#শারমিন আঁচল নিপা
আনহারি চামচ দিয়ে পায়েস না খেয়ে বাটি ধরে খাচ্ছে। এমনটা কেবল আমার বড়ো আপা করত। মানুষের চেহারার সাদৃশ্য মানা যায় তবে আচরণের সাদৃশ্য গুলো কেন মানতে পারছি না। আনহারি কোনোভাবে আমার বড়ো আপা নয়তো? এসব ভেবেও আমি চুপ করে রইলাম। কথা বললাম না। হয়তো বড়ো আপার ঘোরে আছি তাই এমনটা মনে হচ্ছে। আমি আর কিছুই যেন নিতে পারছিলাম না। ঠিক তখনই চোখ পড়ল আনহারির হাতের কনুইয়ের দিকে৷ একটা কাটা দাগ যেটা বড়ো আপারও ছিল৷
আমার স্পষ্ট মনে আছে আমি আর বড়ো আপা শালুক তুলতে গিয়েছিলাম বিলে। ক্ষুধার জ্বালায় অনেক সময় শালুক তুলে খেতাম আমরা। সেদিন শালুক তুলতে গিয়ে আপার কনুইটা বাশের কন্চি দিয়ে কেটে যায়। সে কি রক্ত যাচ্ছিল। আমি তখন আপাকে দূর্বা ঘাস চিবিয়ে ঘাসের রস করে দিয়েছিলাম। এটা কী করে সম্ভব আনহারির হাতেও একই দাগ। আমি এবার কিছুটা নড়েচড়ে আনহারির দিকে তাকিয়ে বললাম
“আচ্ছা সত্যি করে বলেন তো আপনি কী আমার বড়ো আপা? এই যে কনুইয়ের দাগটা আপনার হাতে সেটা কীভাবে হলো? আমার বড়ো আপারও একই রকম একই আকৃতির দাগ। চেহারার সাদৃশ্য মানা যায়। তবে সবকিছুর সাদৃশ্য আমি কেন মানতে পারছি না৷ আমি কেন আপনাকে বারবার আমার আপা ভাবছি। [এটেনশন যে পেইজ থেকে গল্প পড়ছেন আপনারা পেইজটা লক্ষ্য করুন। যদি পেইজের নাম শারমিন আঁচল নিপা না হয় তাহলে দয়াকরে ঐ পেইজ থেকে গল্প না পড়ে রিয়েল লেখিকার পেইজ সার্চ দিয়ে পড়ুন। এরা কপি করছে]
আনহারি আমার কথা শুনে হালকা হেসে বলল
” মাঝে মাঝে দুটো মানুষের মাঝে একই স্বত্ত্বা বসবাস করে। হয়তো এজন্য তোমার বড়ো আপার সাথে আমার এত মিল। অন্যথায় তো এত মিল হত না তাই না। সময় হয়তো সব সামনে আনবে। তুমি বিষয়গুলো নিয়ে অনেক চিন্তা করছো তাই এমনটা হচ্ছে। তুমি যদি চিন্তা কমিয়ে বিচক্ষণ ভাবে সব ভাবতে তাহলে অনেক কিছুই স্পষ্ট হয়ে যেত। অস্থিরতা মানুষের স্বাভাবিক বোধ শক্তি কেড়ে নেয়। তোমার বেলাতেও তাই হচ্ছে। এত অস্থির না হয়ে পায়েস টা শেষ করো। আমি একটু ঘুমাব। সকাল থেকে আমার ঘুম হচ্ছে না। চোখগুলো আর খুলতে পারছি না ঘুমের জন্য। তুমি চায়লেও খাওয়া শেষ হলে আমার পাশে ঘুমাতে পারো। আর কালকে সকালে রওনা দিব তোমার গ্রামের উদ্দেশ্যে। এখন আর এসব নিয়ে কথা না বলি। যতই কথা বলছি ততই সব গুলিয়ে যাচ্ছে। “
আনহারির কথা শুনে আমি চুপ হয়ে গেলাম। আর কথা বাড়ালাম না। সময়ের অপেক্ষা করতে লাগলাম। আনহারি খাওয়া শেষ করে শুয়ে পড়ল। আর আমিও খাওয়া শেষ করে শুয়ে পড়লাম।
দুজনের ঘুম ভাঙলো বিকেল বেলা। আনহারি চা নিয়ে বসেছে৷ আমি উঠতেই বলে উঠল
“পাশের টেবিলে খাবার রাখা আছে খেয়ে নিও। আর আমি আমার কাপড়চোপড় গুছিয়ে নিয়েছি। তোমার তো সব গুছানো। রাতটা কোনোরকম পার করে সকালে আমরা তোমাদের গ্রামে যাব। সব প্ল্যান তোমাকে রাতে বুঝিয়ে দিব। কী করতে হবে কী করা উচিত। এবং আমাদের লক্ষ্য কী।”
আমি একটা লম্বা হাই তুললাম। তারপর মাথা নেড়ে সম্মতি প্রকাশ করলাম। একটু ফ্রেশ হয়ে নিলাম। তারপর টেবিলে রাখা খাবারগুলো খেয়ে নিলাম। এ বাসায় খাবার এবং আরামের অভাব নেই। কিন্তু যেটার অভাব আছে সেটা হচ্ছে বিশ্বাস আর ভালোবাসার। আমজাদ সাহেবের ঘটনাটা আমার ভীষণ বলতে মন চাচ্ছে। কিন্তু ঘটনা যদি উল্টো মোড় নেয় তাই কিছুই বলছি না। সব মিলে চুপ হয়ে বসে আছি।
দিন পেরিয়ে রাত নামল। আমার একটায় চাওয়া এ অমানিশা কেটে সত্যটা সামনে আসুক। বড়ো আপার অত্যচারকারীরা শাস্তি পাক। জানি না সেখানের কী অবস্থা? তারা সেখানে আছে কি’না তাও জানি না। অস্থির অস্থির লাগছে শুধু। এ অস্থিরতা যেন কাটছেই না। আনহারি বিভোড় ঘুমে মগ্ন। আমার ঘুম আসছে না৷ এ ঘরের শীতল এসিও আমার সহ্য হচ্ছে না৷ গরমে হা হুতাশ করে ঘুমিয়ে অভ্যাস৷ হুট করে এত শীতলতা যেন আমাকে গ্রাস করছে৷ আশেপাশে কোনো কাঁথা নেই। তাই বাধ্য হয়েই রুমের বাইরে গিয়ে বসার সিদ্ধান্ত নিলাম।
পা টিপে টিপে আমি রুম থেকে বের হলাম। ড্রইং রুমের একটা চিপায় বসে রইলাম। হঠাৎ করে আধো আধো আলোতে লক্ষ্য করলাম আমজাদ সাহেব ঘর থেকে বের হচ্ছেন৷ কেমন যেন সন্দেহ লাগল। তিনি এত রাতে নিশ্চয় ব্যবসার কাজে যাচ্ছেন না৷ আর গেলেও নিশ্চয় পরিপাটি হয়ে যেতেন। এভাবে ঘরের জামা কাপড় পরে যেতেন না। সব মিলিয়ে আমার সন্দেহ বেড়ে গেল। উনি বের হওয়ার পর পরই আমি পা টিপে বের হলাম। উনি গ্যারেজের দিকে যাচ্ছেন। আমি সেখানের একটা পাশে দাঁড়িয়ে রইলাম। একটা সাদা গাড়ির কাছে গেলেন৷ গাড়িতে কী যেন করছেন। তারপর কিছুক্ষণ থেকে সেখান থেকে চলে আসলেন।
আমিও তার পিছু নিয়ে আবার গৃহে প্রবেশ করলাম৷ ড্রইং রুমের এক ফাঁকে লুকিয়ে গেলাম। তিনি সোফায় বসে সিগারেট ধরালেন। তারপর মালিহাকে কল দিলেন। তার সাথে আস্তে গলায় কথা বললেও বেশ জোরে শুনা যাচ্ছিল। কারণ পুরো জায়গাটা নিস্তব। সে আস্তে গলায় বলল
“আনহারি কীভাবে বেঁচে গেল সেটা আমি বুঝতেছি না। তবে তাকে আবার উপরে পাঠানোর ব্যবস্থা করেছি। গাড়ির ব্রেকটা কেটে দিয়েছি। আমি জানি সে সাদা গাড়ি নিয়েই বের হবে। কারণ এটা তার পছন্দের গাড়ি। আর বিকেল বেলা লক্ষ্য করেছিলাম সে কাপড় গুছাচ্ছে। জিজ্ঞেস করেছিলাম কোথায় যাবে, বলল একটা গ্রামে ঘুরতে যাবে। আর এ সুযোগটায় কাজে লাগালাম। ভেবেছিলাম আমি সকল সম্পত্তির মালিক হব তোমাকে বিয়ে করে সুখী শান্তিতে ঘর করব ডার্লিং। এখন আর সেটা সহজে হচ্ছে না। মৃত মানুষ কী করে বেঁচে উঠে।”
অপর পাশ থেকে বলে উঠছে
“আমি নিজে আনহারিকে গাড়ি চাপা দিয়েছিলাম। তাকে নিজের হাতে খু/ন করেছিলাম৷ ফিংগার প্রিন্ট যেহেতু ম্যাচ হয়েছে এটা আনহারিই। কিন্তু এটা কী করে সম্ভব। এ মেয়ে মরে গিয়ে বেঁচে ফিরল বিষয়টা সত্যিই অদ্ভুত। সমস্যা নেই ও যতবার বাঁচবে আমি ঠিক একইভাবে ততবার তাকে খুন করব৷ আমার জীবনের একটায় লক্ষ্য এ আনহারি ভবনের রাণী হওয়া। তোমার সাথে সংসার করা৷ আনহারির একটা ব্যবস্থা করেই তোমাকে বিয়ে করব। মনে আছে তো কাবিন হিসেবে ভবনটা আমাকে লিখে দিবে তো।”
“জান সব কিছুই তো তোমার হবে। তবে আনহারি বেঁচে থাকতে নয়। আনাহারি মারা গেলে আনাহরির মাকে আস্তে আস্তে পাগল বানিয়ে সব লিখে নিব। কিন্তু দুই বছরে যখনই সব রেডি করলাম তখন এ মেয়ে উড়ে এসে জুড়ে বসল।”
অপর পাশ থেকে রাগী কণ্ঠ ধেয়ে আসলো
“দু বছরে পারোনি। দু’শ বছরেও পারবে বলে মনে হয় না। আমি তোমাকে দু মাস সময় দিলাম এর মধ্যে যা করার করো।”
“ডার্লিং রাগ করো না। আমি দেখছি।”
ফোনটা কেটে গেল। আমজাদ সাহেব ফোনটা কান থেকে নামিয়ে টি টেবিলে রাখল। তারপর সোফায় হেলান দিয়ে বসে রইল চুপ হয়ে। আমি কেবল ভাবছি নারীর ছলনা কত প্রখর হলে একটা পুরুষ বুঝছে না। এ নারী চায় আমজাদ সাহেবের সম্পদ। অথচ আমজাদ সাহেব এত বুদ্ধিমান হয়েও সেটা ধরতে পারছে না। এ নারীর মোহে পড়ে নিজের সন্তানকেও খু/ন করতে পিছ পা হচ্ছে না। আগের বার এমন কাহিনি করার জন্যও তার মনে কোনো অনুসূচণা নেই। নেই কোনো ভ্রূক্ষেপ। নারীর ছলনা সত্যিই অনেক ভয়ংকর।
কিন্তু বিপাকে পড়লাম আমি উনি না উঠা পর্যন্ত এখান থেকে নড়তে পারছি না। উঠতেও পারছি না। উঠলেই ধরা পড়ে যাব। কী করব সেটাই চিন্তা করছি। তবে চিন্তা করার আগেই ধরা পড়ে গেলাম। আমাজাদ সাহেব আমার হাতটা চেপে ধরে বসা থেকে উঠালেন। তারপর রুষ্ঠ গলায় জিজ্ঞেস করলেন
“এখানে কী করছিস? আমাকে ফলো করছিস? তোর এত বড়ো স্পর্ধা। আমজাদ সাহেবের সাথে লাগতে আসিস।”
আমি আমতা আমতা করে উত্তর দিলাম
“আমার তে এসির বাতাস সহ্য হচ্ছিল না। তাই এখানে এসে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। সত্যিই আমি কিছু জানি না। আপনাকে ফলোও করিনি। আমি তো ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।”
আমার কথা শুনে তিনি হাতটা ছেড়ে দিলেন। আর বাড়াবাড়ি করলেন না। স্বাভাবিক গলায় বললেন
“হুম।”
এতটুকু বলেই তিনি ভেতরে চলে গেলেন।
আমি আর এখানে ঘুমানোর সাহস পেলাম না। আবারও আনহারির রুমে চলে গেলাম। সেখানে গিয়ে কাঁপতে কাঁপতেই এক পর্যায়ে ঘুমিয়ে গেলাম।
সকাল বেলা ঘুম ভাঙলো চিৎকার চেঁচামেচিতে। চিৎকার উৎস বরাবর বাইরে বের হয়ে লক্ষ্য করলাম আমজাদ সাহেব সিলিং ফ্যানে ঝুলছে।