আড়ালে কে পর্ব দুই
আমি হ্যালো বলতেই চমকে গেলাম। ওপাশ থেকে মেয়েলি গলায় একজন জিজ্ঞেস করলে কে আপনি। আমি কোন ছেলের কন্ঠ আশা করেছিলাম। সে আবার ধমকের কন্ঠে জিজ্ঞেসা করলো কে আপনি? কাকে চাই?
আমি কি বলবো বুঝতে পারছিলাম না। তারপরেও বললাম তানভীর আছেন? আমি তার কাছে ফোন দিয়েছিলাম।
-ও আচ্ছা দিচ্ছি। ওপাশে হাসির শব্দ। তারপর বেশ শব্দ করে বললো তানভীর দেখতো তোমাকে কে জানি ফোন দিয়েছে।
অল্পসময়টুকুতে কি কি বলবো তানভিরকে তাই মনে মনে আওড়ে নিচ্ছিলাম। ওপাশ থেকে বেশ চওড়া গলায় একটা ছেলে সালাম দিলো। আমি সালামের জবাব দিতেই ছেলেটা জিজ্ঞেস করলো কে আমি?
আমি আদনান রিতুর হাজবেন্ড। রিতুকে চিনোনা তুমি।
-ও আচ্ছা আপনি আদনান ভাইয়া। ভাইয়া ভালো আছেন রিতু আপু কেমন আছে?
হ্যা ভালো। তোমার কি খবর?
তানভীরের সাথে অনেকক্ষন কথা বললাম। খেয়াল করলাম ছেলেটা জানতে চাইছেনা আমি তাকে কেন কল দিয়েছি। যেহেতু তার সাথে আগে কখনো কথা হয়নি তার উপর এত রাতে ফোন দেয়া অবশ্যই কারনবশত হবে এবং তার বেশ বড়সড় কারন হতে হবে। অবশ্য একবার হলেও তার জানতে চাওয়া উচিত। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে ছেলেটা জিজ্ঞেস করলো ভাইয়া কোন সমস্যা হইছে কি রিতু আপুর সাথে? এত রাতে কল দিলেন যে?নাহ আমরা সবাই ভালো আছি। রিতু হঠাৎ করে বললো যে তোমার সাথে কথা বলবে তাই কল দেয়া।
-ও আচ্ছা আচ্ছা রিতু আপু কই?
ও আসলে একটু বাথরুমে গেছে!
-হারামীটা আমার কোন খোঁজ খবর নেয় না। বিয়ে করে তো ছোট ভাইকে পর করে দিয়েছে আর এতদিন পরে কথা বলার কথা বলে এখন বাথরুমে গিয়ে বসে আছে! ঠিক আছে ও আসলে আমাকে কল দিয়েন ভাইয়া।
-আচ্ছা ভালো থাকো। আল্লাহ হাফেজ।
কলটা কেটে দিয়ে একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ছাড়লাম। না কোন ক্লু পাওয়া গেল না। এ ছেলেটা মনে হচ্ছে রিতুর কোন ছোট ভাই। সে কেন এ কাজ করতে যাবে। এ কাজ যে করেছে সে চায়না রিতুর সাথে আমার সম্পর্ক থাকুক। এবং রিতুর তার সাথে কানেক্ট আছে অথবা ছিলো। হতে পারে রিতুর কোন এক্স বয়ফ্রেন্ড। হয়ত এতদিন আমাদের বিয়ের কথা জানতোনা এখন কারো কাছ থেকে জেনেছে তাই হিংসার বর্শবর্তী হয়ে আমাকে ওর ছবিগুলো দিয়েছে। যাতে আমাদের মধ্যে ঝামেলা হয়। কিন্তু রিতু ও তো কখনো বলেনি যে ওর কারো সাথে সম্পর্ক ছিলো। ও বলেছে আমিই প্রথম। রিতুর কথা এত জোড়ালো ভাবে নেয়ার কারন হলো আমি কখনো রিতুকে মিথ্যে বলতে দেখিনি। আমাদের সম্পর্কটা বন্ধুর মত। আমাকে বললেও যে আমি রিতূকে কিছু বলতামনা তা রিতু ভালোভাবেই জানে। তাই লুকোনোর কোন প্রশ্নই আসেনা।আবার এটাও হতে পারে যে আমাদের বিয়ের পরে ও কারো সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছিলো পরে তার সাথে কোন ঝামেলা হয়েছে যার জন্য সে আমাকে সবকিছু জানিয়ে দিতে চায়। কিন্তু এত অল্প সময়ে রিতু এত নিচে নেমেছে আমার বিশ্বাস হতে চায় না। আমার সাথে কি ও তাহলে সুখী না। ও কি ভালো থাকার নাটক করছে। আমি তো ওকে সর্বচ্চো ভালো রাখার চেষ্টা করি। বুঝতে চেষ্টা করি। তারপরেও রিতু এমন কেন করলো। আমার মাথায় কাজ করছিলো না। শুনতে পেলাম ভোরের আজান দিচ্ছে। চিন্তা করতে করতে কখন যে সকাল হয়ে গেছে সেটাই টের পাইনি। রিতুর পাশে এসে শুয়ে পড়লাম। মেয়েটা বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। আমিও একটু পরে ঘুমিয়ে পড়লাম। ফোনের প্রচণ্ড শব্দে ঘুম ভাঙলো। রিতুর ফোন বাজছে। ফোন টা উলটে রাখায় কে ফোন করছে বুঝতে পারলাম না। যেই না ফোনটা দেখতে যাবো অমনি কোথা থেকে যেন রিতু এসে রুমে ঢুকলো। আমার দিকে একবার তাকিয়ে ফোনটা নিয়ে বেল্কুনিতে চলে গেল। আমি ঘুমের ভান ধরে রইলাম। বেশ খানিকক্ষণ পরে রুমে এসে ফোনটা চার্জে লাগিয়ে আবার চলে গেল। আমি উঠে রিতুর ফোনটা চেক করলাম। আম্মা ফোন দিয়েছিলো। আম্মার ফোনটা রিসিভ করতে এত লুকোচুরির কি আছে। আম্মার সাথে সাত মিনিট ছাপ্পান্ন সেকেন্ড কথা বলেছে। নাম্বারটাও চেক করলাম। না আম্মার ই। রিতু আবার রুমে আসলো।
–তুমি উঠে পড়েছো। কটা বাজে খেয়াল আছে। বারোটা।
আমাকে ডেকে দিলেনা কেন? অফিসে যেতে হবেনা।
–শোন আজকে একটা বিশেষ দিন। দেরি যখন করেই ফেলেছো আজ আর অফিসে যাওয়ার দরকার নেই। তোমার বসকে ফোন করে বলে দাও।
রিতুর এরকম আদিখ্যেতা আমার একদম ভালো লাগলো না। বেশ কড়া গলায় বললাম রোজ রোজ অফিস কামাই দেয়া যায় নাকি। চাকরি না থাকলে বিশেষ দিন দিয়ে কি করবো। এখন যেতে হবে।
–ঠিক আছে তাহলে খেয়ে যাও।
আমি বাইরে খেয়ে নেব।
রিতুর মুখটা মলিন হয়ে গেল। যাকগে ও যা করেছে তার তুলনায় এটা কিছুই না। রিতু রুম থেকে চলে গেল।
বাইরে বের হয়ে ভাবলাম আজ আর অফিসে যাবো না। কিছুক্ষণ এলোপাথাড়ি ঘোরাঘুরি করলাম। চায়ের দোকানে আড্ডা দিলাম। হানিফ মামা জিজ্ঞেস করলেন, বাজান তোমার মনটন কি দুইদিন ধইরা খারাপ। মুখটা কেমন শুকাইয়া গেছে।
না চাচা কিছু হয়নি বলে বিষয়টা এড়িয়ে গেলাম। চাচা মনেহয় বুঝতে পারলেন আমি কিছু বলতে চাচ্ছিনা তাই আর জানতে চাইলো না।
চায়ের দোকানে আরিফের সাথে দেখা হয়ে গেল। বেশ অনেকসময় আড্ডা দিলাম। আরিফ বললো, মামা চল আমার বাসায় কেউ নাই।একলা একলা ভাল্লাগছেনা। রাতে খেয়ে একেবারে যাবি। অনেকদিন তো যাসনা।
আরিফের সাথে তার বাসায় গেলাম। স্কুল কলেজ লাইফে বহুবার আসছি। যখনি আরিফদের বাসায় কেউ না থাকতো দুই বন্ধু মিলে আড্ডা দিতাম। সেইসব দিনগুলো মনে পড়ছে। আরিফের সামনে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করছি। এই ছেলেটা আবার না জিজ্ঞেস করে বসে। হঠাৎ মনে পড়লো রিতু বললো আজকে বিশেষ দিন। আজকের দিনের বিশেষত্বটা কি। ভাবতেই মনে পড়ে গেল আজ তো রিতুর বার্থডে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম সাড়ে দশটা বাজে। ইশ আরেকটু আগে মনে পড়লে রিতুকে নিয়ে বাইরে বের হওয়া যেত। আরিফের বাসা থেকে তড়িঘড়ি বের হয়ে রিতুর জন্য কিছু কেনাকাটা করলাম। একটা কাচা বেলীফুলের মালা, মহাদেব সাহার একটা কবিতার বই আর একবক্স চকোলেট।
বাসায় আসতে আসতে আজও লেট করে ফেললাম। রিতু দরজা খুলে দিলো। রিতুর চোখদুটো লাল আর ফোলাফোলা। মেয়েটা নিশ্চই কান্না করছে। আজকের দিনে এরকম করা উচিত হয়নি আমার। রিতুর হাতে প্যাকেটটা ধরিয়ে দিলাম। রিতু প্যাকেট নিয়ে কোন আগ্রহ দেখালো না শুধু বললো ডাইনিংয়ে খাবার দেয়া আছে খেয়ে নিও। রিতু কাথামুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লো। আমারো আর ভালোলাগছিলোনা তাই রিতুর পাশেই চুপচাপ শুয়ে পড়লাম এবং একসময় ঘুমিয়ে পড়ালাম। আমি ঘুমিয়ে পড়লে রিতু উঠে বালিসের পাশ থেকে ফোনটা নিলো। ফ্লাশলাইট অন করে ড্রেসিংটেবিল এর উপরে ওর হ্যান্ড ব্যাগটা থেকে একটা কার্ড বের করলো এবং ছিড়ে টুকরোটুকরো করে জানালা দিয়ে ফেলে দিয়ে আবার চুপচাপ শুয়ে পড়লো..
চলবে…
© Tasmima Yeasmin