আম্মা আমার আব্বাকে ডিভোর্স না দিয়েই দ্বিতীয় বিবাহ করেছিল। আম্মার বয়স তখন পঁয়তাল্লিশ। এ বয়সে তিনি এ কাজ করবেন বিষয়টি একদম কল্পনারও বাইরে ছিল। সবচেয়ে জঘন্য ব্যপার ছিল আম্মা যাকে বিয়ে করেছিলেন তার বয়স ছিল মাত্র ৩৪। বয়সের এত ফারাক হওয়া মহিলাকে সে ছেলে কেন বিয়ে করেছিল সে সময়, আমি এর সঠিক ব্যখ্যা দিতে পারব না। কারণ আম্মার কোনো নিজস্ব সম্পত্তি ছিল না। আম্মার এ কান্ডতে আমার বড়ো আপার সংসারে টান পুরাণ পড়ে। আমার আব্বা ভেঙে পড়ে। আর আমার অবস্থা নাই বা বললাম। আমার সদ্য ঠিক হওয়া বিয়েটা ভেঙে যায়। সব মিলিয়ে আমি এবং আমার পরিবারের বাকি সদস্য একদম ভেঙে পড়ি। মাকে ভীষণভাবে বুঝানোর চেষ্টা করি তুমি যা করেছো এটা ভুল। তবে মা সেটা মানতে নারাজ। তার ভাষ্যমতে তার মনের মিল এখানে হয়েছে সে এখানেই সুখে আছে। সে খুশি হবে যদি আমরা তাকে বিরক্ত না করি।
টানা ১ মাস বুঝিয়ে লাভ হলো না। আমার নাছোরবান্দা মা আমাদের থেকে তার সুখকেই প্রাধান্য দিল। এত বছরের সংসারে মায়ের কোনো কিছু খারাপ আমাদের চোখে পড়ে নি৷ মায়ের চরিত্র , আচার আচরণ, ব্যবহার সব কিছুই উত্তম থেকে উত্তম বলা যায়। তবে সে মা হুট করে কেন এমন সিদ্ধান্ত নিল সেটাই বুঝতে পারিনি।
১ মাস বুঝানোর পর আমরা যখন ক্লান্ত তখন মায়ের আশা আমরা ছেড়েই দিয়েছি। আমার বোনের একটা মেয়ে সন্তান আছে। তার শ্বশুড় বাড়িতে সে একমাত্র ছেলের বউ। আমার মায়ের এসব কান্ড কারখানায় তারাও আমার বোনকে খুটতে লাগল। আমার বোনও বাধ্য হয়ে বাপের বাড়ি চলে আসলো। দুলাভাই এরপর যদিও এসেছিল দুইবার নিতে। তবে আপা যায় নি। এরপর আপার যেন কী হলো, একদম চুপ হয়ে গেল। একদিন হুট করে আপার হার্ট এটাক হলো। আর আপা একদম ঘরে পরে গেল। তখন আপার তিন বছরের মেয়ের দেখাশোনার দায়িত্ব পড়ে আমার উপর। আমি আর বাবা মিলেই আপাকে আর তার সন্তানকে আগলে রেখেছি।
আপার এ অবস্থার সম্পর্কে মাকে কল করে অভিহিত করেছিলাম। মা আসে নি। সে চায় না এখানে এসে তার জীবনের কোনো জটিলতা বাড়াক। সে চায় শান্তি। একদম কড়া করে বলে দিয়েছে আমাদের মৃত্যু হলেও যেন আমরা কখনও তার সাথে যোগাযোগ না করি৷ সে আমাদের মরা মুখও দেখতে আসবে না। আমাদের প্রতি কিসের এত ক্ষোভ ছিল আজও জানতে পারলাম না।
মায়ের এ কথাগুলো আমার নিকট পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্যের মতোই ছিল। কারণ আমার মা আমাদের জন্য সারাটা জীবন খেটেছে। আর এ মা একটা ছেলের জন্য বদলে যাবে এটা মানা ভীষণ কঠিন থেকে কঠিনতর ছিল। বিভীষিকা আমাকে ঘিরে ধরে খু’বলে খাচ্ছে যেন এসব দেখার পর।
এরপর আরও ১ মাস কাটে। সবকিছু স্বাভাবিক করার চেষ্টা চলছে। আপার চিকিৎসাও চলছে। বাবা কিছুটা ভেঙে পড়লেও সবটা মানিয়ে নিয়েছিল। আমার ক্ষেত্রেও তাই।
সময় আরও কিছুদিন কাটল। একদিন খবর আসলো মায়ের কা’টা লা’শ পাওয়া গেছে। কা’টা লা’শ বলতে শুধু ম’ন্ডুটা পাওয়া গেছে। যতই হোক মা তো। সব অভিমান ভুলে মাকে দেখতে গেলাম। মায়ের কা’টা মাথায় কেবল সুচ বসানো ছিল। মনে হয়েছিল কেউ হয়তো মাকে কালুজাদু করে হ’ত্যা করেছে। মা তার বর্তমান স্বামীর বাসায় মা’র্ডার হয়। তার বর্তমান স্বামীও আত্ম’হনন করেছিল। একসাথে তাদের উদ্ধার করা হয়। তবে মায়ের বডিটা আর পাওয়া যায়নি। ধারণা করা হয়েছিল মাকে মেরে হয়তো তার বর্তমান স্বামী আত্মহনন করেছে। এটা কেবল ধারণায় ছিল। সত্যিটা এখনও প্রকাশ পায়নি।
এরপর কেটে গেল দীর্ঘ বছর। বাবা মারা গেল। আপাও সুস্থ হয়ে দুলাভাইয়ের সাথে দেশের বাইরে স্যাটল হলো। আর আমি এ দেশে একলা হয়ে পড়লাম। সবার জীবন সুন্দর হলেও আমার জীবনটা বিভীষিকার আধার থেকে বের হয়নি। যখন কেউ আমার এসব অতীত জানে তখন কেউ আমার সাথে থাকে না। একটা সময় বুঝতে পারি আমি সবার সাথে মেশার যোগ্য না। তাই নিজেকে গুটিয়ে ফেলি। আস্তে আস্তে একা করে ফেলি। আর এ একাকীত্বই আমাকে কুঁড়ে কু্ঁড়ে নি:শ্বেস করে দিচ্ছে।
আমি এখন শান্তিতে ঘুমাতে পারি না। আমার একটু শান্তির ঘুম দরকার ডাক্তার। আমার জীবনে শান্তি দরকার। আমার শরীরে অশান্তি ছড়িয়ে পড়েছে। এটা নির্মূল করা দরকার ডাক্তার। আমাকে শান্তির ঔষধ দিন।
ডাক্তার যুক্তি সামনে থাকা রোগীর কথা শুনে একদম চুপসে গেল। এমন ভয়ংকর অতীতও কারও থাকতে পারে সে বিশ্বাস করতে পারছে না। সামনে থাকা মেয়েটাকে দেখে মনে হচ্ছে না তার মনে এত ক্ষত। অপরূপ সুন্দরী বলতে কোনো বিশেষণের বাস্তবতা যদি থাকে তাহলে এ মেয়ের ক্ষেত্রে নির্দ্বিধায় প্রয়োগ করা যাবে।
যুক্তি এবার তার দিকে তাকিয়ে আবারও জিজ্ঞেস করল
“আপনার নাম যেন কি?”
উত্তর আসলো
“অনন্যা”
“বয়স?”
“৩৫”
যুক্তি অনন্যাকে দুবার নাম জিজ্ঞেস করেছে। একবার জিজ্ঞেস করেছিল সে চেম্বারে ঢুকার পরপরই। এবং সে সয়ম সে নামটা প্রেসক্রিপশনে লিখেছিল সে সাথে বয়সটাও। এরপর তার ঘটনা শুনার পর পুনরায় জিজ্ঞেস করে এটাই যাচাই করতেছিল সে স্বজ্ঞানে এগুলো বলছে কি’না। নাকি তার হ্যালুসিনেশন হচ্ছে। কিন্তু অনন্যার সাথে সে কথা বলে বুঝতে পারল সে যা বলছে সত্যি। যুক্তি আবারও প্রশ্ন করল
“কোথায় থাকেন এখন? আর যে ঘটনাটা বললেন কত বছর আগের?”
অনন্যা হালকা হেসে বলল
“খুব বেশি না.. বছর পনেরো তো হবেই।”
যুক্তি বুঝতেছে না কোথায় থেকে কী করবে। এমন রোগী তার কাছে প্রথম। চিকিৎসাবিদ্যায় সে বেশিদিন পা রাখে নি। বছর দুয়েক হবে। এর মধ্যে অনেক ধরণের রোগীর সম্মুখীন হয়েছে সে। কিন্তু অনন্যার মতো এমন রোগীকে সে ফেইস করেনি। তাই কিছুটা দ্বিধান্বিত হয়ে অনন্যাকে বলল
“আপনার সমস্যাটা জটিল। কাউন্সিলিং দরকার। আপনার চিকিৎসার সুবিধার্থে আমার একজন সিনিয়র স্যার অনুভূমিক প্রান্তর কাছে আপনাকে রেফার করলাম। উনার এড্রেস সহ সকল কিছু আমি লিখে দিলাম। রাতে কল দিয়ে আমি স্যার কে জানিয়ে দিব৷ কাল সকাল দশটায় আপনি উনার চেম্বারে চলে যাবেন।”
অনন্যা মাথা নাড়ল। এরপর প্রেসক্রিপশন টা হাতে নিয়ে সরাসরি চেম্বার ছেড়ে চলে গেল। অনন্যায় যুক্তির শেষ রোগী ছিল। তাই বেশ সময় নিয়ে সে অনন্যার সাথে কথা বলতে পেরেছে। নাহয় অন্য রোগীর চাপে এত সময় নিয়ে কথা বলার সুযোগ ছিল না। অনন্যা চলে যাওয়ার পর সে সব গুছিয়ে চেম্বার থেকে বের হয়ে সরাসরি গাড়িতে উঠল বাসায় যাওয়ার উদ্দেশ্য। তবে গাড়িতে বসে সে বারবার অনন্যার কথা ভাবছে। একজন মহিলার হুট করে পরিবর্তন হয়ে বিয়ে করাটা স্বাভাবিক। তবে কেন ঐ ছেলেটা মহিলাকে বিয়ে করল। এতে ছেলেটার স্বার্থ কী ছিল? কারণ অনন্যার মায়ের নিজস্ব কোনো সম্পত্তিও ছিল না। তারপরও ভালোবাসা নামক শব্দের জন্য বিষয়টি মেনে নিলেও পরবর্তী বিষয়টির অংক কষা বেশ কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে। যেমন কেন সে ছেলেটি আত্মহনন করল? অনন্যার মায়ের বডি কোথায়? অনেক প্রশ্নই জাগছে তার মনে। তবে এটা ভুলে গেলে চলবে না সে একজন ডাক্তার। ইনভেস্টিগেশন করা তার দায়িত্ব না।
মাথা থেকে বিষয়টা ঝাড়তে চায়লেও সে পারছিল না। গাড়ির হালকা ব্রেকে যুক্তির ঘোর কাটল। ড্রাইভার যুক্তিকে বলে উঠল
“ম্যাডাম বাসায় চলে এসেছি।”
যুক্তি সকল চিন্তা বাদ দিয়ে গাড়ি থেকে নেমে বাসায় প্রবেশ করল। বাসায় প্রবেশ করেই তার বাসার একটা কোণে নজর গেল। আর সাথে সাথে চমকে উঠল।
বড়ো আপা ২ পর্ব ১
#শারমিন আঁচল নিপা
প্রাবাসী ভাইদের কাছে অনুরোধ, আপনারে কমপক্ষে ১টি এড এ ক্লিক করবেন