#শারমিন আঁচল নিপা
অনন্যা আর আমি দুজন জমজ বোন। তবে ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে আমি আর সে আলাদা পরিবেশে মানুষ হয়েছি। সে মানুষ হয়েছে অজ পাড়াগাঁয়ে না খেয়ে, না পরে। আর আমি মানুষ হয়েছি এ আনহারি ভবনের বিলাসিতায়। সৃষ্টিকর্তা আমাদের মাঝে এ কঠোর বিভাজনটা সৃষ্টি করেছিল আমাদের বাবার কর্মফলের জন্য। বাবার প্রথম স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও একটা কাজের জন্য গিয়েছিল অনন্যা যে গ্রামে বড়ো হয়েছিল সে গ্রামে। সেখানে মায়ের সাথে বাবার পরিচয়, প্রেম, পরিণয়। মা অবশ্য জানত না বাবার আরেকজন স্ত্রী আছে৷ তাই বিয়ের পর তাদের সংসার বেশ শান্তিতেই যাচ্ছিল। তবে সে সুখ মায়ের কপালে বেশিদন টিকে নি। আমাদের বড়ো মা মানে বাবার প্রথম স্ত্রী বাবার দ্বিতীয় বিয়ে সম্পর্কে জেনে ফেলে। এরপর তার শর্তসাপেক্ষে বাবা আমার মাকে ছেড়ে চলে যায়। বাবা গোয়েন্দা বিভাগে চাকুরি করত। তাই বাবার পরিচয়টা গ্রামের মানুষ জানতে পারেনি। সেজন্য বাবা চলে যাওয়ার পর বাবাকে আর খোঁজ করতে পারেনি কেউ। এরমধ্যে মা অন্তঃসত্ত্বা হয়। মা শেষ ভরসায় বাবার একটা ঠিকানায় জানত সে ঠিকানায় মায়ের প্রেগন্যান্ট হওয়ার ব্যাপারে চিঠি লিখে পাঠায়। তবে ভাগ্য সহায় ছিল না। মায়ের প্রেগন্যান্সির কথা জেনে মাকে তাড়াহুড়ো করে একটা গরীব ঘরে বিয়ে দিয়ে দেয় আমার মামা । যাতে করে গ্রামের মানুষ যা’তা বলতে না পারে।
আর এদিকে মায়ের বিয়ের পর বাবার কাছে চিঠিটা পৌঁছায়। অপরদিকে বাবা জানতে পারে তার প্রথম স্ত্রী মা হতে পারবে না। অপরদিকে মায়েরও অন্যত্র বিয়ে হয়ে গেছে তাই চাইলেও মাকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব না। তাই বাবা চেয়েছিল সন্তান জন্মদানের পর তার কাছে নিয়ে যেতে। কিন্তু এতে আরও সমস্যা বাড়ত। কারণ কোনোভাবে এ ঘরের লোকেরা যদি জানত মায়ের সন্তান এ ঘরের না তাহলে মায়ের ডিভোর্স হয়ে যেত। সেজন্য মামা, বাবাকে হাত জোড় করে এই বাচ্চার দাবি যেন সে না করে। এদিকে একটা সময় পর বাবা জানতে পারে মায়ের জমজ বাচ্চা হবে। তাই তিনি মামাকে অনুরোধ করে একটা বাচ্চা যেন তাকে দেয়। বিনিময়ে মামাকে টাকা দিবে,বিদেশ যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিবে। মামা তাতে রাজি হয়ে যায়। সবার অজান্তে এমনকি মায়ের অজান্তেই আমাকে তুলে দেওয়া হয় আমার বাবার হাতে। যিনি বর্তমানে আমার মামা পরিচয়ে আছেন। আমি আমার মা লাবন্য জোহার ভাইয়ের মেয়ে।
এখান থেকে কাহিনি নেয় নতুন মোড়। বাবা চেয়েছিল তার প্রথম স্ত্রীকে বলবে আমাকে সে এডপ্ট করে দেশ থেকে নিয়ে এসেছে। যেহেতু তারা বিদেশ স্যাটল হয়ে গিয়েছিল। সেজন্য আমাকে তিনি দেশ থেকে বিদেশেও নিয়ে যায়। এদিকে আমার বর্তমান মায়ের বাচ্চা সেসময় প্রসবের সময় হয়। তার শারিরীক অবস্থার অবনতির জন্য তাকে ইমারজেন্সি নেওয়া হয় বিদেশ। সেখানে তার বাচ্চা মারা যায়। আর তখনই আমার বাবা তার বোনের হাতে তার বোনের প্রাণ বাঁচাতে আমাকে তুলে দেয়। আর তার বাচ্চা মারা যাওয়ার বিষয়টি চেপে যায়। এভাবেই আমি চলে আসি এ পরিবারের মেয়ে হয়ে।
আমি বড়ো হই বিলাসিতা ঘেরা জীবনে। অপরদিকে আমার বোন অনন্যা বড়ো হয় দরিদ্রতায়। আমাদের মায়ের পরের ঘরে ফিয়নার জন্ম হয়। ফিয়না আমাদের সৎ বোন।
এবার প্রশ্ন জাগতে পারে আমাদের একসাথে হওয়া আর অনন্যার নিঁখোজ হওয়ার ব্যাপারটি। অনন্যা যে পরিবারে বড়ো হয়েছে সেটা নিম্নবিত্ত হওয়ায় মা অনন্যাকে টাকা দেখে তার থেকে দ্বিগুণ বয়সী একজন সাইকোর কাছে বিয়ে দেয়। যার কাজেই ছিল বিয়ে করে মেয়েদের অত্যাচার করা। অনন্যার আগেও তার দুটো বউ ছিল। সবকিছু মেনে অনন্যা চেয়েছিল সংসার করতে। তবে তার স্বামী দীপক তাকে মিথ্যা অপবাদ দিয়ে ডিভোর্স দেয়।
এরপর অনন্যাকে পাওয়া যায় জাম গাছে ঝুলন্ত অবস্থায়। সবাই এটাকে আত্মহত্যা বললেও এটা ছিল খু/ন। যেটা বারো বছর পর উদঘাটন করা হয়। এ খু/নের সাথে অনন্যার শ্বশুড় বাড়ির লোকজন যুক্ত ছিল সাথে আমাদের মা। তাই মা এখন জেলে আছে। মা খু/ন করে নি। তবে খু/ন হয়েছে দেখার পরও টাকার লোভে সবটা চেপে যায়। স্পটে মা ছিল। আর মায়ের অনন্যার প্রতি রাগ ছিল কারণ সে সময় সে অন্ত:স্বত্ত্বা ছিল বলেই তাড়াহুড়ো করে গরীব ঘরে বিয়ে দিয়েছিল। আর সেজন্য সে অনেক কষ্ট করেছে বাকি জীবন।
ঘটনার অলৌকিকতায় সেদিন লাশ উদ্ধারের পর হাসপাতালে নিয়ে গেলে জানা যায় অনন্যা মারা যায় নি। সে বেঁচে আছে। কারণ অনন্যাকে শ্বাসরোধ করে খুন করার চেষ্টা চলে। তাই সে সেন্সলেস হয়ে যায়। পরবর্তীতে জাম গাছে ঝুলিয়ে দিলেও তার পা গাছের একটা ডালে ঠেঁকে ছিল তাই তার প্রাণ যায়নি।
সে বেঁচে যায় তবে সেটা অজানায় রাখা হয়। কারণ অনন্যার স্বামীর পরিবার প্রতাপশালী ছিল। যদি জানতে পারে বেঁচে গেছে তাহলে আবারও মেরে ফেলবে। তাই সে সময় অনন্যার লাশ পাল্টে বেওয়ারিশ লাশ দেওয়া হয়৷ আর আত্মহত্যা করেছে এটা গ্রামবাসী জানার পর তার লাশ দাফন করতে দেওয়া হয়নি। কোনোরকম একটা জায়গায় তার পালিত বাবা পুঁতে দিয়েছিল। তাই লাশ পরিবর্তনের ব্যাপারটাও কেউ বুঝেনি।
আর হাসপাতালে যার কাছে লাশটা পৌঁছায় সে ছিল আমার পরিচিত। আমাকে কল দিয়ে সে নিশ্চিত হয় এটা আমি কি’না। এদিকে আমি জানতে পেরেছিলাম আমার মতো একজন দেখতে আছে। সেটা জেনেছিলাম দেশের বাইরের একটা আর্ট প্রতিযোগিতায়। সেখানে বিভোর নামের একজন অনন্যার ছবি এঁকেছিল। সেটা আমার ছবি মনে করি। তাই বিনা অনুমতিতে ছবি আঁকার অপরাধে কমপ্লেইন করার পর সবটা জানতে পারি। জানতে পারি আমার মতো দেখতে তাদের গ্রামে একজন আছে।
এরপর অনন্যার ব্যাপারে খুটে খুটে সব জানি। অনন্যাকে এরপর বহুদিন চিকিৎসা করিয়ে মোটামুটি সুস্থ করে আমার বর্তমান মায়ের কাছে আমি সাজিয়ে পাঠাই। কারণ আমি দেশের বাইরে ছিলাম৷ ভেবেছিলাম দেশে ফিরে এসে একটা সারপ্রাইজ দিব সবাইকে। কিন্তু আমার বর্তমান বাবা যে ছিলেন মানে লাবন্য জোহার স্বামী ওয়াজেদ চৌধুরি পরকিয়ার জের ধরে রোড এক্সিডেন্ট করিয়ে অনন্যাকে মেরে ফেলে।
এরপর আমি আসি অনন্যার খুনের প্রতিশোধ নিতে৷ সে প্রতিশোধের জের ধরেই ফিয়নার সাথে দেখা। অবশেষে অনন্যার সাথে অন্যায়কারী সবাইকে শাস্তি দিতে সক্ষম হই৷ প্রতিশোধ নেওয়া শেষ হওয়ার পর আমরা অনন্যার উপস্থিতি বিভিন্ন জায়গায় টের পাই। সবসময় ভাবতাম এটা আমাদের মনের ভুল। তবে বারবার প্রমাণিত হয় এটা আমাদের মনের ভুল না। এই যে দেখুন আপনিও দেখেছেন তাকে। তাহলে বলুন অনন্যা বেঁচে আছে আপনার মনে হয় না?
যুক্তি হালকা নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল
“আমি চেম্বারে যাকে দেখেছি সে দেখতে পুরোপুরি আপনার মতোই। তবে তার অতীত তো আপনাকে বললামেই। তার অতীতের সাথে আপনার বলা অতীতের কোনো মিল নেই। তার বলা অতীত তার সাথে ঘটেছে পনেরো বছর আগে। তার বর্তমান বয়স ৩৫। কিন্তু আপনার বলা ঘটনার সাথে সে ঘটনার কোনো সাদৃশ্য নেই। বুঝতেছি না এ ঘটনাগুলোর সাথে কোনো যোগসূত্র আছে কি’না।”
আনহারি হালকা দম ছেড়ে বলল
“আমি জানি না আপনার চেম্বারে আসা মেয়েটি সত্যিই কে? অন্য নাম হলেও হয়তো বলতাম আপনার চোখের দেখার ভুল। কিন্তু নামও অনন্যা বলেছেন। তাহলে এত ভুল কী করে হবে একটা মানুষের?”
যুক্তির মাথাও ঘুরছে। সব তলিয়ে যাচ্ছে তার। কী হচ্ছে, কেন হচ্ছে কিছুই যেন বুঝতে পারছে না সে। এর মধ্যেই অনুভূমিক প্রান্ত কল দিল। যুক্তি কলটা ধরতেই তিনি বললেন
“আপনার রোগী এত রাতে এসেছেন। আচ্ছা সারাদিন কি উনার সময় ছিল না? আশ্চর্য ব্যাপার আপনার রোগী এসেছেন এত রাতে আমার কাছ থেকে চা খেতে। যাইহোক কথা বলে দেখি। আপনাকে আমি আপডেট দিব।”
যুক্তি কথাটা শুনে হুড়মুড়িয়ে বলল
“ওর সাথে গল্প করুন। আমি এখনই আসতেছি।”
কথাটা বলেই ফোনটা কেটে দিল। যুক্তির এমন আগ্রহ দেখে অনুভূমিক প্রান্তও কিছুটা অবাক হলেন। কিছুটা বিস্ময় নিয়ে ফোনটা হাত থেকে টেবিলে রেখে পাশ ফিরে তাকালেন। সাথে সাথে তার বিস্ময় যেন আরও বেড়ে গেল।
এদিকে আনহারিকে যুক্তি বিষয়টি খুলে বলল। আনহারির তর যেন সয়ছে না। সে রুদিতাকে বাসায় রেখে গেল। বাসার দুজন হ্যাল্পিং হ্যান্ডকে ফিয়নার পাশে বসতে বলল। তারপর তারা রওনা দিল অনুভূমিক প্রান্তর বাসার উদ্দেশ্যে।
খুব দ্রূতই তারা পৌঁছে গেল। কিন্তু সেখানে ঘটে গেল রহস্যময় ঘটনা।
কপি করা নিষেধ