_
পরদিন সকালে হৈ চৈ এর শব্দে ঘুম ভাঙলো। বসার ঘরে গিয়ে দেখলাম বাবা মা চলে এসেছে। মা কে জিজ্ঞেস করলাম মা তোমাদের না আরো পরে আসার কথা। তোমরা এতো তাড়াতাড়ি চলে এলে।
–আসলে তোদের জন্য মন খারাপ লাগছিলো তো তাই। আর তুই তো জানিস যে তোর মা তোকে না দেখে একদমই থাকতে পারে না। একমাত্র ছেলে বলে কথা। তাছাড়া রিতু মাকে তো ফোন করে বলে দিয়েছিলাম। মায়ের হয়ে বাবা উত্তর দিয়ে দিলেন। কি গো মা আদনানকে বলো নি?
–আসলে বাবা আদনানকে সারপ্রাইজ দিলাম।
যাক রিতু সব সামলে নিলো।
ফ্রেস হয়ে বাবা মায়ের সাথে নাস্তা করলাম। রিতু কচি কলাপাতা কালারের একটা শাড়ি পড়েছে সেই সাথে হাতখোঁপায় দিয়েছে কাল রাতের আনা বেলিফুলের মালা। আর চোখে সামান্য কাজল। এতটুকু সাজেই মেয়েটাকে অপ্সরী লাগছে। তবে ফুলের মালা বাসি হয়ে ফুলগুলো শুকিয়ে গেছে। ঠিক রিতুর মুখের মত কেমন নিষ্প্রান মলিন। নাস্তা করে রুমে এসেছি অফিসের জন্য রেডি হতে রিতুও আমার পিছন পিছন আসলো।
–আদনান তোমার কি কোন কারনে মন খারাপ।
রিতুর কথায় আমি চমকে গেলাম। একবার ভাবছি বিষয়টা বলে দেই। পরে ভাবছি থাক। নেক্সট যদি কিছু হয় তখন বলবো। মনের কথা মনে রেখে রিতুকে বললাম
–কই নাতো। মন খারাপ থাকবে কেন।–তাহলে কি কোন বিষয় নিয়ে তুমি আপসেট। না মানে কয়েকদিন ধরে কেমন যেন চিন্তিত দেখাচ্ছে তোমাকে। আমার কাছে বলতে পারো।
–না। তেমন কিছু না।
–কিছুই না হলে আমাকে এরকম এভয়েড কেন করছো। আমি দুদিন যাবত নোটিশ করছি। কোন প্রয়োজন ছাড়া তেমন কথাও বলছোনা।
–কই কে বলেছে। আসলে অফিসে একটা নতুন প্রজেক্টের দায়িত্ব পেয়েছি তো। টু মাচ ক্রিটিক্যাল। সেটা আবার আজকেই বসের সামনে প্রেজেন্টেশন করতে হবে তাই একটু চিন্তিত। সাথে একটু চিন্তিত হবার ভান করলাম। রিতুর সাথে দুদিন যাবত মিথ্যে কথা বলে যাচ্ছি। নিজের কাছেও খুব খারাপ লাগছে।
–ও আচ্ছা। আমিতো ভেবেছিলাম আমার উপরে রাগ করেছো।
রিতুকে আমি কাছে টেনে নিলাম এবং আগের সময়ের মত কপালে একটা চুমু খেলাম। রিতু সাথেসাথেই বললো কাল আর পরশু দুইদিন চুমু দাওনি যাওয়ার সময় সেটাও দিয়ে দাও। অনিচ্ছা সত্ত্বেও রিতুকে আরো কয়েকটা চুমু খেয়ে অফিসে রহনা দিলাম।
অফিসে এসে হাতের কাছের কাজগুলো সেরে নিলাম। কেমন যেন কাজে মন বসাতে পারছিলাম না। বারবার মাথার ভিতর একটাই চিন্তা ঘুরঘুর করছে। তখনি ডেস্কে টোকার শব্দ। আমি না তাকিয়েই বুঝতে পারছি যে বাচাল হাবিব সাহেব এসেছেন এবং এই মূহুর্তে প্যানপ্যান করে আমার মেজাজ না খারাপ করে যাবেন না। ওনার কাজ হচ্ছে ঘুরে ঘুরে সবার ডেস্কে যাওয়া, নিজের কাজ অন্যের উপরে চাপানোর চেষ্টা করা এবং উল্টাপাল্টা কথা বলে মাথা খারাপ করা।ফাঁকিবাজ হলেও সবসময় মুখের ছাপ দেখে মনে হয় মহাব্যাস্ত। ওনার প্রেজেন্ট সাইরেন হচ্ছে টেবিলের উপর টোকা দেয়া।
হাবিব ভাই একটা চেয়ার টেনে বসে পড়লেন।
–কি খবর আদনান সাহেব। কাল অফিসে এলেন না যে?
একটু ব্যাস্ত ছিলাম। তা আপনার কি খবর।
–আমার আর খবর। ঘরে বাইরে সব কাজ তো আমাকেই করতে হয়। ভীষন ব্যাস্ততায় থাকি।
ঘরের সবকাজও আপনি করেন।
–কষ্টের কথা আর কি বলবো ভাই আপনি আপন দেখেই বলছি বলে আমার দিকে কিছুটা ঝুকেঁ এলেন আসলে ঘরের কাজও আমাকেই করতে হয়। বৌ টা ভালো না। ছেড়ে দিবো।
যে স্বামী বৌয়ের ভয়ে ঘরের কাজ করে সে আর যাই হোক বৌকে ছেড়ে দিতে পারে না। তাও মজা নেওয়ার জন্য বললাম তা কবে ছেড়ে দিচ্ছেন।
–শীঘ্রই। আসলে বৌ হচ্ছে হাতলবিহীন স্যুটকেসের মত। বহন করতেও কষ্ট আবার ফেলে দিতেও মায়া লাগে।
উনি একটা দীর্ঘসময় ভাষন দেয়ার টপিক পেয়ে গেলেন। এড়ানোর জন্য বললাম হাবিব ভাই কফি খাবেন? আমি খাবো।
–ভাই জানেননা কফি খাইনা দেখলেও বমি আসে। আপনি খান আমি গেলাম কাজ আছে। হাবিব ভাই কপাল কুচকে উঠে গেল। মনে মনে বললাম তোর কপালে এর থেকেও খারাও বৌ জোটার দরকার ছিলো।
বাসায় ফিরে বেশ একটা ভালো সময় পার করলাম। সবাই একসাথে ডিনার করলাম। কয়েকদিন বাবা মা ছিলোনা কিন্তু মনে হচ্ছে অনেকদিন যেন ছিলনা। রিতুর সাথেও অনেকটা সহজ হয়ে গেছি। খেয়েদেয়ে রুমে আসলাম। আমি আমার মত করে শুয়ে পড়লাম রিতু অন্যদিকে মুখ করে শুয়ে আছে অথচ এই মেয়েটা সবসময় আমার বুকে মুখ লুকিয়ে ঘুমাতো। রিতুকে আমার দিকে ফেরাতে গিয়ে আবার হাত গুটিয়ে আনি। কোথায় যেন একটু আড়ষ্টতা আছে। কিছুক্ষন এপাশ ওপাশ করে উঠে বেলকুনিতে আসলাম। বেলকুনির একপাশে গ্রীনলিফ আর্কিড একপাশে নীল আর্কিড সাথে কোকোপিট ভর্তি ছোটছোট ঝুলন্ত টবে নাম না জানা বীজও রিতুর লাগানো। সবকিছুই সুন্দর ভালো শুধু আমার মনটা ভালো না। আকাশে মেঘ জমেছে। পশ্চিমা বাতাস বইছে। না আমার রিতুকে সবকিছু খুলে বলা উচিত। পিঠে কারো হাতের স্পর্শ পেলাম। তাকিয়ে দেখি রিতু। মেয়েটা হুট করে আমাকে জড়িয় ধরে ঝরঝর করে কেঁদে দিলো। এই মূহুর্তে আমার কিছু জানতে ইচ্ছে না। রিতুর কান্না থামলেই যেন আমি খুশি।
কি হয়েছে রিতু? এভাবে কাঁদছো কেন?
রিতু আমার থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো। এখনো ওর হেচকি উঠছে।
–আদনান তোমাকে অনেক কিছু বলার আছে। আমি তোমাকে অনেক আগে একটা মিথ্যা কথা বলেছি।
তুমি আগে কান্না থামাও পরে শুনবো।রিতুকে শান্তনা দিচ্ছি। রিতু আমার কথা পাত্তা দিলোনা বলতে শুরু করলো
আদনান তোমার সাথে বিয়ের তিনবছর আগে আমার ইফাদ নামের একটা ছেলের সাথে রিলেশন ছিলো। আমরা দুজন দুজনকে অনেক ভালোবাসতাম। কিন্তু ইফাদ হঠাৎ একদিন আমাকে না জানিয়ে স্কলারশিপ নিয়ে জাপান চলে গেল। ইফাদের সাথে যোগাযোগ করার অনেক চেষ্টা করেছি কিন্তু পারিনি এপর্যন্ত বলেই রিতু চোখের পানি মুছে নিলো।
ছেলেটা তোমার সাথে যোগাযোগ করেনি কৌতুহল নিয়ে জানতে চাইলাম?
–না। কিন্তু..
কিন্তু কি?
গতসপ্তাহে ওর সাথে শপিংমলে দেখা হয়েছিলো। আমি ওর সাথে কথা বলেছি। ও বলেছে ও এখনো আমাকে ভালোবাসে। বিয়ে করতে চায়। ও আমার বিয়ের কথা জানতো না। ও বলেছে তোমাকে ডিভোর্স দিয়ে ওকে বিয়ে করতে যদি আমি সত্যি ওকে কখনো ভালোবেসে থাকি। আমিই ফেক আইডি খুলে তোমাকে আমার ছবিগুলো পাঠিয়েছি। রিতু একনিঃশ্বাসে বলে গেল।
আর তাতেই কি আমি তোমাকে ছেড়ে দিবো? সম্পর্ক এত ঠুনকো রিতু।
–ইফাদ আমাকে ওর একটা কার্ড দিয়েছিলো। বলেছিলো আমি যদি রাজি থাকি যেন ওর সাথে যোগাযোগ করি। কিন্তু এখন আমি বুঝেছি তুমি আমাকে কতটুকু ভালোবাসো। তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও আদনান। তোমার ভালোবাসাই আমাকে আমার দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করতে শিখিয়েছে। তুমি আমাকে যা শাস্তি দেবে দাও কিন্তু আমি আর নিতে পারছি না। দুদিন নিজের সাথে অনেক যুদ্ধ করেছি। আমি বুঝেছি যে আমি তোমাকেই ভালোবাসি। তোমার সাথেই থাকতে চাই। আসলে অতীত হয়তো ভুলে থাকা যায় কিন্তু বদলানো যায়না। তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও আদনান প্লিজ।
কি অদ্ভুত এ দুনিয়া। দুদিন আগে যে মেয়ে আমাকে ছেড়ে যাওয়ার জন্য এতো কাহিনী করলো আজ সে আমার সাথে থাকার জন্য শাস্তিও মাথাপেতে নিতে চাইছে। চাঁদের আলোয় রিতুর চোখের পানি চিকচিক করছে। মেঘ কেটে গিয়ে কখন যে চাঁদ উঠেছে খেয়ালই করিনি। টের পেলাম আমার চোখও ভিজে গেছে। চাঁদ তার পূর্ন যৌবন দিয়ে আলো ছড়াচ্ছে আর সেই আলোতে রিতুকে নিষ্পাপ মনে হচ্ছে। আমি রিতুকে বুকে জড়িয়ে নিলাম। বুকের উপর থেকে যেন একটা পাথর নেমে গেছে।
রিতু আল্লাহর কাছে মাফ চাইলে তিনিও মাফ করে দেন আমি তো সাধারন মানুষ। তোমাকে মাফ করে দিয়েছি। সবচেয়ে বড় কথা তোমার ভুল তুমি বুঝতে পেরেছো। রিতু আমাকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।
আদনান আর রিতুর চোখের আড়ালে বেলকুনির নিচ থেকে একটা ছায়া সরে গেল। ইফাদ ভাবছে আবার জাপান চলে যাবে। যার জন্য এসেছিলো যেই তো অন্যের হয়ে গেছে। নিজের বামহাতের পিঠ দিয়ে চোখের পানি মুছে নিলো। সমাজে পুরুষদের কাঁদতে নেই। রিতুকে আদনানের বাম পাজর দিয়ে তৈরি করা হয়েছে তার নয়। হঠাৎ ইফাদ থেমে গিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে বললো হে সৃষ্টিকর্তা আদনান আর রিতুকে তুমি ভালোরেখো। ভীষন ভালো।
*সমাপ্ত*
.
©Tasmima Yeasmin