স্বাদ
_____
হুশহাশ করে গরুর মাংস দিয়ে ভাত খাচ্ছিল রুণু। খাচ্ছিল, আর আম্মার সাথে কথা বলছিল। রাজ্যের কথা! চাকরিটা পাওয়ার পর থেকে বাপের বাড়ি আসা হয় কম, সময়ই নেই। জমে থাকে অনেক, অনেক গল্প।
‘আর ওই মেয়ে, বুঝছো না’, পানি খেতে খেতে তার কলিগের কথা বলল রুণু, ‘যেই চালাক! যার যা-ই হোক সে বুদ্ধি করে নিজেরটা…’
‘তুই এত পানি খাইতাছস কেন?’, আম্মা বললেন মাঝ দিয়ে।
‘উ-হু-হু’, ফুঁ দিয়ে একটু বাতাস বের করে আবার ভাত মুখে দিল রুণু, ‘তরকারি ঝাল! মানে, মজা তো হইসেই। ঝাল আর কি।’
‘তুই তো এমনেই খাইতি। তোর যেমনে পছন্দ ওইভাবেই তো রানছি। আগে তো এত পানি খাইতি না?’
তাই কি?
রুণুর চট করে শ্বশুরবাড়িতে ওর প্রথম রান্নার কথা মনে পড়ে গেল।
যাওয়ার এক সপ্তাহের মাঝে মাংসের তরকারি রেঁধেছিল ও। দেশি মুরগির ভুনা। মজা- বলল সবাই- কিন্তু বেশ ভাল ঝাল! বয়স্ক শ্বশুর বলতে গেলে খেতেই পারেননি। রুণু বেশ লজ্জ্বিত হয়েছিল। তাদের বাসায় সবাই ঝাল খায়, সে-ও ছোট থেকে কড়া মসলাদার খাবার খেয়ে বড় হয়েছে। তার জিভটাই ও রকম৷ বুঝতেই পারেনি ভুলটা কোথায় হচ্ছে।
সবাই যে খুব তার ভুল ধরতে ব্যস্ত হয়ে গেছিল তা-ও না, বরং ‘প্রথমবার তো এটুকু হতেই পারে’- এমন কথাই বলেছিল৷ মারুফও কিছু বলেনি। বলার দরকারই ছিল না আসলে। বিয়ের রয়ে যাওয়া খাবার, নানান জায়গায় দাওয়াত ইত্যাদি শেষে বাসায় নিয়মিত খাওয়া শুরু হতেই রুণু বুঝতে পেরেছিল তার শ্বশুরবাড়িতে ঝাল-মশলা একটু কমই খাওয়া হয়, বাসার রান্নার ধারাটাই এমন।
রুণু অন্যমনস্কভাবে আরেক ঢোক পানি খেল। শুরুতে তার ভীষণ ভোঁতা লাগত মারুফদের বাসার রান্না, মনে আছে। মনে হত একদম পানসে কিছু খাবার খাচ্ছে। কষ্ট করে গিলতে হত। আস্তে আস্তে সয়ে গেছে- না যেয়েই বা কোথায় যাবে? তার একার জন্যে তো আর অন্য রকম রান্না হবে না! আর, শ্বাশুড়ি বলেন, বেশি মশলা খাওয়াও ভাল না। কাজেই নিজে রান্না করলেও সেভাবে করত, খেতও ওই খাবার- এখন ওটাই স্বাভাবিক।
এতই স্বাভাবিক যে ছোটবেলা থেকে টানা পঁচিশ বছর ধরে খেয়ে যাওয়া নিজের বাড়ির পছন্দসই তরকারি আর নিতে পারছে না তার জিভ।
লাল করে রাঁধা ঝোলের সাথে মাখানো ভাতের দিকে তাকিয়ে নিজের অজান্তেই রুণুর বুক থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল। খাপ খাইয়ে আর মানিয়ে নিতে নিতে পছন্দ থেকে পরিচয় পর্যন্ত কখন বদলে যায়, টেরও কি পায় একটা মেয়ে!
©Kazi Oishi