কনে বদল পর্ব ১৬
সকাল বেলা মুখলেছ সাহেব এক গাদা বাজার নিয়ে ছাদে এসেছেন। ওনার বাড়ির দারোয়ান একে একে বাজার রাখছে ছাদে। একটা বড়ো চুলার আয়োজন করা হয়েছে। ছাদে তিনি একটা পিকনিক আয়োজন করবেন।
কাজল ঘুম থেকে উঠে মুখলেছ সাহেব কে ছাদে দেখল। ঘুমঘুম চোখে সালাম দিল। “আসসালামু আলাইকুম আংকেল। “
“ওয়ালাইকুম সালাম।”
“কেমন আছ মা?”
ওনার হাসিমাখা চেহারা দেখতে বেশ ভালো লাগছে। কাজল হাসির জবাবে হাসি দিয়ে বলল,” জি ভালো আছি। আপনি?”
“আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। আজ কি তোমার অফিস আছে মা?”
“জি।”
“আজ না গেলে হয় না?”
“গতকাল ছুটি কাটিয়েছি। আজ তো যেতে হবে আংকেল। “
“দেখ না ছুটি কাটানো যায় কিনা।”
“সে না হয় কাটানো যাবে। কিন্তু কীসের জন্য? “
“আজ আমি তোমাদের সাথে একটা পিকনিক করব। তোমরা হলে আমার গেস্ট। “
“আজ কি কোনো উৎসব আংকেল? “
“তেমন কিছু না। তোমাদের সাথে একটু সময় কাটানো আরকি। তা চারু মা কোথায়? “
“ঘুমাচ্ছে। “
“এত বেলা পর্যন্ত ঘুমে! ওকে তো দেখি সকাল সকাল উঠতে আজ এত দেরি করছে কেন! শরীর খারাপ নাকি?”
“না শরীর ভালোই আছে। আজ ওর প্রিলির রেজাল্ট হবে তাই গতকাল রাতে ঘুমাতে পারেনি।”
“মেয়েটা বড্ড বেশি সিরিয়াস হয়ে যায়! এত ভাবলে হয়?”
চারু কে ডেকে তোলা হলো। তার দায়িত্ব এখন কফি বানান। মুখলেছ সাহেব বসে আছেন ওদের দুইজনের নাস্তা খাওয়া শেষ হলে একসাথে কফি খাবেন।
চারু চট করে তিন কাপ কফি বানিয়ে ফেলল। মেয়েটা দারুণ চটপটে! অনেক বুদ্ধিমান আবার প্রচন্ড রকমের বোকা একটা মেয়ে।
মুখলেছ সাহেব কফিতে চুমুক দিয়ে মুগ্ধ হয়ে গেলেন! “চমৎকার কফি বানিয়েছ মা।”
“হ্যাঁ, আংকেল চারু কফিটা খুব ভালো বানায়। ওর হাতের পিঠা তো খান নাই? কী যে স্বাদ?”
“ও একটু একটু বাড়িয়ে বলছে।”
“তা মা তোমার মনখারাপ নাকি?”
“না তো!”
“কি রেজাল্ট নিয়ে চিন্তায় আছ বুঝি?”
“একটু একটু টেনশন হচ্ছে! “
তোমাদের একটা গল্প বলি শোন। তখন আমি নতুন ব্যবসা শুরু করেছি। ব্যবসার অবস্থা খুব একটা ভালে না। একটা বড় কাজ পাওয়ার কথা। কাজটা পেলে হয়ত টিকে যাব। কাজটা পাওয়ার জন্য আমরা অনেক খাটলাম। শেষ পর্যন্ত কাজটা আমরা পাইনি!
আমার গুটিকয়েক কর্মচারী ছিল সবার মনখারাপ কারন সবাই কোম্পানির অবস্থা জানে।
আমি সেদিন কি করেছিলাম জানো? সবাইকে নিয়ে একটা পার্টির আয়োজন করলাম। ব্যর্থতা কে উদযাপন করেছিলাম। এরপর থেকে আমার কোম্পানির অবস্থা উন্নতি হতে থাকে। আমরা পরাজয়ের ভয় থেকে মুক্ত হয়ে গেছিলাম। তাই কাজের গতি ও গুন এত বেড়ে গেছিল। আমাদের কে পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।
চারু আয়োজন দেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। মুখলেছ সাহেব সল্প আয়োজন বললেও মোটেই তা ছোটো না। তিনি বাড়ির সব ভাড়াটিয়া সহ এলাকার কিছু মানুষ কে দাওয়াত করেছেন। একজন বাবুর্চি আনা হয়েছে রান্নার জন্য।
চারু জিজ্ঞেস করল, “আজ এত আয়োজন? “
“এমনিই করছি রে মা। ” কথাটা ঠিক না। আজ তার জন্মদিন । তিনি কাউকে একথা বলছেন না। তিনি আশা করেছিলেন আজকের দিনটাতে অন্তত মেয়ে তাকে কল দিবে। কল দেয়নি! মেয়ে হয়ত ভুলে গেছে!
তিনি মেয়েকে কল দিয়েছিলেন নাম্বার বন্ধ! তার মনটা খারাপ কিন্তু হাসি দিয়ে আড়াল করে রেখেছেন!
মুখলেছ সাহেব জন্মদিন পালন করতে খুব ভালোবাসেন তা না। তার এ সব করতে ভালো লাগত না। সুইটি খুব বড়ো আয়োজন করে তার জন্মদিন পালন করত। মানুষটা চলে গেছে কিন্তু তার করা কাজ কেমন করে যেন মুখলেছ সাহেবের মধ্যে ঢুকে পড়েছে!
যেমন কফি খেতে তার ভালো লাগত না। কফি সুইটি পছন্দ করত। অথচ এখন তিনি কফি ছাড়া চলতেই পারেন না!
চারুর পরীক্ষার রেজাল্ট জানা গেল। ও প্রিলিতে পাশ করেছে। এখন হাতে খুব বেশি সময় নেই। তিন থেকে চারমাস সময় পাওয়া যাবে লিখিত পরীক্ষার জন্য।
চারুর মনটা খুব একটা ভালো নেই। বারবার ইচ্ছে করছে মামার কাছে ছুটে যেতে। মামার কাছে গিয়ে তার ছোটো অর্জনটা বলতে। আবার চিন্তা করে এখনো কিছুই হয়নি।।
মুখলেছ সাহেব ভিষণ খুশি চারুর রেজাল্ট শুনে। আজকের পার্টির আনন্দের মাত্রা বেড়ে গেছে! শুধু যদি মেয়েটা আজ থাকত!
মানুষজন একে একে সবাই এসে পড়েছে। মুখলেছ সাহেবের বন্ধু আজমল সাহেব গানের ব্যবস্থা করেছেন। খাওয়া-দাওয়ার পর একটু গান বাজনা হবে। ওনার পরিচিত একজন শিল্পী আছে তাকে নিমন্ত্রণ করা হয়েছে। শিল্পী এখনো এসে পৌঁছেনি। আজমল সাহেব বিরক্তি নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন!
সবার সাথে চারু আর কাজল পরিচিত হলো। মুখলেছ সাহেব পরিচয় করিয়ে দিলেন।
শিল্পী এসে পড়েছেন। খুব সুন্দর দেখতে হালকা পাতলা দেহের গড়নের পঁচিশ বছরের একটা মেয়ে। একে দেখলে নায়িকা মনে হয়। কী সুন্দর করে হাসছে।
খাবার দেয়া হয়েছে। বিশ-পঁচিশ জনের মতো মানুষ এসেছেন। ছাদে টেবিল চেয়ারে বসিয়ে খাবারের আয়োজন করা হয়েছে।
ছোট একটা স্টেজ বানিয়েছে এখানে শিল্পীর গান করার জন্য। মুখলেছ সাহেব হাসি মুখে ঘুরছেন। কিন্তু তার মেজাজ খুব খারাপ। তার মেয়ের নাম্বারটা এখনো বন্ধ!
শিল্পী স্টেজে দাঁড়িয়েছেন এ সময় বিদ্যুৎ চলে গেল। চারদিকে অন্ধকার হয়ে গেল। মুখলেছ সাহেব ঝাঁঝ গলায় কুদ্দুস কে ডাকছেন। আচমকা বাতি জ্বলে উঠল।
ছোটো স্টেজে এখান দাঁড়িয়ে আছে একটা ছোটো মেয়ে। একটা টেবিলে বড়ো কেক রাখা। মুখলেছ সাহেব হতবাক হয়ে চেয়ে আছেন। ওনার নাতির দিকে। ওনার মেয়ে আর নাতি এখন স্টেজে দাঁড়িয়ে হ্যাপি বার্থডে বলছে। সবাই ওদের সাথে তাল মিলিয়ে হ্যাপি বার্থডে বলেছেন। কয়েকজন হাত তালি দিচ্ছে।
মুখলেছ সাহেবের চোখে পানি চলে আসল। তার মনে হলো পৃথিবীটা আসলেই খুব সুন্দর!
শিল্পী গান গাওয়া শুরু করেছে। খুব মিষ্টি কন্ঠ! মুখলেছ সাহেব নাতি আর মেয়ের সাথে কথা বলছেন। তার মেয়ে মাধবীলতা গতকাল রাতে বাংলাদেশে এসেছে বাবার জন্মদিন উপলক্ষ্যে। বাবাকে সারপ্রাইজ দেয়ার জন্য কোনো যোগাযোগ করেনি। মাধবীলতা জানত বাবা মায়ের কথা ভেবে এ দিনে একটা অনুষ্ঠান করবে।
চারু দেখছে একটা মানুষের হাসির মাঝে কত পার্থক্য হয়! মুখলেছ সাহেবের মুখে এতক্ষণ যে হাসি ছিল!আর মেয়ে নাতিকে দেখার পর হাসির মাঝে কত ফারাক!
চারুর মনটা কিছুতেই শান্ত হচ্ছে না। বারবার শুধু মামার মুখটা মনে পড়ছে!
“কি রে চারু কী হয়েছে তোর?”
“ভালো লাগছে না।”
হুট করে উঠে বসে চারু। ওকে এভাবে উঠতে দেখে কাজল এসে পাশে বসে বলে,”কী হলো তোর!”
“আমি মামার কাছে যাব।” চারু কাপড় পড়া শুরু করে।
“এত রাতে! সকালে যাইছ।”
“না আমি এক্ষুনি যাব। তুই যাবি আমার সাথে? “
“হ্যাঁ যাব।”
মুখলেছ সাহেব নাতনির সাথে খুনসুটি করছিলেন। এ সময় বেল বেজে ওঠল। তিনি কিছুটা অবাক হলেন এত রাতে আবার কে এলো! দরজা খুলে তাকিয়ে আছেন কাজলের দিকে। “কী মা এত রাতে? কোনো সমস্যা? “
“আংকেল গেটটা একটু খুলতে হবে। আমরা বাহিরে যাব।”
“এত রাতে কোথায় যাবে মা?”
“চারু ওর মামাকে দেখতে যাবে। আপনি তো সব জানেন ওর কথা।”
“এ তো ভালো কথা। তুমি যাও আমি আসছি।”
মুখলেছ সাহেব কুদ্দুস কে গাড়ি বের করতে বলেন। আজ তার আনন্দ মুহুর্ত দেখার বড়ো লোভ হচ্ছে। মেয়েটা এতদিন বাদে যখন মামার সামনে গিয়ে দাঁড়াবে সেই সময়ে মামার প্রতিক্রিয়াটা দেখতে তার খুব ইচ্ছে হচ্ছে।
———
মেরুন রংয়ের একটা শাড়ি পরেছে নীরু। আয়নায় নিজেকে দেখছে। আমি আড় চোখে নীরুকে দেখছি। ও মনে হয় টের পাচ্ছে না। ওকে দেখতে বেশ ভালো লাগছে!
আজ মা ওকে অফিসে যেতে বলেছে। আমি জানি মা কী বলবে ওকে। ওকে কিছুই বলিনি মার কাছ থেকেই শুনুক না।
“কি হলো তোমার? “
“হ্যাঁ, আসছি।”
নীরুকে নিয়ে অফিসে যাচ্ছি। ও আমার পাশে বসে আছে। ড্রাইভার গাড়ি চালাচ্ছে। নীরুকে একটু চিন্তিত মনে হচ্ছে!
“আইসক্রিম খাবা?” জানি না কেন জানি হঠাৎ নীরুকে আইসক্রিমের কথা বললাম। একটা ইগলু আইসক্রিমের দোকান আছে একটু সামনে।
“না, আইসক্রিম খেতে ইচ্ছে করছে না।” অন্য কোনো মেয়ে হলে স্বামীর দেয়া প্রস্তাব নাকচ করত না! খুশি করার জন্য হ্যাঁ বলত। নীরুর মাঝে ভান করা ব্যাপারটা নাই। ও খুব সুন্দর করে না বলতে পারে। সবাই না বলতে পারে না!
আমাদের অফিসটা মতিঝিল এলাকায়। পনেরো তলা বিল্ডিংয়ের সপ্তম তলায় অফিস। দুই ফ্লোর নিয়ে আমাদের অফিস।
আমার মা বসেন সপ্তম তলায়। নীরুকে নিয়ে আমার রুমে আসলাম। আমার অফিস ঘরটা বেশ বড়ে। সামনে একসেট সোফা আছে। একটা বড়ে টেবিল,সামনে দুইটা চেয়ার, একটা বস চেয়ার আছে।
দেয়ালে একটা পেইন্টিং ঝুলছে। এটা আমার এক বন্ধু এঁকেছিল। তখন ও সম্ভবত চারুকলায় পড়ে।
নীরু মুগ্ধ হয়ে আমার অফিস দেখছে!
“কেমন লাগল আমার অফিস?”
“খুব সুন্দর করে সাজিয়েছ তো!”
“চা,কফি কিছু খাবা?”
“না, এক গ্লাস ঠান্ডা পানি দেও।”
আমার রুমে একটা ছোটো ফ্রিজ আছে। একটা বোতল বের করে নীরুকে এক গ্লাস পানি দিলাম। মায়ের ফোন আসল। ওকে নিয়ে মায়ের রুমে যেতে বললেন।
নীরু আর আমি বসে আছি। মা একটা ফাইল দেখছেন। ফাইলটা বন্ধ করে বললেন,”তুমি হয়ত একটু অবাক হয়েছ অফিসে আসতে বলায়।”
নীরু কিছু বলল না। নীরব হয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে আছে।
রায়হানের বাবা যখন মারা যায় তখন ও কলেজে ভর্তি হয়েছে। এত বড়ো ব্যবসার কিছুই আমি জানি না। ওর বাবা কখনো আমাকে অফিসিয়াল ব্যাপারগুলো বলত না। কিছু না জানায় ব্যবসাটা চালিয়ে নিতে আমার অনেক কষ্ট করতে হয়েছে।
ইলিয়াছ ভাইকে নিয়ে পুরো ব্যবসাটা আমি আবার রান করেছি। রায়হানের বাবা যে ভুলটা করেছে সেটা আমি করতে চাই না।
এ অফিস ব্যবসা তোমারও তাই না?”
নীরু চোখ কপালে উঠে গেছে! এমন কথা শুনবে ও হয়ত ভাবতেই পারেনি। শুধু হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়াল।
এখন থেকে তুমি অফিসে আসবে। সব কিছু দেখ জানো। আপাতত তোমাকে একটা পোস্ট দিচ্ছি। সপ্তাহ একদিন অফিসে আসবা। সব বোঝার পর তুমি চাইলে নিজের মতো একটা সাইট চালু করতে পারো বা রায়হানের সাথেও কনস্ট্রাকশনে থাকতে পারো।
আচ্ছা ঠিক আছে এখন তোমরা যাও। রায়হানের সাথে অফিসটা ঘুরে দেখ। আমার একটা মিটিং আছে।”
মায়ের রুম থেকে বের হয়ে গেলাম। “মায়ের কথায় অবাক হয়েছে? ”
“হ্যাঁ, এমন কিছু বলবেন ভাবতে পারিনি!”
নীরুর এমন অবস্থা দেখে আমার একটু হাসি পেল।
“হাসছ কেন?”
“এমনই। “
“খুব মজা পাচ্ছো বুঝি?”
পুরো অফিসটা ওকে দেখালাম। আমার রুমের পাশেই ওর জন্য একটা রুম করা হয়েছে।
নীরু বলল, ” চলো এখন যাই।”
“বাসায় চলে যাবা?”
“না, আজ তোমার সাথে ঘুরব।”
“কোথায় যাবা?”
“জানি না। আগে অফিস থেকে বের হই তারপর ভাববো।”
“ঠিক আছে। তুমি একটু অপেক্ষা করো, আমি হাতের কাজটা শেষ করি। তুমি আমার রুমে এসে বসতে পারো। বা তোমার রুমে অপেক্ষা করতে পার।”
নীরু আমার রুমে এসে বসে আছে।
হাতে বেশ কিছু কাজ জমা পড়ছে। কাজ করতে ইচ্ছে করছে না। আধা ঘণ্টার মতো কাজ করে ওকে নিয়ে বের হয়ে গেলাম।
চলবে–
® নাবিল মাহমুদ