কনে বদল পর্ব ১৮
শেষ পরীক্ষাটা দিয়ে বের হলো চারু। আজ তার কেমন শুন্য শুন্য লাগছে! এতদিন একটা তীব্র টান ছিল। তাড়াতাড়ি বাসায় গিয়ে পরের পরীক্ষার জন্য পড়তে হবে। আজ কিছুই করার নেই।
এ কয়টা মাস একটা ঘোরের মাঝে কেটে গেছে। সব ভুলে ডুবেছিল বইয়ের মাঝে। সকালে ঘুম থেকে উঠে পড়তে বসা। সারাদিন কেটে যেত বই পড়ে। সেই ছোটোবেলার মতো মামী পাশে বসে থাকত! কখমো গুটুর গুটুর করে গল্প করত।
সেইদিন হুট করে রায়হান আসল। এসেই নীরুকে নিয়ে চলে গেল। এরপর নীরু আর আসেনি। মামী কয়েকবার গেছে ওকে দেখতে। চারু যায়নি পড়ার অযুহাতে।
রায়হান মাঝে মাঝে চলে আসে বাজার সদাই নিয়ে। হুট করেই আসে বাসায় যা রান্না হয় তাই খায়। বাড়তি কোনো আয়োজন করতে দেয় না।
চারুর সাথে কথা হয় খুব কম। দেখা হলে,” আপা কেমন আছেন? “
চারুও জবাব দেয়। ভালো, “আপনি?”
“আছি ভালোই। আপনার কিছু লাগবে? “
চারু জবাব দেয়, “না না লাগলে বলব।”
রায়হান আসলে সবচেয়ে বেশি খুশি হয় নায়লা। ওর জন্য দামি দামি চকলেট নিয়ে আসে। মেয়েটা রায়হানের ভক্ত হয়ে গেছে!
পরীক্ষার হল থেকে বের হয়ে চারু রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে ভাবছে একবার কাজলের অফিসে যাওয়া যায়। অনেকদিন ওর সাথে দেখা হয়নি। হুট করে ওর অফিসে উপস্থিত হওয়া যায়।
চারু দেখেছে হুট করে কারে কাছে গেলে তাকে পাওয়া যায় না। দেখা যাবে কাজল অফিসে নাই। না ও এখন অফিসে চাকরিই করে না। কলেজ থাকতে একবার ওরা সব বান্ধবীরা মিলে রোজিনাদের বাসায় যাবে ওকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়ে সারপ্রাইজ দিবে।
বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল রোজিনারা এ বাসা ছেড়ে দিয়েছে! নতুন বাসার ঠিকানা এরা কেউ জানে না।
চারু কাজলের পত্রিকার অফিসে হাজির হলো। কাজল কে অফিসে পাওয়া গেল। পত্রিকার অফিসে অনেক ফর্মালিটি থাকে। সরাসরি কাজলের কাছে যাওয়া গেল না। কাজলকে ফোন করে জানান হলো তারপর চারুকে রুমে যাওয়ার অনুমতি দেয়া হলো।
কাঁচে ঘেরা একটা মাঝারি ধরনের ঘর। খুব সুন্দর করে সাজানো হয়েছে ঘরটা। মেয়েদের সব কিছু খুব গোছানো থাকে মনে হয়! এলোমেলো মেয়ে খুব কম দেখা যায়। প্রকৃতি মেয়েদের খুব সুন্দর করে বানিয়েছেন। মেয়েরা যেখানে থাকে তা সুন্দর করে নেয়। একটা রকিং চেয়ারে বসে আছে কাজল। ওর পিছনের দেয়ালে একটা পাহাড়ের ছবি ঝুলান। দেখলে মনে হয় আর্ট করা ছবি।
একটা সূর্যমুখি ফুলের মতো হাসি দিয়ে কাজল বলল, “কেমন আছিস?”
হাসি হাসি মুখে চারু বলল,” ভালো আছি। তোর কী খবর? বেশ জমিয়ে বসেছিস মনে হয়!”
এবার কাজলের হাসিটা একটু চওড়া হলো। “আছি আরকি। তা তোর পরীক্ষা কেমন হলো? “
“পরীক্ষা ভালোই দিয়েছি।”
“তোর হয়ে যাবে। কী খাবি বল?”
কাজলের পাশেই একটা কলিং বেল আছে। বেলে চাপলে মনে হয় একজন ছুটে আসবে! কাজল মনে হয় খুব বড়ো পদ পেয়ে গেছে!
“না রে কিছু খাব না। তোর কী খুব জরুরি কাজ আছে?”
“কেন বল তো?”
“আজ তোকে নিয়ে ঘুরবো। অনেক দিন কোথায় যাওয়া হয়নি!”
“আচ্ছা ঠিক আছে। চল তোকে রুয়েলের সাথে পরিচয় করিয়ে দেই।”
“রুয়েলটা আবার কে?”
“আমার বস। খুব ভালো মানুষ! “
চারুকে নিয়ে কাজল ঢুকল অন্য একটা রুমে। এ রুমটা কাজলের ঘরের চেয়ে আর বড়ো। ঘরটা অনেকটা কাজলের ঘরের মতো করেই সাজানো! রুমে বসে আছেন চল্লিশ-পয়তাল্লিশ বয়সের একজন ভদ্রলোক। দেখতে বেশ সুন্দর! খুব হাসি-খুশি মানুষ মনে হয়। চারুকে দেখে উঠে দাঁড়ালেন।
কাজল সামনের চেয়ারে বসে বলল, “এ হলো চারু।”
ভদ্রলোক চারুর দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হাসি দিয়ে বললেন, “আমি রুয়েল। আপনার কথা শুনেছি কাজলের কাছে। দেখে ভালো লাগল। বসুন, বসুন।”
চারু কাজলের পাশের চেয়ারে বসল।
রুয়েল সাহেব বললেন, “কী খাবেন বলেন?”
কাজল বলল, “আমরা একটু বের হবো। তুমি একটু এদিকটা সামলে নিয়ো কেমন।”
“ঠিক আছে সমস্যা নাই।”
“কাজল বলল চল চারু।” চারু উঠে দাঁড়িয়ে রুয়েলের দিকে তাকিয়ে একটু মিষ্টি হাসি দিয়ে বলল, “আজ তাহলে উঠি।”
“আজ সময় দিলেন না। আরেকদিন আসবেন সময় করে।”
ওরা অফিস থেকে বেরিয়ে রাস্তায় চলে এলো
চারু বলল,”কোথায় যাওয়া যায় বলত?”
“ওমা! তুই আমাকে অফিস থেকে বের করে নিয়ে এসে এখন বলছিস কোথায় যাবি তা-ই জানোছ না?”
“কোথাও যাব তা তো ঠিক করিনি। তোর সাথে আজ ঘুরতে ইচ্ছে করছে বাস।”
“আচ্ছা তাহলে চল ক্যাম্পাসে যাই। অনেকদিন যাওয়া হয় না।”
“লিটনের কোনো খবর জানোছ? সেই একদিন হুট করে দেখা হলো আর কোনো খবর নেই!”
কাজল অবাক হয়ে চারুর দিকে তাকায়।” তুই লিটনের খবর শুনিসনি?”
“না তো। কী হয়েছে ওর?”
“লিটন তো সুইসাইড করেছে গত মাসে!”
“কী বলিস! ও কেন এমন কাজ করবে? ওকে তো সবসময় খুব হ্যাপি মনে হত।”
“আমরা ভিতরের লিটন কে বুঝতে পারিনি। ওর ওপরেরটা শুধুই দেখেছি! কতটা দুঃখ ও গোপনে পুষত কে জানে?”
“খুব খারাপ লাগছে রে! লিটনের মতো এমন ব্রাইট ছেলে অকালে ঝরে গেল!”
ওরা এখন বসে আছে টি এস সি তে। দুই কাপ চা নিয়ে এসে এক কাপ চারু কে দিয়ে বলল, “নীরুর খবর কি রে?”
“নীরু তো প্রেগন্যান্ট। “
“বাঃ! ভালো খবর। তা এখন আছে কোথায় তোদের বাড়ি?”
“না, রায়হানদের বাড়িতে আছে। মামী মাঝে মাঝে দেখতে যায়। আমাকে বলেছিলেন যেতে, যায়নি।”
“যা একদিন দেখে আয়। যেদিন যাবি আমাকে বলিস তো গিয়ে দেখা করে আসব।”
“ঠিক আছে বলব।”
” তোকে একটা কথা বলা হয়নি। “
চারু কাজলের দিকে তাকায়। ” কী কথা রে?”
কাজল কেমন একটু লজ্জামাখা হাসি দেয়। “আমি বিয়ে করতে যাচ্ছি। “
চারুর মুখে হাসি ফুটে উঠে।” তা-ই? এত দারুণ খবর! তা পাত্রটা কি রুয়েল সাহেব? “
কাজল বিস্মিত হয়ে বলে, “তোকে আমি বোকা মেয়ে ভাবতাম! তুই এতটা চালাক হলি কবে?”
“এ আর কঠিন কি? তোর বস তাকে তুই তুমি করে বলছিস! রুয়েল সাহেব তোর সাথে কথা বলছিল! তোদের মধ্যে একটা সম্পর্ক হয়ে বোঝায় যায়।”
“হ্যা, রুয়েল অনেকদিন থেকেই বলছে। ভাবলাম বিয়েটা করেই ফেলি।”
“ভালো সিদ্ধান্ত নিয়েছিস।”
“ভালো হবে বলছিস?”
“হ্যাঁ, রুয়েল সাহেব কে তো ভালোই মনে হলো।”
চল হলে একটু ঢু মেরে আসি।
————–
জানি না নীরুর কী হয়েছে? ওকে ইদানীং কেমন মনমরা লাগে! প্রেগন্যান্ট হওয়ার পর মেয়েদের অনেক পরিবর্তন হয়। তা-ই হয়েছে নাকি বুঝি না। আমার খুব খারাপ লাগে!
নীরুর মা হওয়ার খবর শুনে সবচেয়ে বেশি খুশি হয়েছে মা। সারাক্ষণ নীরুর খবর রাখে। বাড়িতে নীরু টুকটাক কাজ করত সব কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছেন।
মাঝেমধ্যে দেখি মা নানা ধরনের খেলনা কিনে আনেন।
রুবিনা জিজ্ঞেস করে, “মা তুমি খেলনা কিনেছ কেন!”
“দেখে ভালো লাগল তাই কিনলাম। খেলনটা সুন্দর না?”
“হ্যাঁ, খুব সুন্দর! “
“যত্ন করে রেখে দে তো মা।”
মায়ের খুশি দেখে আমার খুব ভালো লাগে!
আজ মামা আসছেন বাসায়। মামা আসলে নীরু খুব খুশি হয়। মামা বাসায় আসলেই নীরুকে ডাকবে। “কোথায় আমার বউ মা?”
নীরু কাছে এসে বলে, “কেমন আছেন মামা?”
“ভালো আছিরে মা।”
“চা খাবেন মামা? চা দিই।” নীরু চায়ের জন্য যেতে চায়।মামা হাত ধরে বলেন, এখানে বসো মা। তোমাকে কোথায় যেতে হবে না। এ অবস্থায় কাজটাজ সব বন্ধ। “
আমি বললাম, “মামা অনেক মেয়ে এ সময়েও অফিস করে।”
মামা ধমকের স্বরে বললেন, ” একদম বাজে কথা বলবি না! মেয়েদের কষ্টের তুই কী বুঝোস? “
“তুমি মা ওর কথা শুনবে না।”
নীরু হাসে। রুবিনা বলল, “মামা তাহলে ভাইয়া তোমাকে চা বানিয়ে খাওয়াবে?”
“হ্যাঁ, যা তো রায়হান চা বানিয়ে নিয়ে আয়।”
নীরু বলে, “মামা আমার এখন কোনো সমস্যা হচ্ছে না।”
“বসো তো। সবসময় তো তুমিই বানায় এ কয়েক মাস না হয় ও বানাক।”
আমি বুঝলাম মামা ছাড়ার পাত্র না। আমি আর রুবিনা চা বানাতে গেলাম।
মাঝ রাতে ঘুম ভেঙে গেল দেখি বিছানায় নীরু নাই! ওদের বাড়ি থেকে আসার পর থেকে এমন হয়। নীরু রাতে উঠে বারান্দায় বসে থাকে উদাস হয়ে! আমার খুব খারাপ লাগে ওকে এমন দেখতে! মেয়েটা জানে না ওকে আমি কি পরিমান ভালোবাসি।
আচ্ছা এমনটা কেন হচ্ছে? বাড়িতে কোনো ঝামেলা নাকি এ সময়টাতে মেয়েদের এমনই হয়। আমি ঠিক বুঝতে পারি না। চারু মেয়েটা একদিন আসেনি নীরুকে দেখতে! আম্মা কিছুদিন পর পর আসেন আমাদের বাড়িতে। নীরুকে নিয়ে যেতে চান ওনার ওখানে। আমার মা রাজি না। মায়ের কথা আমার নাতি আমার বাড়িতে হবে। আপনি বরং আমার এখানে চলে আসেন। দুই বিয়ান মিলে মেয়েকে দেখাশোনা করি। আমার তো সেই নীরু কে দেখতে ইচ্ছে করে।
উঠে বারান্দায় গেলাম। দেখি নীরু বসে আছে আকাশের দিকে তাকিয়ে। আমি কাছে গিয়ে ওর পাশে দাঁড়িয়ে ওর গায়ে হাত রেখে বললাম, “কী হয়েছে নীরু?”
“ঘুম আসছে না।”
পাশে বসে পড়লাম। নীরু আমার কাঁধে রেখে হাত ধরল। আমি ওকে একটু কাছে টেনে নিলাম। কোনো কথা বললাম না। অনেকটা সময় নীরবেই কাটল।
নীরবতা কাটিয়ে নীরু আদুরে গলায় বলল, “আচ্ছা যদি মরে যাই তুমি কি আমায় ভুলে যাবে?”
কথাটা তীরের মতো বুকে বিঁধল! ” এ সব কী বলো নীরু! তুমি জানো না তোমাকে আমি কতটা ভালোবাসি? “
“আমার শুধু মনে হয় আমি আর বাঁচব না!”
“কী সব আজেবাজে চিন্তা করো না তো।”
আকাশে কী সুন্দর চাঁদ উঠেছে। চাঁদের আলো এসে গায়ে লাগছে। নীরু বলল, “চলো ছাদে যাই।”
“আচ্ছা চলো যাই।”
দুইজন ছাদে এসে বসলাম। মনে পড়ল সেই বাসর রাতের কথ। আমাদের বাসর রাতটা এমন করে ছাদে কেটেছিল। “তুমি বসো আমি কফি বানিয়ে আনছি।”
আমি এখন ভালো কফি বানাতে পারি। ছাদের রুমে গিয়ে দুই কাপ কফি বানালাম। এ ব্যবস্থাটা নীরু এসে করেছে। ও আর রুবিনা প্রায়ই ছাদে আসে।
দুই কাপ কফি নিয়ে নীরুর পাশে এসে বসলাম। চাঁদের আলোতে ওকে খুব সুন্দর লাগছে!
কফিতে চুমুক দিয়ে নীরু বলল, খুব ভালো কফি বানানো শিখে গেছ তুমি!”
আমি একটু হাসলাম। “তা-ই! ভালো লাগছে? “
“হুঁ, অনেক ভালো হয়েছে! “
অনেক রাত পর্যন্ত দুইজনে ছাদে বসে গল্প করলাম। নীরু গুটুর গুটুর করে ভালো কথা বলতে পারে।
অফিসে এসেছি বেশ কয়েকদিন পর। নীরু মানসিকভাবে অনেকটা দূর্বল হয়ে পড়েছে! এ সময়টাতে মেয়েরা একটু ভয় পায়। কিন্তু নীরু মনে হয় একটু বেশি ভয় পাচ্ছে! নাকি সত্যি ওর কোনো সমস্যা হচ্ছে বুঝতে পারছি না। আমার কেমন ভয় ভয় লাগে ওকে নিয়ে। এমনিতে একজন গাইনি ডাক্তার ওকে নিয়মিত দেখছে।
মা আমাকে রুমে ডাকল। আমি মায়ের রুমে গিয়ে দেখি মাকে কেমন চিন্তিত মনে হচ্ছে। ” মা বললেন, রুবিনা কল দিয়েছে, বউমার শরীরটা ভালো লাগছে না। তুই এখনি বাসায় যা। আমি মিটিং শেষ করে আসছি।”
আমার মাথায় কাজ করছে না। কী হলো আবার নীরুর?
চলবে–
® নাবিল মাহমুদ