলাদা। এমন সুযোগ হাত ছাড়া করা যায় বুঝি।
ছোটো ছেলে ব্যাঙের মতো তরতর করে নারিকেল গাছের মাথায় উঠে পড়ল। উপর থেকে একটা করে ডাব ফেলতে লাগল। নিচে দাঁড়িয়ে থাকা কালাম ডাব কুড়িয়ে দাঁ দিয়ে কেটে আমাদের হাতে দিলো।
ডাব খাওয়ার জন্য কোনো পাইপ নেই। ডাব খেতে হবে চুমুক দিয়ে। চুমুক দিতে গিয়ে শাড়ি ভিজিয়ে ফেলেছে নীলা আপু।
লিটন ভাই বললেন, ” তুমি তো গোসল করে ফেলেছ শুধু মাথাটা বাকি, এক কাজ করো মাথাটাও ভিজিয়ে নাও। ডাবের পানিতে গোসল করে পবিত্র হয়ে গেলা। মানুষ দুধ দিয়ে গোসল করে তুমি না হয় ডাব দিয়ে করলা।”
লিটন ভাইয়ের কথা শুনে হাসতে গিয়ে নীরুর অবস্থাও নীলা আপুর মতো।
যাক ভালোই হলো দুই রমনীর ডাবের পানিতে স্নান দৃশ্য দেখা হয়ে গেল।
বাঁকা চোখে লীটন ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে রইল নীলা আপু।
দ্বীপের শেষপ্রান্তে ছোটো আরেকটা দ্বীপ কে ছেড়ে দ্বীপ বলে। পাথরে ঘেরা এড়িয়া। সাগরের ঢেউ এসে পাথরে আঘাত করে দেখতে বেশ লাগে! আমাদের সাথে আরো অনেকেই এসেছে ছেড়া দ্বীপে।
পাথরে দাঁড়িয়ে আছি আর সমুদ্রের পানি এসে পা ছুঁয়ে দিয়ে যাচ্ছে। পানি খুব ঠান্ডা। আচমকা একটা নাম না জানা পাখি নীরুর হাতের মোবাইলটা ছো মেরে নিয়ে গেল! মোবাইল বেশিক্ষণ ঠোঁটে ধরে রাখতে পারল না। মোবাইলটা পড়ে গেল সাগরের মাঝে! আমরা হতভম্ব হয়ে চেয়ে রইলাম!
নীরু মুখটা কেমন মলিন হয়ে গেল! বেচারির সাথে একের পর এক দূর্ঘটনা ঘটছে!
ফেরার সময় ফিরলাম ছোটো স্পিডবোডে। হোটেলে আসতে আসতে বারোটা ভেজে গেছে। নীরু বাথরুমে গেছে। এ সময় মামার ফোন আসল। রিসিভ করতেই ধরা গলায় মামা বললেন, “রায়হান দ্রুত ঢাকায় চলে আয়।”
“কী হয়েছে মামা?”
“নীরুর বাবা মারা গেছে! ” আমি কিছু সময় কেমন শুন্য হয়ে গেলাম! বুকের মধ্যে কেমন করতে লাগল। কী হাসিখুশি মানুষটা আর নেই! নীরুকে এখন কিছুই বলা যাবে না। কেঁদে কেটে সব এক করে ফেলবে।
সব শুনে লিটন ভাই বললেন, চিন্তা করো না। জাহাজ ছাড়বে তিনটায় আমাদের হাতে এখন সময় আছে দুই ঘন্টা। ওপার থেকে এয়ারপোর্ট যেতে দুই ঘন্টা লেগে যাবে। ঢাকায় পৌঁছাতে রাত হয়ে যাবে! এতক্ষণ লাশ রাখবে?
“এছাড়া কী করার আছে ভাই?”
“ঠিক আছে তুমি সব গুছিয়ে নেও। আমরাও রেডি হচ্ছি।”
“আপনারা আবার কেন কষ্ট করবেন? “
“এটা তুমি কী বললা রায়হান! যাও দ্রুত সব গুছিয়ে নাও। আর নীরুকে বলবা আমাদের সমস্যার জন্য জরুরি যেতে হচ্ছে। “
লিটন ভাই নীল আপু ঝটপট রেডি হয়ে বেরিয়ে আসলেন। প্রথমে কিছু খেয়ে নেয়া দরকার এরপর খাওয়ার সুযোগ হবে না। নীরু কিছুই জানালাম না। তারপরও ওকে খুব অস্থির লাগছিল! আমাকে জিজ্ঞেস করছিল বারবার,” কী হয়েছে? “
হালকা হেসে এড়িয়ে গেছি। কাছের মানুষ চলে গেলে মনে হয় একটু হলেও আচঁ পেয়ে যায় মন। না হলে নীরুকে কিছু বলা হয়নি! অথচ ওকে কেমন মনমরা লাগছে!
টেকনাফ এসে পৌঁছেলাম ছয়টায় এখন পথটা কত দীর্ঘ মনে হচ্ছে! পুরোটা পথ নীরু কোনো কথাই বলল না। কেমন ঝিম মেরে বসে আছে! সারাক্ষণ কথা বলা লিটন ভাইও চুপ মেরে আছে!
আমার কেমন লাগছে ঠিক বুঝতে পারছি না। একজন মানুষের মৃত্যুর খবর শুনলে খারাপ লাগে। যে মানুষটা কিছুদিন আগে অপরিচিত ছিল। এখনো কি খুব জানাশোনা হয়ে গেছে তা না। তবুও ওনার হাসিমাখা মুখটা বারবার মনে পড়ছে!
এয়ারপোর্ট থেকে যখন নীরুদের বাড়ির দিকে রওয়ানা দিলাম তখনি নীরু হু হু করে কান্না শুরু করে দিলো! এতক্ষণ ধরে চলা সন্দেহটা বোধহয় বিশ্বাসে পরিনত হয়েছে।
নীরুদের বাড়িতে পৌঁছালাম রাত দশটার সময়। ওর বাবার কবর দেয়া হয়ে গেছে! গত রাতে মারা যাওয়া মানুষটা কে এত সময় ধরে রেখে দেয়া যায় না! বাড়িতে মা ও মামাকে দেখলাম। আনোয়ারা আমার শাশুড়ি এখন কিছুটা শান্তই ছিলেন। নীরুকে দেখে হাউমাউ করে কাঁদা শুরু করলেন।
কান্না মনে হয় ছোঁয়াছে রোগের মতো সবার মাঝে ছড়িয়ে যায়। এদের কান্নার শব্দে আমার চোখ ভিজে যাচ্ছে! কেমন একটা চাপা কষ্ট হচ্ছে!
মন্জু ছেলেটার সাথে আমি আর লিটন ভাই কবর দেখতে বের হলাম। বক্সনগর এলাকায় একটা বড়ো মাদরাসা আছে দারুন্নাজাত নামে। মাদরাসার পাশের কবরস্থানে কবর দেয়া হয়েছে।
———-
সকাল থেকে চারুর মনটা কেমন অস্থির হয়ে আছে। কিছুতেই মন বসছে না। বি সি এস পরীক্ষা দেয়ার জন্য এ কয়দিন ভালোই পড়াশোনা করেছে। আজ পড়তেও ভালো লাগছে না! মনে হচ্ছে কি যেন হারিয়ে গেছে। ঠিক বুঝতেও পারছে না!
“কি ইয়াং লেডি কী খবর?”৷ চারু ঘুরে দেখে মুখলেছুর রহমান দাঁড়িয়ে আছেন। মুখে আন্তরিক হাসি। একটা থ্রি কোয়ার্টার , কালো টিশার্টে তাকে ভালোই মানিয়েছে।
চারু একটু মুচকি হাসি দিলো কিছু বলল না।
“তোমার কি কোনো কারণে মনখারাপ? “
“না তো।”
“না তোমার মুখটা শুকনো শুকনো লাগছে! মনে হচ্ছে কোনো বিষয় নিয়ে খুব চিন্তায় আছ?”
“তেমন কিছুই হয়নি।”
“হলে বলতে পার। আমি এক ঝটকায় সমাধান করে দিতে পারি।”
একটু হালকা হাসি বলল, “হলে অবশ্যই বলব।”
“এক কাজ করো। কড়া করে এক কাপ কফি খাও দেখবে শরীর ঝরঝরা হয়ে গেছে। তোমার সাথে আমিও এক কাপ পেলাম।”
চারু রুমে এসে কফি বানায়। দুই কাপ কফি নিয়ে ছাদে ফিরে আসে।” নিন আপনার কফি।”
হাত বাড়িয়ে কফি নিতে নিতে মুখলেছুর রহমান বললেন, ” বাঃ! তুমি তো খুবই চটপট কাজ করতে পার। আমার মেয়েটাও এমন ছিলো। সব কাজ করে ফেলত নিমিষেই। “
“কোথায় এখন উনি?”
“কে? মাধবীলতা আমার মেয়ের নাম। নামের মতো দেখতেও ছিল বেশ সুন্দর!” মেয়েটা আমার কেমন আছে জানি না!” একটা দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লেন।
চারুর মনটাও কেমন উদাস হয়ে গেল।
চলবে–
® নাবিল মাহমুদ