মা’র সাথে অতটা শক্ত ভাবে কথা বলা মনে হয় তনুর ঠিক হয়নি। তাদের বিদায় দিয়ে এখন তার মনটা ভিষণ খারাপ লাগছে। তবে এই মন খারাপ লাগাটা মোটেও ঠিক হচ্ছে না। মা’র কথা শুনে হঠাৎই তনুর রাগ উঠে গিয়েছিলো। রাগ উঠাটাই স্বাভাবিক। রাগ উঠার অবশ্য যথেষ্ট কারণও আছে।
বিয়ের প্রায় এক মাস পরে যখন তনু বুঝতে পারলো, শাহেদ আসলে একজন অক্ষম পুরুষ। তখন তনু একদিন শাহেদকে না জানিয়ে তাদের বাসায় চলে গিয়েছিলো। ইচ্ছে ছিলো আর শাহেদের কাছে ফিরে আসবে না। এই সংসার আর করবে না। তার বয়সই বা কত? মাত্র ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেছে। রেজাল্টও খারাপ না। আবার সে লেখাপড়া শুরু করতে পারবে। এখনো যদি সে ভর্তি হয় তাহলে কোন রকম ইয়ার লস হবে না। যে কোন কলেজে এখনো ভর্তির সুযোগ রয়েছে। তনু খুব আশা নিয়ে তার মাকে বলেছিলো,
: মা, আমি আর ঐ বাড়িতে ফিরে যাবো না। তোমাদের কাছে থাকবো।
: এসব কি বলছিস তুই ? তুই সংসার করবি না মানে! শাহেদের সমস্যাটা কোথায়? ও কি তোকে মারধোর করে? নাকি খাওয়ায় কষ্ট দেয়? না দেখতে খারাপ? তোর কি মাথা নষ্ট হয়ে গেছে তনু? কি সব আবোল তাবোল বলছিস?
তনু অবাক হয় সেদিন তার মা’র দিকে তাকিয়ে ছিলো। শুধুমাত্র খাওয়ায় কষ্ট আর গায়ে হাত না তুললেই কি ছেলেরা ফেরেস্তা হয়ে যায়? এছাড়াকি আর কোন সমস্যা থাকতে পারে না! না, তনু সেদিন তার মার কাছে শাহেদের অক্ষমতার কথা বলতে পারেনি। মুখ ফুটে কথাটা বলতে তার সাংঘাতিক সংকোচবোধ হচ্ছিলো। আর মাকে এইসব কিভাবে বলবে? ভেবেই কুল পাচ্ছিলো না। তাই শেষ পর্যন্ত বাবার পায়ের কাছে বসে অসহায়ের মতো বললো,
: বাবা, আমি লেখাপড়া করতে চাই।
তনুর বাবা তাকে ঐখানেই থামিয়ে দেয়। আর কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে তিন উঠে দাড়ান। কয়েক পা এগিয়ে তনুর দিকে না ফিরেই,
: শোন মা, তোর ছোট ছোট দু ভাই-বোন আছে। সামনে তাদের এসএসসি পরীক্ষা। তুই কি চাস, তাদের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যাক? ওদের ভবিষ্যৎ নষ্ট করে দিয়ে তোর লেখাপড়া শুরু করতে?
বাবার কথায় মনে হলো মা তার শরিরে আরো শক্তি ফিরে পেলো। তাই বাবার সাথে সাথে মাও গলা মেলালেন,
: আমিও তো তাই বলি। বড়বোন যদি সংসার করতে না পারে তাহলে ছোটবোনের বিয়ে দিব কিভাবে? এসব সর্বনাশা ঘটনা ঘটালে ছোট ভাইটারই কি আর লেখাপড়া হবে? আমরাই বা সমাজে মুখ দেখাবো কি করে?
কথার এক পর্যায়ে মা কান্নাকাটি শুরু করে দিলেন। তনুর ছোট দুই ভাই-বোন তানিয়া আর তমাল এসে মার দুপাশে বসে মাকে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করছিলো। কিন্তু দুজনের একজনও তনুর দিকে তাকালো না পর্যন্ত। অথচ ছোটবেলা থেকে তিনজন একসাথে বড় হয়েছে। তনুর সাথে ওদের বয়সের তেমন একটা পার্থক্য নেই। তারপরও বড়বোন হিসেবে যখন যেখানে যতটুকু সেক্রিফাইস করা দরকার ছিলো, প্রয়োজনের তুলনায় বরং কখনো কখনো সেটা বেশি করার চেষ্টা করেছে তনু। আর বাবা তো তার বক্তব্য শেষ করে বাসা থেকেই বের হয়ে গেলেন। যাওয়ার সময় দরজায় দাড়িয়ে গলার স্বর যথাসম্ভব গম্ভীর করে,
: শাহেদকে ফোন করো। এসে ওকে নিয়ে যাক।
তনু সেদিন বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিলো, এরা কি তার সত্যিই বাবা-মা? নাকি তাকে রাস্তা থেকে কুড়িয়ে এনে ছিলো? আর ভাই-বোন দুজন! তারাই বা সব কিছু ভুলে গেলো কেমন করে? কতবার নিজের প্লেটের মাছ, মাংসের টুকরাটা নিজে না খেয়ে দুজনের প্লেটে তুলে দিয়েছে। তবে কি তনুর ভালোবাসায় কোন ভুল ছিলো? একটু পর ফোনে মাকে বলতে শুনে ছিলো,
: বাবা শাহেদ, তনুর মনে হয় শরীর খারাপ, জ্বর। জ্বরের ঘোরে কি সব আবোল তাবোল বকছে। অফিস থেকে যাওয়ার সময় ওকে নিয়ে যেও বাবা।
তনুর সেদিন মরে যেতে ইচ্ছে করছিলো। সাহসের অভাবে আত্মহত্যা করতে পারেনি। শাহেদ অফিস না করে লাঞ্চ আওয়ারে ছুটি নিয়ে তনুকে নিতে এসেছিলো। দুপুরে তনুদের বাসায়ও খায়নি। এমনকি এক মুহুর্ত দেরিও করেনি। এসেই তনুকে নিয়ে বের হয়ে গেছে। মা অবশ্য জামাইকে অনেক করে খেয়ে যেতে বলেছিলেন। বাসায় এসেও শাহেদ, তনু কেউই খায়নি। সকালে তনু যাওয়ার আগে কিছু রান্না করে যায়নি। এসেও অনেকটা সময় সে একা একা কান্না করেছে। শাহেদও ওকে কিচ্ছু জিগ্যেস করেনি। বিকেলের দিকে তনু অবশ্য রান্না করে ছিলো তখনও কিছু খায়নি সে। তবে সেদিনের পর থেকে শাহেদের রাতের অত্যাচার শুরু হয়েছিলো। শারীরিক ভাবে সে অক্ষম হলে কি হবে? বিকৃত আচরণে সক্ষম ছিলো দারুণ ভাবেই। সে সব কথা মনে হতেই তনু নিজের অজান্তেই একটু কেঁপে উঠলো।
এরো বেশ কিছু সময় পরের কথা। তনুর সংসার জীবনের বয়স তখন কত হবে? প্রায় বছর পেরিয়ে আরো দুই-তিন মাস। সেদিন অবশ্য শাহেদকে বলে কয়েই সে তার বাবার বাড়ি গিয়েছিলো। মা-বাবার আগেরবারের অপমানজনক ব্যবহারে কথা তনু একদম ভোলেনি। কিন্তু কি করবে? তার তো আর যাওয়ার জায়গা ছিলো না। তনুর সেদিনের কথাগুলি খুব স্বাভাবিক ছিলো না। তবে কোন রকম ঝগড়াঝাটিও হয়নি তাদের মধ্যে।
: তোমার সাথে আমি আর থাকতে চাই না শাহেদ। আমাদের মধ্যে আজ পর্যন্ত কোন শারীরিক সম্পর্ক হয়নি। এভাবে চললে আমি তো কখনোই মা হতে পারবো না। তাই ভেবেছি আমাদের আলাদা হয়ে যাওয়াই মনে হয় ভালো।
তনুর একথায় শাহেদ কোন উত্তর দেয়নি। প্রতিদিনের মতো সে অফিসের উদ্দেশ্যে বের হয়ে গেছে। এদিকে বাবার বাড়ি গিয়ে তনুর মনে হলো এখানে কেন এসেছে সে! তারচাইতে বরং ট্রাকের নিচে পড়া বুঝি তার জন্য অনেক আরামের হতো। তনুর ছোটবোন তানিয়া যখন বললো,
: আপা, আমার একটা বিয়ের সম্মন্ধ এসেছে। তুই তো জানিস বাবার আর্থিক অবস্থা তেমন একটা ভালো না। এই সময়ে যদি তোর একটা ভুল সিদ্ধান্তের কারণে আমার বিয়েটা ভেঙ্গে যায়, তাহলে এখন যে তোর অবস্থা তারচাইতে খারাপ অবস্থায় আমি পরবো। তোর চাইতেও অনেক কমপ্লিকেশন নিয়ে মেয়েরা সংসার করছে। তুই কেন পারছিস না? বেটার তুই বাসায় ফিরে যা। এ বাসায় আসবি। তবে সেটা যেন বেড়ানোর উদ্দেশ্যেই হয়ে থাকে।
সেদিন মা আর তমাল কেউই তনুর সাথে কথা তো দূরে থাক একবার চোখের দেখা দেখতেও নিজেদের ঘর থেকে বের হয়নি। আর বাবা তো বাসায়ই ছিলো না। তনু তার বাবার বাড়ির ড্রয়িং রুম থেকেই বের হয়ে চলে এসেছিলো। রোদে, গরমে প্রচন্ড পানি পিপাসা পেয়ে ছিলো। কিন্তু এক গ্লাস পানি খাওয়ার মতো রুচি হয়নি তার।
শাহেদ তার গায়ে কখনো হাত তোলেনি। কিন্তু রাতের আচরণের কারণে তার গায়ে যেসমস্ত দাগ বসে যেতো তাতে বরং সবাই মনে করতো, শাহেদ তনুকে না জানি কত আদর করে। স্বামী সোহাগের চিন্হ দেখে সবাই ভুল সিগন্যাল পেতো। বিল্ডিংয়ের কারো সাথে ছাদে বা সিঁড়িতে কখনো কোন ভাবির সাথে দেখা হলে এসব দাগের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে থাকতো। তাদের চোখের ভাষা তনু ঠিকই বুঝতে পারতো। কেউ কেউ তো নিজের মুখের লাগাম টানার ধার ধারতো না। দুষ্টামির ছলে তাকে দু’কথা শোনাতে ছাড় দিতো না। তনু কিন্তু বাইরে বের হওয়ার সময় নিজেকে বড় ওড়না দিয়ে যথেষ্ট ঢেকে ঢুকে যেতো। তারপরও প্রতিবেশীর তীক্ষ্ণ দৃষ্টির কাছে প্রায়ই ধরা খেয়ে যেতো।
তনু কখনোই কাউকে বোঝাতে পারেনি এই দাগ সব সময় স্বামী সোহাগের হয় না। কিছু কিছু দাগ অত্যাচারেরও হয়ে থাকে। যেমনটা বোঝাতে পারেনি বড় আপাকেও। বাবার বাড়ি থেকে মোটামুটি বিতারিত হয়ে তনুর শেষ আশ্রয় বড় আপার বাসায় গিয়ে উঠে ছিলো,
: তনু, পুরুষ মানুষের টুকটাক সমস্যা থাকেই। তাকে নিজের যোগ্যতায় সংশোধন করে নিতে হয়। ভালোবাসা দিয়ে সুদ্ধ করে তুলতে হয়। নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে একটা সমাধান খুঁজে বের করতে হয়। সবাইকে জানাজানি করলে সেটা নিজেরই ক্ষতি। তোমার বাসায় মন না বসলে আমার বাসায় কয়দিন থাকো। শাহেদকে নিয়ে কোথাও ঘুরে আসো। দেখবে সব ঠিক হয়ে গেছে। শাহেদ অতটা খারাপ ছেলে নয়, তুমি যতটা ভাবছো।
আপাকেও সব কথা খুলে বলতে পারেনি তনু। ইশারা ইঙ্গিতে যতটুকু বোঝানো সম্ভব ততটুকুই বলেছে। শেষ পর্যন্ত তনু বুঝতে পারলো, সে আসলে তার সমস্যার কোন কিছুই বোঝাতে পারেনি। যতটুকু বোঝাতে পেরেছে ততটুকুই ভুল বুঝেছে তারা। অথবা তার বোঝানোতেই গন্ডগোল ছিলো। ভুলটা তবে কি তনুর নিজের মধ্যে?
প্রতিটা মানুষের নিজের সমস্যা বলার একটা প্র্যাক্টিস ছোটবেলা থেকেই থাকা উচিৎ। আর এই প্র্যাক্টিসটা শুরু হওয়া উচিৎ নিজের পরিবার থেকে। কিন্তু না আমাদের সমাজ বা পরিবার ব্যবস্হা এমন যে, তোমার সমস্যা? কাউকে বলো না। লুকিয়ে রাখো। লোকে খারাপ বলবে। তনুর জীবনটাও এর ব্যাতিক্রম নয়। খুব ছোটবেলায় যখন সে স্কুলে ভর্তি হয় তখন সেখানে তার সাথে অনেক রকম ঘটনাই ঘটতো। তারা তাকে নিষেধ করতো কাউকে কিছু না বলতে। বাসায় অনেক সমস্যা হতো। মা বারণ করতো বাবাকে এসব বলা যাবে না। খুব রাগ হবেন তাহলে। নিজের মেয়েলি শারীরিক সমস্যা যত জটিল আকার ধারণ করুক না কেন। ডাক্তারের কাছে যাবা? মাথা খারাপ! এমন সমস্যা সব মেয়েদের হয়। আবার আপনা আপনিই ঠিক হয়ে যায়। কাউকে কিছু বলা যাবে না। জানানো যাবে না। নিজের মধ্যে লুকিয়ে রাখতে হবে। নইলে মানুষ খারাপ বলবে তাকে। দীর্ঘদিন এমন নিজের মধ্যে লুকিয়ে রাখতে রাখতে আর কাউকে না বলতে না বলতে কখন যে প্রয়োজনীয় কথা বলতে ভুলে গেছে? সেটা আর তনুর খেয়াল করা হয়ে উঠেনি।
চলবে…….
আফরোজা খানম তন্দ্রা