#WriterঃMousumi_Akter
চারদিক নিকষ কালো অন্ধকার। কিছুই দেখা যাচ্ছেনা।প্রান্তিক গুদাম ঘরের সামনে এগিয়ে গেল।দরজায় দাঁড়িয়ে আছে চারজন। তাদের হাতে লাঠি। প্রান্তিকের চোখ দুটো লাল টকটকে হয়ে আছে। মানুষের মাথায় খু’ন চড়লে নাকি হুঁশ থাকেনা।প্রান্তিকের চোখের দিকে তাকালে মনে হচ্ছে নেশায় আসক্ত। কিন্তু এই নেশা খু* নে*র নেশা। রজনি রজনিগন্ধ্যার বাগান দিয়ে বসে বসে অনেক কষ্টে এসেছে।রজনির মন বলছে এদিকে কিছু একটা আছে। অজানা কিছু সে জানতে চলেছে।রজনির কৌতুহলি মনের মাঝে হাতুড়ির বাড়ির মত শব্দ হচ্ছে বারবার।প্রান্তিকের চোখে যেন সে ধরা না পড়ে যায়। প্রান্তিক তেজস্রী মুখে পাহারাদার দের বলল, ” দরজা খোলো। “
পাহারাদাররা দরজা খুলল।
প্রান্তিক পিস্তল এর দিকে তাকিয়ে বলল, ” কবর খোড়ো তোমরা চারজন। ওর কবর আমার ফুল বাগানেই দিবো।”
একজন দাঁড়িওয়ালা মানুষ বলল, ” সত্যি কি ওকে মে’রে ফেলবেন। আর একবার ভাবা যায়না।”
“আমার ভাবা শে’ষ।”
“আপনি আমাকে মে’ রে ফেলুন। আমার ক’ব’৷ র আমি খুড়ছি।আমাকে কবর দিন। ওর মৃ’ ত্যু আমি সহ্য করতে পারব না।” বলেই লোকটা হুঁ হুঁ করে কেদে দিল।
প্রান্তিক লোকটার মাথায় পিস্তল ধরে বলল, ” এত মায়া ওর জন্য তোমার ফারুক চাচা।এত মায়া। তাহলে যাও আমার ক’ব’র খোড়ো।”
“না আমি তাও পারব না বাবা।”
“আজ তোমাকে ক’ব’র খুড়তেই হবে।হয় ওর ক’ব’র হবে নাহলে আমার।আজ যদি ওকে আমি মা’র’তে না পারি নিজেকে শেষ করে দিবো।”
ফারুক প্রান্তিকের পা জড়িয়ে ধরে বলল, ” বাবা আপনারা দু’জনে একসাথে থাকলে মানুষ কাঁপে।আপনাদের দু’জন কেই আমি ভালবাসি।আপনারা একজন আরেকজন ছাড়া অপূর্ণ। দু’জনকেই বাঁচতে হবে। আমি চাই আপনি আর একটিবার ওকে ক্ষমা করে দিন।”
“এত কিছুর পরেও ফারুক চাচা। প্রান্তিক চৌধুরীকে আপনি চিনেন না? চিনেও এমন আবদার করা বিলাসিতা চাচা।”
“আপনি ওকে এ শহর ছেড়ে তাড়িয়ে দিন।তবুও ওর প্রাণ ভিক্ষা দিন। ও যা করেছে তা ক্ষমার অযোগ্য অন্যায়।তবুও কেনো যেন ওর প্রতি ভীষণ মায়া কাজ করে বাবা।ওর জন্য ভীষণ কষ্ট হচ্ছে আমার। ও বেঈমানি করেছিল মানসিক যন্ত্রণায়।এইখানে ওর কোনো দোষ নেই।”
প্রান্তিক গর্জে উঠে বলল, ” চাচা আর একবার ওর হয়ে কথা বললে আপনাকে আমি ছাড়ব না।”
” আপনার বোন সামান্য কষ্ট পেয়েছে বলে আপনি ওকে মে’ রে ফেলবেন। তাহলে ওর বোন তো দুনিয়ায় নেই। ও একজনের ভাই। ওর কি ইচ্ছা করবেনা প্রতিশোধ নিতে।”
প্রান্তিক রক্তচক্ষু নিয়ে ফারুকের দিকে তাকাল। গুদাম ঘরে টর্চ লাইট জ্বালিয়ে প্রবেশ করল। প্রান্তিক ভেতরে প্রবেশ করার সময় ওদের ইশারা দিল।ওরাও ভেতরে প্রবেশ করল ফারুক বাদে। ফারুক বাইরে বসে কাদছে। রজনি অবাক হয়ে ওদের কথা শুনছিল।রজনির মন ডেকে বলছে ভেতরে শ্রাবণ আছে। আরেক মন বলছে না শ্রাবন হবে কীভাবে? রজনি আরো খানিক টা হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে এল। দরজার বাইরে থেকে উঁকি দিয়ে চমকে উঠল। চেয়ারে হাত, পা বাঁধা র*ক্তা*ক্ত অবস্থায় পড়ে আছে শ্রাবণ। ফর্সা, সুন্দর চেহারাটা ক্ষত-বিক্ষত হয়ে গিয়েছে আঘাতে আঘাতে। প্রান্তিক ক্রামগত শ্রাবণ কে আঘাত করছে আর বলছে, ” আজ-ই তোর জীবনের শেষ দিন শ্রাবণ। যদি কিছু চাওয়ার থাকে শেষ চাওয়া চেয়ে নে।”
শ্রাবণ কোনও রকম মুখ তুলল।বাদামি চোখ দু’টোতে করুণ আর্তনাদ ভরা। চোখ দিয়ে দু’ফোঁটা অশ্রু ছেড়ে বলল,
” আমাকে মে’ রে ফেলুন ভাই! আমার জন্য মৃ’ত্যু ই উপযুক্ত শাস্তি। কিন্তু মা-রা-র আগে আমাকে একটা সত্য বলে যেতে দিন। একবার অন্তত প্রিয়তার সামনে গিয়ে বলতে দিন, ‘ আমি প্রিয়তাকে ভালবাসি ভাই। ভীষণ ভালবাসি। ‘
“তুই আমার বোনকে ভালবাসিস?আর একবার যদি এই কথা উচ্চারণ করিস তোর জিহবা আমি টেনে ছি- ড়ে ফেলব শ্রাবণ।তুই আমার বোনকে কোনদিন ই ভালবাসিস নি ।নিজের মত ইউজ করেছিস। হাউ ডেয়ার ইউ শ্রাবণ। তুই প্রান্তিক চৌধুরীর বোনকে ইউজ করিস।”
শ্রাবণের চোখ দু’টো অশ্রুসিক্ত। অনুশোচনা আর অপরাধবোধ তাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে।মুখভরা মায়া।এই সুন্দর চেহারায় মলিনতা বড়ই কষ্টদায়ক ব্যাপার।বেদনায় জর্জরিত কন্ঠে তীব্র যন্ত্রণা নিয়ে শ্রাবণ বলল,
“আমি অভিনয় করতে করতে ক্লান্ত হয়ে কখন ওকে ভালবেসেছি বুঝতে পারিনি ভাই। আমার উদ্দেশ্য ছিল অভিনয় করা কিন্তু আমি অভিনয় করতে পারিনি। আমার ভালবাসা সত্য ছিল ভাই।আমাকে মৃ’ত্যু দন্ড দেওয়ার আগে একবার ওর কাছে ক্ষমা চাইতে দিন। ওর কাছে ক্ষমা চাওয়া ছাড়া মৃ’ত্যু আমাকে দিবেন না ভাই।আপনার পায়ে ধরি। একজন মৃত্যু পথযাত্রী মানুষের শেষ আকুতি আপনি মঞ্জুর করুণ।এই পৃথিবীতে আমার কেউ নেই। ওর ওই মুখটায় আমাকে শান্তি দিত। আমার প্রতিহিংসায় ভরা চেহারা বারবার শান্ত হয়ে যেত ওর মুখ দেখলে।”
শ্রাবণের কথাগুলো হৃদয়স্পর্শ কাতর। এত করুণ আকুতি একজন মৃত্যু পথযাত্রী প্রেমিকের ইতিহাসে হয়ত নেই।
রা’গে প্রান্তিকের সমস্ত শরীর রি রি করে জ্বলছে। কেনো জ্বলছে সে জানেনা।অস্বস্তি হচ্ছে প্রান্তিকের।শ্রাবণের চেয়ারে একটা লা-থি মে’ রে পিস্তল শ্রাবণের মাথায় ধরে বলল, ” বেঈমানের কোনো জায়গা নেই আমার কাছে। তুই আমার হৃদয় টা ক্ষত-বিক্ষত করে দিয়েছিস। আমার ভাই ছিলি তুই।আপন ভাই। ভাই মানে বুঝিস তুই। অন্তকে আমি কখনো অতটা আপণ মনে করিনি।আমার ভেতর বাহির সব তুই জানতি। সব জেনে বুঝে কীভাবে পারলি আমার এত ক্ষতি করতে। তুই আমার সব তথ্য আমার শ*ত্রু*দের দিয়েছিস,আমার ব্যবসায়ের ক্ষতি করেছিস,আমাকে খু*ন করার প্লান করেছিস কতবার।কিন্তু সফল হতে পারিস নি।তোকে হৃদয় দিয়ে আগলে রাখার যোগ্য উপহার কি এগুলো ছিলো শ্রাবণ।”
“আমি জানি আপনি বিশ্বাস করবেন না আমাকে। শেষ বারের মত আপনাকে বলছি, আপনার সাথে মিশে মিশে যে মায়া আমার তৈরি হয়েছিল ভাই সেই মায়া আপনার ক্ষতি করতে গিয়েও আবার আমাকে আটকে দিয়েছে।যখনি বোনের মৃত মুখটা ভেষে ওঠে আমি হন্য হয়ে যায় আবার যখনি আপনার মুখটা দেখি আমি হারিয়ে যায়। এভাবে আমি ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছিলাম ভাই। একবার প্রতিশোধের চিন্তা একবার ভালবাসার চিন্তা এই দু’য়ের মাঝে আমি পা’গ’ল হয়ে যাচ্ছিলাম। আমি চাইলে তো আপনাকে বি’ষ দিতে পারতাম আর আপনিও খে*য়ে নিতেন চোখবুজে।মেব রে ফেলতে চাইলে তো কত উপায় ছিল কিন্তু আমি পারিনি ভাই।”
প্রান্তিক চোয়াল শক্ত করে বলল, ” তোকে আমি খু*ন করতে পারছিনা ক্যানো শ্রাবণ। আজ যদি আমি তোকে খু*ন করতে না পারি তাহলে নিজেকে খু*ন করে ফেলব। তোর মত বেঈমানের জন্য আমার হাত কেনো কাঁপছে। বন্ধুত্ব কি? ভাই কি? তুই কিভাবে বুঝবি? তুই তো প্রমান করে দিলি মানুষ কাছে আসে ধোঁকা দেওয়ার জন্য। আমি তোর সব অন্যায় ক্ষমা করে দিতাম কিন্তু তুই আমার রজনিগন্ধ্যার দিকে কেনো খারাপ দৃষ্টি দিতে গেলি? এই একটা অন্যায় আমি কোনদিন ক্ষমা করতে পারবনা।কোনদিন না। তুই জানিস না ও আমার প্রাণভোমরা। আমার প্রাণের চেয়েও বেশী প্রিয়।আমার রজনিগন্ধ্যার দিকে যে তাকাবে সে আমার যত আপণজন ই হোক আমি পু* তে ফেলব।রজনি আমার ভালবাসা,আমার জীবন,আমার সুখ,আমার শান্তি।”
হঠাৎ রফিক রজনি কে দেখে বলল, “কে ওখানে?”
রজনি রফিকের পা জড়িয়ে ধরে কেদে বলল, “প্লিজ চাচা আমার কথা উনাকে বলবেন না।আপনার পায়ে ধরি। আমাকে সত্যটা বলুন।এখানে কি হচ্ছে।উনি কেনো শ্রাবণ ভাইয়াকে এভাবে আঁটকে রেখেছেন।”
“একমাত্র তুমিই হয়ত পারবে প্রান্তিক বাবাকে শান্ত করতে।”
“কিন্তু কি হয়েছে চাচা।”
শোনো তাহলে। সে অনেক বছর আগের ঘটনা। জাহাঙ্গীর নগর ইউনিভার্সিটিতে পড়ত প্রান্তিক বাবা।ভার্সিটির নেতা ছিল বাবা। শ্রাবণ অনেক জুনিয়র ছিল প্রান্তিক বাবার। প্রান্তিক বাবার দলে কাজ করত। শ্রাবণের সাথে একদিন প্রান্তিক ওর বাড়িতে যায়। ওই বাড়িতে শ্রাবণের বোনের সাথে প্রান্তিকের দেখা হয়।শ্রাবণের বোন ও জাহাঙ্গীর নগরেই পড়ত। ওখান থেকেই প্রান্তিকের সাথে একটা বন্ধুত্ব হয়। শ্রাবণের বোন প্রান্তিক কে ভীষণ পছন্দ করত।প্রান্তিকের জন্য পা-গ-ল হয়ে যায়। কিন্তু প্রান্তিক পাত্তা দিতনা। একদিন কোনো একটা কারণে প্রান্তিক শ্রাবনের বোনকে ডাকে। কি বলতে ডাকে শ্রাবণ তা জানত না। ওইদিন ই শ্রাবণের বোন ধ-র্ষ_ন হয় আর সে সুইসাইড করে মা*রা যায়৷ বোন ছাড়া দুনিয়াতে আর কেউ ছিল না শ্রাবনের। বোনের মৃত্যুর জন্য প্রান্তিক কে সন্দেহ করে শ্রাবণ।একদম পা*গ*ল হয়ে যায়। শ্রাবণ বোন কে হারিয়ে একা হয়ে যায়৷ বোন ছাড়া একা জীবন চলতে পারছিলনা।ভার্সিটি টপার ছাত্র লেখাপড়া বাদ দিয়ে দিল।প্রান্তিক শ্রাবণের ওই ভয়াবহ অবস্থা দেখে ওকে ভাল রাখতে নিজের বাড়িতে নিয়ে আসে।বোনের মৃ*ত মুখ শ্রাবণের মস্তিষ্কে অন্য এক শ্রাবনের সৃষ্টি করে। ও ধীরে ধীরে ড্রাগে আসক্ত হয়। ওর উদ্দেশ্য থাকে প্রান্তিক কে সেই একই কষ্ট দেওয়া।প্রান্তিকের বোনের সাথে ভালবাসার অভিনয় করে ক্ষতি করা। প্রান্তিকের ক্ষতি করা, প্রান্তিকের ভালবাসার মানুষের ক্ষতি করা। কিন্তু ও চেয়েও পারেনি। ওর উদ্দেশ্য অসৎ ছিল কিন্তু প্রান্তিক এবং প্রিয়তা দুজনকেই ভালবেসে ফেলে।ওদের মায়ায় আঁটকে যায়। বারবার চেয়েও ও কিছু করতে পারেনি।ড্রাগ নিলেই প্রতিশোধ এর জন্য পা* গ* ল হয়ে যেত। আবার প্রান্তিকের ভালবাসা দেখে থেমে যেত।আফসোসের বিষয় প্রান্তিক যখন শ্রাবণের সব ধরে ফেলল তখন শ্রাবণ জানল প্রান্তিক ওর বোনের মৃ*ত্যু*র জন্য দায়ী ছিলনা।এখন ওরা দুজন স্রোতের বিপরিতে চলে গিয়েছে।প্রান্তিক কোনদিন ক্ষমা করবেনা শ্রাবণ কে।”
রজনি রফিকের কথা শুনে কাদছে।উঁকি মেরে দেখল প্রান্তিক রা-গে কাঁপছে। নিজের মাঝে নেই। এই মুহুর্তে একটা অ-ঘটন ঘটবেই। রজনির চোখ দিয়ে ক্রামাগত পানি পড়ছে। প্রান্তিক এত রাগি -জেদি হয়েও শ্রাবণের এত বেঈমানি জানার পরেও শ্রাবণের প্রতি ভালবাসার কমতি নেই। শ্রাবণ আর প্রান্তিকের ভালবাসা আসলেই খাটি ছিল।শ্রাবণ প্রান্তিকের ক্ষতি চেয়েও ভালবাসার কাছে হেরে গিয়ে কিছু করতে পারেনি।এই পৃথিবীতে সব থেকে বেশী অসহায় মানুষ টা শ্রাবণ।যে ঘৃণা আর ভালবাসার মাঝখানে অবস্থান করছে।
চলবে?…