রাতের খাবার এলো শাহেদের বোন মেজো আপার বাসা থেকে। শাহেদরা চারবোন তিনভাই। শাহেদ ভাইবোনদের মধ্যে সবার ছোট এবং সবার আদরের। কিন্তু বিয়ের পর কোন এক আশ্চর্য কারণে সে তার ভাইবোন কারো বাসায়ই তেমন একটা যেতো না! এমনকি তনুকেও যেতে দিত না। এ নিয়ে সবার অনেক অভিযোগ ছিলো। সবই তনুর কাছে। সেটাও হতো ফোনে ফোনে। তনুদের বাসায়ও তেমন কেউ আসতো না। শাহেদকেও তেমন একটা কেউ ঘাটাতো না।
সকাল, দুপুর এবং রাত মিলিয়ে তনুর বাসায় অনেক খাবার জমে গেছে। এবেলায় না পাঠালেও চলতো। সন্ধার পর পরই সবাই মোটামুটি চলে গেছে। শুধু তনুর মা-বাবা রয়েগেছেন। এবার নিশ্চয়ই একটু আরাম করে খেতে বসতে পারবে তনু। টেবিলের কাছে গিয়ে খেতে বসে দেখে তেমন কিছু খাবার নেই। এক গামলা ভাত, ছোট একটা বাটিতে ডাল আর একটা পিরিচে একটু ভর্তা, সামান্য ভাজি আছে। তনুর অসম্ভব ক্ষুধা পেয়েছে। এখন তো রীতিমতো মাথা ঘুরাচ্ছে। টেবিলের অপর পাশে চেয়ারে বসা তনু তার মার দিকে তাকিয়ে,
: মা, মেজআপার বাসা থেকে তো আরো অনেক কিছু খাবার পাঠিয়ে ছিলো। ওগুলো কই?
: ওগুলো তো শেষ মা। অনেকেই খেয়ে গেলো না?
: সন্ধার পর তো তেমন কেউ ছিলো না। তানিয়া আর তমালরা শুধু ছিলো। কিন্তু ওরাও তো খেয়ে যায়নি।
এ কথা শুনে মা হরবরিয়ে বলতে লাগলো,
: হ্যাঁ ওরা খেয়ে যায়নি বলে আমি ওদেরকে খাবার দিয়ে দিয়েছি। এতো রাত পর্যন্ত এখানে ছিলো। এই রাতে কি বাসায় গিয়ে আবার রান্না করে খাবে? আর তোর তো মাথার ঠিক নেই। খাস কি খাস না। তাছাড়া কি গরম পরেছে। খাবার গুলো শুধু শুধু নষ্ট হবে। তাই ভাবলাম ওদের দিয়ে দেই। আইর মাছ তানিয়ার জামাইয়ের খুব পছন্দ। আর মুরগির মাংস তো তোর পছন্দ না। ওদের বাচ্চারা খাবে ভেবে আর রাখিনি। তাছারা কম বয়সি বিধবা মেয়েদের মাছ-মাংস না খাওয়াই ভালো।
তনু এই পুরো সময়টা তার মার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো। আজ তনুর এই সময়েও মায়ের চোখে তার জন্য এক ফোঁটা দরদের লেশ মাত্র দেখতে পেলো না। সেই জায়গায় তার ছোট ভাইবোনদের জন্যই যাবতীয় চিন্তা দখল করে বসে আছে। তনু খুব শান্ত গলায়,
: মা, তোমরা আর আমার জন্য কষ্ট করো না। আজ কার বাসায় যাবে?
একথা শুনে তনুর মা একটু থতমত খেয়ে যায়।
: না মানে, তুই একা থাকবি? বিধবা মেয়েদের একা থাকতে নেই।
“বিধবা” শব্দটা মার মুখ থেকে আর শুনতে ইচ্ছে করছে না তনুর। এই পর্যায়ে তনু তার মাকে থামিয়ে দিয়ে,
: খুব বেশি তো রাত হয়নি। আমি উবার কল করে দিচ্ছি।
তনু তার মাকে আর কথা বলার সুযোগ না দিয়ে নিজের ঘরে চলে গেলো। একটু পর মা-বাবাকে বিদায় দিয়ে মেইন দরজা ভেতর থেকে বন্ধ করতে গিয়ে খেয়াল হলো কোন লকটা কোন দিকে ঘুরিয়ে তালা লাগাতে হয়? সেটা তনুর মনে আছে কিন্তু বেশ কিছু দিনের অনভ্যস্তার জন্য সামান্য উল্টা পাল্টা হচ্ছিলো। আজ প্রায় দেড় দুই মাস হতে চললো মেইন দরজা ভেতর থেকে বন্ধ করার প্রয়োজন হয় না তনুর। কারণ শাহেদ অফিস যাওয়ার সময় প্রতিদিন তনুকে বাইরে থেকে তালা লাগিয়ে যেতো। আর যখন ঘরে ফিরতো? তখনো ঘরে ঢুকেই ভেতরের লকগুলি সে নিজের হাতে লাগিয়ে দিতো।
একদিন শাহেদ অফিস থেকে এসে দেখে তনু বাসায় নেই। দরজায় তালা লাগানোও নেই। একটু পর তনু ঘরে ঢুকে। তার কাঁধে লেপ দেখার পরও শাহেদের ভ্রু কুঁচকানো প্রশ্ন,
: কই গেছিলা?
তনু ঘরে ঢুকেই শাহেদের প্রশ্ন শুনে দরজার সামনেই থমকে দাড়ায়। তাদের বাসার লিফ্টটা কয়েকদিন ধরে নষ্ট। সিড়ি ভেঙ্গে ছাদে উঠা নামার কারণে ডিসেম্বরের এই শীতেও তনু দরদর করে ঘামছিলো এবং হাঁপাচ্ছিলো।
: শীত চলে আসছে। তাই লেপ রোদে শুকানোর জন্য ছাদে দিয়ে ছিলাম।
: লেপ নিয়ে আসতে এতো দেরি হয় নাকি? আমি তো বাসায় এসেছি তাও আধা ঘন্টা। দরজাও খোলা ছিলো।
তনু আর কথা বাড়ায়নি। ছাদে যেয়ে ভাবিদের সাথে কথা বলতে গিয়ে তার দেরি হয়েছে। তনু আশেপাশের তেমন কারো বাসায় যায় না। অনেক দিন পর তাকে পেয়ে ভাবিরাও গল্পের ঝুলি নিয়ে বসেছিলো। শাহেদের সেদিনের কথায় তনু তেমন কিছু মনে করেনি। এরপরে আরেক দিন তনু পাশের ফ্লাটে গিয়েছিলো। নিজের প্রয়োজনেই। তখন কাঁচা আমের সিজন। শাহেদ ভাতের সাথে আমের আচার খেতে পছন্দ করে। সেই রেসিপি জানতে। বাসার দরজা খোলা রেখেই গিয়ে ছিলো। কারণ ভাবির ড্রয়িংরুম থেকে তনুর বাসার দরজা পরিস্কার দেখতে পাওয়া যায়। দেখা গেলো ভাবির চাইতে ভাবির হাসবেন্ড খুব ভালো আচার বানাতে জানেন। তাই ভাইই রেসিপি বলতে ছিলেন, কিভাবে আচার বানাতে হয়? লিখতে গিয়ে তারা তিনজনেই অনেক হাসাহাসি করতে ছিলো। শাহেদ অফিস থেকে এসে তাদের দরজায় দাড়িয়ে তনুকে দেখেও না দেখার ভান করে ভেতরে ঢুকে যায়। তনুও লেখা থামিয়ে দৌড়ে তাড়াতাড়ি বাসায় চলে আসে। ভাই-ভাবি দুজন দুজনের দিকে নিরব চাহনি দেয়। বাকি রেসিপি লেখার জন্য তনুকে পেছন থেকে আর ডাক দেন না।
: তোমাকে না বলেছি, কারো বাসায় না যেতে?
তনু উত্তর দিতে যাবে এমন সময় শাহেদ ধমক দিয়ে তনুকে থামিয়ে দেয়।
: আমি কোন ইন্টারভিউ নিচ্ছি না যে প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। আমি যা বলেছি সেটা মেনে চলতে হবে। কারো বাসায় যাওয়া আমার পছন্দ নয়।
শেষবারের ঘটনায় তনুর কি ভুল ছিলো? সেটা সে এখনো চিন্তা করে বের করতে পারে না। সেদিন সেনিটারি ন্যাপকিন শেষ হয়ে গিয়েছিল। শাহেদকে অফিস থেকে ফেরার পথে ফোন করে যে আনতে বলবে? সেটা একদম অসম্ভব। কারণ শাহেদ এসব কোনদিনও তনুকে কিনে দেয় নাই। তার নাকি ফার্মেসীতে গিয়ে বলতে ভালো লাগে না। যেদিন তনু মাসের বাজার করতে বাইরে যায়? তখনি সে তার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সব কিনে আনে। কারণ মাসের ঐ একদিনই তনু বাসার বাইরে গেলে শাহেদ তেমন কিছু বলে না বা তনুকেও বাইরে যাওয়া কিংবা দেরি হওয়ার জন্য কোন রকম কৈফিয়ত দিতে হয় না। সেদিন তনু সারাদিন লাগিয়ে ঘুরে ঘুরে বাজার করে। শুধু একটাই সমস্যা, যাই কিনুক না কেন? শাহেদকে সব কিছুর ভাউচার দেখিয়ে বাজারের খরচের হিসাবের খুঁটিনাটি মিলিয়ে দিতে হয়।
তনু গোসলের যাওয়ার আগে খেয়াল করে ন্যাপকিন শেষ। কিন্তু তার এখনি লাগবে। তাই সে দরজায় তালা দিয়ে পাড়ার ফার্মেসীতে গিয়েছিলো সেনিটারি ন্যাপকিন কিনতে। এসে দেখে দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। সে তো ভয় পেয়ে যায়! কলিংবেল বাজায়। ভেতর থেকে কোন আওয়াজ নাই। তারপর শাহেদকে ফোন করে। দরজা ভেতর থেকে বন্ধ, এই কথা বলার জন্য। ফোন করার পরই বুঝতে পারে, কেন দরজা ভেতর থেকে বন্ধ? শাহেদের মোবাইল বন্ধ দরজার ওপাশে বেজে উঠে। তারমানে শাহেদ অফিস থেকে দুপুরে বাসায় চলে এসেছে! এখন সে দরজাও খুলছে না। তনুর ফোনও রিসিভ করছে না। একবার তনু ভাবে, সে কি বড় আপার বাসায় চলে যাবে? কিন্তু তাতে আরো হিতে বিপরীত হতে পারে। এর আগেও আপার বাসায় গিয়ে কোন লাভ হয়নি। তনু অনেক চিন্তা ভাবনা করে সিঁড়িতে বসে থাকার সিদ্ধান্ত নেয়। তাতে অবশ্য বিল্ডিংয়ের অনেকের সাথে তনুর দেখা হয়। সবাইকে সে বলে,
: চাবিটা হারিয়ে ফেলেছি। তাই শাহেদের আসার অপেক্ষায় আছি।
: তাহলে আমাদের বাসায় এসে বসেন ভাবি।
: না থাক। এখানেই বসি। কখন আবার ও চলে আসে তার তো কোন ঠিক নেই।
আশেপাশের সবাই মোটামুটি শাহেদের অসামাজিক আচরণ সম্পর্কে ভালো ভাবেই অবহিত। তাই তনুকে আর কেউ তেমন কিছু বলে না। সেদিন তাকে ঐ সিঁড়িতে বসে থাকতে হয়েছিলো রাত বারোটা পর্যন্ত। তারপর শাহেদ দরজা খুলেছিলো। সেদিন কেন যেন তনুরও বড্ড জেদ চেপে গিয়েছিলো। সেও দেখতে চায় শাহেদ কতক্ষণ তাকে বাইরে বসিয়ে রাখে? আর সেদিনের পর থেকেই শুরু হয় তার নিজেরই ঘরে বন্দী জীবন যাপন।
চলবে…….
আফরোজা খানম তন্দ্রা