তুমি আমার বাসা থেকে বের হয়ে যাও। তোমার সঙ্গে সংসার করা আর আমার পক্ষে সম্ভব না।
ছেলের রুম থেকে এই ধরনের চিৎকারে আমি বিচলিত হলাম। রোহান এবং নাতাশার সম্পর্ক কিছুদিন ধরেই ভালো যাচ্ছে না। আমার ছেলে রোহান একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরি করে। নাতাশা চাকরি করে একটা এন জি ও তে। দুইজনই ভালো চাকরি করে। তারা প্রেম করে বিয়ে করেছে। পাঁচ বছরের সংসার। বিয়ের পর আমি তাদের ভালবাসা দেখে মুগ্ধ হতাম। তাদের টাইমলাইন ভরে থাকতো যুগল ছবিতে।
যদিও ভালোবাসায় আমার বিশ্বাস অতি সামান্য। যে জিনিস একসময় শেষ হয়ে যায় তাকে কেন্দ্র করে পুরো জীবন ঘুরপাক খাওয়াকে আমার বেশ অযৌক্তিক মনে হয়। তবুও আমার ছেলের ভালোবাসা দেখে আমার মনে হতো পৃথিবীতে নিশ্চিত ব্যতিক্রম বলে কিছু আছে।
আমার এবং তিতাসের সংসার জীবনের পঁয়ত্রিশ বছরের পূর্তি হবে এই সেপ্টেম্বরে। সেই নিয়ে আমাদের বেশ প্ল্যানও আছে। রোহান, নাতাশাও আমাদের বেশ উৎসাহ দিচ্ছে একটা অনুষ্ঠান করার জন্য। আমার কাছেও মন্দ লাগছে না। নানান অনুষ্ঠানের মাধ্যমে নিজেকে ব্যস্ত রাখাই আমার কাছে ইদানীং জীবন মনে হয়। জীবনের সমাপ্তি ঘটতে পারে যেকোনো সময়, শুধু থেকে যাবে কিছু স্মৃতি।
রোহান নাতাশার সঙ্গে ঝগড়া করছে নাতাশার এক বন্ধুকে নিয়ে। রায়হানের সঙ্গে নাতাশার বেশ ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। তারা একসঙ্গে লং ড্রাইভে যায়, সিনেমা দেখে, গল্প করে, গান শুনে। সারাদিন তারা বহুবার কথা বলে। এইসব কিছু রোহান নাতাশার কল লিস্ট থেকে, তার অফিস থেকে এবং রায়হানের বন্ধুদের থেকে বের করেছে। আমার ভাতিজাও নাকি ওদের নৌকায় ঘুরতে দেখেছে ৩০০ ফিটে।
এতসব অভিযোগের পর নাতাশা তেমন কোন উত্তর দেয়নি। সে শুধু বলেছে রায়হান তার খুব ভালো বন্ধু। এবং দুইজন বন্ধু এমন সময় কাটাতেই পারে তাতে দোষের কিছু নেই। রায়হানের প্রতি তার ভালবাসা নেই। আছে গাড় বন্ধুত্ব। তাই নাতাশার মন খারাপ হলে সে রায়হানের সঙ্গে ঘুরে বেড়ায়।
রোহানের অভিযোগ পরিষ্কার। তোমার মন খারাপ হলে তুমি আমাকে বলবে। ওকে বলার কি আছে? আর তুমি যে এই ঘুরে বেড়িয়েছ কখনো আমায় বলেছো? অনুমতি নিয়েছো? তার সঙ্গে তুমি লং ড্রাইভে যাবে। তাহলে আমাদের সম্পর্কে বিশ্বাসের জায়গাটা কোথায়? তোমার কল লিস্ট থেকে এটা পরিষ্কার যে তার সঙ্গে তুমি সারাদিন অনেকবার কথা বলো। তোমার সঙ্গে ওর ভালোবাসা, প্রেম। আর যেখানে তোমার সঙ্গে ওর প্রেম সেখানে আমার কোন স্থান নেই। তাহলে এই সম্পর্ক টানার কোন মানে হয় না।
এত ঝগড়া ঝাটির মধ্যেও আজকে নাকি নাতাশা, রায়হানের সঙ্গে দেখা করেছে। রোহান আজ সারাদিন তাদের পিছু নিয়েছিলো। তারা একসঙ্গে বসে বার্গার কিং এ লাঞ্চ করেছে এবং নাতাশা নাকি অনেক কান্না করেছে। রায়হান তার চোখের পানি মুছে দিয়েছে।
রোহান বাসা থেকে বের হয়ে যাচ্ছে বলতে বলতে
আমি তোমাকে অনেক বিশ্বাস করেছিলাম, অনেক ভালবেসেছিলাম। তুমি আমার বিশ্বাস ভঙ্গ করেছো, আমার ভালোবাসাকে তুচ্ছ করেছো। আমি আর তোমাকে চাই না।
আমার ইচ্ছে করছে ছেলেকে ডেকে থামাই। তারপর ভাবলাম থাকুক কিছুক্ষণ মন খারাপ করে। জীবনে দুঃখ, কষ্টকে আপন করে নিতে জানতে হয়।
আমি ভাবছি তিতাস এবং আমার জীবনে এমন ঝগড়া খুব একটা হয়নি। কেন হয়নি? আসলেই কি আমি সারাজীবন ওর প্রতি বিশ্বস্ত ছিলাম? আমার জীবনে কি কখনো স্খলনহয়নি? অথবা তিতাসের জীবনেও কি কখনো প্রেম ভালোবাসা আসেনি?
আমার জীবনে স্থলনতো হয়েছে।
দূরবীন উপন্যাসের হেমকান্তের জীবনে রঙ্গময়ীর ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য। এটাকে জমিদার হেমকান্তের স্খলনহিসেবেই সবাই ধরে নেয়। কিন্তু দেখা যায় হেমকান্তের জীবন রঙ্গময়ী ছাড়া অপূর্ণ ছিলো। সেই সময়ের সামাজিক প্রেক্ষাপটে জমিদার হেমকান্তকে বিপত্নীক দেখানো হয়েছিল।
কিন্তু এই ব্যাপারটা ধ্রুব সত্য যে একজন মানুষ সারাজীবন ধরে অপর একজন মানুষকে ভালবাসতে পারে না। সম্পর্ক জোয়ার ভাটার মতো। একসময় তারা একে অপরের প্রতি আগের টান অনুভব করে না। কথা বলার বিষয় পাওয়া যায় না। তবুও আমরা কেন জানি এই ব্যাপারটাকে মানতে নারাজ। আমাকে তাকেই ভালবাসতে হবে। জীবনের সব কথা তার সঙ্গেই বলতে হবে।
আমি ভাবছি এই ষাট বছরের জীবনে আমার স্খলনহয়েছে বেশ কয়েকবার। বিয়ের সাত বছর পর আমি দিনার প্রেমে পরেছিলাম। বেশ ভালোভাবেই পরেছিলাম। ওর সঙ্গে কথা না বললে ভালো লাগতো না। তার সঙ্গে ঘুরতে যাওয়া, হাত ধরে বসে থাকা কি অসাধারণ লাগতো। সাদামাটা দিনগুলো কি সহজেই রঙ্গিন হয়ে উঠতও। তখন কি আমি তিতাসের সঙ্গে খারাপ ছিলাম? না মনে পরছে না। বরং ভালোই ছিলাম। তিতাসের সঙ্গে নিত্য নতুন গল্প করতাম। জীবনে গল্প করার বিষয়টা কিভাবে জানি আবার ফিরে এসেছিলো। কিন্তু ঐ যে ভালবাসায় আমার বিশ্বাস নেই। তাই দিনার সঙ্গে সম্পর্ক থেকেও আমি বেরিয়ে এসেছিলাম। পঁয়ত্রিশ বছরের বিবাহিত জীবনে এক সন্ধ্যায় অফিসের কলিগ সাদিয়াকে বাসায় পৌঁছে দেয়ার সময় তাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খাওয়ার ঘটনাও ছিলো। কিছুদিন সাদিয়ার প্রেমে বুঁদ ছিলাম। মিমির প্রেমে পরি যখন আমার বয়স পঞ্চাশ। সেই প্রেম ছিলও কথা বলার প্রেম। মেয়েটা আমার চাইতে বিশ বছর ছোট ছিলো। কিন্তু কি উচ্ছ্বাস, আবেগ দিয়ে কথা বলতো। আমি মুগ্ধ হয়ে শুনতাম।
তিতাস কোনদিন আমার উপর তেমন গোয়েন্দাগিরি করেনি। হয়তো সে আমার পরিবর্তনগুলো ধরতে পারতো না। হয়তো তার কাছে আমি সবসময় বর্নহীণ একজন মানুষ ছিলাম। যার মধ্যে প্রেম ভালবাসার বালাই নেই। অথচ কি অদ্ভুত ব্যাপার আমি তিতাসের উপর নজর রাখতাম। প্রায় তার মোবাইল, ম্যাসেঞ্জার চেক করতাম। আমি জানি তিতাসও বেশ কয়েকবার প্রেমে পরেছিল।
বান্টির সঙ্গে তার ম্যাসেজ দেখে আমি ভাবতাম তিতাস হয়তো আমাকে ছেড়ে চলেই যাবে। তারা প্রচুর ম্যাসেজ দিতো একে ওপরকে। একদিন আমি হিসেবে করেছিলাম। সারাদিনে ৬২৬ টা ম্যাসেজ। কি নিয়ে তাদের কথা হতো না। গল্প, কবিতা, নাটক, সিনেমা, আমাকে নিয়ে কথা হতো।
সেখানে কি অবলীলায় তিতাস লিখতো
আমি তার মতো না। আমার সঙ্গে তার যায় না। সে পছন্দ করে তার ঘর খুব সুন্দর সাজানো, গুছানো হবে, ইন্টেরিয়র দিয়ে ছবির মত বাড়ি হবে আর সেখানে এসব বিষয়ে আমার আগ্রহ অতি সামান্য। তার মনে হতো তার খুব সুন্দর গাড়ি হবে আর সেখানে আমার চলার মত একটা গাড়ি হলেই হয়।
বান্টি যখন লিখতো
তিতাস তোমায় আমি ভালোবাসি।
তিতাসও উত্তর দিতো।
তোমাকে আমারও ভাল লাগে বান্টি। তোমার সঙ্গে কথা বলে বড় শান্তি পাই।
বান্টি লিখতো
আসো আমরা কিছু সময় একসঙ্গে নিভৃতে কাটাই। উত্তাল হই।
তিতাস তাতে রাজি হত না।
না বান্টি তোমাকে আমার ভালোলাগে হয়তো ভালো ও বাসি। কিন্তু এই কাজ করলে গিলটি ফিলিংস হবে যে।
তিতাস আমার সঙ্গে স্বাভাবিক আচরণ করতো। কিন্তু মাঝে মাঝে তার নিজের অজান্তে হেসে ফেলা হাসি দেখে আমি বুঝতাম বান্টিকে মনে করে সে হাসছে। মেয়েদের মন কি অদ্ভুত। তার মনে একজন বাস করে। কিন্তু সে সংসার করে আরেকজনের সঙ্গে।
কেউ একজন তার মনকে স্পর্শ করেছে এটাকে সে পাপ মনে করে না। কিন্তু শরীরকে স্পর্শ করাকে সে পাপ মনে করে।
এই পঁয়ত্রিশ বছরের দীর্ঘ বিবাহিত জীবনে তিতাসের জীবনে অনেক ভালোলাগা এসেছে। এমনকি তুষারের সঙ্গে একদিন বাইরে ঘুরতে গিয়ে তাদের চুমু খাওয়ার গল্পও আমি পড়েছি। কখনো কখনো আমার মনে হতো তিতাসকে জিজ্ঞেস করি। তাকে ছেড়ে দেই। তারপর মনে হতো স্খলন সবার হয়। আমি যেখানে একেই দোষে দোষী ওকে জিজ্ঞেস করে কি হবে? কাটুক না এইভাবে জীবন। জীবনে জটিলতা বাড়িয়ে লাভ কি? যে জটিলতা আমাদের সন্তানের উপর প্রভাব ফেলবে। জীবনে টানাপোড়ন এসেছে আবার তা ঠিক হয়েছে। কখনো অস্থির হয়ে খারাপ আচরণ করেছি আবার ঠিকও হয়েছি। আচ্ছা তিতাস যদি আমার ব্যাপারগুলো জানতো ও কি করতো?
এখন আমরা বেশ ঘুরে বেড়াই। আজকে সন্ধ্যায় আমাদের কক্সবাজার যাওয়ার ফ্লাইট। দুইজন সমুদ্রের পাড়ে বসে সমুদ্র দেখবো। তার বিশালতাকে উপভোগ করবো।
আমি বাসার ছাঁদে গেলাম আমি জানি সেখানে রোহান থাকবে। রোহান মন খারাপ করে বসে আছে। তার চোখে কিছু অশ্রুকণাও দেখতে পাচ্ছি।
আমি বললাম
বাবা বিবাহিত জীবন খুব অদ্ভুত। দুইজন অপরিচিত মানুষ বড় স্বপ্ন নিয়ে একসঙ্গে থাকা শুরু করে। আসলে গোড়াতেই গলদ। বিবাহিত জীবন নিয়ে বড় স্বপ্ন দেখার কোন অর্থ নেই। বরং স্বপ্নগুলো ছোট ছোট হলে এই জীবনটা মধুরে হতে পারতো। তুমি কি আসলেই নাতাশার মতো? নাতাশার যা ভালো লাগে তা কি তোমার ভালো লাগে?
বাবা।
তুমি কি জানো নাতাশার বেশ ঘুরতে ভালো লাগে। তোমার ঘুরা পছন্দ না। ওর খুব কেয়ারিং ভালো লাগে তুমি কিন্তু কেয়ারিং টাইপের ছেলে না। ওর খুব ভালো লাগে কেউ একজন রাতের বেলায় ওর সঙ্গে পার্কে হাটুক। কিন্তু হাটার চাইতে তুমি ঘুম পছন্দ করো। ও চায় কেউ একজন ওকে সারপ্রাইজ দেক। কিন্তু তুমি একদম সারপ্রাইজ দিতে জানো না। ওর বৃষ্টি ভালো লাগে তোমার শীত। ওর আম ভালো লাগে আর তোমার ফল একদম পছন্দ না। ওর শপিং করতে ভালো লাগে আর তোমার ঝামেলা মনে হয়। আমি শুনেছি তুমি শারীরিক ভাবেও তেমন সক্রিয় না। ও তোমাকে অনেকবার ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে চেয়েছি। কিন্তু তুমি যেতে নারাজ। এই যে এত বিপরীত ভালো লাগা তবুও তুমি চাও যে নাতাশা সবকিছুকে সহ্য করে শুধু তোমার সঙ্গে থাকুক। তার চাইতে তুমি কেন তার মত হতে পারছো না?
বাবা এগুলো আমার ভাল লাগে না।
হুম আমার সন্তান এটাইতো সমস্যা। আমাদের সঙ্গীর যা ভাল লাগে তা আমাদের ভালো লাগে না। আমরা শুধু চাই সেটা আমার সঙ্গী বুঝুক, আমাকে মেনে নিক। আমি মানতে পারবো না। তুমি যে সেদিন ঈশিতার সঙ্গে নর্থ ইন্ডে কফি খেলে তা কি তুমি নাতাশাকে বলেছো? সে সময় তুমি যে ঈশিতার হাত ধরেছিলে তা কি ওকে বলেছও?
বাবা তুমি জানো কিভাবে?
জানি বাবা। আজ তুমি বলনি অথবা ও তা জানে না বলে তুমি ওকে একের পর এক নীতি কথা শুনাচ্ছো। এটা ঠিক না। আমাদের স্খলন হয়। জীবনের নানা সময়ে নানান কারণে হয়। তবুও তার জন্য জীবনের গতিপথ পরিবর্তন করতে নেই। জীবনে কোথাও এবং কারো কাছে পুরো সমাধান নেই। সবার কাছে আছে ভাঙ্গা ভাঙ্গা সমাধান। তাই বৃথা কারো কাছে পুরো সমাধান খুঁজতে যাওয়া বোকামি। তুমি কি নাতাশাকে ভালোবাসো?
খুব।
তাকে ছেড়ে দিতে পারবে?
খুব কষ্ট হবে।
তাহলে এমন কাজ করতে যেও না। বরং যতটুকু পারো তার মত হতে চেষ্টা করো। সম্পর্ককে বাঁচিয়ে রাখতে শিখো। পৃথিবীতে সবকিছুকে দেখতে নেই। সবকিছুকে ধরতে নেই। জীবনকে সুন্দর করার একমাত্র শর্ত হচ্ছে একে এতো সিরিয়াসলি নেয়ার কিছু নেই। একে হাল্কা ভাবে নিতে হয়। তার মধ্যেই আনন্দ খুঁজে নিতে হয়।
স্খলন
#আমিনুলের_গল্প_সমগ্র।