সানজিদার এমন প্রশ্নে তনু বেশ অপ্রস্তুত হয়ে যায়। সাথে সাথেই কোন উত্তর খুঁজে পায় না। চুপ করে মাথাটা নিচু করে তার কোলের উপর খুব অবহেলায় ফেলে রাখা দু’হাতের দিকে তাকিয়ে চিন্তা করতে থাকে আসলেই তো! আমি কেন অসুস্থ হলাম? শাহেদের মৃত্যুতে তো আমার চাইতে বেশি খুশি আর কেউ হয়নি। একথা মনে আসতেই সে আতংকিত দৃষ্টিতে সানজিদার দিকে এমন ভাবে তাকালো যেন তনু সানজিদার কাছে ধরা পরে গেছে! সামনে বসে থাকা সানজিদার স্হির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা চোখ দুটি দিয়ে তনুর মনের অবস্থা সব জেনে ফেলছে। শাহেদের মৃত্যুর জন্য তনুই দায়ী। সে তনুর মাথার ভেতর ঢুকে ব্রেনের প্রতিটা কোষে কোষে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আর জেনে যাচ্ছে তনুর সব গোপন খবর। তনুই শাহেদের মৃত্যুর জন্য দায়ী।
তনু এক মনে নিজের একহাতের নখ দিয়ে আরেক হাতের নখ খোটাতে থাকে। এক পর্যায়ে নখের ভেতর থেকে চিকন ধারায় রক্ত বেড়িয়ে আসে। কিন্তু তনুর সেদিকে কোন রকম ভ্রুক্ষেপ নেই। সে বিরবির করে ঐ একই কথা নিজের মনে বলতে থাকে,
: শাহেদের মৃত্যুর জন্য আমি দায়ী। আমার কারণেই শাহেদের মৃত্যু হয়েছে। আমি দায়ী। আমি দায়ী। দায়ী হ্যা দায়ী দায়ী দায়ী দায়ী।
তনুর এই অবস্থা দেখে সানজিদা তাড়াতাড়ি নিজেই বলে,
: তনু, আপনি আমার দিকে তাকান। আমার দিকে তাকান বলছি।
সানজিদা তনুকে একবার, দুইবার, পাঁচবার ডাকার পরও সে তার দিকে তাকাচ্ছে না দেখে, এক সময় সে নিজের চেয়ার থেকে উঠে গিয়ে তনুর কাছে গিয়ে দেখে তনুর নখের কোনা থেকে রক্ত বের হচ্ছে। সে দ্রুত তনুর দু’হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে কিছুক্ষণ ধরে থেকে তনুকে শান্ত হওয়ার সময় দেয়। এরপর আস্তে করে তনুর কাঁধে হাত রাখে। এবার তনু মুখ উঠিয়ে সানজিদার দিকে তাকালো। সেই দৃষ্টি ছিলো সম্পূর্ন ফাঁকা। সানজিদা বুঝতে পারে তনু তার দিকে তাকিয়েছে ঠিকই কিন্তু তাকে দেখছে না। হয়তো চিনতে পারছে না। তনু আবার তার কোলের উপর থাকা কিছুক্ষণ আগেই সানজিদার হাত থেকে ছাড়া পাওয়া দুই হাতের দিকে তাকালো। তনুর চাহনি দেখে সানজিদা বেশ ঘাবড়ে যায়। এতোদিনের পরিশ্রম বুঝি তার ছোট্ট একটা বোকামির জন্য বৃথা হতে চললো। ছোটই বা বলে কিভাবে? এভাবে প্রশ্ন করা তার মোটেও উচিৎ হয়নি। বিশেষ করে তনুর মতো কেসের ক্ষেত্রে তো এমন প্রশ্ন করা অপরাধের সামিল। সে তারাতাড়ি আবার তনুর দুইগালে ধরে নিজের দিকে মুখ তুলে তনুর চোখে চোখ রেখে,
: তনু, আপনি আর আমি এই দু’জন মিলে একটা দারুণ কাজ শুরু করেছি। আমরা দুজন একটা টিম। আমি চাই না আমাদের এই টিমটা হেরে যাক। কাজটি একদম শেষ পর্যায়ে এসে নষ্ট হয়ে যাক। প্লিজ আপনি আমাকে সাহায্য করুন। আমি আপনার সাথে আছি। পুরো ব্যাপারটিতে আপনার কোন দোষ নেই। আমি আপনার চোখে দেখতে পাচ্ছি আপনি একদম নিষ্পাপ, নির্দোষ। সেই সাথে বিশ্বাস করি আমাদের এই টিম ওয়ার্ক নিশ্চিত সফল হবে।
সানজিদার স্পর্শ বা কথা, যেটাই হোক না কেন? তনু সামান্য হলেও শান্ত হলো। তার দ্রুতগতির শ্বাস-প্রশ্বাস স্বভাবিক হওয়া শুরু করলো। সানজিদা এবার তনুর গাল থেকে হাত সরিয়ে তনুর পিঠে রাখলো,
: তনু, আপনি না স্টুডেন্ট ভালো ছিলেন? আবার লেখাপড়া শুরু করতে চান? আপনি অনেক সাহসী একটা মেয়ে। আপনার মতো এতো সাহসী মেয়ে আমার ক্লায়েন্ট হিসেবে খুব কম পেয়েছি।
এই পর্যায়ে তনু স্বাভাবিক হলেও আর কথা বলতে চায় না,
: আমার শরীরটা ভালো লাগছে না। আমি বাসায় যাবো।
: ঠিক আছে আজ তাহলে আমরা আর কোন কথা বলবো না। আপনার ডেট মনে হয় আবার পরশুদিন। সেদিন অবশ্যই আমরা অনেক সুন্দর সময় কাটাবো।
কলিংবেল বাজিয়ে সানজিদা তার এসিস্ট্যান্টকে তনুর আপাকে নিয়ে আসতে বললেন। আর তনুকে বাইরে অপেক্ষা করতে বললেন। আপা চেম্বারে ঢুকে সামনের চেয়ারটায় বসলেন।
: কেমন আছেন?
: জি ভালো। তনু কি আগের মতো হতে পারবে?
সানজিদা শাহেদার কথায় একটু শব্দ করে হেসে উঠে,
: কেন নয়। উনি তো এখনই যথেষ্ট সুস্থ।
সানজিদার কথা শুনে আপা সাথে সাথে বলে উঠলেন,
: আলহামদুলিল্লাহ। শুকুর আলহামদুলিল্লাহ। আল্লাহর দরবারে লাখ লাখ শুকরিয়া।
: তবে তার সাথে এমন কোন কথা বলা উচিৎ হবে না যেটা শুনে উনি নিজেকে অপরাধী মনে করে। বা তার স্বামী মারা যাওয়ার জন্য নিজেকে দোষী ভাবে। উনি কিন্তু অলরেডি নিজেকে খুনি ভেবে বসে আছেন। এই ব্যাপারটা থেকে উনাকে বের করে আনতে হবে। আচ্ছা শাহেদের মৃত্যুর জন্য কি আপনারা কখনো তাকে কোন দোষ দিয়েছিলেন?
শাহেদা জিভে কামড় দিয়ে,
: তওবা তওবা, আস্তাগফিরুল্লাহ্। এমন কথা আমরা কখনো মনেও আনি না। ডাক্তার তো বলেছিলেন হিটস্ট্রোকের কারণে শাহেদের মৃত্যু হয়েছে। তাহলে আমরা কেন ওকে দোষ দিব? তাছাড়া আমরাও জানতাম আমাদের ভাইয়ের দোষ ছিলো। তনুকেই বরং অনেকগুলো বছর অমানুষিক যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়েছে।
: অন্যরা? আত্মীয় স্বজন বা প্রতিবেশী? অথবা বন্ধু বান্ধব? সময় নিয়ে, চিন্তা করে তারপর বলুন।
শাহেদা একটু ভেবে,
: হ্যা, শাহেদের মৃত্যুর দিন তো অনেক মানুষ বাসায় এসেছে। তাদের আলোচনায় অনেক কিছুই ছিলো। কিন্তু আমরা তাদের কথাকে কোন রকম কানে তুলিনি। আসলে তখন বুঝতেই পারিনি যে কারো এমন কথায় তনুর এতো বড় ক্ষতি হয়ে যাবে।
: না, আমি বলছিনা তাদের কথায় তনুর এমন অবস্থা হয়েছে। তার এই অবস্থার জন্য আসলে তার অতীত জীবনের অনেক ঘটনাই দায়ী। শাহেদের মৃত্যুতে সেটা বাস্ট হয়েছে। ঠিক আছে আজ আর নয়। যদি তেমন কিছু আপনার মনে পরে তবে নেক্সট সেশনে আমাকে জানাতে ভুলবেন না প্লিজ। কারণ ঐ দিনটার প্রতিটা খুটিনাটি ঘটনা, কথা সব কিছু আমার জানা প্রয়োজন। তনুর সুস্থ হওয়ার সার্থেই জানা অত্যন্ত জরুরী। খুব সামান্য থেকে সামান্যতম কিছুও যেন বাদ না পরে। এছাড়া তনুর অসুধ নিয়মিত চালিয়ে যাবেন। কোন অবস্থাতেই যেন একবেলার অসুধ বাদ না যায়। মনে রাখবেন, তনুর সুস্থতার জন্য আমাদের চাইতে আপনাদের সহযোগী মনোভাব এবং সঠিক সেবা ওর জন্য সবচাইতে বেশি প্রয়োজন।
শাহেদা উঠে দাড়াতে গিয়ে,
: তনুকে কি কয়েকদিনের জন্য আমরা কোথাও বেড়াতে নিয়ে যেতে পারি?
: না, উনি এখনো নতুন কোন কিছু এক্সেপ্ট করার মতো যথেষ্ট সুস্থ নন। প্রয়োজন হলে আমরাই আপনাকে জানাবো। আর হ্যা, ওকে আবার নতুন করে লেখাপড়া শুরু করার বিষয়টা কি আপনারা একটু ভেবে দেখবেন?
: সেটা কি আর সম্ভব হবে বলুন?
: কেন নয়! অসম্ভব বলে তো মনে হচ্ছে না আমার কাছে। আপাতত তাকে আবার আপনি লেখাপড়া করাতে চান, এই বিষয়টা নিয়ে তনুর সাথে বা ঘরে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে দেখন তো কি হয়? আমার মনে হয় লেখাপড়ার বিষয়টা তনুর মধ্যে দারুণ ভাবে পরিবর্তন আনতে পারে। হয়তো সে তার হারানো মনোবল আবার ফিরে পেতে পারে।
ডাক্তারের চেম্বার থেকে বের হয়ে আপা গাড়ি ছেড়ে দিয়ে একটা রিক্সা নেয়। দুজনে রিক্সায় উঠে বসে। আপা তনুর একটা হাত ধরে থাকে।
: তনু, আজ আমরা অনেক সময় নিয়ে রিক্সায় ঘুরে বেড়াবো। বৃষ্টি আসলেও হুড উঠাবো না। ভিজবো।
তনু শাহেদার দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বলে,
: আপা, তোমার বৃষ্টির পানি সহ্য হয় না। জ্বর চলে আসবে। দরকার নেই বৃষ্টিতে ভেজার।
শাহেদা অবাক হয়ে যায়! একথা তনু মনে রেখেছে! সাথে কি চোখে সামান্য পানিও চলে আসে? হবে হয়তো। বয়স হয়েছে। খুব সামান্য কারণেই আমরা অনেক সময় আবেগী হয়ে যাই। শাহেদা নিজের আবেগকে পাত্তা না দিয়ে তনুর দিকে তাকিয়ে,
: আসুক জ্বর। তারপরও আজ আমরা ভিজবো। কিন্তু তুই এসব মনে রেখেছিস!
শাহেদার চোখে মুখে অবাক হওয়ার রেশ তখনো এতোটুকুও কমেনি। সে নিজের মনেই আবার বলতে থাকে,
: সেই যে তোর বিয়ের পর পর তিনদিন টানা বৃষ্টি। প্রথম দিনের ঝুম বৃষ্টিতে সবাই দলবেঁধে ভিজলাম। বৃষ্টিতে ভেজা তোর পছন্দ না। তারপরও তোকে জোর করে ভিজানো হলো। আর সেদিন থেকেই আমিও বৃষ্টির সাথে পাল্লা দিয়ে পাঁচ দিনের জন্য বিছানা নিলাম। তোর সে কি কান্না।
এবার তনু আপার দিকে মুখ ফিরিয়ে,
: মনে থাকবে না কেন আপা? তখনও আমরা আলাদা বাসা নেইনি। তোমার বাসায় থাকি। আর সেবারই বৃষ্টিতে ভিজে তোমার জ্বর আসার কারণে শাহেদ আমার গায়ে প্রথম হাত তোলে। যেন তোমার অসুস্থ হওয়ার জন্য আমিই দায়ী ছিলাম।
বলতে বলতে তনুর চোখে বেয়ে পানি গড়িয়ে পরে। ঠিক এমন সময় কোত্থেকে যেন হঠাৎই দমকা ঝড়ো হাওয়া আসে। তনুর গালবেয়ে গড়িয়ে পরা পানির ফোঁটা বাতাস তার ঝাপটার সাথে উড়িয়ে নিয়ে যায়। আর শাহেদা শক্ত করে তনুর হাত আঁকড়ে ধরে। যেন শাহেদার ঐ শক্ত হাতের বেষ্টনী তনুকে বলতে চায়,
“আমি তোর পাশে আছি। সব সময় তোর সাথে আছি”
স্পর্শের নিজস্ব কিছু ভাষা আছে। সব সময় সব কথা মুখে বলতে হয় না। শুধু দুজনের ঐ স্পর্শের মাঝে কানেক্টিভিটি থাকাটা প্রয়োজন। খুব বেশি প্রয়োজন।
চলবে…….
আফরোজা খানম তন্দ্রা