#ইসরাত_মিতু
#সত্য_ঘটনা_অবলম্বনে
জীবন সংগ্রামে কখনো কখনো আমরা এমন ভাবে হেরে যাই যা কিনা কোনো কিছুর বিনিময়েও আর ঠিক হয়না!
সিমার জীবনটাও তেমন কিছুতে পরিনত হলো, হয়তো এই সমস্যার কোনো সমাধান নেই, আর ঠিক হবার আশাও নেই! সিমা বিমর্ষভাবে সারাদিন রুমে শুয়ে রইলো, খুব ইচ্ছে হলো ওর আম্মাকে জানাতে কিন্তু তার শারিরীক অবস্থার কথা চিন্তা করে চুপ করে রইলো, কোনো খাওয়া-দাওয়া ও করলো না, দিন শেষে রাত হলো, ছোটো বোনটা এসে খেতে ডাকলো কিন্তু সিমা ভালো লাগছে না বলে দরজা বন্ধ করে দিলো, বাড়ির সবাই জানতে চাইলো কী হয়েছে তবুও কোনো কিছুই বললো না, চোখ-মুখের অবস্থা দেখে সিমার আম্মা ঠিকই বুঝতে পারলো তার মেয়েটা ভালো নেই!
পরের দিন জোর করে ওর আম্মা খাবার খাওয়ালো, আর স্বান্তনামূলক কথা বললো, সিমা তো জানে পৃথিবীর কোনো কথাই তাকে শান্তি দিতে পারবে না!
দু’দিন পর সিফাত এসে সিমাকে নিয়ে গেলো ওদের বাসায়।
বাসায় ফিরে সিমার মনে হলো সে যেনো খুব অচেনা, অজানা, অপরিচিত কোনো বাসায় ভুলে চলে এসেছে, হয়তো এখনি কেউ এসে বলবে .. কে তুমি?
সিমা নিজ রুমে গিয়ে ফ্রেশ হলো, শশুড়- শাশুড়ির সাথে দেখা করলো, রাতের খাবারের আয়োজন করলো, সিফাত সিমাকে বাসায় দিয়ে তখনি বের হয়ে গিয়েছিলো, অনেক রাত করে বাসায় ফিরলো!
এত রাত হলো আসতে তোমার, বলতেই সিমার দিকে সিফাত রক্তবর্ণ চোখ নিয়ে তাকালো, এমন সিফাতকে সিমা চিনেনা, সিমা জানেনা এই সিফাতের মনে কী আছে!
সেই রাতে সিফাতের সাথে সিমার কোনো কথা হলো না।
দু’জন দু’পাশ ফিরে শুয়ে রইলো!
সকাল বেলা সিফাত বাসা থেকে বের হওয়ার সময় সিমাকে বললো..
— তুমি তো জানো, যা কিছু সমস্যা সব তোমার, আমার কোনো সমস্যা তারা পায়নি, টেস্টটিউব বেবী নিতে চাইলে অন্য কারো ডিম্বানু নিতে হবে যা কিছুতেই সম্ভব না, সেই সন্তান তো তোমার আমার হবে না, আর এটা নাজায়েজ কাজ হবে, বাবা এটা কিছুতেই মেনে নিবে না, তারা চাচ্ছে না আমরা বাচ্চা দত্তক নিই, কারন সেই সন্তান আমার রক্তের হবে না, অন্যের সন্তানকে কখনো নিজের সন্তান বলা যায় না! দু’দিন আগে আর পরে সেই সন্তান ঠিকই আমাদের ছেড়ে চলে যাবে!
— সিমা এর জবাব কী দিবে বুঝে উঠতে পারলো না, শুধু বললো তুমি কী চাও?
— আমি কী চাইবো! বাবা-মা’র সাথে এসব নিয়ে কথা হয়েছে, তারা যা বলেছে তাই-ই তোমাকে বললাম! আমার কিছু চাওয়ার নেই, আর পাওয়ারও নেই! এসব বলে সিফাত বাসা থেকে ওদের অফিসে চলে গেলো।
সারাদিন সিমা সংসারের কাজ করে, সবার মন মতো চলার চেষ্টা করে, ইচ্ছে করেই কাজে ডুবে থাকে যাতে অন্য কথাগুলো ভেবে ভেবে কষ্ট না পায়, দিন শেষে রাত আসে কিন্তু সিফাত একবারও সিমাকে ফোন দেয় না, প্রতিদিন দেরী করে বাড়ি ফেরা এখন সিফাতের অভ্যাস হয়ে গিয়েছে। যে কোনো কথায় সিমার উপর রেগে যাওয়া যেনো নিত্তনৈমত্তিক ব্যাপার!
এভাবেই কিছুদিন পার হলো, একদিন সিমা সিফাতকে রাতের বেলা রুমের মধ্যে বসিয়ে জিজ্ঞেস করলো..
—কি হয়েছে তোমার? তুমি কেমন যেনো হয়ে গিয়েছো, ঠিক মত কথা বলো না, বাসায়ও দেরী করে আসো, কয়েকবার ফোন করেও তোমাকে পাওয়া যায় না, আমার কোনো ভুল বা অন্যায় হলে বলো, আমি নিজেকে শুধরে নিবো, কিন্তু তুমি এমন করলে আমার খুব কষ্ট হয়, আমার প্রতিটি মুহূর্ত বিশাল পাহাড়ের মত আমাকে ঘিরে রাখে, নিশ্বাস নিতে পারিনা! দয়াকরে বলবে, কি হয়েছে তোমার? কি চাও তুমি ?
—আমি কী চাই! তা তুমি সত্যই জানতে চাও? তুমি বোঝো আমি কী চাই, আমার চাওয়া নিয়ে তোমার কোনো চিন্তা আছে, যদি আমাকে নিয়ে ভাবতে তাহলে সবই বুঝতে, সিফাত একটু উচ্চস্বরে কথাগুলো বলে উঠলো!
—আমি তো তোমাকে নিয়েই ভাবি, আমার জীবন তোমাকে কেন্দ্র কর ঘুরে, তোমার ভালোবাসা দিয়েই তো আমার জীবনের সুখ। বলো, তোমার কী চাওয়া, সব আমাকে বলো, আমি তোমার চাওয়াগুলোকে পরিপূর্ণ করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো, তবুও তোমার মুখে হাসি দেখতে চাই!
— তুমি বুঝেও না বোঝার ভান করো, তুমি বোঝো না আমি কী চাই? আমার সন্তান লাগবে , নিজের সন্তান, নিজের রক্তের! আর কতদিন আমি সন্তানহীন থাকবো?
সারাজীবন কী শুধু অন্যদের সন্তান দেখে দেখে জীবন পার করবো?
—সিমা চুপ করে রইলো কতক্ষণ, মনের মধ্যে কেমন একটা কু ডাকলো! দু’চোখে আধার নেমে এলো , ও খুব করে বুঝতে পারলো সিফাত কী চাচ্ছে, বুকের ভিতরে সাইক্লোন বইতে লাগলো, মুখের ভাষা আটকে গেলো, কিছু বলার অবকাশ ছিলো না তখন ওর!
—হুম, জানতাম তুমি কিছুই বলবেনা, তোমার তো জীবন নিয়ে কোনো ভাবনা-ই নেই, আমার খুশি দিয়ে তুমি কী করবে? শুধু মুখে বলো ভালোবাসি, আর অন্তরে সেটা নিয়ে কোনো চর্চা-ই নেই.. সিফাত কথাগুলো খুব অভিমান নিয়ে বললো।
—আচ্ছা, তবে কী তুমি আরেকটি বিয়ে করতে চাও? বিয়ে করতে চাইলে বিয়ে করতে পারো, তাছাড়া তো আর কোনো উপায় নেই সন্তান হওয়ার, আমি তো আর মা হতে পারবোনা!
— সত্যি বলছো, তোমার কোনো আপত্তি নেই তো, তুমি অনুমতি দিচ্ছো আমাকে বিয়ে করার? বিশ্বাস করো, আমি তোমাকেই ভালোবাসি, তোমাকেই ভালোবাসবো সব সময়, তুমি আমার কাছে যেমন ছিলে এতদিন তেমনি থাকবে, তোমার কোনো অসম্মান বা অবহেলা কখনোই হবে না, আমি তোমার সিফাত তোমারই থাকবো। আমার শুধু একটি সন্তান প্রয়োজন, অন্য কিছু না। আমার ঘরে যেই মেয়ে-ই আসুক না কেনো সে কখনোই তোমার বরাবর হবে না, তার সাথে আমার সম্পর্ক শুধু সন্তানের জন্য হবে, কোনো ভালোবাসা থেকে নয়!
এসব কথা বলতে বলতে সিফাত সিমাকে জড়িয়ে ধরে রাখলো!
— আমি শুনেছি দ্বিতীয় বিয়ে করলে ছেলেরা অনেক বদলে যায়, প্রথম স্ত্রীকে অনেক অবহেলা করে, তুমিও যদি এমন হয়ে যাও?
— কী যে বলো, তা কখনোই হবে না! আমি কখনো বদলে যাবোনা, তুমি দেখে নিও!
—আমি তোমাকে অনুমতি দিচ্ছি বিয়ে করার, আমার এতে কোনো আপত্তি নেই, আচ্ছা আমি বাবা-মা’র সাথে কালকেই কথা বলবো এই ব্যাপারে, তুমি এখন ঘুমাও, কথাগুলো সিমা এমনভাবে বললো যেনো এটা একদমই নরমাল একটা ব্যাপার!
শুধুমাত্র সিমা টের পাচ্ছিলো বুকের যন্ত্রনার রাক্ষুসে থাবা, যা বুকটাকে চিড়ে চিড়ে খাচ্ছে! সারা রাত জেগে রইলো সিমা, চিন্তা করলো একথা কিছুতেই ওর আব্বা-আম্মাকে জানানো যাবেনা, আম্মা এসব শুনলে অসুস্থ হয়ে যাবে আর আব্বা এখানে থাকতে দিবে না একদমই, ও সিফাতকে ছেড়ে কোথাও গিয়ে শান্তি পাবে না।
সিমার অন্ধ ভালোবাসা-ই সিমার দুর্বলতা হলো, সিফাতের ইচ্ছে ছিলো পরিবেশটা এমন করে তৈরী করবে যাতে সিমা-ই বাধ্য হয় বিয়ের কথা বলতে, আর তাই হলো! সিমা বিষয়টা বুঝতে পেরেছিলো তবে তা অনেক সময় পরে!
পরের দিন সকাল বেলা সিমা ওর শশুড়-শাশুড়ির রুমে গেলো..
— বাবা আপনাদের জন্য একটা খুশির খবর আছে, আপনাদের ছেলে তো আরেকটি বিয়ে করতে রাজী হয়েছে, পাত্রী দেখা শুরু করে দিন!
— কী বলছো এসব, তোমার কী মাথা ঠিক আছে? যা বলছো ভেবে বলছো তো, সায়রা বানু বলে উঠলো।
— জ্বী মা, সত্যিই বলছি, সে বলেছে আরেকটি বিয়ে করবে, আর আমিও অনুমতি দিয়েছি।
— সত্যিই তুমি অনুমতি দিয়েছো, পাগলের মত কী বলছো, সকাল সকাল উল্টাপাল্টা কী শুরু করে দিলে, সিফাতের বাবার প্রশ্নবিদ্ধ চোখ সিমার দিকে!
— না, বাবা কোনো উল্টাপাল্টা বলছি না, আমি একদম সত্যটাই বলছি!
— আচ্ছা তাই নাকি তাহলে তো সিফাতের সাথে কথা বলতে হয়, এটা কোনো কথা হলো! একথা বলেই সিফাতের বাবার ঠোঁটের কোঁণায় হাসি ফুটে উঠলো!
সিমা সেই হাসি খুব স্পষ্ট ভাবে দেখতে পেলো! হাসির রেখাটা ওর হৃদয়ে এসে কাঁটার মত করে বিঁধলো।
একদিন পর,
ভাবী, ভাবী .. ইরা ওর শশুড় বাড়ি থেকে এসে সিমাকে জোড়ে জোড়ে ডাকা শুরু করলো…
কী হয়েছে, এভাবে ডাকছো কেন? আগে বসো, কেমন আছো তুমি? একটা ফোন দিয়ে আসবে না? সব কিছু ঠিক আছে তো? সিমার একের পর এক প্রশ্নে ইরা রেগে গেলো।
— আহ্, চুপ করো তো ভাবী, আমি ঠিক আছি, এখন তুমি বলো- তুমি ঠিক আছো? তোমার মাথায় কী কোনো প্রবলেম আছে? তুমি কী বলেছো মা’কে, ভাইয়্যাকে আরেকটি বিয়ে করাবে? এসব কোন ধরনের নোংরামি, নিজেকে মানুষের কাছে হাস্যকর বানাতে ল্জ্জা লাগছে না তোমার? তোমার কী মনে হয়, তুমি ভাইয়্যাকে বিয়ে করালে তোমার সুখের দিন আসবে? তোমার কপাল পুড়বে, তুমি নিঃশ্বেষ হয়ে যাবে। এখনি বলে দাও, তুমি এসব এমনেই বলেছো, তুমি চাওনা সে বিয়ে করুক!
— না ইরা, এটা আর বলা সম্ভব না, তোমার মত করে তো তোমার ভাইয়্যা চিন্তা করে না আমাকে নিয়ে, তার সন্তান লাগবে, সে বাবা হতে চায়, বিয়ের এগারো বছর হতে চললো এখনো মা হতে পারলাম না, আমার প্রবলেমের কারনে সে কেন পিতার সুখ থেকে বঞ্চিত হবে বলো! সে নিজেই বিয়ে করতে চাচ্ছে, আমাদের সম্পর্কও সেই আগের মত নেই, অনেক কিছুই বদলে গিয়েছে!
— ভাবী তাই বলে এমন একটা সিদ্ধান্ত নিবে? ভালোবাসা কী এমনি ঠুনকো বিষয়, সন্তানের জন্য তা নষ্ট হয়ে যাবে!
— সিফাত একদিন না একদিন তো বিয়ে করতই, এখন হয়তো আমি নিজেই বলেছি আর পরে হয়তো একা একাই করে নিতো, তখন তো আমার কষ্টটা বেশি হতো!
ভালোবাসাটা আসলে একটা গাছের মত, একটা গাছ বেঁচে থাকার জন্য সূর্যের আলো লাগে, কার্বন-ডাই অক্সাইড ও পানি লাগে, কোনো একটা কিছু ঘাটতি হলেই কেমন ফ্যাকাশে হওয়া শুরু করে গাছটি ঠিক তেমনি আমাদের ভালোবাসাও সন্তানের অভাবে ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছে! তা আর ঠিক হবে না! কারন সন্তানের অভাব আমি কখনোই পূরণ করতে পারবো না!
— কাজটা ঠিক করছো না ভাবী, তোমার জীবনের খারাপ সময় তুমি নিজেই ডেকে আনতে যাচ্ছো!
এখনো সময় আছে ভাইয়্যাকে বুঝাও! একথা বলে ইরা ওর মা’য়ের রুমে চলে গেলো, কিছুক্ষণ পর বের হয়ে এলো রাগান্বিত হয়ে, তোমাদের সবার মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে, তোমরা সব পাগল হয়ে গিয়েছো, যা ইচ্ছে করো, একটা কেন দশটা বিয়ে করাও তোমাদের ছেলেকে , এসব বলতে বলতে ইরা বাসা থেকে বের হয়ে গেলো, শত ডেকেও ওকে ফিরানো গেলো না!
সিমা জানে, ইরার কথায় কোনো ভুল নেই, সিফাত কী সত্যিই ওকে ভুলে যাবে? নাকি সেদিন রাতে যা যা বলেছে সব কিছুই সত্য বলেছে, সিমা আর ভাবতে পারছে না, দু’ চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে ওর।
সিফাত, আমি একবার একটু ডাক্তারের কাছে যেতে চাচ্ছিলাম, আরেকবার একটু কথা বলতে চাই, আর তুমিও না বলেছিলে আমরা ইন্ডিয়াতে যাবো ট্রিটমেন্টের জন্য, কবে যাবে কিছু ভেবেছো?
সিমার কথা শুনে সিফাত সাফ বলে দিলো, এখন এসব আপাতত বাদ দাও। পরে দেখা যাবে, আর ডাক্তারের কাছে গিয়ে কী হবে, তিনি তো যা বলার বলেই দিয়েছে! আর ইন্ডিয়া যাওয়ারও তেমন কোনো প্রয়োজন দেখছি না আমি!
সিমা সিফাতের কথা শুনে অবাক হয়ে গেলো, যে মানুষটা দিনের পর দিন কোথায় কোন ডাক্তার ভালো আছে খুঁজে খুঁজে বের করে আমাকে নিয়ে যেতো, আমি যেতে না চাইলেও জোড় করে বুঝিয়ে শুনিয়ে বাধ্য করতো যেতে আর সে কিনা আজকে একথা বলছে!
সিমা আর কিছুই বললো না!
দু’তিন দিন পর সিমার কানে এলো সিফাতের জন্য পাত্রী খোঁজ করা হচ্ছে, আরো আগে থেকেই হচ্ছিলো কিন্তু সিমা কিছুই জানেনা! বিষয়টা কেমন অস্বাভাবিক লাগলো সিমার কাছে, তাহলে কী তারা আমি অনুমতি দেয়ার আগে থেকেই পাত্রী দেখা শুরু করেছে, আর যা যা আমার সামনে সবাই বলেছে সবই লোক দেখানো….!!!
চলবে…