বৈধব্য ৯ম পর্ব
মা মরা সবার ছোট ভাই, শাহেদের প্রতি শাহেদার ভালোবাসা দিন দিন মাত্রা ছাড়াচ্ছিলো। দেরিতে স্কুলে ভর্তি করানোর ফলে সে ক্লাসে সবার চাইতে বড় ছিলো। শুধু বড় হলেও এক কথা ছিলো। কিন্তু না, দুষ্টামিতেও সে ছিলো ঐ প্রাইমারি স্কুলের মধ্যে সবার থেকে সেরা। গায়ের শক্তিতেও তার সাথে পেরে উঠা শক্ত ছিলো। আজ এর সাথে ঝগড়া তো কাল ওর সাথে মারামারি। ক্লাসের পড়াতেও ছিলো একদম অমনোযোগী। যার দরুন প্রায়ই তাকে শাস্তি স্বরুপ ক্লাসের বাইরে দাড় করিয়ে রাখা হতো। এ কারণে তার ক্লাসের অন্যান্য ছেলে-মেয়েরা তাকে ক্ষেপাতো। তাকে দেখলেই দূরে দাড়িয়ে হাসাহাসি করতো। এ নিয়েও তার মনে ছিলো চরম রাগ। কারণ ছেলেদের তো তাও মাইর দেয়া যায়। কিন্তু মেয়েদেরকে তো সবার সামনে কিছু বলাও যায় না। মাইর তো চিন্তাও করা যায় না। তাই মাঝে মধ্যে মেয়েদের বেঞ্চের উপর কেঁচো, বিচ্ছু, তেলাপোকা মেরে জিগা গাছের আঠা দিয়ে লাগিয়ে রাখতো। আবার কখনো কখনো বসার সীটে সবার আগে স্কুলে এসে কাঁদা মাখিয়ে দিতো। কোন মেয়ে পরে বা খেলতে গিয়ে ব্যাথা পেলে সে তখন খুব জোরে জোরে হাসতো আর হাত তালি দিয়ে চিৎকার করতো,
: খুব ভালো হইছে। উচিৎ শিক্ষা হইছে। আল্লাহ বিচার করছে।
একদিন শাহেদা বাড়ি থেকে কি একটা কাজে বের হয়েছিলো। স্কুলের পাশ দিয়েই তাকে যেতে হবে। শাহেদ আর তার ছেলেকে দেখবে বলে স্কুলে ঢুকেই দেখে শাহেদ ক্লাসের বাইরে কান ধরে দাড়িয়ে আছে। আর যাবে কোথায়? শাহেদের হাত ধরে সে সাথে সাথে হেডমাস্টারের রুমে গিয়ে,
: স্যার, বাচ্চারা তো আর ইশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর নয় যে সব পড়া সে নিজে নিজে বাসা থেকে শিখে আসবে। আমি বাচ্চাকে স্কুলে কেন পাঠাই? লেখাপড়া শেখার জন্যই তো। নাকি? টিচার কেন তাকে শেখাতে পারে না? সে না শিখতে পারলে তো সেটা টিচারেরও ব্যার্থতা। একে তো লেখাপড়া শেখাতে পারে না। তার উপর আবার শাস্তি দিচ্ছে? এ কেমন টিচার?
হেডমাস্টার সেদিন নরম সুরে শাহেদাকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করলেন,
: শাহেদ, ক্লাসের অন্যান্য বাচ্চাদের তুলনায় একটু কম মনোযোগী। আবার সামান্য দুষ্টামিও করে। তাই হয়তো…..। তাছাড়া আপনার নিজের ছেলেও তো ঐ ক্লাসের ছাত্র। কই তাকে তো কোন টিচার……।
শাহেদা মাস্টারমশাইকে আর তেমন কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে শাহেদকে নিয়ে সোজা বাড়ি চলে আসে। আরেকদিনের কথা, স্কুল ছুটির আগেই শাহেদ কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি গিয়ে হাজির। তাকে জিগ্যেস করতেই সে তার হাত বাড়িয়ে শাহেদাকে দেখায়। সেখানে একটা বেতের বারির দাগ স্পট। শাহাদাত আঙ্গুলের মাথা থেকে শুরু করে কোনাকুনি একদম হাতের কনুই পর্যন্ত গিয়ে দাগটা শেষ হয়েছে। সেদিন শাহেদার যে রুদ্রমূর্তি সবাই দেখেছে, এমনটা কোনদিন কেউ দেখেনি। এমন কি তার জামাইও না। যে শিক্ষক শাহেদকে মেরে ছিলো, তাকে আর পরবর্তীতে সেই স্কুলে চাকরি করতে দেয়া হয়নি। তিনি অনেক ভাবে শাহেদার সাথে দেখা করে ক্ষমা চাওয়ার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু শাহেদা কিছুতেই তার সাথে দেখা করেননি।
স্কুলটা শাহেদার শ্বশুরের দান করা জমিতে প্রতিষ্ঠিত। স্কুল ভবন তৈরির সময়ও তিনি অনেক সহযোগিতা করেছেন। টাকা-পয়সা তো বটেই বিভিন্ন সরকারি অফিসে দৌড়াদৌড়ি এবং কাগজপত্র, পারমিশন সব কিছুই তিনি করে দিয়েছেন। তাছাড়া তাদের পরিবার গ্রামের মধ্যে বেশ প্রভাবশালী। তাই স্কুলের সব শিক্ষকরাই তাদেরকে একটু সমঝে চলেন। শাহেদার এই আচরণেরও কেউ কোন প্রতিবাদ তো দূরের কথা। টু শব্দ পর্যন্ত করেনি। যার ফলে স্কুলের বাকি শিক্ষকরা পরবর্তীতে শাহেদকে নিয়ে আরকখনো কোন রকম অভিযোগ করা বন্ধ করে দেন।
এভাবেই শাহেদ বড় হতে থাকে। বড় হওয়ার সাথে সাথে কাঁদতে কাঁদতে বুর কাছে যাওয়ার ঘটনাও তখন একেবারে কমতির দিকে। শাহেদের দুষ্টামীতে একটু ভাটা পরে যখন সে হাইস্কুলে যায়। অন্য স্কুল, দূরে এবং সেটা সরকারি। সেখানে আর তার পরিবারের কোন প্রভাব খাটে না। সেই ভাটাতে আরো বাঁধ তৈরি হয় একটা বিশেষ ঘটনায়। যা কিনা শুধুমাত্র শাহেদা একাই জানে। কখনো কারো কাছে এ ব্যাপারে কোনদিন আলোচনা করেনি। এমনকি তার স্বামীর সাথেও না। শাহেদের বন্ধুত্ব হতো সব সময় তার চাইতে আরেকটু বড় এবং বখাটে টাইপ ছেলেদের সাথে। যার কারণে দুষ্টামির গন্ডিটা শুধুমাত্র স্কুলের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতো না। এ গ্রাম ছেড়ে ও গ্রামের সীমাও কখনো লঙ্ঘন হয়ে যেতো। এমনিতে সে খুব একটা হৈচৈ টাইপ ছেলে ছিলো না। কিন্তু দলে থেকে যে কোন দুষ্টামির সবচাইতে ভয়ংকর কাজটা সেই আগ বাড়িয়ে নিজের কাঁধে তুলে নিতো।
এরই মধ্যে একদিন স্কুলের টিফিনের পর বন্ধুরা মিলে ঠিক করে আর ক্লাস করবে না। তারা সবাই মিলে সিনামা দেখতে যাবে। যেই ভাবা সেই কাজ। সিনামা দেখে ফেরার পথে একটু জঙ্গল ঘেরা একটা পরিত্যক্ত বাড়ি পরে। সেখানে সবাই মিলে জীবনের প্রথম সিগারেটে টান দিবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়। তাদের সবার বয়সটাই এমন যে যখন যেটা মনে হচ্ছে তখনই সেটা করতে হবে। না করতে পারলে যেন তাদের জন্য সেটা যুদ্ধে পরাজয়ের মতই অনুভূত হয়। এই হেরে যাওয়াটা তারা কেউই মানতে নারাজ। যথারীতি সিগারেট কিনে আনার দায়িত্বটা পরে শাহেদের উপর। সবাই যার যার সিগারেটে টান দিয়ে একেকজন খকখক করে কাশতে থাকে। শুধুমাত্র শাহেদই কোন রকম না কেশেই প্রথম টানটা দিতে পারে। এই নিয়ে সবাই খুব হৈচৈ করতে থাকে। এক পর্যায়ে বন্ধুরা সবাই একত্রে লাইন ধরে হিসু করতে দাড়ায়। ছেলেদের এই খেলাটা বুঝি খুব কমন একটা খেলা এবং তারা এই খেলাটা খেলতে মোটেও লজ্জা বা অস্বস্তি অনুভব করে না। কার হিসু কতদূর যায়? আবার একজনের হিসু দিয়ে অন্য জনের সাথে কাট্টাকাট্টি খেলে। শাহেদ কেন যেন এই খেলাটায় কখনোই আগ্রহবোধ করে না। বন্ধুরা যখন এই খেলা খেলে তখন সে দূরে গিয়ে চুপচাপ দাড়িয়ে থাকে। কখনো বন্ধুদের সামনে হিসু করে না।
অনেকটা সময় ধরে তারা বাইরে। তাই আজ তারও হিসু পেয়েছিলো। সে সবার থেকে একটু দূরে গিয়ে হিসু করতে থাকে। এমন সময় সব বন্ধুরা তার কাছে দৌড়ে এসে কাট্টাকাট্টি খেলতে যায়। শাহেদ হঠাৎ তাদের উপর প্রচন্ড খেপে যায়। কিন্তু বন্ধুরা শাহেদের রাগের কোন তোয়াক্কা না করে বরং তাকে একটু ধাক্কা দিয়ে নিজেরা হাসতে থাকে। দুষ্টামির ছলে ধাক্কাধাক্কির এক পর্যায়ে ব্যাপারটা অন্য দিকে মোড় নিতে থাকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সেটা ধস্তাধস্তিতে পরিণত হয়। শাহেদ তাদেরকে বার বারই মানা করে তার সাথে যেন তারা এমন না করে। একটা সময়ে সে চিৎকার করে ওদের ধমকাতে থাকে। কিন্তু কে শোনে কার কথা? বয়সটা তো বাবা-মায়ের কথা শোনার পর্যায়েই নাই। সেখানে বন্ধুর কথা? কখনোই না। আর এই বন্ধুদের সবাই মিলে যখন একটা হুজ্জুতের মধ্যে থাকে, সেই সময়তো ডেফিনেটলি শোনার সময় না। এই বয়সটা না শোনারই। বয়সটা না থামারই। বয়সটা নিজেকে কন্ট্রোল না করতে পারারই।
শাহেদের চিৎকারে বরং বন্ধুরা আরো মজা পেয়ে সবাই মিলে জোর করে টেনেহিঁচড়ে তার প্যান্ট খুলে ফেলে। আর খুলেই সবাই কেমন যেন থমকে যায়। সবার চোখ আটকে যায় শাহেদের পুরুষাঙ্গের দিকে। সেটার দৈর্ঘ্য নিয়ে সবার নানা রকম প্রশ্ন। এর মধ্যে আবার কেউ কেউ অতিউৎসাহী হয়ে হাত বাড়িয়ে নেড়েচেড়ে দেখতে যায়। শাহেদ তাদেরকে ধাক্কা দিয়ে নিজের কাছ থেকে সরিয়ে দেয়। কয়েকজনকে ঘুষি আর লাথিও মারে। এতে হিতে বিপরিত হয়। বন্ধুরা শাহেদের এই আচরণে রেগে গিয়ে সবাই মিলে এক সময় তাকে পেটাতে শুরু করে। আর বলতে থাকে,
: তুই তো হিজরা। আমাদেরটা এতো বড় তোরটা এতো ছোট কেন? হিজরা কোথাকার। এতোদিন তুই আমাদের থিকা লুকাইছস? এই জন্য তুই আমাদের সাথে গোসল করস না? মুতের খেলা খেলস না? তুই হিজরা। শালা হিজরা।
এতোদিনের বন্ধুদের এই হিংস্রতা দেখে শাহেদ পুরোপুরি ভেঙ্গে পরে। এই বন্ধুদের জন্য সে কি না করেছে? আর তার এই সামান্য ব্যাপারটা তারা এভাবে নিলো? তাকে হিজরা বললো? বন্ধুরা তাকে কাপড় ছাড়া ঐভাবেই মাটিতে ফেলে রেখে চলে যায়। কতক্ষণ এভাবে পরে ছিলো তা সে নিজেও জানে না। একটু অন্ধকার হয়ে এলে চোখের পানি মুছে কাপড় পরে নেয়। বাড়ি এসে সোজা কলপাড়ে গিয়ে বাইরের কাপড় পরেই গায়ে পানি ঢালতে থাকে। এমন সময় শাহেদা দৌড়ে তার কাছে এসে,
: কই ছিলি এতোক্ষণ! আর এই দিকে আমরা তোকে সারা গ্রাম খুঁজে হয়রান! তারপর শুনলাম তর বন্ধুদের সাথে স্কুল থেকে সিনামা দেখতে গেছস নাকি? কিরে কথা কস না কেন? শাহেদ, সিনামা দেখতে যাবি ভালো কথা, আমাকে বলে গেলেই তো আর আমি তোকে নিয়ে অযথাই টেনশন করি না।
এতো কিছু বলার পরও যখন শাহেদ তার বুর কোন কথার উত্তর দিচ্ছে না। তখন শাহেদা তার কাঁধে হাত রেখে,
: কি রে শাহেদ কি হইছে? আয় কাছে আয় পিঠটা ডইলা দেই।
এই সময় শাহেদ তার বু’কে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে,
: বু, আমি কি হিজরা?
আর কোন কথা বলতে পারে না সে। শাহেদাও তার মুখে আচমকা এই কথা শুনে হতভম্ব হয়ে যায়। মুখে কোন কথা সরে না। এরপর রাত অল্প গভীর হলে সবাই যখন ঘুমিয়ে পরে তখন শাহেদা তার ছোটভাইয়ের জন্য খাবার প্লেটে বেরে নিয়ে তাকে ডেকে মুখে তুলে খাইয়ে দেয়। প্রথমে শাহেদ খেতে না চাইলেও পরে ক্ষুধার কথা ভেবে খাওয়া শুরু করে। কয়েক গাল খাওয়া হলে শাহেদা আসতে ধীরে খুক খুক করে কেশে গলা পরিস্কার করে নীচু স্বরে বলতে শুরু করে,
: শোন বেটা, তোরে আমি শহরে নিয়া অন্য স্কুলে ভর্তি কইরা দিবো। তুই কোন চিন্তা করিস না।
এ কথা শুনে শাহেদ তার বুর চোখের দিকে তাকায়। বুঝার চেষ্টা করে তার বোন তাকে সত্যি কথা বলছে নাকি সাময়িক সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করছে? কিন্তু মুখে কিছু বলে না। শাহেদা তার মুখে আরেকগাল খাবার তুলে দিয়ে,
: আরেকটা কথা, শহরের অনেক বড় ডাক্তার দেখাবো তোকে। তোর কোন সমস্যা নাই। এই রকম ছোট অনেকেরই থাকে। এটা কোন ব্যাপার না। এটা খুবই স্বাভাবিক ঘটনা।
এইবার শাহেদ বেশ নিশ্চিন্তবোধ করে। খাওয়া শেষ করে শাহেদার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পরে। শাহেদা হাত ধোয়ার জন্যও উঠে যায় না। পাছে ভাইয়ের ঘুমের ব্যাঘাত না ঘটে। ঝুটা হাত নিজের শাড়ির আঁচলে মুছে ঠিকই কিন্তু সেই হাত দিয়ে শাহেদের মাথায় ছোঁয় না। অনেক ছোটবেলায় সে শুনেছে ঝুটা হাতে যাকে ছোঁয়া হয় তার নাকি অমঙ্গল হয়। এটা মনে হওয়ার সাথে সাথে সে জিভে কামড় দিয়ে মনে মনে তওবা কাটে। এবার তার বা হাত দিয়ে শাহেদের মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পারিয়ে দেয়। পাশেই তার বড় ছেলে ঘুমিয়ে। কিন্তু সে তার ছেলের গায়ে একবারের জন্যও হাত বুলিয়ে দেয় না। শুধু তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করে, সে ঘুমের ভান ধরে তাদের কথা শুনলো কিনা?
চলবে……
আফরোজা খানম তন্দ্রা