বিবাহ বার্ষিকী উপহার স্ত্রীর জন্য
শুনেছি মানুষের বউয়েরা গাড়ি, বাড়ি, সোনা গয়নার জন্য স্বামীর সাথে ঝগড়া করে। ঝগড়া করে বাপের বাড়ি যায় আবার ডিভোর্সও নাকি হয়! কী আজব! কিন্তু আমার বউ গাড়ি, বাড়ি চাওয়া তো দূরের কথা তার নিজের জন্য কোনোদিনও একটা সুতা পর্যন্ত চায়নি। আমি অবাক হই কেনো নীলুফার কিছু বলে না? তার কি কোনো চাওয়া পাওয়া নেই!? কোনো অভিযোগ নেই?
আজ পর্যন্ত শুধু বাজারের লিস্টটাই আমার পকেটে টুকে দিয়েছে৷ সেই লিস্টে চাল, ডাল, পেঁয়াজ, রসুন থেকে শুরু করে চিনি, সাবান সবই আছে কিন্তু তার নিজের জন্য প্রয়োজনীয় কোনো জিনিস নেই। বাজার থেকে আমি যা-ই আনি তাতেও কোনো আক্ষেপ নেই। লাক্স সাবান হোক আর লাইফবয় সাবান হোক সে সবকিছুতেই খুশি!
একটা মানুষ অল্পতে এতো খুশি কীভাবে হয়? আমি যদি নীলুর স্বামী না হয়ে বউ হতাম প্রতিদিন মনে হয় ঝগড়া করতাম! আমি যে ভীষণ চুজি তাও না কিন্তু একজন স্বাভাবিক মানুষের পক্ষে এতোটা সেটিসফাইড থাকা উচিৎ না।
নীলুর জন্মদিন, আমাদের বিবাহবার্ষিক কিংবা ছোটোখাটো কোনো প্রোগ্রামেও আমি নীলুকে কোনো উপহার দেইনি। আমার আর্থিক অবস্থা এত বেশি খারাপ না যে আমি নীলুকে কিছু দিতে পারবো না। শুধু মনে আছে আমাদের প্রথম বিবাহবার্ষিকীতে তিনটা লাল গোলাপ দিয়েছিলাম। নীলু তাতেই খুশি ছিলো। সেই গোলাপগুলো সুন্দর করে আমাদের ডাইনিং টেবিলের উপর সাজিয়ে রেখেছিল। কতোদিন আর ভালো থাকে! পাঁচদিন পর্যন্ত ফুলগুলো দেখার মতো ছিল তারপর আস্তে আস্তে শুকিয়ে গেছে। এই হলো আমার নীলুকে দেওয়া বিশেষ উপহার!
আমরা আমাদের বিবাহিত জীবনে অনেক সুখি। অন্তত নীলুফারকে দেখে আমার তাইই মনে হয়। কখনো আমাদের মধ্যে ঝগড়া হয় নাই। মান-অভিমান আমি কিছুটা করলেও নীলু কখনো করেনি। জীবন এতো পানসে হলে চলে!?
যারা আমার আপনজন, নীলুকে দেখেছে, নীলুর সাথে মিশেছে সবাই বলে আমি নাকি অনেক ভাগ্যবান। আমার মা-বাবা, ভাই-বোন সবাই নীলুকে পছন্দ করে। আর নীলুও অনেক করে আমাদের পরিবারের জন্য। আমার ছোটো বোনটার যখন সাতদিনের মধ্যে বিয়ে ঠিক হলো আমার হাত একদম শূন্য ছিল। বাড়ির বড় ছেলে, একমাত্র ছোটো বোনের বিয়েতে কিচ্ছু দেবার ছিলো না। মা-বাবাও আশা করেছিলেন আমি যদি কিছু দেই। নীলুফার ওই সময় তার বিয়ের গয়না সুলতানাকে নিজের হাতে পড়িয়ে দিয়েছিল। আমি বার বার মানা করা সত্ত্বেও নীলু দিয়েছে। নিজের মধ্যে কী পরিমাণ অপরাধবোধ তখন কাজ করছিল বলে বুঝাতে পারবো না।
এমনি আমার বউয়ের তেমন কিছু ছিলোনা। গয়নাগাটি বলতে সেই বিয়ের গয়নাই। এরপর আমি কখনো তাকে কিছু বানিয়ে দেই নাই। নীলুফারও কখনো কিছু চায়নি। সুলতানাকে সেই গয়নাও দিয়ে দিলো। বিয়ের পর অবশ্য সুলতানা সেই গয়না ফেরত দিতে এসেছিল। নীলু নেয় নাই। ‘তুমি নতুন বউ। আমার লাগলে আমি নিয়ে আসবো। তোমার কাছে থাকুক।’ এই যুগে কেউ এমন করতে পারে?! ‘বেশি ভালো, ভালো না”- নীলুকে বলে আমার অভিমান ঝেরেছি।
নীলু চুপ ছিলো। নীলুফার কেনো কিছু বলেনা?!
আমি বাইরে বেরোলেই জিজ্ঞেস করি ‘নীলু তোমার কি কিছু লাগবে?” নীলুর একটাই উত্তর ‘না না, কিছু লাগবে না। সব আছে আমার!”
আমি ভাবি, নীলু আর আমার সম্পর্কের মধ্যে কি কোনো দেয়াল আছে? নীলু কি বলতে লজ্জা পায়? আমাকে কি সে আপন ভাবে না? নাকি আমিই নীলুকে কোনো এক অদৃশ্য শক্তিতে আঁটকে রেখেছি?
অফিসের কলিগদের কাছে কতো গল্প শুনি। বউ এটা করেছে, সেটা করেছে অথচ আমার কোনো গল্প নেই! মামুন ভাইয়ের বউ নাকি আবদার ধরেছে এবার শীতে কক্সবাজার নিয়ে যেতেই হবে। সেই কক্সবাজার যাওয়া উপলক্ষে শপিং করে দিতে হবে। কত প্ল্যান! মামুন ভাই, বউয়ের কথা বলতে বলতে বিরক্ত হলেও আমার শুনতে ভালোই লাগে। আমার মনে পড়ে যায় আমাদের মেয়েটার যখন তিন বছর বয়স আমরাও প্ল্যান করেছিলাম কক্সবাজার যাবো কিন্তু আর যাওয়া হয় নাই। এরপর আমিও বলিনি, নীলুফার তো নয়-ই! নীলুফার একটু এমন আবদার করলে কী হয়!?
নীলু একদম সিম্পল। কখনো কোনো প্রসাধনী মুখে মাখে না। ঘুরেফিরে সেই বেবি লোশন। পরনে সবসময় সুতি ড্রেস। আর কোমড় পর্যন্ত দোলানো চুলের বেনি। চোখে তার ভীষণ মায়া! নেশা লাগানোর মতো মায়া! হঠাৎ যখন চোখে কাজল দেয় নীলুফারকে অপ্সরীর মতো লাগে! বিয়ের আগে প্রথম দেখে মনে হয়েছিল সে আমার কতো চেনা, কতো আপনজন! মাঝে মাঝে আমার ইচ্ছা করে নীলুফারও একটু সাজুক। অন্তত আমার জন্য! আমারও কেনো জানি সেই কথাটি আর বলা হয় না!
আচ্ছা, এবার আসল কথায় আসি। আজকের কথা। সন্ধ্যায় বাইরে যাব ঔষুধ কিনতে। প্রেসক্রিপশনটা খুঁজে পাচ্ছি না। নীলুফারকে জিজ্ঞেস করলাম জানালো ওয়ারড্রপের ড্রয়ারে নাকি আছে। সে মেয়েকে পড়াচ্ছিল তাই বললাম আমি নিজেই খুঁজে নেবো। ড্রয়ারে ঔষধ খুঁজতে যেয়ে সবুজ রঙের ফাইলটা আজকেও চোখে পড়ল।
ওটা আমি প্রায়ই দেখি কিন্তু কখনো খুলে দেখা হয় না। অফিসের কিছু একটা হবে ভেবে পড়েই ছিল। আর এই ড্রয়ার সাধারণত আমি খুলি না। আমার কিছু দরকার হলে নীলু নিজেই খুঁজে দেয়। আজ কী মনে করে সবুজ ফাইলটা হাতে নিলাম।
ফাইলের খুলেই একটা ধাক্কা খেলাম। ভিতর শুধু কাগজ আর কাগজ। কাগজ বললে ভুল হবে। সবই চিঠি। নীলুকে লেখা আমার চিঠি! নীল কালি, কালো কালির জেল কলম দিয়ে লেখা রং বেরং এর চিঠি! কত বছর আগের হবে? সেই যখন ট্রেনিং এর জন্য চিটাগং ছিলাম তখনকার চিঠি। প্রতি সপ্তাহে নীলুকে চিঠি লিখতাম। তখন মনে হয় আমাদের বিয়ের ছয় সাত মাস হবে। নীলু মাস্টার্সের ছাত্রী ছিল। তার বড় ভাইয়ের বাসায় থেকে ক্লাস করতো। নীলুর ক্লাস আর আমার ট্রেনিং -দুজন দু’প্রান্তে। প্রায়ই কান্নাকাটি করতো মেয়েটা। আর বড় ভাইয়ের বাসায় যেয়ে থাকতে আমার খুব লজ্জা লাগত। নীলুর ক্লাস না থাকলে আমার কাছে নিয়ে আসতাম। দুজনের একসাথে থাকার কী আকুলতা ছিল তখন!
আমার মেয়েটা হওয়ার আগেও নীলু লম্বা সময় বাবার বাড়িতে ছিল। তখনো চিঠি লিখেছি। বড় বড় চিঠি। সেই চিঠিও এখানে আছে! নীলুর তখন মোবাইল ফোন ছিলো না। ল্যান্ডফোনে আর কতই বা কথা বলা যেতো!? এটা ভেবে লজ্জা লাগল নীলুও আমাকে প্রতিটা চিঠির উত্তর দিয়েছে কিন্তু একটা চিঠিও আমার সংগ্রহে নেই। চিঠিগুলো কোথায় যেনো হারিয়ে ফেলেছি! আর নীলু কী যত্ন করেই না রেখেছে!
আচ্ছা, আইসক্রিমের কাঠি কেউ রাখে?! হ্যাঁ নীলু রেখেছে। চকবার আইস্ক্রিমের দুইটা কাঠি সুন্দর করে মোড়ানো। উপরে স্কচটেপের উপর লেখা ‘তাঁর সাথে আমার প্রথম আইস্ক্রিম খাওয়া, জাতীয় জাদুঘর, ঢাকা।’ লেখার নিচে তারিখও আছে!
বিয়ের পর প্রথম যখন নীলুফারকে নিয়ে ঢাকা আসি তখনকার কথা। আমাদের প্রথম বেড়ানো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, কার্জন হল আর জাদুঘর। মনে হচ্ছিল যেনো সেদিনের কথা। আমার চোখে ভাসছে আমি আর নীলু রিকশায় ঘুরে বেড়াচ্ছি। নীলুর পরনে আকাশী রঙের শাড়ি। খোঁপায় ছোট্ট বেলি ফুল। কার্জন হলের সামনে থেকে কিনে দিয়েছিলাম। সেদিন সারাদিন আমরা ঘুরেছি। আমি আরো অবাক হলাম যখন দেখলাম ছোট্ট একটা প্লাস্টিকের বক্সে শুকনো বেলি ফুলটা!!! প্লাস্টিকটা আর খুলতে ইচ্ছা করলো না, যদি নষ্ট করে ফেলি! শুধু নিচের লেখাটা পড়ে চোখটা ঝাপসা হয়ে গেলো ‘তাঁর দেওয়া প্রথম খোপায় তারার ফুল”।
এতটুক পর্যন্ত ঠিক ছিল। শুকনো গোলাপের প্যাকেটটক দেখেই আমার বুকটা হাহাকার করে উঠলো! আমাদের প্রথম ম্যারেজ এনিভার্সারিতে যে তিনটা গোলাপ নীলুফারকে দিয়েছিলাম সেই গোলাপ। টুকটুকে লাল গোলাপ শুকিয়ে কেমন কালচে হয়ে গেছে। কিন্তু গোলাপে রয়ে যাওয়া ভালোবাসার সেই চিহ্নটুকু এখনো সতেজ! আমার চোখ ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে… পারছিনা আর এই ভার সহ্য করতে! দম বন্ধ হয়ে আসছে… এত কষ্ট লাগছে কেনো! আমার মন হচ্ছে এই মুহূর্তে, এক্ষুনি পৃথিবীর সব গোলাপ এনে নীলুকে ভরিয়ে দেই!
আচ্ছা, আমি কী নীলুকে ঠকাচ্ছি? নীলুর চাওয়া-পাওয়া , অভিযোগবিহীন জীবনে হাসতে হাসতে বেঁচে থাকা যেনো আমার জন্য এক শাস্তি মনে হলো!
নীলু বলার জন্য কেনো আমাকে অপেক্ষা করতে হবে!? আমার কী কোনো চাওয়া পাওয়া নেই? শখ নেই? কল্পনা নেই? নীলু চেয়ে নিবে কেনো? আমার ধারণা ভুল! ছোটো ছোটো উপহারে কোনো কৃত্রিমতা নেই। ভালোবেসে যেকোনো কিছুই তো আমি দিতে পারি! আর কিছু দেওয়াই মানে যে দামী মূল্যবান চকচকে জিনিস হতে হবে, তা না! হতে পারে নীলুর জন্য কোনোদিন একটা গোলাপ, একটা চকলেট, কিংবা এক ডজন সেফটিপিন!
ড্রয়ারের ভিতর ফাইলটা যেভাবে ছিল সেভাবেই রেখে চলে এসেছিলাম। প্রেসক্রিপশন খুঁজে না পাওয়া গেলেও খুঁজে পেয়েছিলাম আমার চিকিৎসার আসল ওষুধ। আজকে থেকে তাই ঠিক করেছি নতুন করে শুধু নীলুর সবুজ ফাইল নয়, তাঁর মনের ফাইলও সাজিয়ে দিবো!
খাদিজা তুল কোবরা কাব্য