আমার স্ত্রীকে পরপুরুষের সাথে আবাসিক হোটেলের পাওয়া গেছে। অনৈতিক কাজ করতে গিয়েছিল সেখানে। আমি গেলে ওঁদের ছেড়ে দিবে। মিনিট দুয়েক আগে একজন অচেনা ভদ্রলোক কল দিয়ে কথাগুলো জানালেন আমাকে। বিরক্ত হয়ে কলটা কেটে দিলাম। পিয়াসী এমন মেয়েই নয়। আমি সম্পূর্ণ বিশ্বাস করি ওঁকে। তাছাড়া পিয়াসী বাড়ি থেকে খুব একটা বের হয় না। বাড়িতে মা, ছোটবোন, বাবা সবাই থাকে। ওঁরা বেশ নজরে রাখে পিয়াসীকে। তাই আর এসব কথায় কান দিলাম না। অফিস ছুটি হয়েছে অনেকক্ষণ হলো, বাড়ি ফিরতে হবে।
সবে চার মাস বিয়ে হয়েছে আমার। নতুন বউ রেখে অফিস যেতে একটুও ভালো লাগে না। তবুও কি আর করার! বাড়ি ফেরার পথে বউয়ের জন্য দুইটা বেলি ফুলের মালা কিনলাম। হয়তো খুব খুশি হয়ে মেয়েটা। বেলি ফুলের মালাটা পকেটে রাখতে গিয়ে মনে পড়লো, বউ শিউলি ফুল খুব পছন্দ করে। তবে কোনো দোকানে শিউলি ফুল পেলাম না। এক প্রকার বাধ্য হয়েই বেলি ফুল নিয়ে বাড়ি ফিরতে হলো। পিয়াসীর সাথে সময় কাটাতে না পারলে আজ-কাল কিছুই ভালো লাগে না আমার।
বাড়ি ফিরতেই পিয়াসী ঠান্ডা এক গ্লাস শরবত নিয়ে আমাদের ঘরে এলো, টেবিলের উপর গ্লাসটা রাখতে রাখতে বললো, ” অনেক কষ্ট হয়েছে না তোমার? সারাদিন এতো কাজ করলে বাড়িতে ফিরে বড্ড ক্লান্ত লাগে। নাও এই শরবত টুকু খেয়ে নাও জলদি। “
–” সে না হয় আমি শরবত খেয়ে নিলাম। কিন্তু মহা রাণীর কি আমার সাথে দুদণ্ড সময় কাটানোর ইচ্ছে আছে নাকি আবার রান্নাঘরে পাখির মতো উড়াল দিবে? “
–” তুমি যে কি বলো না। জানো এখনও কত রান্না বাকি? সবকিছু সময় মতো শেষ না করলে মা বাবা বোন কি খাবে রাতে?”
পিয়াসীকে পিছন দিয়ে জড়িয়ে ধরলাম। মেয়েটা আমার কাছে আসলেই পালাই পালাই করে, কিন্তু কেন যে বোঝে না আমাকে! পারলে আমি ২৪ ঘন্টাই ওর সাথে থাকতাম।
–” আরে কি করছো তুমি? কেউ দেখে ফেললে কি হবে শুনি? আমি গেলাম, কাজ আছে আমার। “
পিয়াসী রান্নাঘরে চলে গেলো। আমি শরবতের গ্লাসে চুমুক দিলাম। মেয়েটার রান্নার হাতটা যা না। একদম অমৃত লাগে সবকিছু।
রাতের খাওয়া শেষ পিয়াসী ঘরে আসলে ও-র হাতে বেলি ফুলের মালাগুলো ওর হাতে দিলাম। মন ভুলানো হাসি দিয়ে মালাগুলো হাতে নিলো মেয়েটা। এই হাসির থেকে বড় প্রাপ্তি হয়তো আর কিছুই হতে পারে। বউটাকে বড্ড ভালোবেসে ফেলেছি।
–” আমি চুলে খোঁপা করি। তুমি নিজের হাতে পরিয়ে দাও। “
পিয়াসীর খোঁপায় মালা পরিয়ে দিতে গিয়ে লক্ষ্য করলাম, ওর ঘাড়ে একটা কাটা দাগ। কেউ হয়তো ইচ্ছে করে এমনটা করেছে। আমার নামের প্রথম অক্ষরের মতো অনেকটা।
–” পিয়াসী তোমার গলায় এই কাটা দাগটা কিসের?”
–” কি জানি, বলতে পারবো না আমি। হয়তো ছোট বেলায় কেটে গিয়েছিল। ঠিক মনে নেই। “
আমার সারা শরীর ঘামে ভিজে যাচ্ছে। আমি যেমনটা ভাবছি তেমনটা জানি কখনোই না হয়। পিয়াসীকে ছেড়ে বাথরুমের দিকে হাঁটা দিলাম। চোখেমুখে পানি ছড়িয়ে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করছি। একটু স্বাভাবিক হয়ে ঘরে ফিরে এলাম।
পিয়াসী তখন শুয়ে পড়েছে। ওর কোমর সমান চুল সারা বিছানা ছুড়ে ছড়িয়ে আছে। অদ্ভুত মায়া সারা মুখে। যে কোনো পুরুষই এই মায়াতে আকৃষ্ট হয়ে যাবে।
এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি ও-র দিকে। কয়েক মুহুর্ত পরে পিয়াসীর মুখটা ঝাপসা হয়ে এলো, চোখের সমানে ভেসে উঠলো বারো বছর আগের কাহিনী।
” সন্ধ্যায় দিকে সবুজ আর আমি রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছি। এই পথ দিয়েই তেরো বছর বয়সী এক কিশোরী বাড়িতে ফিরবে। স্বভাবে এখনও বাচ্চামি রয়ে গেলেও আজকাল মেয়েটার শরীরটা বেশ সুন্দর হয়ে উঠেছে। যেন সদ্য প্রস্ফুটিত গোলাপ। এমন শরীরের লোভ পাড়ার বখাটে ছেলেদের বহুকাল ধরেই।
সবুজ হাতে কয়েকটা আইসক্রিম নিয়ে এসে বললো, ” দোস্ত মেয়েগুলো দিয়ে আয় তো। আর এইটা আমাদের শিকারকে দিবি। আমি ঘুমের ঔষধ মিশিয়ে দিয়েছে এতে৷ তবে সাথে সাথে ঔষধ কাজ করবে না। “
সবুজের থেকে আইসক্রিম নিয়ে মেয়েগুলো কাছে গেলাম। ওরা তখন নিজেদের পৃথিবীতে মত্ত হয়ে আছে।
–” এই যে বনুরা, কেমন আছো তোমরা?”
আমার কথায় হয়তো ওঁরা বিরক্ত হলো, পিছন ফিরে একসাথে বলে উঠলো, ” কে তুমি? দেখছো না আমরা খেলা করছি। “
–” আমি তোমাদের বড় ভাইয়া। দেখো তোমাদের জন্য আইসক্রিম নিয়ে এসেছি। “
আমাদের শিকারটা বড্ড চালাক। হুট করে বলে ফেললো, ” তোমাকে তো চিনি না। আর অচেনা লোকের থেকে কোনো খাবার খেতে নেই। আমরা কেউ আইসক্রিম খাবো না। “
অন্যরা অসন্তুষ্ট হলেও ওর কথায় সায় দিলো। ন্যাকা কান্না ভাব ধরে বললাম, “আসলে আমারও না তোমাদের মতো ছোট একটা বোন ছিলো। কয়েকদিন আগে গাড়ির নিচে চাপা পড়েছে, এখন সে আকাশে চলে গেছে আমাকে রেখে। বোন ছাড়া কেউ ছিলো না আমার। তোমরাও তো আমার বোনের মতো তাই এগুলো নিয়ে এলাম। থাক তোমরা নিতে না চাইলে এসব নিতে হবে না। “
এরপর সকলেই একে একে আইসক্রিমগুলোকে নিয়ে নিলো। মুচকি হেসে মনে মনে বললাম, ” বইয়ের বিদ্যায় কি আর চালাক হওয়া যায়!”
আপাতত এখানের কাজ শেষ। তুড়ি বাজাতে বাজতে নিজের জায়গায় ফিরে এলাম। সবুজ উত্তেজিত হয়ে প্রশ্ন করলো, ” কি রে মামা কাজ হয়েছে তো?”
শয়তানী হাসি দিয়ে বললাম, ” কোন কাজটা হয় না আমাকে দিয়ে?”
সবুজের চোখে মুখে হাসির ছাপ ফুটে উঠলো। সন্ধ্যে তখনও নামেনি ধরণীর বুকে। চারিদিকে শেষ বিকালে আলো ছড়িয়ে আছে। কিশোরী মেয়েটা নিজের বাড়ির পথ ধরেছে। কাছাকাছি আসতেই সবুজ গিয়ে ওকে বাঁধা দিলো।
–” একি তুমি আজ এতো সকাল সকাল বাড়িতে ফিরে যাচ্ছো যে? তোমাদের খেলা শেষ?”
সবুজকে আগে থেকেই চিনতো মেয়েটা। ওঁদের বাড়ির পাশেই বাড়ি।
–” সবুজ ভাইয়া মাথাটা খুব ব্যাথা করছে, বড্ড ঘুম পাচ্ছে গো। তাই চলে এসেছি। “
–” কেন শরীর খারাপ নাকি? দেখি তোমার জ্বর এসেছে কিনা।”
সবুজ মেয়েটার কপালে হাত চেপে ধরে, ঠোঁটে কোণে বিশ্রী একটা হাসি খেলা করছে ওর। মেয়েটা মিনিট পাঁচেক ও দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না। সবুজের হাতের উপর ঢলে পড়ে গেলো।
–” যা কড়া ঔষুধ মিশিয়েছি না মামা। কাজ হতেই হবে। “
প্রতিত্তোরে আমার চোখে মুখে এক বিশ্রী হাসিতে ভরে গেলো। পাঁজা কোলা করে পাশের পোড়া বাড়িতে নিয়ে গেলাম মেয়েটাকে। ক্ষুদার্থ পিশাচের মতো শরীরের প্রতিটা ভাঁজের স্বাদ নিতে লাগলাম দুই বন্ধু মিলে। কড়া ঘুমের ঔষধের ফলে মেয়েটা চোখ খুলতে পারেনি, তবে সবকিছু অনুভব করেছে। ব্যাথায় চিৎকার করেছে, গোঙ্গানির শব্দে চারিপাশ মুখরিত হয়েছে।
সবশেষে পকেট থেকে একটা ধারালো ব্লেড বের করলাম। সবুজ চমকে বলে উঠলো, ” তুই কি ওঁকে মেরে ফেলতে চাইছিস? দেখ ভুলেও একাজ করিস না। “
হেসে বললাম, ” আরে না পাগলা! চিহ্ন দিয়ে দিবো, এ মেয়ে শুধুই আমার। “
বলতে বলতে মেয়েটার ঘাড়ে একটা পোঁচ দিলাম। নিজের নামের প্রথম অক্ষরের মতো। সাদা চামড়া কেটে গিয়ে রক্তে ভরে গেলো জায়গাটা ।
–” এতো রক্ত কেন রে এর? কি খায় রে?”
সবুজ বিরক্ত হয়ে বললো, ” তুই দিলি ঝামেলা করে। “
পাশের ঝোপ থেকে কিছু পাতা এনে কাটা জায়গায় লাগিয়ে দিয়ে বললাম, ” যা গোসল করে এসে তোর কাজ কর। “
সবুজ মেয়েটাকে কোলে করে ওঁদের বাড়িতে নিয়ে গেলো। গিয়েই ন্যাকা কান্না শুরু করে দিলো।
–” দেখেন চাচি বোনের কি দশা হয়েছে। “
মেয়েটার মা বাবা আৎকে উঠে ছিলো তাদের মেয়ের এমন দশা দেখে। মেয়ের বাবার চোখে মুখে ভয়। নতুন এলাকায় কাজে এসেছে, সৎ লোক তিনি। মুখের উপর সত্যি কথা বলতে ভয় করেন না। সেদিনও মাস্তান মন্টুর মুখের উপর বলে এসেছে,” যে জমি তোমার নয় সে-ই জমির কাগজ আমি তোমাকে দিতে পারবো না। দরকার হলে ভূমি অফিসের চাকরি ছেড়ে দিবো। “
সে-ই সাহসী লোকটাকে আজ বড্ড ভিতু লাগছে। তার শত্রুদের তিনি ভয় করেন না ঠিকই। কিন্তু মেয়েকে নিয়ে বড্ড ভয় তার। একটাই মেয়ে তাদের। বিয়ের পনেরো বছর পরে বাবা হয়েছে লোকটা। এ সাতরাজার ধন সে হারাতে চায় না। এই ভয়েই সাতদিন পর লোকটা এলাকা ছাড়ে। থানা পুলিশ করেনি ভয়ে কারণে।
আমি অবশ্য এসব চোখে দেখিনি। সবুজের থেকেই বর্ণনা শুনেছি। লোকটা কাপুরুষতা দেখে সেদিন যেমন হেসেছি, তেমন খুশিও হয়েছিলাম। কোনো ঝামেলায় পড়তে হয়নি আমার। “
অতীতের স্মৃতি থেকে বেরিয়ে এলাম। পিসায়ী ঘুমিয়ে পড়ছে। কিন্তু আমি কিছুতেই শান্ত হতে পারছি না। পিয়াসী ঘাড়ে ঠিক তেমন কাটা দাগ। না না আমি কোনো ভুল করছি না, এটাই সে-ই পিয়াসী। মাথা কাজ করছে না। উপায় না পেয়ে সবুজকে কল দিলাম। ছেলেটার সাথে আজও সম্পর্ক রেখেছি।
কয়েকবার রিং হওয়ার পর কলটা রিসিভ করলো।
–” কি হলো রে? এতো রাতে বউ রেখে আমাকে কল দেওয়ার কারণ?”
–” কারণ ছাড়া তোকে কল করিনি ভাই। ওই মেয়েটার নাম কি ছিলো?”
–” কোন মেয়েটা?”
–” আরে ওই বরিশালের বাচ্চা মেয়েটা। পোড়াবাড়ি! “
–” কার কথা বলছিস বুঝতে পারছি না, ম্যাসেজ দিয়ে সবটা খুলে বল। আমার কথা বলার সময় নেই। বউ জেগে আছে, ডাকছে আমাকে। “
সবুজ কলটা কেটে দিলো। কাজের সময় ছেলেটাকে পাওয়া যায় না। দুই হাত দিয়ে মাথা চেপে ধরে মেঝেতে বসে পড়লাম। হঠাৎ খেয়াল এলো বিকেলের অচেনা লোকটার কথা! বউকে আবাসিক হোটেলে পাওয়া গেছিলো। কে আমার সাথে এমন মজা করলো নাকি সত্যি!
চলবে
সূচনা পর্ব
আবছা আলোয় তুমি
কলমে : #ফারহানা_কবীর_মানাল
#আবছা_আলোয়_তুমি
পার্ট -২
কলমে : #ফারহানা_কবীর_মানাল
বউকে আবাসিক হোটেলে পাওয়া গেছিলো। কে আমার সাথে এমন মজা করলো নাকি সত্যি!
আর কিছু ভাবতে পারছি না। পিয়াসী গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। মেয়েটার মুখের দিকে তাকলে কেমন অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে। এ অনুভূতি বলে বোঝাতে পারবো না। চোখের সামনে ভেসে উঠছে সবুজ ওঁকে কিভাবে স্পর্শ করেছিলো। আজ যদি অন্য কোন পুরুষ ওর গায়ে হাত দিতে যায়, তাকে খু’ন করতেও আমি পিছপা হব না। কিন্তু সেদিন সবুজের প্রতিটা স্পর্শে আমিও মজা পেয়েছিলাম। পৈশাচিক আনন্দ হয়েছিলো আমার।
আবারও বাথরুমে গিয়ে হাত মুখ ধূয়ে এলাম। মোবাইল হাতে নিয়ে সে-ই অচেনা নম্বরে কল দিলাম। নম্বরটা বন্ধ! এ কোন মায়াজালে আবব্ধ হলাম আমি। কি করা উচিত আমার! সবুজকে ম্যাসেজ দিয়ে সবকিছু বলে রাখলাম। শুধু এটা জানালাম না যে পিয়াসীর ঘাড়ে আমি দাগটা দেখতে পেয়েছি। এ ব্যাপারে সবুজকে কিছু জানাতে চাই না আমি।
অনেক রাত পর্যন্ত ঘুমাতে পারিনি। সকালে পরিচিত কন্ঠের ডাকে ঘুম ভাঙলো। গত চারমাস ধরে পিয়াসী আমাকে প্রতিদিন ঘুম থেকে ডেকে দেয়। ঘুম থেকে উঠে ওর হাসি মাখা মুখটা না দেখলে সেদিন কিছুই ভালো লাগে না আমার।
কত সুন্দর করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে পিয়াসী, আমিও এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি ওর দিকে।
–” কি দেখছেন এতো? উঠবেন না? অফিসে দেরি হয়ে যাবে তো। “
–” হুম উঠবো, অনেক বেলা হয়ে গেছে তাই না?”
–” হ্যাঁ, প্রায় নয়টা বেজে গেছে। আজ আপনি নিশ্চয়ই বসের বকা শুনবেন। হি হি।”
পিয়াসী হাসলে কত সুন্দর লাগে ওঁকে, একদম নিস্পাপ দেখতে লাগে। কারো হাসিতে কি এতো মায়া থাকতে পারে? পিয়াসী দেখতে অপরূপা সুন্দরী। তাঁর রূপের বর্ননা আমি দিতে পারবো না, তবে আমার চোখে সদ্য ফোঁটা গোলাপও ওর রূপের কাছে হার মানবে। বিছানা ছাড়তে ছাড়তে বললাম, ” বসও নতুন বিয়ে করেছে, নিজেই দেরি করে আসে। “
পিয়াসী হাসতে হাসতে বিছানা গোছাতে লাগলো। আমি ফ্রেশ হতে চলে গেলাম।
।
বেলা এগারোটা বাজে। অফিসে বসে সবুজের এসএমএস চেক করছি। ছেলেটা শুধু বলছে তুই ফ্রি হয়ে কল দিস। মাথার পোকাটা আবারও নড়ে উঠলো।
তড়িঘড়ি মোবাইলটা বের করে সবুজকে কল দিলাম। দুইবার রিং হওয়ার পর রিসিভ করলো।
–” কি রে তোর কাছে কত কিছু জানতে চাইলাম। কিছুই তো জানালে না। “
–” হ্যাঁ দোস্ত। মনে পড়ছে, মেয়েটার নাম পিয়াসী। বাবার নাম মকবুল চৌধুরী। ওর বাবা ভূমি অফিসে চাকরি করতো। বেশ কয়েকদিন আমাদের বাড়ির পাশে ছিলো তাই একটু চিন্তা করতেই সব মনে পড়ছে। তা হঠাৎ ওর কথা জানতে চাইলে কেন? আরও কত মেয়েই তো ভো’গ করেছ সোনা। “
–” আরে এমনই! কাল রাতে মনে পড়েছিলো তাই। জোস ছিলো কিনা!”
ওঁকে আর কিছু বলতে না দিয়ে কলটা কেটে দিলাম। আমার সন্দেহই ঠিক তাহলে। এটাই সে-ই পিয়াসী কিন্তু এখন কি করবো আমি! কিছু ভালো লাগছে না। পরিবেশটা একদম বিষাক্ত লাগছে, অফিসে নানান কাজ পড়ে রয়েছে। কিন্তু কোন কিছু করতে ইচ্ছে করছে না। মিনিট দশেক ঝিমিয়ে স্যারের থেকে ছুটি নিয়ে বেরিয়ে এলাম। গন্তব্যহীন হয়ে হেঁটে চলেছি, নির্জন রাস্তায়! ভর দুপুরে কোথাও কেউ নেই। পথের পাশে শিউলি ফুল পড়ে আছে কিন্তু আজ পিয়াসীর জন্য ফুল কুড়াতে ইচ্ছে করছে না। নিজেকে শেষ করে দিতে পারলে হয়তো একটু ভালো লাগতো।
ফোনটা তখন থেকে বেজে চলছে, হয়তো পিয়াসী কল দিচ্ছে। মোবাইলটা বের করে বন্ধ করে রাখলাম। এখন কারো সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না।
।
সন্ধ্যার দিকে বাড়িতে ফিরে গেলাম। বাড়িতে কেউ নেই। হয়তো কোথায়ও বেড়াতে গেছে। পিয়াসী সোফাতে ঘুমিয়ে আছে, ওর কাছে গিয়ে কপালে হাত বুলিয়ে দিলাম। প্রচন্ড ঘৃ’ণা লাগছে ওঁকে স্পর্শ করতে। কিন্তু কেন?
–” সারাদিন কোথায় ছিলেন আপনি? জানেন কতটা চিন্তা হচ্ছিল আমার!”
–” বাইরে কাজ ছিলো। “
–” ওহ আচ্ছা। তাহলে আপনি একটু অপেক্ষা করেন। আমি আপনার শরবত নিয়ে আসছি। “
–” শরীর ভালো লাগছে না, তুমি বরং এক কাপ কফি বানিয়ে আনো। “
বিশ মিনিট পর পিয়াসী কফি নিয়ে এলো। সাত পাঁচ না ভেবে কফিতে চুমুক দিলাম। কফির স্বাদটা কেমন অন্য রকম লাগছে।
–” কফিতে কি মিশিয়েছ পিয়াসী?”
–” লেবুর রস আর আদা। “
–” কফিতে কি কেউ এসব দেয় নাকি?
–” কেন খেতে ভালো লাগছে না? “
–” না খেতে ভালোই লাগছে, তবে স্বাদটা অদ্ভুত। “
–” মাথাব্যথা করছে বললেন তাই এসব দিয়েছি। না খেতে পারলে ফেলে দিতে পারেন। “
–” বাকিরা কোথায় গেছে? কাউকে দেখছি না যে। “
–” সকলে নানুবাড়িতে গেছে, আপনি কল ধরলে আমিও যেতে পারতাম। “
পিয়াসী মন খারাপ করে বসে রইলো। কয়েক চুমুক কফি খাওয়ার পর আর খেতে ইচ্ছে করলো না। কফিটা ফেলতে গেলাম কিন্তু ফেললাম না। এক চুমুকে খেয়ে নিলাম।
বিছানায় শুয়ে আছি। পিয়াসী কপালে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। যদি কখনো পিয়াসী জানতে পারে আমার অতীত। তবে নিশ্চয়ই আমাকে ছেড়ে চলে যাবে। নয়তো ঘৃ’ণা করবে! কিন্তু আমি কি চাই পিয়াসী আমাকে ছেড়ে চলে যাক! এমনিতে খুব শান্ত মেয়ে পিয়াসী। আজ পর্যন্ত আমার মুখের উপর কোনো কথা বলেনি। সব সময় ভালো বেসেছে আমাকে। খেয়াল রেখেছে আমার। সেদিনের কাজটা না হলেই হয়তো ভালো হত। আজ নিজের মাঝে এতো দ্বিধা পুষতে হতো না।
।
ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি জানি না। সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি বেলা এগারোটা। পিয়াসী পাশে বসে কাঁথা সেলাই করছে।
–” এগারোটা বেজে গেছে, তুমি আমাকে এখনও ডাকলে না কেন?”
–” শরীর খারাপ ছিলো আপনার। আর আজ অফিস ছুটি, সবকিছু মিলিয়ে আপনাকে আর ডাকতে ইচ্ছে করেনি। ঘুমিয়ে থাকলে আপনাকে দেখতে বড্ড ভালো লাগে। “
শেষ কথাটা বলে লজ্জায় মুখ লুকিয়ে ফেললো পিয়াসী। আমি উঠে ফ্রেশ হয়ে আসলাম। সকালের নাস্তা শেষ করে একটু হাঁটতে বেরিয়েছি। ঘরে বসে থাকতে ভালো লাগছে না একটুও।
এই রাস্তায় শেষে একটা ফাঁকা মাঠ আছে, সেখানে যাব একটু। কিছুটা সময় কাটিয়ে বাড়িতে ফিরবো ভেবেছি। এ মাঠে সচারাচর লোকজন আসে না। বিকালের দিকে কয়টা বাচ্চা আসলেও সকাল দুপুরে একদম ফাঁকা থাকল। কিন্তু আজ মাঠে ভিড় উপচে পড়ছে। এতো লোকজন কেন এখানে! ভিড় ঠেলে এগিয়ে গেলাম।
একি দেখছি আমি! সবুজের লা’শ! হ্যাঁ সবুজ মাটিতে পড়ে আছে। কেউ ওকে বি’শ্রী ভাবে খু’ন করেছে। সারা শরীরে আ’চ’ড়ের দাগ। হঠাৎই চারপাশে অন্ধকারে ভরে গেলো আমার। সবুজ কি করে এখানে আসতে পারে? নাকি চোখের ভুল দেখছি আমি। ভয়ে, চিন্তায় কোন কথা বলতে পারলাম না আমি। স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। সবুজের লা’শ কেউ শনাক্ত করতে পারলো না। পুলিশ এসে ওর লাশটা নিয়ে চলে গেলো। কিন্তু ওর বাড়ি থেকে এতো দূরে কেউ কেন ওঁকে মারতে যাবে? আর এখানেই বা আসলো কি করে! পরক্ষণেই মনে হলো ওর শত্রুর অভাব নেই। মা’দ’কে’র ব্যবসা করতে গিয়ে অনেক শত্রুই জোগাড় করেছে। তাছাড়া প্র’তা’র’ণার বিষয়টা তো আছেই। শুনেছি ওর কোন প্রেমিকা অনেক বেশি সিরিয়াস ছিলো ওঁকে নিয়ে, তাঁর সাথে সম্পর্ক শেষ করে অন্য মেয়েকে বিয়ে করেছে সবে দুমাস হলো। সেও প্র’তি’শো’ধ নিতে পারে।
বেশিক্ষণ সেখানে থাকলাম না। বাড়িতে চলে এলাম। পিয়াসী পোলাও গোশত রান্না করছে। রান্নাঘরে গিয়ে ওঁকে পিছন দিয়ে জড়িয়ে ধরলাম।
–” এ বাবা! কি করছেন আপনি? আমাকে রান্না করতে দিন। “
–” কার জন্য রান্না করছেন মেডাম?”
–” আপনার জন্য। “
–” তাহলে আমিই তো বিরক্ত করবো নাকি?”
–” উফফ! কথার জালে না ফাঁসিয়ে গোসল করে আসুন। বেলা একটা বাজে। “
পিয়াসীর কথায় মুচকি হাসলাম। এই কথার জালে কত মেয়েকে ফা’সি’য়ে রু’ম পর্যন্ত নিয়ে এসেছি। সেই কথায় জালেই তাদেরকে ছেড়ে চলে এসেছি। বিষয়টা বেশি মনে করতে চাইলাম না। তোলায়ে নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলাম। সবুজের জন্য খারাপ লাগছে একটু। কতটা সময় একসাথে কাটিয়েছি দুজন।
দুপুরে খেতে বসেছি। মোবাইলটা অনেক্ক্ষণ ধরে বেজে চলেছে। পিয়াসী খাওয়া ছেড়ে মোবাইলটা নিয়ে আসলো। কল রিসিভ করে মোবাইল কানের কাছে ধরলাম।
–” আসসালামু আলাইকুম, আমি থানা থেকে আসিফ বলছি। “
–” ওয়ালাইকুম আসসালাম। জ্বি বলুন৷ “
–” একটা হ’ত্যার ব্যাপারে আপনার সাথে কথা বলতে চাই। আপনি সময় করে একটু থানায় চলে আসবেন। “
–” কি জন্য থানায় আসতে হবে?”
–” একজন অপরিচিত ব্যাক্তির লা’শ পেয়েছি আমরা। শেষবারের মতো আপনি উনাকে কল করেছিলেন গতকাল বেলা এগারোটা নাগাদ। আপনার ওনাকে শনাক্ত করতে আসতে হবে এই আর কি।”
–” জ্বি স্যার চলে আসবো। “
কথা শেষ হতেই পিয়াসী ব্যস্ত হয়ে প্রশ্ন করলো, ” আপনাকে থানায় আসতে বললো কেন? কোনো সমস্যা হয়নি তো?”
আমি ওর ঘাড়ে হাত রেখে বললাম, ” না রে পাগলী। কিছুই হয়নি। একটা ব’ডি শনাক্ত করতে ডেকেছে। তেমন কিছু না। তুমি চিন্তা করো না৷ এত সহজে আমি তোমার পিছু ছাড়ছি না। “
পিয়াসী আস্তে একটা কিল দিলো আমাকে। দু-জনে মিলে সবকিছু গুছিয়ে রাখলাম। আর খেতে ইচ্ছে করছে না৷ আবার থা’না’য় যেতে হবে। শুনেছি পুলিশে ধরলে আঠারো ঘা। এখন নিজেই দেখতে যাচ্ছি।
মাথাটা যেন ফেটে যাবে আমার। এতো টেনশন নিতে পারছি না। যদিও আমি সবুজের খু’ন করিনি। তবুও না জানি কোন ঝামেলায় ফেঁসে যাই। একটা শার্ট গায়ে ঝুলিয়ে থানার দিকে রওনা দিলাম। সবকিছু কেমন আবছা আলোয় ঢেকে গেছে। সবকিছু দেখা যাচ্ছে ঠিক কিন্তু কিছুই বোঝা যাচ্ছে না।
চলবে…..
#আবছা_আলোয়_তুমি
পার্ট -৩
কলমে : #ফারহানা_কবীর_মানাল
–” লা’শটা কার বলতে পারেন মনির সাহেব?”
ওসি সাহেবের কথায় ধ্যান ভাঙলো আমার। এতো সময় এক দৃষ্টিতে সবুজের লা’শের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। কত স্মৃতি দু’জনের! সবুজের পরিচয় লুকিয়ে রাখলে আমি নিজের ফেঁসে যাবো। তাই কোন ঝুঁকি নিতে চাইলাম না।
–” হ্যাঁ, উনি আমার বাল্যকালের বন্ধু। মাঝে মাঝেই কথা হতো আমাদের। “
–” তা উনার কল লিস্ট দেখেই বোঝা যাচ্ছে। তা উনি কি আপনার কাছে এসেছিল কাল? আপনার এলাকায় লা’শ পাওয়া গেছে। “
–” না, আমাদের দেখা করার কোন পরিকল্পনা ছিলো না। “
–” আপনি কয়েকদিন শহরের বাইরে যেতে পারবেন না। উনার হ’ত্যার সাথে আপনার সম্পর্ক থাকলেও থাকতে পারে। “
–” কি বলতে চান আপনি? আমি আমার ব্যালকালের বন্ধুকে খু’ন করেছি? এমনটা কখনোই নয়। “
–” হ’ত্যা’কা’রী ধরা না পড়া পর্যন্ত আইনের চোখে সবাই অপরাধী। সন্দেহের বাইরে কেউ নেই। “
–” আচ্ছা। “
–” উনার বাড়িতে খবর দেওয়ার ব্যবস্থা করুন। কাল পোস্টমর্টেম রিপোর্ট অনুসারে হ’ত্যা’কা’রীর সন্ধান করা হবে। “
–” আমার কি আর কোন কাজ আছে এখানে?”
–” না, আপনি চাইলে এখন আসতে পারেন। না চাইলে চা খেয়ে যেতে পারেন। “
— আপাতত চা খাওয়ার ইচ্ছে নেই। ধন্যবাদ। “
মনির থানা থেকে বেরিয়ে গেলো। ওসি সাহেব হেসে কনস্টেবলকে বললো, ” লোকটার তেজ দেখেছিস। খু’নের আ’সা’মী হলে আমি রি’মা’ন্ডের দায়িত্বটা নিবো। “
প্রতিত্তোরে কনস্টেবল হেসে কুটিকুটি হয়ে গেলেন।
রাস্তায় উদ্দেশ্যহীন ভাবে হেঁটে চলেছে মনির। সবুজের কে’স ওপেন হলে সে নিজেও ফেঁসে যেতে পারে। এসব নিয়ে দারুণ চিন্তা তাঁর, আবার মনের মাঝে রহস্য দানা বেঁধেছে। কে এ কাজ করতে পারে? সবকিছু মিলিয়ে পাগল পাগল অবস্থা মনিরের।
সেদিন বাড়ি ফিরে পিয়াসীর সাথে তেমন কথা হয়নি তার, একদম চুপসে গেছে লোকটা। পিয়াসীও নিজের মতো কাজ করে গেছে। মনির কাছে তেমন প্রশ্ন করেনি।
পরেরদিন সকাল দশটা। থানার এককোণে দাঁড়িয়ে আছে মনির। সাথে সবুজের স্ত্রী আর তার ভাই। সকলেই ওসির দিকে তাকিয়ে আছে, কি-না কি-না সংবাদ দিবে সে। ওসি সাহেব কিসব রিপোর্ট দেখে চলেছে তখন থেকে। কপাল কুঁচকে আছে তার।
মিনিট দশেক পর ওসি মুখ খুললেন। সবুজের স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন, ” আপনার স্বামীর সাথে কেমন সম্পর্ক আপনার?”
নবনীতা চোখের কোণে জমে থাকা পানিটা মুছতে মুছতে বললো,” বিয়ে হয়েছে সবে দু’মাস। এতোদিন সম্পর্ক ভালোই চলছিলো। দু’দিন আগে উনার সাথে ঝগড়া হয়েছে। উনার অন্য মেয়ের সাথে সম্পর্ক ছিলো। এটা নিয়েই ঝামেলা। “
ওসি সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ” উনাকে কেউ খু’ন করেনি। বরং অতিরিক্ত ম’দ্য পান ও নে’শার দ্রব্য সেবন করার জন্য উনার মৃত্যু হয়েছে। “
–” তাহলে গায়ে অমন আছড় এলো কেন? মা’দ’কদ্রব্য খেয়ে মৃ’ত্যু বরং করলে গায়ে নিশ্চয়ই এমন আঁচড়ের দাগ হবে না।'”
মনিরের এমন প্রশ্ন হয়তো ওসি সাহেবের পছন্দ হয়নি। এমন গোয়েন্দাদের মতো জেরা করলে কারই বা ভালো লাগবে। ওসি সাহেব মনিরের দিকে তাকালেন, তাঁর চোখেমুখে স্পষ্ট বিরক্তির ছাপ ফুটে ওঠে। তবুও নিজেকে সামলে জবাব দেয়,
–” আঁচড়ের দাগগুলো কুকুরের নখের! অন্তত পোস্টমর্টেম রিপোর্ট এটাই বলছে। বাকিটা বলতে পারবো না। “
–” কুকুর কেন হঠাৎ সবুজের সাথে এমন করতে যাবে?”
–” তা না হয় আপনি কুকুরে গিয়ে প্রশ্ন করেন। “
ওসির উত্তর তেমন পছন্দ হলো না মনিরের। তবুও চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো। কোনো প্রকার ঝামেলা চায় না সে। এমনিতেই নিজের জীবন নিয়ে বিপাকে আছে মনির। সে-ই মেয়েকেই বিয়ে করছে যাকে বারো বছর আগে বন্ধুর সাথে মিলে নিজেই ধ’র্ষ’ণ করেছে। অতিরিক্ত পৈশাচিক আনন্দের আশায় মেয়েটার ঘাড়ে ধা’রা’লো ব্লে’ড দিয়ে নিজের অক্ষর খোদাই করে দিয়েছে। আজকাল পিয়াসীকে তেমন স্পর্শ করতে ইচ্ছে হয় না মনিরের, সবসময় ভয়ে থাকে এই বুঝি পিয়াসী তাকে চিনে ফেললো। সাজানো সংসার হয়তো এইবার শেষ হয়ে যাবে। সে-ই সাথে পরিবারের আদর্শ ছেলের মুখোশটা ছিঁড়ে আসল রূপটা বেরিয়ে আসবে। নানান চিন্তায় বেহাল দশা তার। এর মাঝে সবুজের খু’নের কোনো দায় নিতে চায় না সে।
–” আপনাদের কি কাউকে সন্দেহ হয়? তাহলে তার বিরুদ্ধে মামলা করতে পারেন। “
ওসি সাহেবের কথায় নবনীতার দিকে তাকায় মনির। নবনীতা ডানে বামে মাথা নাড়িয়ে না সূচক জবাব দেয়। ওসি সাহেব টেবিলের উপর ফাইলগুলো রাখতে রাখতে বললেন,” তাহলে কিছু কাগজে সই করে লা’শটা নিয়ে যান। কে’স এই পর্যন্ত! “
কোন হ’ত্যার মামলা এতো তাড়াতাড়ি বন্ধ হতে পারে জানা ছিলো না মনিরের। তবুও যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। সবুজের খু’ন হোক বা নিজের দোষে মা’রা যাক। এটা নিয়ে মাথা ব্যাথা নেই মনিরের। বরং বেশ ভালোই হয়েছে তার। সবুজের সাথে সাথে মনিরের কুকর্মগুলোও চাপা পড়ে গেছে। থা’না থেকে লা’শ ছাড়িয়ে নিয়ে সবুজের বাড়ির দিকে রওনা দিলো সবাই। থানা থেকে লাশ ছাড়িয়ে নিয়ে এতো ঝামেলা আগে জানতো না মনির। তবুও বন্ধু লা’শ ছাড়িয়ে বাড়ি পর্যন্ত নিয়ে গেলো। নিজে দাঁড়িয়ে থেকে কবর খুঁড়ে, লা’শ মাটি দিয়ে তারপর বাড়ির পথে রওনা দিলো।
ওদিকের সবুজের কাজ শেষ করতে করতে অনেক দেরি হয়ে গেছে। রাত দুইটার দিকে বাড়িতে ফেরে মনির।
পিয়াসী তখনও পায়চারি করেছে বারান্দায়, বারবার গেটের দিকে উঁকি দিচ্ছে। যদি কোথাও মনিরের চিহ্ন দেখতে পায়, এই আশায়! বারবার কল দিচ্ছে স্বামীকে কিন্তু মনিরের মোবাইল বন্ধ।
দরজায় কড়া নাড়তেই পিয়াসী দৌড়ে আসে। হয়তো তাঁর অপেক্ষায় শেষ হয়েছে।
–” কে ওখানে? “
–” পিয়াসী আমি মনির। দরজা খোল। “
মনির কন্ঠ শুনে দরজা খুলে দেয় পিয়াসী। তারপর কাঁদতে কাঁদতে জড়িয়ে ধরে মনিরকে। মনির অবাক হলেও প্রকাশ করে না। পিয়াসীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে,” দরজায় দাঁড়িয়ে রাখবে বুঝি আমাকে?”
–” আপনার সাথে তা-ই করা উচিত। কোথায় ছিলেন আপনি এতো সময়? জানেন কত চিন্তা হচ্ছিল আমার! “
মনির হয়তো পিয়াসীর অভিযোগ বুঝতে পেরেছে, পিয়াসীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো, ভুং হয়ে গেছে আমার। আর কখনও এমন কাজ করবো না,। “
পিয়াসী তবুও মন খারাপ করে থাকে। মনির পিয়াসীর মন ভালো করার চেষ্টা করে না, বরং নিজের মতো করে হাতমুখ ধুয়ে শুয়ে পড়ে। সারাদিন অনেক ধকল গেছে আজ।
সকালে ঘুম থেকে উঠে পিয়াসীকে কোথাও দেখতে পায় বা মনির। পিয়াসীর নাম ধরে ডাকতে থাকে। পিয়াসী তখন রান্নাঘরে সকালের নাস্তা বানাতে ব্যস্ত। মনির পিয়াসীকে খুঁজতে খুঁজতে রান্নাঘরে চলে আসে। পিয়াসী রান্না করছে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। কেন জানি খুব ভয় পেয়ে গেছিল সে।
–” পিয়াসী এতবার ডাকছি, সাড়া দিচ্ছো না কেন?”
–” আমি রাগ করে আছি। “
মনির কর্কশ গলায় বলে, ” কি জন্য রাগ করে আছে তুমি?”
পিয়াসী কিছু বললো না। মনির নিজের রাগকে সংযত করে পিয়াসীকে জড়িয়ে ধরলো।
–” আমার বউটা বুঝি ভীষণ অভিমান করে আছে আমার উপর? কি করবে বলো! তোমার বরটা যে একটুও ভালো না। শুধু শুধু এতো ভালো একটা বউকে কষ্ট দেয়। “
পিয়াসী মুখ ফুলিয়ে বলে,” আমার বরটাও অতো খারাপ না। আমাকে অনেক ভালোবাসে। “
মনির কোনো কথা বলে না, পিয়াসীকে ছেড়ে রুমে চলে আসে। মনিরের এমন ব্যবহারে পিয়াসীর খুব খারাপ লাগে। চোখের কোণে অশ্রু টলটল করে। ওড়না দিয়ে জমে থাকা পানিটা মুছে নিজের কাজে মন দেয় পিয়াসী।
সকালে খাওয়ার সময়, মনির পিয়াসী সামনা-সামনি দুইটা চেয়ারে বসে আছে। নিরবে খাবার খাচ্ছে দু’জন। নিরবতা ভেঙে মনির প্রশ্ন করে
–” বাকিরা কবে বাড়িতে আসবে?”
–” মা বলেছে আজ বিকালে। “
–” তোমার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে। “
–” কি সারপ্রাইজ? “
–” বলে দিলে কি আর সারপ্রাইজ থাকে নাকি হুমমম?”
–” তবুও বলেন না!”
–” আমরা আগামীকাল কক্সবাজার যাচ্ছি। আমাদের হানিমুনটা বাকি রয়ে গেছে কিনা!”
পিয়াসী উওর দেয় না। লজ্জায় মুখ নিচু করে থাকে। পিয়াসীর অভিমান ভাঙাতে পেরেছে বলে মনিরও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। কোনো রকমের অশান্তি চায় না সে। পিয়াসীর সাথে সংসার করবে কিনা এটা নিয়ে বড্ড চিন্তিত সে। বাড়ি থেকে দূরে কোথাও গিয়ে নিরালায় সিদ্ধান্তটা নিতে চাইছে। তারপর কি করা যায় দেখা যাবে। তাছাড়া পিয়াসীর নামে অঢেল সম্পত্তি রয়েছে। পিয়াসীর দাদা তার সকল সম্পত্তি একমাত্র নাতির নামে লিখে দিয়ে গেছেন। তাছাড়া পিয়াসীর নানাও পিয়াসীর জন্য ঢাকায় ফ্ল্যাট কিনে দিয়েছে। মকবুল সাহেবের একমাত্র মেয়ে পিয়াসী। তাই বাপের সম্পত্তিও কোন এক সময় পিয়াসীর নামে চলে আসবে। জায়গা জমি বিক্রি করার লোক তার শশুর নয়। এসব কালে কালে মনিরই ভোগ করবে। হুটহাট পিয়াসীকে তালাক দিয়ে সে-ই সম্পত্তি হারাতে চায় না। আবার পিয়াসীকে তা’লা’ক দিয়ে তাকে নিয়ে নানান কথা ছড়াবে, পিয়াসীর আচরণ খুবই ভালো৷ আজও কোনো ছেলের সাথে কথা বলতে দেখেনি মনির। তাই স্বভাব চরিত্রের দোষ দিয়ে পিয়াসীকে তা’লা’ক দেওয়া সম্ভব নয়। এতে পরিবারের কাছে তার ইমেজ নষ্ট হয়ে যাবে। পিয়াসী একজন ভালো বউ, ভালো ভাবি। বাড়ির সকলেই ও-র উপর সন্তুষ্ট। তবুও নিজের দ্বিধা কাটিয়ে উঠতে পারে না মনির।
চলবে
আবছা_আলোয়_তুমি
শেষ পার্ট
কলমে : #ফারহানা_কবীর_মানাল
পিয়াসী একজন ভালো বউ, ভালো ভাবি। বাড়ির সকলেই ও-র উপর সন্তুষ্ট। তবুও নিজের দ্বিধা কাটিয়ে উঠতে পারে না মনির।
সকালের মিষ্টি রোদ মুখে পড়তেই চোখ খোলে পিয়াসী। সম্পূর্ণ রাস্তা ঘুমিয়ে কাটিয়েছে সে, জীবনের প্রথম সমুদ্রকে এতোটা কাছ থেকে দেখতে পাবে, ভাবতেই মনটা খুশিতে ভরে যাচ্ছে তাঁর। মনির পাশের সীটে বসে আছে। ছেলেটা গাড়িতে ঘুমাতে পারে না। বড্ড ক্লান্ত লাগছে তাঁকে।
–” আমরা চলে এসেছি বুঝি?”
–” না এখনও কিছুটা পথ বাকি। তুমি তো সারাপথ ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিলে, যদিও আমার জন্য ভালো হয়েছে। ঘুমন্ত তুমিটাকে বড্ড সুন্দর লাগে। “
পিয়াসী মুচকি হাসে। উত্তরে কিছুই বলে না। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে সবকিছু দেখতে থাকে।
হোটেল রুমে বসে আছে মনির-পিয়াসী। সকালে কিছু খাওয়া হয়নি তাঁদের। মনির বাইরে থেকে কিছু কিনে আনবে ভাবছে, কিন্তু তাঁর শরীর বড্ড ক্লান্ত। হাঁটতে ইচ্ছে করছে না।
–” আপনি একটু বিশ্রাম করুন, আমি গিয়ে কিছু কিনে নিয়ে আসছি। “
মনির মাথা নেড়ে হ্যাঁ সূচক জবাব দেয়। পিয়াসী রুম থেকে বেরিয়ে আসে। বেশ তাড়াতাড়ি ফিরে আসে পিয়াসী। দু’জনে মিলে সকালের নাস্তা সেরে নেয়। মনিরের শরীর যেন আর চলছে না, বিছানায় পিঠ এলিয়ে দেয় সে। পিয়াসী ঘুরে ঘুরে রুমটা দেখতে থাকে। যদিও তাকালে সবটা দেখা যায়। তবুও প্রতিটা জিনিসকে ছুঁয়ে দেখতে চায় মেয়েটা।
সারাটাদিন বেশ ভালোই কাটে দু’জনের।
আজ রাতের আকাশে কোন তারা নেই। চারপাশ গাঢ় অন্ধকারের ঢেকে আছে। সাগর পাড়ে মনিরের কাঁধে মাথা দিয়ে বসে আছে পিয়াসী। সামনে বিশাল কালো সমুদ্র, উপরে অন্ধকার আকাশ। তবুও সবকিছু উপভোগ্য লাগছে ওঁদের কাছে। মনির পিয়াসীর হাত ধরে বসে আছে। নিজের মনের সাথে যু’দ্ধ করে মনির ঠিক করেছে সে পিয়াসীর সাথেই থাকবে। অকারণে অতীত সামনে আনার কোন মানেই নেই।
–” আপনার কোন বোন গাড়ি এক্সিডেন্টে নিহত হয়েছিল? “
পিয়াসীর প্রশ্নে চমকে উঠে মনির। তবুও নিজেকে সামলে বলে, ” আমার কোন বোন মারা যায়নি তো। কে বলেছে তোমায় এসব? “
পিয়াসী একদম শান্ত হয়ে বসে আছে। চারদিক যেন একদম নিস্তব্ধ!
–” আপনিই বলেছিলে! “
মনিরের মস্তিষ্ক কাজ করা বন্ধ করে দিচ্ছে। এসব কি কথা বলছে পিয়াসী। মেয়েটা হয়তো মজা করছে কিন্তু মনিরের কেমন যেন লাগছে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে।
–” কবে বলেছি তোমাকে এসব কথা?”
–” বারো বছর চারমাস আগে!”
–” কিসব বলছো তুমি পিয়াসী? মাথা খারাপ হয়ে যায়নি তো তোমার?”
–” আমার মাথা ঠিকই আছে। আপনি হয়তো ভুলে গেছেন। অবশ্য এতদিন আগের কথা মনে না থাকাটাই স্বাভাবিক। “
–” পিয়াসী!”
মনির কোন কথা খুঁজে পায় না। এই মুহুর্তে কি বলা উচিত বা কি করতে হবে কিছু জানে না সে৷ পিয়াসী সবটা জেনে গেছে কি করে! নাকি আগে থেকেই সব জানতো? যদি সবকিছু জানতো তাহলে কেন বিয়ে করেছে মনিরকে?
–” আমি আর আগের মতো নেই পিয়াসী। আমি অনেক বদলে গেছি। “
পিয়াসী হাসে। হাসির শব্দে চারিপাশ মুখরিত হয়ে ওঠে।
–” প্রথমে আমিও তেমনটাই ভেবেছিলাম। হয়তো আপনি অনেক পাল্টে গেছেন। কিন্তু মাস খানেক আগে ভুলটা শুধরে গেছে। “
মনিরের ইচ্ছে হয় পিয়াসীর গ’লা চে’পে ধরতে কিন্তু পারে না৷ কোন এক অচেনা শক্তি তাঁর হাত পা অবশ করে দিয়েছে। মাথাটা কেমন ঝিম ধরা, চারপাশ বড্ড অন্ধকার!
তারপর আর কিছুই মনে করতে পারে না মনির। অজ্ঞান হয়ে ঢলে পড়ে বালির উপরে। শেষ মুহূর্তে মনে পড়ে পিয়াসী তার জন্য কফি নিয়ে এসেছিল সন্ধ্যায়। স্বাদটা একদম আদা-লেবু দেওয়া কফির মতো। আদো কি কফিতে আদা লেবু দেওয়া ছিল!
জ্ঞান ফিরে নিজেকে একটা বন্ধ ঘরে আবিষ্কার করে মনির। চেয়ারের সাথে হাত পা বাঁধা তাঁর। পিয়াসী একা নিশ্চয়ই তাকে এভাবে বাঁধতে পারে না। কে আছে পিয়াসীর সাথে!
চোখ তুলে তাকাতেই নজরে আসে ওসি সাহেবকে। হ্যাঁ উনি সেই পু’লি’শ অফিসার যে সবুজের মামলা তদন্ত করেছিলেন। প্রথমে মনে হয় লোকটা খবর পেয়ে মনিরকে সাহায্য করতে এসেছে, পরক্ষণেই ভুলটা ভাঙে যখন তাঁর মুখের বিশ্রী হাসিটা চোখে পড়ে।
–” একে কি করে মা’র’তে চাও পিয়াসী? সকাল হলে ঝামেলা। “
–” সব সত্যিটা জানিয়ে!”
মনির ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে পিয়াসীর দিকে, জ্ঞান ফিরেছে তাঁর। ভাঙা গলায় বলে, ” পিয়াসী তোমার সাথে এই লোকটা কে? আমাকে এভাবে আটকে রেখেছ কেন?”
–” যে বুঝেও না বোঝার ভান করে তাকে কিছু বোঝাতে যেও না পিয়াসী। সকাল হলে সমস্যা হবে। “
পিয়াসী কিছু বলে না, মনিরের দিকে তাকিয়ে থাকে। এতদিন এই লোকটাকে মা’রার জন্য অপেক্ষা করতো আজ কেন পারছে না সে। নিজের দ্বিধা কাটিয়ে বলে, ” যে আমার সুন্দর শৈশবটাকে ধ্বংস করে দিয়েছে, তাঁকে কি করে বাঁ’চি’য়ে রাখি বলেন? রাতের পর রাত ঘুমাতে পারিনি৷ মা’য়ের হাহাকার, বাবার আফসোস দেখতে দেখতে বড় হয়েছি। সুখের সংসারে এই একটাই তো কাটা হয়ে উঠেছিলো। “
–” সবুজকে কে মেরেছে পিয়াসী?”
–” আমি! আপনার বন্ধু চরিত্র অনেক বেশি ভালো ছিলো, তাই পরিচয় দিয়েই কথা বলেছি, এক রাতের নিমন্ত্রণ দিয়েছিলাম। সে-ও আসতে রাজি হয়ে গেলো। আর মামলা চাপা দিতে তো মারুফ আছে। “
–” আমায় মে’রে ফেলবে তুমি? আমি না তোমার স্বামী?”
–” কেউ নয় আপনি আমার। আপনি শুধু মাত্র একজন খু’নি, যে আমাকে জীবন্ত লাশ বানিয়ে দিয়েছে। “
–” আমি আগের মতো নেই বিশ্বাস করো তুমি, সত্যি বলছি খুব ভালোবাসি তোমাকে। “
মারুফ দৌড়ে মনিরকে মা’র’তে আসে। কয়েকটা ঘু’সি দিতেই নেতিয়ে পড়ে মনির।
–” মাসখানেক আগে একদিন মোবাইল রেখে ওয়াশরুম গিয়েছিলেন আপনি। কৌতুহল বশত আপনার মোবাইলটা হাতে নিয়েছিলাম। ওয়ালপেপারের উপর আমার ছবি দেওয়া থাকলেও আপনার ফেজবুক আইডি জুড়ে অসংখ্য মেয়ে বান্ধবী। ফেজবুক আইডির পাসওয়ার্ড বদলে নিজের মোবাইলে আইডিটা লগইন করে নিলাম। ব্যাস! আপনার সব খবর আমার কাছে চলে আসতে লাগলো।”
–” তুমি পাসওয়ার্ড বদলে দিলে কি করে?”
–” ওটিপি দিয়ে, অবশ্য মোবাইলে ওই সীমটাই ছিলো বলে কাজটা করতে পেরেছি। “
মনির আর কিছুই বলে না, দিন পনেরো আগে অফিসের সুন্দরী কলিগ মিতালীর সাথে একান্তে সময় কাটিয়েছে। ডজনখানেক মেয়ের সাথে প্রেমের সম্পর্ক তাঁর। সে এখন চাইলেও পিয়াসীকে কিছু বোঝাতে পারবে না।
–” এতো কিছুর পরেও আপনাকে আমি সত্যিই মাফ করে দিতাম, যদি কুমারীর ক্ষতি করতে না চাইতেন। “
অফিসের দারোয়ানের পনেরো বছরের মেয়ে কুমারী। কলিগের সাথে মিলে তাঁকে ধর্ষণ করার পরিকল্পনা করেছিল মনির। সব কথা ম্যাসেন্জার দিয়ে বলতো বলে পিয়াসী সবটা জেনে গিয়েছে।
পিয়াসী আর দেরি করে না, ড্রাগসের ইনজেকশনটা মনিরের ঘাড়ে পুশ করে দিলো। মনিরের জীবন প্রদীপ আজই নিভে যাবে। এরপর একটা নখ দিয়ে মনিরের সারা শরীরের আঁচড় কেটে দেয় পিয়াসী। এটা সেই কুকুরের নখ যার আঁচড়ের দাগ সবুজের শরীরেও ছিল।
শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার আগে ভাঙা গলায় মনির বলে ওঠে, ” পিয়াসী সত্যি তোমাকে ভালোবাসি।”
কথাটায় বিন্দুমাত্র বিচলিত হয় না পিয়াসী। যে ভালোবাসে সে বিশ্বাস নষ্ট করে না। তবুও চোখের কোণে পানি জমে তাঁর। কেন কাঁদছে পিয়াসী! উত্তরটা পিয়াসী নিজেও জানে না। বারো বছর ধরে সবুজ আর মনিরকে খুঁজে বেড়িয়েছে সে, বারো বছর আগে সেদিনের ঘটনা জানার পর মনির আর সবুজের মুখ মনে এঁকে রেখেছে ঘৃণায়। মনিরকে খুঁজেছে সারা শহরে, গ্রামে, মফস্বলে! অবশেষে বাবাকে দিয়ে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে মনিরের বাড়িতে, সব পরিকল্পনা আজ সফল হলো তাঁর। এতটা পথ পিয়াসীর পাশে থেকেছে মারুফ। মারুফ পিয়াসীর প্রেমিক। ছেলেটা পুলিশে চাকরি করে বলে বেশ সুবিধা হয়েছে তাঁর।
–” পিয়াসী চলো এখান থেকে।”
মনিরের লাশের সামনে বসে ছিল পিয়াসী। মারুফের কথায় উঠে দাঁড়ালো। পিছন ফিরে জড়িয়ে ধরলো মারুফকে। তারপর ঘাড়ে পুশ করে দিলো ড্রাগস ইনজেকশন!
–” একি পিয়াসী! আমার সাথে কেন এমনটা করলে? আমি তো ভালোবাসি তোমাকে। “
–” মিথ্যা বলো না মারুফ। তুমি আমাকে ভালোবাসনি, তুমি ভালোবেসেছ আমার অঢেল সম্পত্তিকে। “
–” এসব কি বলছ তুমি? না না এ সত্যি নয়। প্লিজ আমাকে হাসপাতালে নিয়ে চলো, আমি বাঁচতে চাই। “
–” কখনোই না মারুফ। মনে পড়ে তুমি কিছুতেই এসব কাজে আসতে চাওনি। সবুজের হ’ত্যায় কোন প্রকার সাহায্য করতে চাওনি। আমি হাজারবার বলেছি তোমার আমি সবুজকে মা’র’তে চাই কিন্তু তুমি না করতে। সেদিন হঠাৎ সবুজের ছবি দেখে আমার সঙ্গী হলে কেন?”
–” ভেবেছিলাম ভালোবাসি যখন তখন পাশে থাকা উচিত। “
–” মিথ্যা কথা! কারণ সবুজের স্ত্রী তোমার প্রেমিকা। তাছাড়া তুমি আমাকে ভালোবাসলে একটা কেস চাপা দিতে দশ লাখ টাকা দাবী করতে না। খোঁজ নিয়ে জেনেছি তুমি ওই টাকা দিয়ে নবনীতাকে হীরার হার কিনে দিয়েছ। “
–” তুমি এসব কি করে জানলে পিয়াসী?”
–” মারুফ আমি সেই মেয়ে, যে বারো বছর আগের ঘটনা এখনও মনে রেখেছি। মনির আর সবুজকে খুঁজে বের করেছি। এসব কাজ আমার তেমন কঠিন মনে হয় না এখন। “
মারুফ আর কিছু বলতে পারে না, ঢলে পড়ে মেঝেতে। পিয়াসী দু-হাত দিয়ে নিজের মুখটা ঢেকে নেয়। আজ বড্ড ক্লান্ত লাগছে তাঁর, একটা লম্বা ঘুমের প্রয়োজন। জীবনের শুরুটা মনির সবুজ অন্ধকার করে দিয়েছিল, মারুফের বিশ্বাসঘাতকতা পিয়াসীকে কষ্ট দেয়নি, বরং পাথর করে দিয়েছিল। সাত বছরের সম্পর্ক ভুলে মারুফ নবনীতার প্রেমে পড়েছে! কথাটা জানার পর আর কিছু ভাবতে পারেনি পিয়াসী। মনিরের মতো তাঁকেও বিদায় করে দিয়েছে। আচ্ছা পৃথিবীতে কি একজনও পুরুষ নেই যাকে বিশ্বাস করা যায়!
লা’শ দুইটা ওখানে রেখেই বাইরে চলে আসে পিয়াসী, সাগরের পানিতে গোসল শেষে বাসস্ট্যান্ডের দিকে হাঁটা দেয়। তাঁকে এ শহর ছাড়তে হবে, যেতে হবে বহুদূর!
সমাপ্ত