তনুর ঘুমে দুচোখ জড়িয়ে আসছে। এর মধ্যেই সে বুঝতে পারছে রুমে শাহেদ ঢুকেছে। ডাইনিং এর লাইট জ্বালানো। তাই শাহেদের মুখটা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে না। তনু বেড রুমে শুয়ে আছে। এই রুমের লাইটটা সে নিজেই বন্ধ করেছিলো। রুমে লাইট জ্বালানো থাকলে তনু ঘুমাতে পারে না। পুরো বাসায় তনু একা, তাই ডাইনিংএর আলোটা জ্বালিয়ে রেখেছিলো। শাহেদ রুমে ঢুকেই তনুর উপর ঝাপিয়ে পরলো। তনু বুঝতে পারছিলো এখনই সে তার উপর ঝাপিয়ে পরবে। কিন্তু কোন ভাবেই তনু তার শরীরটা নাড়াতে পারছিলো না। হঠাৎই তনু নিজেকে রুমের ফাঁকা জায়গাটায় আবিস্কার করে। শাহেদ বিছানায় শোয়া।
: কাপড় খোল।
তনু ভীত স্বরে,
: এসব কি বলছো!
: কেন বাংলা বুঝস না মাগী? কাপড় খোল কইলাম।
তনু কাঁপা কাঁপা হাতে কামিজটা খুলে নিজের হাতেই ধরে রাখে। আর হাত দুটো বুকের কাছে ভাজ করে রাখে। এই সময়ে শাহেদ চিবিয়ে চিবিয়ে গলার স্বর একদম খাদে নামিয়ে,
: সব কাপড় খোল। তোর গায়ে কোন কাপড় দেখতে চাই না আমি। তোর এতো বড় সাহস তুই আমারে ছাইড়া যাইতে চাস? তুই আমার বোনের কাছে বিচার দেস? বিচার পাইছস? পাইছস বিচার? তোর বাপ-মা তোরে জায়গা দেয় নাই? তোর আমার বাসা ছাড়া যাওয়ার কোন জায়গা নাই। বুঝতে পারছস?
তনুর গায়ে কোন কাপড় নেই। সেই অবস্থাতেই দাড়িয়ে দাড়িয়ে সে দরদর করে ঘামতে থাকে। আর নিরবে চোখের পানি দু’গাল বেয়ে পরছিলো।
: এখন যা আমার জন্য এক গ্লাস পানি নিয়া আয়। যাওয়ার আগে রুমের লাইট জ্বালাইয়া দিয়া যাবি।
এ কথা বলে শাহেদ তনুর লাইট জ্বালানো পর্যন্ত আর অপেক্ষা না করে সে নিজেই লাইট জ্বালাতে যায়। এই সময় তনু দৌড়ে ওকে জাপটে ধরে,
: লাইট জ্বালিও না প্লিজ। আমি আর কোনদিন তোমার কথার অবাধ্য হবো না। তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাবো না। কারো কাছে বিচার দিব না। তোমাকে না জানিয়ে কিছুই করবো না।
তনু এসব বলতে বলতে পাগলের মতো কান্না করছিলো। এক সময় সে আর দাড়িয়ে থাকতে পারে না। নিচে বসে শাহেদের পা জড়িয়ে ধরে প্রলাপ বকতে বকতে কান্না করতে থাকে। এই সময়ে তনু বিরবির করে একই কথা বার বার বলছিলো।
এমন সময় তনুর ঘুম ভেঙ্গে যায়। উঠে দেখে তনু তখনো হালকা হেঁচকি তুলছে। আর চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পরছে। পুরো শরীর ঘামে ভিজে গেছে। চোখ মুছে নিজেকে ধাতস্থ হওয়ার সময় দেয় সে। বুঝতে পারে এতোক্ষণ স্বপ্ন দেখছিলো। একদম হুবহু সেদিনের ঘটনাই সে আজ স্বপ্নে দেখেছে। এটা কি করে সম্ভব! বড় আপার বাসা থেকে তনু নিজেই বাসায় ফিরেছিলো। এই ফেরাটা যে তার জন্য ছিলো কতটা অসম্মানজনক! আর কোনদিন না ফিরতে পারলেই বরং সে স্বস্তি পেতো। সকালে যাওয়ার সময় শাহেদকে সে বলেছিলো, আর ফিরে আসবে না। কিন্তু তনুর এমনই পোড়া কপাল যে, দিন শেষে তাকে নিজ থেকেই ফিরে আসতে হয়ে ছিলো। আর সহ্য করতে হয়েছিলো জীবনের চরম অপমান। সেদিনের রাতটা কত দীর্ঘই না মনে হয়েছিলো তনুর কাছে। সে সারাটা রাত অপেক্ষা করেছে, শাহেদ কখন ঘুমিয়ে পরবে আর সে তার শরীর ঢাকতে পারবে।
না, তনু এতো বড় অন্যায় করার পরও শাহেদ একদম তার গায়ে হাত তোলেনি। শরীরকে ক্ষতবিক্ষত করতে আচড় কাটেনি। কোন রকম দাঁত বসিয়ে কামড়ে দেয়নি। রাগের চরম পর্যায়ে ধস্তাধস্তি করেনি। এমনকি সামান্যতম ছুঁয়ে দেখেনি পর্যন্ত। শুধুমাত্র সারারাত গায়ে কোন রকম কাপড় ছাড়া ফ্লোরে বসিয়ে রেখেছিলো। একটা মেয়েকে মানসিকতার একদম গভীরের শেকড় কেটে মেরুদণ্ড ভেঙ্গে গুড়িয়ে দেয়ার জন্য মনে হয় দিনের পর দিন বছরের পর বছর গায়ে হাত তুলে নির্যাতন করার কোন প্রয়োজন পরে না। মানসিক ভাবে সারা জীবনের জন্য পঙ্গু করে দিতে এমন একটা রাতই যথেষ্ট।
মাঝরাতে ঘুম ভেঙ্গে যাওয়ার পর তনু খেয়াল করে তার খুব ক্ষুধা পেয়েছে। অনেক সময় খালি পেটে থাকার দরুন এখন পেটটাও ব্যাথা করছে। কাল রাত থেকে এখন পর্যন্ত ঐ যে দুই গাল ভাত খাওয়া হইছিলো। মা-বাবাকে বিদায় দিয়ে মনটা খারাপ হয়ে ছিলো, তাই আর খেতে ইচ্ছে করছিলো না। তাছাড়া তখন ক্ষুধার ভাবটাও মরে গিয়েছিলো। তাই সে কোনমতে একটু পানি খেয়ে শুয়ে পরেছিলো। বিছানা থেকে উঠে তনু টেবিলের কাছে গেলো। ভাতটা গন্ধ হয়ে গেছে। ডালটাও মনে হয় টকে গেছে। কেমন একটা টক টক গন্ধ ছড়িয়ে আছে পুরো ঘরটায়। তনু বাটিতে অল্প ভাত নিয়ে ধুয়ে একটা পেয়াজ ছিলে তাতে লবণ, কাঁচামরিচ ডলে নিয়ে খেতে বসলো। তনুর কি যে মজা লাগছিলো খেতে। একদমে কয়েকগাল খেয়ে ফেললো। ঘর এমন নিরব, নিস্তব্ধ। কোথাও কোন সারা শব্দ নেই। শুধু তনু তার নিজের পান্তা ভাত খাওয়ার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছে। এই মাঝরাত্তিরে পেয়াজের কামড়টা তনুর কাছেই কেমন যেন খুব অবাঞ্ছিত শোনালো।
তনু তার নির্দিষ্ট চেয়ারে বসে একা একা খাচ্ছে। আর তাকিয়ে আছে শাহেদের বসার চেয়ারটার দিকে। এটা অবশ্য তনুর কাছে মোটেও নতুন ঘটনা নয়। শাহেদের সাথে একসাথে বসে কবে খেয়েছে? কখনো কি খেয়েছে? এই মুহুর্তে সে অনেক চিন্তা করেও বের করতে পারলো না। শাহেদকে টেবিলে খাবার দিয়ে তনুকে তার সামনে থেকে সরে যেতে হতো। কারণ শাহেদ তার খাওয়ার সময় তনু আশেপাশে থাকুক এটা পছন্দ করতো না।
: তুমি তো আমাকে ছেড়ে চলেই গিয়েছিলে। তুমি না এলে তো আর তোমার সাথে আমার খাওয়া হতো না। তাছাড়া আমি তো তোমাকে ফিরিয়ে আনিনি। তুমি নিজের প্রয়োজনেই ফিরে এসেছো। যে নাকি আমাক ছেড়ে যাওয়ার সাহস দেখায় তার সাথে এক টেবিলে খাওয়ার প্রশ্নই উঠে না।
এরপর থেকে তনু শাহেদের সাথে এক টেবিলে বসা বন্ধ করে দেয়। বিয়ের পর শাহেদ তনুকে নিয়ে কখনো শপিং করতে বা বেড়াতে নিয়ে যায়নি। তনু নাকি মানুষের সামনে প্রেজেন্টেবল না। কারো সাথে মেলামেশা করার মতো ভদ্র আচরণও নাকি তার জানা নাই। তাই শাহেদ তনুকে কোথাও নিয়েও যায় না।
: যার বাপের বাড়ি ঢোকার অনুমতি নাই, তার তো কোথাও বেড়াতে যাওয়া উচিৎ না।
এসব শুনতে শুনতে তনু নিজেও এক সময় বিশ্বাস করা শুরু করে, আসলেও তো তাকে তার ভাই-বোন পছন্দ করে না। ঐ বাড়িতে বাবা নিজে তাকে যেতে বারণ করেছেন। আর এখন তো তানিয়ার বিয়ে হয়েছে বেশ বড় ঘরে। বছর না ঘুরতেই সেই ঘর আলো করে ফুটফুটে জমজ বাচ্চা হয়েছে। তমালও নাকি নতুন বৌ ঘরে এনেছে। তমালের প্রেমের বিয়ে। মেয়েকে নিয়ে একরাতে নাকি নিজেই বাসায় এসে উপস্থিত। বাবা নাকি কিছুই বলেনি। হাসিমুখে মেনে নিয়েছেন সব কিছু। এতো কিছু তনুর বাবা বাড়িতে হয়ে গেলো। কই কেউ তো তনুকে বড় বোন বা বাড়ির বড় মেয়ে হিসেবে কখনো কিছু জিগ্যেসও করলো না। এমনকি ফোন করেও জানায়নি। এর ওর কাছ থেকে তনু এসব জেনেছে। তনুর সাথেই কেন এই সব কিছু হবে! সবাই কেন তনুর সাথে এমন করবে!
তারমানে, হয়তো তারই সব দোষ? তার মধ্যে নিশ্চয়ই কোন সমস্যা আছে। এসব ভেবে সে শাহেদের সমস্ত অন্যায় এক সময় নিজের অজান্তেই মেনে নেয়া শুরু করে। শাহেদের সাথে কথা বলা কমিয়ে দেয়। সবার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। আশেপাশের কারো সাথে তেমন একটা মেশে না। সব সময় খেয়াল রাখে শাহেদ কি পছন্দ করে? সেটা করার জন্য ব্যস্ত থাকে। শাহেদ তনুর কখন, কোন কাজটা অপছন্দ করলো? তাই নিয়ে চিন্তিত থাকে। আর থাকে আতংকিত।
কখন বিকেল গড়িয়ে রাত নেমবে? কখন শাহেদ অফিস থেকে ফিরবে? সে কি আজকেও তাকে নিয়ে ঘুমোতে যাবে? শাহেদের হাতের নখগুলি কি আজ কেটেছিলো? আঁচড়ের গভীরতা কি খুব বেশি হবে? কামড়ের সংখ্যাটাইবা কতগুলি হবে? গায়ে কাপড় বিহীন কতক্ষণ থাকতে হবে তাকে? সময়টা কি কাল রাতের চাইতেও দীর্ঘ হবে?
চলবে…….
আফরোজা খানম তন্দ্রা