বড় আপা তনুকে তার বাসায় নিয়ে এসেই সোজা বাথরুমে ঢুকে যান। শাওয়ার ছেড়ে তার নিচে তনুকে দাড়াতে বলেন। সাবান হাতে নিয়ে তনুর শরীর ডলে দিতে গিয়ে বলেন,
: তনু, নিজে নিজে তোর কাপড় খুলতে পারবি? শরীরে অনেক দিনের ময়লা জমেছে রে। একটু ভালো করে গোসলটা করিয়ে দেই?
এই কথা শুনে তনু দু’হাত তার বুকের কাছে জড়ো করে তার বুক ঢাকার চেষ্টা করে। চোখের মধ্যে প্রচন্ড আতংক নিয়ে বাথরুমের এক কোনায় গিয়ে জড়োসড়ো হয়ে দাড়িয়ে থাকে।
: ঠিক আছে আমি খুলে দিচ্ছি। আমি তোর মায়ের মতো। আমাকে কিসের লজ্জা রে? তুই পেছন ঘুরে দাঁড়া।
এরপর বড় আপা তনুকে আলতো করে ধরে নিজের কাছে টেনে নেয়। তনুকে ঘুরিয়ে আপার দিকে পিঠ দিয়ে দাড় করিয়ে কাপড় খুলতে থাকে। জামা খোলার পরই আপার চোখ তনুর পিঠে আটকে যায়। চমকে নিজের অজান্তেই দুহাত দিয়ে নিজের মুখ চেপে ধরেন,
: আল্লাহ এ তুমি কি দেখাইলা আমাকে!!
তনুর পিঠে হাজারটা কামড়ের দাগ। কয়েকটা তো একদম কাঁচা। হয়তো শাহেদ যেদিন মারা গেছে সেদিনের। তনু বেশ অনেক দিন হলো গোসল করে না। এই কয়দিনের গরমে ঘাম আর শরীরের ময়লায় বসে যাওয়া দাঁতের ক্ষত স্থানে ইনফেকশন হয়ে গেছে। কোন কোন ক্ষতের উপরের কালো হয়ে মরে যাওয়া চামড়ার নিচে আবার পুঁজ জমা হয়েছে। এসব দেখে আপা তনুকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠে। একহাত দিয়ে তনুর মাথায় আদর করতে করতে মনে মনে বলেন,
: আহারে বাচ্চাটা আমার, না জানি শাহেদের কত অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে এই সাত বছরে!!!
পরক্ষনেই আবার তওবা কাটেন। মৃত ভাইয়ের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করেন,
: আস্তাগফিরুল্লাহ্। আল্লাহ আমার ভাইটার কবরের আজাব মাফ করে দিও।
গোসলের পর তনুকে আপার মেয়ের রুমটায় নিয়ে গিয়ে হাত-পায়ে লোশন লাগিয়ে দেন। আপা এতো কিছু তনুকে করে দিচ্ছে অথচ সে কিছুই বলে না। রোবটের মতো আপার প্রতিটা কথা পালন করতে থাকে। এটাকে ঠিক পালন করা বলে না আসলে। তনুর মধ্যে কোন রকম বোধই আর কাজ করছে না। আপার কোন কথা তনুর কান পর্যন্ত পৌঁছাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না। ঘরে যা খাবার ছিলো আপা তাড়াহুড়ো করে কোন মতে তাইই মাখিয়ে তনুকে কয়েক গাল খাইয়ে দিল। তনু খেতে একদম আপত্তি করেনি। তাকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে আপা নিজের রুমে এসে এশার নামাজ পড়তে গিয়ে জায়নামাজে মোনাজাত করার সময় অঝোর ধারায় কাঁদতে থাকে,
: আল্লাহ, আমার সন্তানের মতো ভাইটাকে মাফ করে দিও।
বড় আপার মনে পরে যখন শাহেদের জন্ম হলো,
চার ভাই তিনবোনের মধ্যে শাহেদ সবার ছোট। ওর জন্মের পর থেকেই তাদের মা অসম্ভব অসুস্থ হয়ে পরেন। শাহেদকে একফোঁটা দুধ খাওয়ানোর মতোও অবস্থা তার থাকে না। আর কেন যেন মাও শাহেদকে একদম দেখতে পারতেন না। শাহেদকে দুধ খাওয়ানোর জন্য তার কাছে নিলেই তিনি দূরদূর করে শাহেদাকে তাড়িয়ে দিতেন,
: এই আপদডারে আমার কাছ থন সরা। নিয়া যা আমার সামনে থিকা। তরে না কইছি ওরে আমার কাছে আনবি না। ও আমারে মাইরা ফালাবো। আমার মরন অসুখ নিয়া ও দুনিয়াত আইছে। আমারে না খাইয়া ওর শান্তি নাই। যা আমার ঘর থন। দুরে যা।
সত্যি সত্যিই শাহেদের মা তিন, চার মাসের মাথায় রাতে ঘুমের মধ্যেই মারা গেলেন। সবার আদরের ছিলো শাহেদ। মা মারা যাওয়ার পর তাকে সবাই আরো বেশি আদর কারতো। মা মরা ছেলে, মায়ের মৃত্যুতে নিস্পাপ শিশুর নিশ্চয়ই কোন দোষ থাকতে পারে না। শাহেদের বড় আপা শাহেদা, নিজের নামের সাথে মিলিয়ে ছোটভাইটার নাম রাখেন শাহেদ। তার বয়স যখন প্রায় এক বছর হবে হবে তখন শাহেদার বিয়ের সম্মন্ধ আসে। বিয়ের সম্মন্ধ অবশ্য আরো আগে থেকেই আসছিলো। কিন্তু সে রাজি হচ্ছিলো না শুধু মাত্র শাহেদকে সাথে নিতে পারবে না বলে। একমাত্র বড় দুলাভাইরাই শাহেদের ব্যাপারে কোন রকম আপত্তি করেননি।
এদিকে শাহেদার শ্বশুর বাড়ির সবাই শাহেদকে বেশ আন্তরিকতার সাথেই গ্রহণ করেছিলেন। ঐ বাড়িতে কোন ছোট বাচ্চা ছিলো না। শাহেদা ছিলো বাড়ির বড় বৌ। তার দুই দেবরও তখন সদ্য লেখাপড়া শেষ করে সরকারি চাকরির সন্ধানে বিসিএসএর প্রিপারেশন নিচ্ছে। সবার মোটামুটি চোখের মনি হয়েই শাহেদ বড় হচ্ছিলো। বরং শাহেদের কোন দুষ্টামির জন্য শাসন করতে গেলে শাহেদার শ্বশুরবাড়ির কেউ না কেউ সেটার বাঁধা হয়ে দাড়াতো। যার কারণে ছোটবেলা থেকেই তার অন্যায়ের জন্য তেমন কোন শাসন কখনোই করা হয়নি। শাহেদের বয়স তখন হয়তো তিন বছর। সেই সময় শাহেদার ছোট দেবর জামিল কোত্থেকে যেন কয়েকটা গিনিপিগের বাচ্চা বাড়িতে নিয়ে আসে পালবে বলে। তার আবার পশুপাখি পালার খুব শখ। বাড়ির কবুতর, মুরগী, বিড়াল, কুকুর এ সব কিছুর খেয়াল সে নিজেই রাখে। কিন্তু বিপত্তিটা ঘটে এই গিনিপিগের বাচ্চার বেলায়ই। সেদিনই শাহেদের হাতে একটা মরা গিনিপিগের বাচ্চা দেখতে পাওয়া যায়। খুব স্বাভাবিক ভাবেই সে ঐ মরা বাচ্চাটাকে হাতে ঝুলিয়ে সারা উঠোন ঘুরে বেড়াচ্ছে। জামিল ঘর থেকে এই দৃশ্য দেখে দৌড়ে এসে ওর হাত থেকে গিনিপিগটা নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখতে দেখতে,
: কি করেছিস ওকে তুই! মেরে ফেলেছিস নাকি!!
: না, আমি তো ওকে আদর করছিলাম।
জামিল এই সময় ওকে জোরে ধমক দিয়ে উঠে। শাহেদাও তার ঘর থেকে উঠোনে বের হয়ে এলে শাহেদ কান্না করতে করতে দৌড়ে তার কাছে এসে দু হাতে হাটুর কাছে জড়িয়ে ধরে,
: বু, আমি ওকে মারিনি। আদর করেছি।
শাহেদা জামিলের দিকে তাকিয়ে নরম সুরে,
: জামিল, ও ছোট বাচ্চা। ইচ্ছে করে তো আর মারেনি। আদর করতে গিয়ে হয়তো গলায় জোরে চাপ লেগে মরে গেছে। গিনিপিগগুলোকে আর মাটিতে রেখো না। খাঁচাটা বরং কবুতরের বাসার উপর রাখো।
বড় ভাবির কথার উপর কথা বলবে এমন বেয়াব ছেলে জামিল নয়। তাছাড়া ভাবি সন্তান সম্ভবা। এই সময়ে তো তার সাথে তর্ক করার প্রশ্নই উঠে না। সে নিজেও শাহেদকে অনেক আদর করে। তবে আজ যে কাজটা সে করেছে? তার জন্য তাকে শাস্তি দেয়া উচিৎ ছিলো। কিন্তু বড় ভাবির জন্য জামিল আর শাহেদকে কিছু বলে না। তবে গিনিপিগগুলি আর সে বাড়িতে রাখে না। যেখান থেকে এনে ছিলো, সেখানে আবার দিয়ে আসে।
শাহেদের ছয় বছর বয়সে স্কুলে ভর্তি করা হয়। প্রতিদিন স্কুলে যাওয়ার সময় হলেই সে শাহেদার আঁচলের নিচে গিয়ে মরা কান্না করতে থাকে,
: বু রে বু আমারে তুই লেখাপড়া করতে পাঠাস কেন? তুই না গেলে আমিও স্কুলে যাবো না। তুই জানস না তরে ছাড়া আমি কোথাও যেয়ে থাকতে পারি না? আমি লেখাপড়া শিখবো না। আমি বাড়িতে তোর সাথে সারাদিন থাকবো। তোর সাথে রান্নাবান্না করবো। বু, তর পায়ে ধরি আমারে স্কুলে যেতে বলিস না।
শাহেদের এসব কথা শুনে বাড়ির সবাই হেসে খুন। ছোটবেলা থেকেই শাহেদের মুখে বড়দের মতো পাকনা কথা সবারই শুনতে খুব ভালো লাগতো। কেউ কখনো এসবের প্রতিবাদ করেনি। ওকেও কেউ বোঝায়নি যে বড়দের সাথে এভাবে কথা বলতে হয় না। যখন যেটা প্রয়োজন, কষ্ট করে হলেও সেটা তাকে করতে হবে। বরং সবাই খুব মজা পেয়েছে তার এসব কথায়। সেবার তাকে আর একদিনের জন্যও স্কুলে পাঠানো যায়নি। যদিও বা এক,দুইদিন গিয়েছে? সেটাও শাহেদার সাথে গিয়েছে। একবারের জন্যও তাকে ক্লাশে ঢোকানো যায়নি। আবার শাহেদার সাথে তখনই বাড়িতে চলে এসেছে। এরপর শাহেদাও আর তেমনটা জোরজবরদস্তি করে শাহেদকে ক্লাশে পাঠানোর চেষ্টা করেনি। শাহেদের কান্না সে একদম সহ্য করতে পারতো না। এর কয়েক বছর পর শাহেদার বড় ছেলেকে যখন স্কুলে ভর্তি করানো হলো? তখন সেই স্কুলের হেডমাস্টারকে সুপারিশ করে মামা- ভাগ্নাকে একসাথে একই ক্লাশে ভর্তি করানোর ব্যবস্হা করানো হয়। অথচ তাদের দুজনের বয়সের পার্থক্য তিন বছরেরও কিছু বেশি।
ছোটবেলা থেকেই বাচ্চাদের ন্যায়, অন্যায়ের শিক্ষা দেয়াটা খুব জরুরী। খুব বেশি কঠিন ভাবে না হোক, সহজ ভাবে, আস্তে আস্তে, একটু একটু করে বাস্তবতার সাথে পরিবারের ছোট সদস্যদের পরিচয় ঘটানো প্রয়োজন। আমরা অনেক সময় ভাবি ছোট মানুষ, কিইবা বয়স? বড় হলে একাই শিখবে। সময়, পরিস্থিতি এবং প্রয়োজন হয়তো কাউকে অনেক সময় সঠিকটা শেখায়। কিন্তু সবার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা এক রকম নয়। সবার শেখার ক্যাপাসিটিও এক রকম হয় না। কেউ নিজে নিজে শেখে। আবার কারো হয়তো অন্যের সাহায্য লাগে। তবে অন্যায়, সেটা যে বয়সেই করুক না কেন? সেটা অন্যায়। বয়স কম বলে অন্যায়ের শাস্তি হয়তো ছোট হবে। অন্যায়কে প্রশ্রয় বা হেসে অন্যায়টাকে হালকা করা মোটেও ঠিক না।
চলবে……….
আফরোজা খানম তন্দ্রা