#শারমিন আঁচল নিপা
সেখানে গিয়ে তারা লক্ষ্য করল সোফায় একটি মেয়ে বসে আছে তবে সেটা অনন্যা না। অনুভূমিক প্রান্ত তার সাথে বসে চা খাচ্ছেন আর কথা বলছেন। যুক্তির উপস্থিতি টের পেয়ে সে পাশ ফিরে তাকাল। তাকিয়েই আনহারিকে দেখে একটু চমকালো। এর কারণ হলো যখন সোফায় বসে থাকা মেয়েটি ঘরে প্রবেশ করে তখন সেটা আনহারির মতোই দেখতে ছিল। কিন্তু ফোন রাখার পর মেয়েটির চেহারা পরিবর্তন হয়ে যাওয়া তাকেও বেশ ভাবায়। তখন মনের ভুল বলে বিষয়টি এড়িয়ে যায়। অনুভূমিক প্রান্ত যুক্তির দিকে তাকিয়ে আনহারির দিকে ইঙ্গিত করে হালকা গলায় বলল
“মেয়েটি কে?”
যুক্তি হালকা একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল
“এটা অনন্যার জমজ বোন আনাহারি। কিন্তু আপনি তো বলেছিলেন অনন্যা এসেছে। তাহলে উনি কে?”
অনুভূমিক প্রান্ত কী বলবে বুঝতে পারছে না। এমন একটা বিষয় রোগীর সামনে বললে রোগীই তাকে মানসিক বিকারগ্রস্ত ভাবতে পারে। আর এটা বিশ্বাসযোগ্য বিষয়ও ছিল না। তাই সেটা তার দৃষ্টিভ্রম মনে করে এড়িয়ে যায়। কিন্তু তবুও একটা কথা থাকে। যদি সেটা তার দৃষ্টিভ্রমই হয় তাহলে সে কেন আনহারির মতো দেখতে মেয়ে দেখেছিল। কারণ আনহারির মতো কাউকে তো সে আগে দেখিনি। সে দেখলে যেকোনো একটা কমন ফেইস দেখতে পারত। সব যেন গুলিয়ে যাচ্ছে তার। তবুও নিজেকে স্বাভাবিক করে যুক্তিকে উত্তর দিল
“তুমি তো আমাকে উনার কথায় বলেছিলে। উনিই তো অনন্যা।”
যুক্তি অবাক হয়ে গেল অনুভূমিক প্রান্তর কথা শুনে বিস্ময় নিয়ে বলল
“উনি কেন অনন্যা হবে? অনন্যা দেখতে আনহারির মতো। আমার চেম্বারে যে এসেছিল তিনি সে নয়।”
এদিকে সোফায় বসে থাকা মেয়েটি আপন মনে চা খাচ্ছে। এখানে কি নিয়ে কথা হচ্ছে এতে তার কোনো মাথা ব্যথা নেই। সে তার মতো করেই চা খেয়ে যাচ্ছে। যুক্তি মেয়েটির দিকে তাকাল। মেয়েটিকে উদ্দেশ্য করে বলল
“আপনি কে? সেদিন তো আপনি আমার চেম্বারে যান নি৷ আপনাকে তো আমি চিনি না। আর আপনি স্যারের ঠিকানা কোথায় পেয়েছেন? স্যারের ঠিকানা তো আমি অনন্যাকে দিয়েছিলাম। কে আপনি যে আমার নাম করে স্যারের বাসায় এত রাতে চা খেতে এসেছেন৷ আমি তো আপনাকে চিনি না। আপনি আমাকে চিনেন কী করে?”
মেয়েটির পাল্টা উত্তর আসলো। মেয়েটির উত্তর শুনে যুক্তি নিজেই থমকে গেল। মেয়েটি উত্তরে বলল
“আপনাকে তো আমিই দেখিয়েছিলাম। আমিই অনন্যা। আর আপনিই তো উনার ঠিকানা দিয়েছিলেন। আমার এত রাতে একা একা বাসায় ভালো লাগছিল না৷ তাই উনার সাথে একটু চা খেতে এসেছিলাম। আপনি আমাকে চিনতে কেন পারছেন না?”
যুক্তির মাথা থেকে বিষয়টা সরছেই না৷ সে একটু রুড হয়ে বলতে লাগল
“আপনি অনন্যা না। অনন্যা অন্য একটা মেয়ে। আপনি অনন্যা সেজে এসেছেন৷ আমি কী পাগল নাকি যে আমি চিনতে পারব না। আমি তো মানসিক রোগী না বরং রোগীর চিকিৎসক। আমাকে ফাঁকি দেওয়া এত সহজ না৷ বলুন অনন্যা কোথায়? আমার চোখ ফাঁকি দেওয়া এত সহজ কথা না। আবারও বলছি বলুন অনন্যা কোথায়?”
যুক্তি কথাগুলো বলতে বলতেই হুট করে আক্রমণাত্মক হয়ে উঠে। মনে হচ্ছিল তাকে কেউ হিপনোটাইস করেছে। নিজের উপর তার কন্ট্রোল চলে যায়। সে হুট করেই মেয়েটির গায়ে হাত তুলতে চলে যায়। যুক্তির এ অবস্থা দেখে অনুভূমিক প্রান্ত আর আনহারি তাকে ধরে একপাশে নিয়ে আসে। সে আরও উদ্ধত হয়ে যায়। তাকে অনুভূমিক প্রান্ত স্বাত্ত্বণা দিয়ে বলে
“তুমি শান্ত হও। আমি বিষয়টি দেখছি।”
মিনেট দুয়েকের মধ্যেই যুক্তি একদম সুস্থ হয়ে যায়। সে স্বাভাবিক হয়ে অনুভূমিক প্রান্তকে জিজ্ঞেস করল
“আমাকে ধরে এভাবে বসে আছেন কেন? আর মেয়েটি কোথায়? আমাদের কোথাও একটা ভুল হচ্ছে। এই মেয়েটি সেই মেয়ে না।”
বলেই পাশ ফিরে তাকাল। তিনজনেই লক্ষ্য করল মেয়েটি আর নেই সেখানে। তিনজনেই কিছুটা অবাক হলো। তাদের ধারণা মেয়েটি যুক্তিকে সামলানোর সময় চলে গিয়েছে সুযোগ পেয়ে। যুক্তিকে আনহারি বলে উঠল
“হঠাৎ করে তোমার কী হয়েছিল? এতটা এগ্রেসিভ হয়ে গেলে? তুমি কী এখন ঠিক আছো?”
যুক্তি নিজেও বুঝতেছে সে কেন এমন করল। আর এটাও তার মাথায় ঘুরছে এ যদি অনন্যা হয় তাহলে তার চেম্বারে কে এসেছিল? সব কিছুই তালগোল পাঁকিয়ে যাচ্ছে তার। যুক্তি হালকা গলায় উত্তর দিল
“আমি জানি না আমি কেন এমন করেছি।”
তখন অনুভূমিক প্রান্ত যুক্তিকে স্বাত্ত্বণা দিয়ে বলল
“এখানে আমাদের তিনজনেরেই হয়তো হ্যালুসিনেশন হয়েছে। কিছু কিছু মানসিক রোগ আছে যা সবার মধ্যে খুব সহজে ছড়িয়ে পড়ে। তোমার চেম্বারে হয়তো এ মেয়েটিই এসেছিল। তার যে রোগটা সেটা তোমার সাবকনসিয়াস মাইন্ডকে সে মুহুর্তে দখল করে ফেলেছিল । সেজন্য হয়তো তুমি তাকে আনহারির মতো কল্পনা করেছিলে। এখন এটা মনে আসতে পারে তুমি তো আনহারিকে আগে দেখোনি। তাহলে এরকম কল্পনায় কেন আসবে। মাঝে মাঝে আমাদের জীবনে এমন কিছু ঘটে যেটার ব্যখ্যা থাকে না। এই যে ধরো আমরা মাঝে মাঝে স্বপ্ন দেখি। দেখা যায় কিছুদিন বা কিছু বছর পর আমাদের সাথে একই জিনিস ঘটে। এটাও ঠিক এরকম। এখানে তুমি অনন্যার মতো কাউকে কল্পনা করেছিলে। আর সে সত্যি সত্যি বাস্তবে আনহারি হয়ে চলে এসেছে। আর সেটা এসেছে খুব দ্রূত তাই অদ্ভুত লাগছে তোমার কাছে বিষয়টি।”
যদিও অনুভূমিক প্রান্ত নিজেও জানে বিষয়টিতে কড়া রহস্যে মিশে আছে। তবুও যুক্তির মনোযোগ সরাতে এগুলো বলা। যুক্তি একটু স্বাভাবিক হলো। যুক্তি স্বাভাবিক হলে আনহারি যুক্তিকে বাসায় যাওয়ার প্রস্তাব দেয়। আনহারির প্রস্তাব মেনে যুক্তি রাতেই অনুভূমিক প্রান্তকে বিদায় দিয়ে বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়৷ কারণ রুদিতাকেও সে বাসায় রেখে এসেছে। ফিয়নাও অসুস্থ। তাড়াতাড়ি বাসায় যাওয়া জরুরি। আনহারি গাড়ি ড্রাইভ করছে। যুক্তি আনহারিকে জিজ্ঞেস করল
“আচ্ছা তোমার কী মনে হচ্ছে সত্যিই আমরা সবাই হ্যালুসিনেট করছি?”
আনহারি গাড়ি চালাতে চালাতে বলল
“কিছুই বুঝতে পারছি না। যতবার অনন্যার উপস্থিতি আমি টের পেয়েছি ততবারেই কিছু অদ্ভুত বিষয় ঘটেছে। আজকেও ঘটল। আর সবচেয়ে বড়ো বিষয় হচ্ছে যে মানুষটা আমাদের সামনে আসতে চাচ্ছে না তাকে আসলে জোর করে আনা সম্ভব না। আমার মনে হয় অনন্যা বেঁচে থাকলেও আমাদের সাথে সে লুকোচুরি খেলেই মজা পাচ্ছে। আর যদি মারা যায় তাহলে অন্য কেউ আমাদের সাথে মাইন্ড গেইম খেলছে। কিছু তো একটা আছে। যেটা গত তিন বছরেও আমি বুঝতে পারছি না। হয়তো ঐভাবে ঘাটিনি৷ নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম। এখন মনে হচ্ছে একটু ঘাটাঘাটি প্রয়োজন। তোমার চেম্বারে এসে অনন্যা যে অতীত বলেছে সেটা তো বানোয়াট। এদিকে আবার এখানে অন্য একটা মেয়ে নিজেকে অনন্যা দাবি করছে। সবকিছুই এলোমেলো লাগছে। এসব নিয়ে না ভাবি আজ। কাল থেকে এসব নিয়ে ভাবা শুরু করব।
এদিকে কখন যে তাদের মধ্যে সম্বোধন আপনি থেকে তুমি হয়ে গেছে তাদেরেই হয়তো খেয়াল নেই। দুজনের দুজনকে বেশ আপন লাগছে। গাড়িটা হালকা ব্রেক কষে দাঁড়াল। পুরো বাড়িটা অন্ধকার হয়ে আছে। আনহারি গাড়ির হর্ণ বাজাতে লাগল। কিন্তু কেউ গেইট খুলতে আসছে না। কিছুটা রাগান্বিত হয়ে গাড়ি থেকে নেমে লক্ষ্য করল গেইটের তালা খোলা। কিন্তু সেখানে কোনো দারোয়ান নেই। সে গেইটটা খুলে আবার গাড়িতে উঠল। গাড়িটা বাড়ির ভেতর নিল। ঘুটঘুটে অন্ধকার হয়ে আছে। এ সময় লোডশেডিং হওয়ার কথা না। আশেপাশের বাসাগুলোতে কারেন্ট আছে বুঝায় যাচ্ছে। আর এখানে লোডশেডিং হলেও জেনারেটর আই পি এস অটো জ্বলে উঠত। আনহারির কাছে বিষয়টা ভালো ঠেকছে না। সে মোবাইলের টর্চ জ্বালিয়ে যুক্তিকে সাথে নিয়ে বাড়ির ভেতরটায় যেতে লাগল।
বাড়ির ভেতরে ঢুকে আনহারির শ্বাস বন্ধ হয়ে যেতে লাগল।
কপি করা নিষেধ