মায়াবতী
পর্ব:৫২
তানিশা সুলতানা
অথৈ ইতি বেগমকে কিছু বলতে যাবে তার আগেই অর্ণব অথৈয়ের হাত ধরে। ইশারায় থামতে বলে। তন্নির সামনে বলা ঠিক হবে না। ইতি বেগম আঁচলে মুখ লুকিয়ে বেরিয়ে যায় এই বাড়ি থেকে। এখানে সে থাকতে পারবে না। কি জবাব দেবে সবার? জবাব দেওয়ার মুখ আছে তার?
তাছাড়া তারেক তার দিকে মুখ তুলে তাকাচ্ছেও না।
বাইরে থেকে চিৎকার চেঁচামেচির শব্দ ভেসে আসে। চিৎকার করে কাঁদছে। সবাই চমকে ওঠে। তন্নি মাথা উঁচু করে শোনার চেষ্টা করে। আশা বেগম জানালা দিয়ল উঁকি দিয়ে দেখে পাশের বাসার একজন মারা গেছে।
পাশের বাসার একটা মহিলা মারা গেছে। কিডনিতে পাথর হয়েছিলো তার। চিকিৎসার অভাবে সে মারা গেলো। ছোট একটা মেয়ে তার। পাঁচ কি ছয় বছরের হবে৷ ওই বাড়ির কান্না শব্দ অর্ণবদের বাড়িতে আসছে। আশা বেগম আর আর্থি ছুটে চলে যায় দেখতে। তন্নিও দাঁড়িয়ে যায়। তারেক প্রশ্ন করে
“কোথাও যাবে?
” আমি মরা দেখতে যাবো। বলেই হাঁটতে থাকে। অর্ণব আর অথৈ পেছন পেছন যেতে থাকে। মরা বাড়িতে গিয়ে তন্নি মহিলাটির লাশের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। কি সুন্দর ঘুমিয়ে আছে। গলা ওবদি চাদর টেনে দেওয়া তার। চেহারা জ্বল জ্বল করছে। পাশেই তার স্বামী বাবা মা কাঁদছে। বাচ্চাটা খাটিয়া ধরে বসে আছে। তন্নির নিজের ছোট বেলার কথা মনে পড়ে যায়। মায়ের কথা মনে পড়তে থাকে। সেও তো এই বয়সী ছিলো। এভাবেই তার মা চলে গেছিলো তাকে একা করে। এইভাবেই সেই দিন তাদের বাড়িতে ভিড় জমেছে। নানা নানু কাঁদতে-কাঁদতে এসে পড়েছিলো। তারেক তাকে বুকে জড়িয়ে কাঁদছিলো। মাথার চিনচিন ব্যাথাটা বাড়তে থাকে তন্নির। হাত বাড়িয়ে অর্ণবের হাতটা শক্ত করে ধরে “এই লোকটা আবার বিয়ে করবে তাই না অর্ণব? ওই বচ্চাটার সৎ মা আসবে। আমারই মতো তাকে খুব মারবে। তারপর আমারই মতো একদিন সে অসুস্থ হয়ে যাবে।
অর্ণব তন্নির মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।
” বাড়ি চলে মায়াবতী। এখানে থাকতে হবে না।
তন্নি অর্ণবের দিকে তাকায়। তারপর অথৈয়ের দিকে তাকায়।
“ওনার তো বড় অসুখ হয় নি। অনেকেই তো আছে কিডনিতে পাথর হলে চিকিৎসা দিলে ঠিক হয়ে যায়। উনি কেনো হলে না?
অথৈ তন্নিকে এক হাতে জড়িয়ে নিয়ে বলে
” জন্ম মৃত্যু আল্লাহ হাতে। কখন কার মৃত্যু চলে আসবে কেউ বলতে পারে না। যার হায়াত নেই সে শুকনো পথে পড়ে গিয়েও মা*রা যাবে।
তন্নি আর কথা বলে না। আবারও মনোযোগ দিয়ে দেখতে থাকে মহিলাটিকে। আর মনে মনে ভাবতে থাকে “তারও কি হায়াত শেষ? সেও কি পৃথিবীতে বেশিদিন থাকতে পারবে না? অর্ণবকে নিজের করে পাওয়া হবে না? অনি তাতান ওদের নিয়ে সুখের সংসার করা হবে না? অথৈয়ের মুখটা দেখা হবে না? জীবনটা এখানেই শেষ?”
ভাবতে ভাবতে ভয় ঢুকে যায় তন্নির মনে। শরীর ঘেমে যায়। বুক কাঁপতে থাকে। অস্থির হয়ে ওঠে সে। চোখ দুটো মেলে রাখতে পারছে না। তন্নির অবস্থা দেখে অর্ণব ঘাবড়ে যায়। দুই হাতে জড়িয়ে নেয় তন্নিকে। শরীর ঢলে পড়ছে তন্নির। অর্ণব দ্রুত কোলে তুলে নেয় তন্নিকে। অথৈ কেঁদে ফেলে। আর্থি আর আশা বেগম ওদের দেখতে পেয়ে দৌড়ে আসে। তন্নিকে নিয়ে চলে যায়।
অর্ণব তন্নিকে বাড়িতে না নিয়ে সোজা হাসপাতালে নিয়ে যায়। এখনো সেন্স ফেরেনি তন্নির। আশা বেগম গাড়িতে তন্নির হাত পা ডলে দিচ্ছে। অথৈ মাথা হাতিয়ে দিচ্ছে। আর্থি বাতাস দিচ্ছে। এসিতেও তন্নির শরীরের ঘাম জুড়াচ্ছে না।
আশা কাঁদতে কাঁদতে একটাই কথা বলছে
“ওকে কেনো ওই বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিলি?
রিজুয়ান নিজের চেম্বারে বসে তন্নিকে নিয়ে ভাবতেছিলো। তন্নিকে সে চিনে। বহুবছর আগে দেখেছিলো একটা স্কুলে। সেখান থেকেই তার ভালো লেগেছিলো তন্নিকে।
তারপর কাজের সূত্রে তাকে চলে যেতে হয়েছিলো চিটাগং। সেখান থেকে ফিরেছে বছর হলো। তন্নিকে খুঁজেছে সে। কিন্তু পায় নি। এমন একটা সময় তন্নিকে পেলো সে যখন তার বাঁচা মরা দুটোই আল্লাহর হাতে। তারওপর সে বিবাহিত।
রিজুয়ান মুচকি হাসে।
” তোমাকে আমি সুস্থ করবো তন্নি। আমার সবটা দিয়ে হলেও তোমায় আমি ভালো করে তুলবো।
বিরবির করে বলে রিজুয়ান। তখনই একজন ওয়ার্ডবয় এসে বলে
“স্যার তন্নি নামের মেয়েটাকে হাসপাতালে আনা হয়েছে।
কপালে চিন্তার ভাজ পড়ে রিজুয়ানের। সে দ্রুত বেরিয়ে যায় কেবিন থেকে।
তন্নিকে চেকআপ করছে রিজুয়ান। অর্ণব অথৈ আর্থি আশা সবাই বাইরে বসে আছে৷ অর্ণব কেমন পাথরের মতো বসে আছে। দৃষ্টি তার ফ্লোরের দিকে। আশা ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়
অর্ণব ফ্লোরে দৃষ্টি রেখেই শক্ত গলায় বলে
“আমি যদি ভুল কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি তুমি অথৈ আর আর্থিকে নিয়ে বেঁচে থেকো মাম্মা। পাপার খেয়াল রেখো। আমার প্রতি কোনো অভিযোগ রেখো না। আর আমার মায়াবতীর পাশে আমাকে কবর দিও।
আশা ছেলেকে জড়িয়ে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে। অথৈ আর্থি ভাইয়ের দুই পা জড়িয়ে কাঁদতে থাকে। অর্ণব ওদের শান্তনা দেয় না। মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় না। কাঁদেও না। চুপচাপ মাথা নিচু করে থাকে।
_
তন্নিকে স্যালাইন দেওয়া হয়েছে। রিজুয়ান পাশেই বসে আছে। নার্স চলে গেছে। এক্সট্রা একটা কেবিনে রাখা হয়েছে তন্নিকে।
যখন তখন সেন্স ফিরে আসবে তন্নির। রিজুয়ান দেখছে তন্নিকে। সে তার মাকেও কল করেছে। একটু পরে সে আসবে তন্নিকে দেখতে।
মা রিজুয়ানের বেস্টফ্রেন্ড। প্রথম থেকেই তন্নির কথা মাকে বলতো সে। তার মায়ের তন্নিকে দেখার খুব শখ।
তন্নি পিটপিট করে চোখ খুলে। মাথার ওপর সাদা দেয়াল দেখে বুঝতে পারে এটা হাসপাতাল।
তন্নি আশেপাশে তাকায়। রিজুয়ানকে দেখে আলতো হাসার চেষ্টা করে। রিজুয়ানও হাসে।
” এখন কেমন লাগছে?
তন্নি জবাব দেয়। খানিকটা সময় নিয়ে রিজুয়ানকে দেখে। তারপর বলে
“আমাকে বাঁচিয়ে দিন না প্লিজ। আমি মৃত্যুকে ভীষণ ভয় পাই৷ আমি বাঁচতে চাই৷ আমার অর্ণবের সাথে কিছুদিন থাকতে চাই।
রিজুয়ান তন্নির মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।
” তোমার কিচ্ছু হয় নি। একদম ঠিক আছো তুমি। ওই জাস্ট একটু মাথায় পবলেম হইছে। কিছুদিন পরে এটা ঠিক হয়ে যাবে।
এতো ভেঙে পড়েছে কেনো তুমি? বোকা মেয়ে
তন্নি হাসতে গিয়েও হাসে না।
“তাহলে অর্ণব আর অথৈ কাঁদছে কেনো?
রিজুয়ান দীর্ঘ শ্বাস ফেলে
” ভীষণ ভালোবাসে তো তেমায়। তাই তোমার অসুস্থতা মেনে নিতে পারছে না।
তন্নি আর কিছু বলে না। মনকে বোঝাতে থাকে। রিজুয়ান তন্নির স্যালাইন দেখে বেরিয়ে যায়।
অর্ণবের সামনে দাঁড়িয়ে কড়া গলায় বলে
“তন্নি অসুস্থ। একজন পেশেন্ট মনের জোর পায় তার পরিবারের থেকে। কিন্তু আপনারা? অলওয়েজ তার মনোবল দুর্বল করে দিচ্ছেন। সে ভয় পাচ্ছে। ইমোশন লুকাতে না পারলে তন্নিকে রেখে আপনারা চলে যায়।
অর্ণব দাঁড়িয়ে যায়।
” মায়াবতী ঠিক আছে?
“তাকে ঠিক থাকতে দিচ্ছেন আপনারা? মরা কান্না জুড়ে দিয়েছেন। আপনারা বাসায় গিয়ে কাঁদুন দয়া করে।
বলেই রিজুয়ান চলে যায়। অর্ণব তন্নির কেবিনের দিকে যায়। অথৈ চোখের পানি মুছে নেয়। তন্নির সামনে একদম কাঁদা যাবে না। কিছুতেই না।
চলবে