#শারমিন আঁচল নিপা
আনহারি কথাটা শুনে দম ধরে বসে রইল কিছুক্ষণ। তারপর সে দ্রূত ব্যাংক কর্মকর্তাকে বলল ব্যাংকে যে গিয়েছে সে তার জমজ বোন। সে যেন তার থেকে টাকাটা দ্রূত উদ্ধার করে। ব্যাংক কর্মকর্তা শিহাব আনহারির কথা শুনে চমকে গেল। সে ফোনটা না কেটেই নিজের কক্ষ থেকে দৌঁড়ে বের হলো। কিন্তু ততক্ষণে অনন্যা চলে গেছে টাকা নিয়ে। শিহাব আনহারিরকে বিষয়টি জানালো।
আনহারি চুপসে গেল। তার শরীর কাঁপছে। একসাথে এতগুলো টাকা অনন্যা নিয়ে কী করবে? আদৌ কি এটা অনন্যা? নাকি অন্য কেউ অনন্যা সেজে এমন করছে। তার সাথে তো অনন্যার শত্রুতা ছিল না। বরং সে আরও অনন্যাকে বেটার লাইফ দিয়েছিল। তাহলে অনন্যা কেন তার সাথে এমন করছে। সে নিজেকে সামলাতে চেয়েও পারছে না। এতগুলো টাকার শোক সে সহ্য করতে পারছে না। চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে তার। তার বাবার মৃত্যুর পর পুরো বিজনেসটা সে দাঁড় করিয়েছে। তাই এ টাকার মূল্য সে জানে। কতটা কষ্ট করে টাকা ইনকাম করতে হয় সেটাও তার অজনা না।
যুক্তি আনহারির চোখে পানি দেখে বলে উঠল
“এনিথিং রং?”
আনহারি কাঁদতে কাঁদতে সবটা খুলে বলল। ফিয়নারও কথাগুলো শুনে মনে হচ্ছে, যে এ কাজ করছে সে অনন্যা না। সে অনন্যার বেশ ধরে অন্য কেউ। হয়তো লুটপাটের জন্যই এ তিন বছর পরিকল্পনা করেছে। সে নিজেকে সামলে আনহারিকে বলল
“ব্যাংকে নিশ্চয় সিসি ক্যামেরা আছে। আমরা যদি সিসি ক্যামেরা দেখি তাহলেই তো বিষয়টা পরিষ্কার হয়ে যায়।”
ফিয়নার কথা শুনে যুক্তিও একমত পোষণ করে বলল
“আমাদের উচিত এখনই থানায় জানানো। এবং এরপর ব্যাংকের সিসি ক্যামেরা চেক করা। তাহলেই কিছু বিষয় পরিষ্কার হয়ে যাবে।”
আনহারি থানায় কল দিতে যাবে এর মধ্যেই আনহারির মোবাইলটা বেজে উঠল। সে বুঝতে পারছে না কে! এ মুহুর্তে অচেনা কারও সাথে কথা বলার ইচ্ছায় তার নেই। তাই কলটা কেটে দিল। কল কাটার সাথে সাথে আবারও কল আসলো। সে এবার বাধ্য হয়ে কল ধরতেই ঐ পাশ থেকে একজন বলে উঠল
“আমি পুলিশ অফিসার আনাম। এ মুহুর্তে থানায় না থাকায় আমি থানার নম্বর দিয়ে কল দিতে পারিনি। তাই আমার ব্যক্তিগত নম্বর দিয়ে কল দিলাম। আমি আপনার কেইসটা সম্পর্কে জেনেছি। আমার কাছে বিষয়টি বেশ জটিল মনে হয়েছে। আপনি চাইলে আমি আপনার সাথে দেখা করতে চাই।”
এ যেন মেঘ না চাইতেই জল। আনহারি ঢোক গিলে উত্তর দিল
“আমার বোন অনন্যা আমার ব্যাংক একাউন্ট থেকে টাকা তুলে নিয়ে গেছে ৮০ লাখ। আপনি আমাকে এ ব্যাপারে সাহায্য করুন। আর আমাদের সন্দেহ সে আমাদের বোন অনন্যা না। সে হয়তো অন্য কেউ তবে অনন্যা সেজে আমাদের সাথে মাইন্ড গেইম খেলছে। আর লুটপাটের জন্যই হয়তো সে এ কাজ করেছে। আর দ্বিতীয়ত সে আমার বাসায় এসে আলমারি থেকে আমার ব্যাংক কার্ড আর চেকটা সরিয়েছে। আমি বিষয়টি তখন খেয়াল করতে পারিনি। মাত্র খেয়াল করলাম। আপনি কোথায় আসতে চান বলুন আমি এখনই আসছি।”
অফিসার আনামের কপালটা কুচকে গেল কথাগুলো শুনে। সে হালকা গলায় বলল
“আপনি সরাসরি ব্যাংকে আসুন। সেখানের কাজ শেষ করে আমরা কোথাও বসব।”
আনহারি কলটা কেটে যুক্তিকে বলল
“বোন তোমার কোনো আপ্যায়ন আমি করতে পারলাম না। এমন এমন ঘটনা ঘটছে যাতে করে নিজের মাথায় ঠিক রাখতে পারছি না। আমি এখন ব্যাংকে যাব। তুমি চায়লে এখানে থাকতে পারো।”
যুক্তি হালকা হেসে উত্তর দিল
“আমি ঠিক আছি। এত কিছু করা লাগবে না। না চাইতেও এ অসমাপ্ত ঘটনায় আমি জড়িয়ে গিয়েছি। যদি কোনো হেল্প লাগে আমাকে বলবে। আমি চেষ্টা করব। আর এখানে থাকা হবে না। রুদিতার বাবা বিদেশ থেকে কয়েকদিনের মধ্যেই চলে আসবে। এছাড়া রুদিতার স্কুল, আমার চেম্বার সব মিলিয়ে চাইলেও এখানে থাকা সম্ভব না। আমি আমার বাসাতেই বেশি কমফোর্ট ফিল করব। তাই আমরা বাসায় চলে যাব। একটা কাজ করা যেতে পারে একসাথে যাওয়া যেতে পারে।”
আনহারি মাথা নাড়িয়ে কেবল সম্মতি প্রদান করল। এরপর আনহারি ফিয়নার দিকে তাকিয়ে বলল
“নিজের খেয়াল রাখিস। নিজেকে শেষ করে দিয়ে আমাকে একা করে দিস না। আমার জীবনে আর আপন বলতে কেউ নেই। প্রিয় স্বামীর ধোকা। আপন বাবার আদর না পাওয়া। পালিত বাবার মুখোশ বের হয়ে আসা। আপন মায়ের জেল আর পালিত মায়ের অসুস্থতা। সব মিলিয়ে আমি বেশ ছন্নছাড়া। আজ যদি আমার মেয়ে টুলটুলকে ফিরে পেতাম তাহলে দুনিয়ার সকল অসুখ ভুলে সুখে থাকতে পারতাম। কিন্তু সে উপায়ও নেই।”
বলা বাহুল্য যে আনহারির এক বছরের সন্তান হারিয়ে যায়। এরপর থেকে আনহারি পাগলের মতো হয়ে যায়। সে সময় তার স্বামী সাপোর্ট না দিয়ে উল্টো সন্তান হারানোর সকল দোষ তার ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়। আর সে সূত্র ধরেই তারা আলাদা থাকা শুরু করে। যদিও ডিভোর্স হয়নি তবে আলাদা থাকে। সে যেন আরেক রহস্য মুড়ানো ঘটনা।
ফিয়না আনহারির কথা শুনে তার হাতটা ধরে বলল
“আমি কিছুই করব না। এর শেষটা না দেখে নিজেকে শেষ করব না। কথা দিলাম তোমার পাশে থাকব। তুমি যাও। যদি সে অনন্যা হয়ে থাকে তাহলে কেন এরকম করছে এটা আমাদের জানতে হবে। আর যদি অনন্যা না হয়ে অন্য কেউ হয়ে থাকে তাহলে জানতে হবে তার মূল মটিভ টা কী। কেন সে অনন্যা সেজে এমন করছে৷”
আনহারি ফিয়নার কথা শুনে তার মাথায় হাত বুলিয়ে বাসা থেকে বের হলো। দারোয়ানকে কড়া করে নিষেধ করল যেন তার মতো দেখতে কেউ আসলেও সহজে যেন ঢুকতে না দেয়। একমাত্র সে যদি তার হাতে থাকা কাগজটা না দেখায়। এখানে আনহারি একটা কোড ব্যবহার করেছে। সে তার হাতে থাকা কাগজে কয়েকটা সংখ্যা লেখে। পরবর্তীতে সে আসল আনহারি নিশ্চিত হতে সে এই সংখ্যা গুলোই বলবে। যদি বলতে না পারে তাহলে বুঝতে হবে সে আনহারি না। তাকে যেন তখন আটক করে রাখা হয়। এ কথাগুলো সে ইশারা ইঙ্গিতেই দারোয়ানগুলোকে বুঝিয়ে দেয়। সে চাচ্ছিল না যুক্তিও এ বিষয়গুলো জানুন। কারণ এ মুহুর্তে কাউকে বিশ্বাস করে সবটা বলে দেওয়া বোকামি।
যুক্তিকে নিয়ে আনহারি গাড়িতে উঠল। গাড়িটা চলতে লাগল। মাঝপথে যুক্তিকে তার গন্তব্যে নামিয়ে দিয়ে সে চলে গেল ব্যাংকে। সেখানে আগে থেকেই অফিসার আনাম অপেক্ষা করছিল। আনহারি গাড়ি থেকে নামতে দেখে সে বলে উঠল
“আপনার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম। তবে আপনি আসার আগে আমি একটা কাজ করেছি। সিসি টিভি ফুটেজটা চেক করেছি। সেখানে একটা বিষয় লক্ষণীয় মেয়েটির সাথে আমার পুরোপুরি সাদৃশ্য আছে। এমনি আপনার কপালে থাকা দাগটাও মেয়েটির কপালে আছে।”
এ কথা শুনে আনহারি একটু চমকালো। কারণ তার এ কাটা দাগটা হয়েছে ১ বছর আগে। তার সন্তান হারানোর পর সে যখন তার স্বামীর সাথে কথা কাটাকাটি করে তখন তার স্বামী রাগে ফুলদানী ছুড়ে মারে। সে ফুলদানী টা তার কপালে এসে লাগে। যার জন্য তার এমন দাগ হয়৷ তাহলে অনন্যার কী করে একই রকম দাগ হয়েছে। তার মাথাটা ঝিমঝিম করছে এসব ভেবে। তবুও নিজেকে সামলে সে বলে উঠল
“আমিও সিসি ক্যামেরাটা দেখতে চাই। আমি দেখতে চাই সে কী সত্যিই অনন্যা কি’না। নাকি অন্য কেউ আমার বেশ ধরে এমনটা করছে। “
অফিসার আনাম আনহারির কথা শুনে তাকে নিয়ে ব্যাংকে প্রবেশ করল। ব্যাংক ম্যানেজারের রুমে গিয়ে দুজন বসলো। তার সামনেই সিসি টিভি ফুটেজটা আরেকবার অন করা হলো। এবার সিসি টিভি ফুটেজটা সে ভালো করে দেখতে লাগল। মেয়েটা ঠিক তার মতো করেই ব্যাংকে প্রবেশ করেছে। মেয়েটা একদম আনহারির মতো। তার চালচলনও একইরকম। সে যেভাবে ব্যাংকে আসে, কথা বলে মেয়েটাও ঠিক সেভাবেই কাজ করছে। তারপর ব্যাংক থেকে টাকা উত্তোলন করে। সে একটু দ্রূত পায়ে হেঁটে ব্যাংক থেকে বের হলো। ঠিক এ সময় আনহারির নজর গেল মেয়েটির হাতের দিকে। হাতের দিকে তাকাতেই তার দম বন্ধ হয়ে যেতে লাগল। সাথে সাথে তার প্যানিক এটাক হয়ে গেল।
কপি করা নিষেধ