‘গরুর মাংসের দাম কতো করে?’ সোবহান ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন। ফিরোজ বলল, ঠিক জানি না। আটশো টাকার মতো মনে হয়। সোবহান বলল, কিছুদিন ধরে গরুর মাংস দিয়ে বিরিয়ানি খেতে ইচ্ছে করছে। ফিরোজের ছোটো মেয়ে মিতা দাদুর পাশের চেয়ারে এসে বলল, দাদু ঠিক বলছো আমারও খেতে ইচ্ছে করছে। আম্মুর হাতের বিরিয়ানি যা মজার হয় না।
মিতা ফিরোজের দিকে তাকিয়ে বলল, বাবা এই শুক্রবার গরুর মাংস আনো না। গলির মাথায় ওখানে যে প্রতি শুক্রবার গরুর মাংস পাওয়া যায়।
ফিরোজ মেয়ের কথায় কোনো উত্তর দিলো না৷ একবার মেয়ের দিকে তাকিয়ে আবার চুপচাপ খাবার খাওয়ার দিকে মনযোগ দিলো।
ফিরোজ সেই শৈশব থেকে শহরে, যখন ক্লাস থ্রিতে পড়ে তখন থেকেই বাবা মায়ের সাথে শহরে থাকে। বাবা শুধু বাড়িতে থাকতেন শুক্রবার। শুক্রবার মা মুরগী খিচুড়ি রান্না করতেন। শুক্রবার দিন নিয়ে একটু আলাদা আয়োজন ছিলো। অবশ্য এখানকার প্রতিবাসা থেকে শুক্রবার মাংস ,পোলাওয়ের ঘ্রাণ ভেসে আসতো। ফিরোজদের বাসায়ও পোলাও মুরগী রান্না হতো, আবার কখনো খিচুড়ি।
ফিরোজ এখন একটা কোম্পানিতে চাকরি করে, শহরে স্ত্রী এবং দুই সন্তান সহ বাবাকে নিয়ে থাকেন।
ফিরোজের অফিস থেকে এই বাড়িটা দূরে। অফিসের কাছাকাছি বাসা ভাড়া অনেক, তাই এতোদূরে বাসা ভাড়া রাখা। প্রতিদিন বাসে ঝুলে ঝুলে অফিসে যায়, আবার ঝুলতে ঝুলতে ফিরে আসে। ফিরোজের কখনো বাসের এতো মানুষের ভিতরে দাঁড়িয়ে থাকতে বমি এসে যায়, তারপর অসহ্য জ্যাম সে আছেই, তখন বাস থেকে নেমে হাঁটতে শুরু করে।
ফিরোজের বড় ছেলে সোহেল হোস্টেলে থাকে, এবার কলেজে পড়ে সোহেল৷ সেখানে মাসে সাত হাজার টাকা দিতে হয়, মিতা ক্লাস সিক্সে পড়ে তার পড়াশোনার খরচ দিতে হয়। মাসে কমপক্ষে দুই হাজার টাকার ওষুধ কিনতে হয় বাবার জন্যে। এসব সবকিছু ফিরোজের বেতনের টাকা থেকেই। বাবা নিজের বলতে চাকরিজীবনে তেমন কিছু করতে পারেননি, ফিরোজের নামে গ্রামে একটা জমি রেখেছেন। এই তার সম্বল। ফিরোজ কখনো ভাবে গ্রামের সেই জমিতে একটা বাড়ি তুলে পরিবার সহ গ্রামে রাখবে। আবার এদিকে ভাবে ছেলেমেয়ের পড়াশোনায় ক্ষতি হবে তাই শহরে না থাকলে।
গত দুই মাসে ফিরোজের গরুর মাংস কেনা হয়নি। আজকে যখন বাবা এবং মেয়েটা মাংসের কথা বলল, ফিরোজ এই বিষয় খেয়াল করে দেখলো।
বাবা খাবার নিয়ে কখনো কিছু বলেন না, কিন্তু আজকে বললেন। ফিরোজ কোনোকিছু খেতে চেয়েছে আর বাবা সেই জিনিস নিয়ে আসেনি এমন হয়নি। ফিরোজ মনে মনে ভাবছে তার বাবা সবচেয়ে ভালো বাবা, কিন্তু সে একজন ভালো সন্তান হতে পারেনি, বাবার সব আবদার চাইলেই পূর্ণ করতে পারে না। আর এদিকে ফিরোজ নিজেও ভালো বাবা হতে পারেনি, ছেলেমেয়ের আবদারও পূর্ণ করতে পারে না। পিছন থেকে অভাব টেনে ধরে। এইতো মেয়েটা কিছুদিন আগে একটা পুতুল দেখে কিনতে চাইলো, মিতার মা তখন মেয়ের সাথে রাগ করে কিছু কথা শুনালো। ফিরোজ পুতুলটার দাম জিজ্ঞেস করে এসেছে, একদাম বারোশো টাকা, এতো টাকায় পুতুল কেনবার মতো ক্ষমতা তার নেই। তার কাছে টাকা থাকলে সত্যি সত্যি মিতাকে ওই পুতুলটা কিনে দিতো। একটা পুতুলই তো চেয়েছে।
ফিরোজ সকালবেলা উঠে অফিসে যায়। আজকে বুধবার। অফিস ছুটির পরে ফিরোজের বন্ধু চয়নের কাছে যায়। চয়নের নিজের একটা কোচিং সেন্টার আছে মিরপুরে, বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কোচিং। চয়নের স্ত্রীর নামে, যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা পড়ায়।
ফিরোজ চয়নের অফিসে বসে আছে, চয়ন চা দিতে বলায় চা দিলো।
ফিরোজ বলল, তোর এখানে আমারে কোনো একটা সাবজেক্ট পড়াতে দে। চয়ন বলল, তুই পড়াবি? ফিরোজ বলল, তুই আমাকে জানিস না পড়াতে পারবো কিনা। চয়ন বলল, আরে শালা তুইতো অংকের জাহাজ ছিলি। কিন্তু এই জেনারেশনের পোলাপান একটু আপডেট অনেক টেকনিক নিয়ে পড়াতে হয়। ফিরোজ বলল টেকনিক গুলো তুই শিখিয়ে দিবি। চয়ন বলল, ঠিক আছে। সন্ধ্যা সাতটা থেকে নয়টা এই দুই ঘন্টা পড়াতে হবে পারবি? ফিরোজ বলল হ্যাঁ পারবো। চয়ন বলল তাহলে তুই পদার্থ আর গনিত এই সাবজেক্ট পড়াবি। ফিরোজ বলল আচ্ছা কালকে থেকেই আসি। চয়ন বলল আয়, তোর সপ্তাহে চারদিন পড়াতে হবে, তেরো হাজার টাকা পাবি। ফিরোজ বলল, টাকা নিয়ে সমস্যা নেই।
ফিরোজ চয়নের অফিস থেকে বের হয়। যাক যে আশা নিয়ে এসেছে সেই আশা পূর্ণ হয়েছে। ফিরোজের অফিস ছুটি হয় ছয়টায়। চয়নের এখানর আসতে ত্রিশ মিনিটের বেশি লাগবে না। ফিরোজ অবশ্য দশ হাজারের মতো আশা করছিলো, তবে ভালো একটা এমাউন্ট আসবে।
ফিরোজ অফিস ছুটির পরেই কোচিং সেন্টারে চলে যায়। ক্লাস নিয়ে বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত দশটা বেজে যায়। পারুল জিজ্ঞেস করে তোমার এতো দেরি হলো কেন আজকে আসতে? ফিরোজ বলল, এখন অফিসে একটু চাপ ফিরতে এমন দেরি হবে। পারুল বলল আচ্ছা, সেই সকালে যাও আর রাত দশটা অন্য কোনো চাকরি দেখো পাও কিনা। ফিরোজ বলে, এখানেই ভালো আছি চলতেছে তো।
শুক্রবার ফিরোজ বাজার করতে বের হয় গলির মুখে মাংসের দোকানে থামে তারপর আবার হেঁটে সবজির বাজারে যায়, সবজি কিনে সাথে তেলাপিয়া মাছ কিনে। সবজি আর তেলাপিয়া মাছ নিয়েই ফিরোজ বাসায় ফিরে আসে।
কোচিং সেন্টারে এক মাস ফিরোজের চলে যায়। আজকে মাসের চার তারিখ, চয়ন তেরো হাজার টাকার একটা খাম ফিরোজের হাতে দেয়। চয়ন খামটা ফিরোজের হাতে দিয়ে বলল, তুইতো অনেক ভালো পড়াও, তোর বেতন মনে হয় বাড়বে, ছাত্ররা তোর পড়ানো নিয়ে অনেক খুশী।
ফিরোজ টাকাটা নিয়ে বের হয়, একটা পুতুলের দোকানে যায়। মিতা যে দোকান থেকে পুতুল পছন্দ করেছে, সে দোকানের পতুলটা বিক্রি হয়ে গেছে। মিতা যেমন পুতুল পছন্দ করে ছিলো তেমন একটা পুতুল খুঁজে বের করে। তেরোশো টাকায় ফিরোজ একটা পুতুল কিনে। পারুলের একটাই ভালো শাড়ি ছিলো, সেদিন দরজার সাথে আটকে আঁচল ছিঁড়ে যায়, ফিরোজ পারুলের জন্যে একটা শাড়ি কিনে নেয়, বাবার জন্যে একটা লুঙ্গী কিনে।
বাসায় বাসে ফিরছে তখন বড় ছেলে সোহেলের হোস্টেলে কল দিয়ে বলে শুক্রবারে সোহল যেনো বাসায় আসে।
শুক্রবার ফিরোজ গলির মুখের মাংসের দোকান থেকে দুই কেজি গরুর মাংস কিনে৷ সোহেল এসেছে হোস্টেল থেকে, মিতা রান্নাঘরে পারুলের পাশেই দাঁড়ানো।
ফিরোজ নামাজ পড়ে বাসায় আসতেই পোলাও এবং মাংসের ঘ্রাণ পায়। টেবিলে পারুল খাবার নিয়ে এসে রেখেছে, মিতা গরম পোলাওয়ে একটা হাতপাখা দিয়ে বাতাস করছে, পুরো ঘরে পোলাওয়ের ঘ্রাণ ছড়িয়ে গেছে।
পারুল গোসল থেকে বের হলেই সবাই খাবার টেবিলে বসে। ফিরোজের সামনের চেয়ারে তার বাবা, বাবার পাশেই মিতা, সোহেল ফিরোজের এক পাশে, অন্য পাশে পারুল বসেছে। ফিরোজ পরিবারের সবার মুখগুলো একবার তাকিয়ে দেখলো, বহুদিন পরে এমন একটা আনন্দের দৃশ্য দেখছে ফিরোজ। ফিরোজ শুধু এখন নিজের জন্যে বাঁচে না, এই মুখগুলোর জন্যেই বাঁচে। মানুষ একটা সময় আসলেই নিজের জন্যেই শুধু বাঁচে না, পরিবারের জন্যে বাঁচে, প্রিয় মানুষের জন্যে বাঁচে। প্রিয় মানুষদের জন্যে একটু ভালো খাবার, একটা ভালো পোষাক, একটা পছন্দের জিনিস দেওয়ার ভিতরে অদ্ভুত আনন্দ থাকে।
বেঁচে থাকার দিনগুলো
-মুস্তাকিম বিল্লাহ