বৈধব্য ৭ম পর্ব
শাহেদ মারা গেছে আজ তিনদিন।
সকাল থেকে তনুর ফোন ক্রমাগত রিং বেজেই চলেছে। শুধু আজ সকাল নয়। তিনদিন ধরেই কিছুক্ষণ পর পর কল আসতেছে। কিন্তু তনু একবারের জন্যও কল রিসিভ করছে না। রিং হলে মোবাইলে লাইট জ্বলে উঠে তার দিকে তনু একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। কথা বলার আগ্রহ পায় না। এখন তো মোবাইলের চার্জও শেষ হয়ে গেছে। এখন মোবাইল টোটালি বন্ধ। একটু পর তনুর বাসার কলিং বেল বেজে উঠে। একবার, দুইবার, তিনবার এমন করে প্রায় দশ-বারোবার বেল বাজার পর দরজায় জোরে জোরে ধাক্কার শব্দ শুনতে পায় তনু। সেই সাথে তার নাম ধরে দরজার বাইরে থেকে কেউ একজন ডাকছে। সেই ডাকের মধ্যে যথেষ্ট আতংকও জড়িয়ে আছে।
এইবার তনু বিছানা থেকে উঠে দরজা খুলে দেয়। দিনের বেশির ভাগ সময় সে বিছানায়ই শুয়ে থাকে। একা মানুষ, খুব একটা রান্নার ঝামেলায় যায় না সে। খুব বেশি ক্ষুধা লাগলে ডিম অথবা নুডুলস সেদ্ধ করে খেয়ে নেয়। তনু দরজা খুলে দেখে বড় দুলাভাই দাড়িয়ে,
: কি রে বৌমা! কি হয়েছে তোর?
তনুর বিয়ের প্রথম দিন থেকেই বড় দুলাভাই তাকে একেক সময় একেক সম্বোধনে ডাকতো। দুলাভাইয়ের যখন যে মুড থাকে সেই মুডের উপর ডিপেন্ড করে, তনুকে কোন সম্বোধনে ডাকবে সে? কতদিন পর তনু এই ডাকটা শুনছে! পাঁচ বছর হতে চললো তনুর বাসায় কেউ আসে না। তনুরও কারো বাসায় যাওয়া বন্ধ ছিলো এতোদিন। কিন্তু এতোদিন পর তনু এই ডাক শুনেও কোন রকম ভাবান্তর হলো না। সে কোন উত্তর দিচ্ছে না দেখে দুলাভাইই আবার বলে উঠলো,
: দরজা খুলছিস না কেন! ফোনও ধরতেছিস না। গত তিনদিনে কয় হাজারবার তোকে ফোন করা হয়েছে জানিস তুই? এখন তো আবার ফোনও বন্ধ করে দিছিস! কি সমস্যা বলতো মা? আমাকে খুলে বল।
সোফায় পাশাপাশি বসেছে তারা। বড় দুলাভাই তনুর হাতে ধরে তার পাশে বসিয়ে দিলেন। তনু দুলাভাইয়ের দিকে তাকিয়ে,
: বড় দুলাভাই, আমার না কিছুই ভালো লাগে না।
দুলাভাইও তনুর চোখের দিকে তাকালো। তার মনে হলো তনু তার দিকে তাকিয়ে আছে ঠিকই। কিন্তু কিছুই দেখছে না। তনুর চোখে রাত জাগার চিন্হ স্পষ্ট। মুখটা কি একটু শুকিয়েছে? দুলাভাই ছেলে মানুষ। এতো কিছু তিনি ঠিক খেয়াল করতে পারলেন না। শুধু বললেন,
: আজ শাহেদের মৃত্যুর তিনদিন। আমার বাসায় খুব ছোট করে কোরআন শরিফ খতম আর দোয়ার ব্যবস্হা করা হয়েছে। আমরা ভাইবোনরাসহ কয়েকজন আত্মীয় স্বজন আসবেন। এই বাসায়ই করার ইচ্ছা ছিলো। তুই একা মানুষ। মনের অবস্থাও ভালো না। এইসব কথা চিন্তা করেই তোর বড় আপাও বললো আমাদের বাসায় ব্যবস্হা করতে। এই ব্যপারে কথা বলার জন্যই গত দুই দিন ধরে তোকে ফোন করে যাচ্ছিলাম।
এই পর্যন্ত বলে দুলাভাই একটু দম নেন। তনুও একদম চুপ। এতো কথার কোন প্রতিত্তোর দেয় না সে। চুপ করে দুলাভাইয়ের কথা শুনছে। আসলেই কি শুনছে? দুলাভাই আবার বলে উঠেন,
: চল মা, আমার সাথে আমাদের বাসায় চল। তোর বড় আপা তোকে আমার সাথে করে নিয়ে যেতে বলেছে।
তনু দুলাভাইয়ের চোখে স্থির দৃষ্টি ফেলে,
: না দুলাভাই, আমি যাবো না।
তনু আর কিছু বলে না। মাথা নিচু করে বসে থাকে। ওর কথা বলার ভঙ্গি দেখে কি মনে করে দুলাভাইও ওকে আর জোর করে কিছু বলে না। এরপর আর কথা না বাড়িয়ে উঠে দাড়ায়,
: তোর মন যেহেতু চাচ্ছে না তাহলে থাক। না গেলি, বাসায়ই থাক। নিজের খেয়াল রাখিস মা। এই কয়দিনেই তোর মুখটা শুকিয়ে গেছে।
দুলাভাই চলে যাওয়ার পরও তনু সোফায় বসে থাকে। উঠে গিয়ে দরজাটা বন্ধ করে না। ইদানীং তনুর রাতে একদম ঘুম হচ্ছে না। রাত যতই গভীর হয় তার মধ্যে এক ধরনের অস্থিরতা কাজ করতে থাকে। কিছুতেই নিজেকে স্থির রাখতে পারে না। এক সময় বিছানা থেকে উঠে গিয়ে ঘরের লাইট জ্বালায়। আবার একটু পর লাইট বন্ধ করে সুইচবোর্ডের সামনে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। এরপর নিজের জামা কাপড় খুলে ফেলে। কয়েকদিনের না কাটা হাতের বড় বড় নখ দিয়ে নিজের বুকে, হাতে, পায়ে, যতটুকু পিঠ ছুঁতে পারে সব জায়গায় আঁচড় কাটে। আর ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদতে থাকে। নিজের দুই হাতে কামড়ে রক্ত বের করে ফেলে। এক সময় ক্লান্ত হয়ে কাপড় ছারাই ফ্লোরে শুয়ে থাকে। সারাটা রাত সে জেগে কাটিয়ে দেয়। এভাবে তনু নিজেকে নিজে প্রতি রাতে শাস্তি দেয়। এমনটা করলে কেন যেন তনুর মনটা শান্ত হয়। ক্ষতবিক্ষত শরীরের দিকে তাকালে এক ধরনের প্রশান্তি বোধ করে। কারণ সে পাপি, সে খারাপ। এমন শাস্তি তার পাওনা।
এর কয়েকদিন পরের কথা। তনু দরজা খুলে পাশের বাসার কলিং বেল চাপলো। রুমা ভাবি দরজা খুলে তনুকে দেখে কোমল গলায় জিগ্যেস করে,
: আরে ভাবি তুমি! কেমন আছো? তোমার বাসার কলিং বেল বাজালে তুমি দরজা খুলো না কেন? সেদিন আমি তোমার জন্য খাবার রান্না করে ছিলাম। কিন্তু তুমি দরজা খুলোনি বলে দিতে পারিনি। তোমার কোন খোঁজও নিতে পারি না।
এসব শোনার পরও তনুর মুখ একদম নির্বিকার। ভাবির দিকে শূণ্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। কিছু বলছে না দেখে,
: কি ব্যাপার ভাবি? তোমার কিছু লাগবে? তোমার শরীর ঠিক আছে তো?
তনু একটু আমতা আমতা করে,
: হ্যাঁ, লাগবে। কিন্তু কি লাগবে? এখন ঠিক মনে করতে পারছি না।
রুমা ভাবি তনুর কাছে কয়েক পা এগিয়ে এসে সামান্য ভ্রু কুচকে,
: ভাবি, তুমি বরং কিছু দিন তোমার বড় ননাসের কাছে থেকে এসো। এভাবে একা থাকা তোমার ঠিক হচ্ছে না। ভাই মারা গেছেন, সেই বাসায় আবার তুমি একদম একা একা থাকছো। এটা কি ঠিক হচ্ছে বলো? তাছাড়া বিধবা…..
তনু তাকে আর কোন কথা বলতে না দিয়ে মাথা নিচু করে নিজের ফ্লাটে এসে দরজা বন্ধ করে দেয়। এরো কয়েকদিন পর রুমা ভাবি সিঁড়ি দিয়ে উঠার সময় দেখে তনু সিঁড়িতে গালে হাত দিয়ে বসে আছে।
: ভাবি, এভাবে বসে আছো যে? কোন সমস্যা?
তনু একটু ইতস্তত করে,
: ঘরের চাবিটা হারিয়ে ফেলেছি। তাই শাহেদের জন্য অপেক্ষা করছি। ও এলে তারপর ঘরে ঢুকবো।
এইবার রুমা চমকে উঠে। কিন্তু তনুকে কিছু বলে না। সে তনুর ব্যাগটা নিয়ে তার ভেতর থেকে খুঁজে ঘরের চাবি বের করে তালা খুলে তনুকে বলে,
: আসো তনু ভাবি ঘরে আসো।
রুমা ডাকার পরও তনুকে আগের মতই বসে থাকতে দেখে সে নিজেই তনুকে দু’হাতে ধরে আবারও বলে,
: ভাবি চলো আমরা ঘরে যাই।
তনু চাবি দেয়া পুতুলের মতো উঠে দাঁড়ায়। কিছুই বলে না। তারপর নিজের ঘরে গিয়ে রুমার দিকে না তাকিয়েই দরজা বন্ধ করে দেয়। তনু দরজা বন্ধ করার পর রুমা তার হাতে লুকিয়ে রাখা তনুর বাসার চাবিটার দিকে তাকায়। সে শুধু মনে মনে আল্লাহর কাছে দোয়া করে,
: আল্লাহ, তনু যেন ভেতর থেকে দ্বিতীয় সিকিউরিটি লকটা না লাগায়।
রুমা আরেকটু সময় তনুর দরজার সামনে দাড়িয়ে থাকে। শুধু একটা লক লাগানোর শব্দ শুনতে পায়। একটু পর তনুর পায়ের আওয়াজ ধীরে ধীরে দূরে সরে যেতে থাকে। রুমা ঐ সময়েই নিজের ঘরে এসে শাহেদের বড় আপার কাছে ফোন করে। অনেক দিন আগে তনু তার মোবাইল থেকে বড় আপাকে ফোন করেছিলো। তখনই নাম্বারটা সে সেভ করে রেখেছিলো ভবিষ্যতে কখনো কাজে লাগতে পারে ভেবে। ভাগ্যিস রেখেছিলো!
সেদিন বিকেলেই বড় আপা তনুর বাসায় এসে হাজির। এসে দেখেন এই পনেরো, ষোলো দিনে তনুর চেহারার দিকে তাকানো যাচ্ছে না।
: তনু, চেহারার একি হাল করেছিস!
বড় আপা তনুর মাথায়, বুকে পিঠে হাত বুলাতে থাকে। শরীরের যতটুকু দেখা যাচ্ছে ততটুকুতে অসংখ্য কামড় আর নখের আঁচড়ের দাগ। চোখ দুটো বসে গেছে। চোখের চারপাশে কালসিটে দাগ পরে গেছে। গালদুটো ভেঙ্গে গেছে। গলার হাড়দুটো বের হয়ে আছে। মাথার চুল উসকোখুসকো। গোসল মনে হয় না এই কয়দিন একবারও করেছে। কারণ ওর শরীর থেকে কেমন বোটকা একটা গন্ধ আসছে। গায়ের পড়নের কাপড় নোংরা। ঘরের অবস্থা আরো কাহিল। ডাইনিং টেবিল, রান্নাঘরের বেসিনে স্তুপ করা বাসনকোসন। ফ্লোরে ধুলার আস্তর। ঘরের সবগুলো জানালা বন্ধ। এই কয়দিনে একবারও খুলেছে কিনা সন্দেহ।
এসব দেখে বড় আপা কেঁদে ফেলে। কান্না করতে করতে বলেন,
: তুই এক্ষুনি আমার সাথে আমার বাসায় চল।
চলবে……
আফরোজা খানম তন্দ্রা