বৈধব্য ১ম পর্ব
আজ সকালেই তনুর স্বামী শাহেদ মারা গেছেন।
তনুর কেন যেন কান্না পাচ্ছে না। চোখে একফোঁটা পানি নেই তার। একদম শুকনো খটখটে। অথচ বাসায় যেই আসছে প্রথমেই তনুর কাছে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কান্নাকাটি করছে। এরা আবার কান্না করেই ক্ষান্ত হচ্ছে না, সাথে বিলাপও করছে কেউ কেউ। নরমালি কিন্তু কারো কান্না দেখলেই তনুরও কান্না পায়। সিনামার দূঃখের সিন দেখে জীবনে কতবার হাপুস নয়নে কেঁদেছে তনু। এই স্বভাবের জন্য তনুর বাবার বাড়ির সবাই তাকে অনেক খেপাতো। তনুর ছোট ভাই তো রীতিমতো গামছা এগিয়ে দিতো।
: নে আপা চোখ মোছ। লজ্জা পাইস না। লাইট নিভায়ে দিব? নাকি গামছায় কুলাবে না বালতি, গামলা লাগবে?
আজ তনুর স্বামী মারা গেছে! আজ থেকে সে বিধবা! আর সে কিনা কি সব আবোল তাবোল ভাবছে! মাথাটা হালকা ঝাকি দিয়ে তনু তার মাথা থেকে এইসব আজেবাজে ভাবনা দূর করার চেষ্টা করলো। কিন্তু মাথা ঝাকিয়েও তেমন কোন কাজ হচ্ছে না মনে হয়। কোন না কোন ভাবে তার মাথায় আজব আজব চিন্তা ভাবনা কোত্থেকে চলে আসতেছে! জোর করেও মনের মধ্যে কোন রকম দূঃখবোধ আনতে পারতেছে না সে। কেমন যেন অদ্ভুত একটা অনুভূতি তার সারা শরীরে খেলা করছে। এই অনুভূতির সাথে মোটেও সে পরিচিত নয়।
শুনেছে কান্না নাকি সংক্রামক। কিন্তু আজ কেন তনুকে এই সংক্রমিত ঘটনা কোন রকম সংক্রমিত করতে পারছে না! তনু অবশ্য এর জন্য অসম্ভব রকমের লজ্জিতবোধ করছে। অপেক্ষাকৃত কম আলো যে ঘরটায়? সেখানে বসে রয়েছে সে। এতো চিপার ঘরে বসেও রক্ষা হয়নি তার। সবাই খুঁজে খুঁজে তাকে ঠিকই বের করে ফেলছে। আর দফায় দফায় কান্নাকাটি করছে। মাথার ঘোমটাও সামান্য একটু বড় করে সামনের দিকে টেনে রেখেছে সে। যেন চট করে কেউ বুঝতে না পারে, তনু একদম কান্নাকাটি করছে না। তার শুকনো চোখও যেন কেউ দেখতে না পায়। সব চাইতে ভালো হতো যদি একটু ঘুমিয়ে নেয়া যেত। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে নিশ্চয়ই সদ্য বিধবা হওয়া কোন নারী ঘুমায় না? স্বামী হারানোর শোকে যে কেউ চোখে অন্ধকার দেখার কথা। কিন্তু তনুর কেন এমন দুনিয়া অন্ধকার করা ঘুম পাচ্ছে!
ডাক্তার বলেছেন, প্রচন্ড গরমে শাহেদ হিট স্ট্রোক করেছে। সময়টা ধারণা করা হচ্ছে মাঝরাতের দিকে। এই কথা শুনে তনুর প্রথমেই যে কথাটা মনে হয়েছে, অর্ধেক রাত সে একটা মৃত লাশের পাশে শুয়ে কাটিয়ে দিয়েছে! ঘুনাক্ষরেও টের পায়নি! অবশ্য টের পাবেই বা কিভাবে? ভোর রাতের দিকে তনু নিজেই উঠে পাশের রুমে চলে গিয়েছিল। তাদের এই বেড রুমে ফার্নিচারের জন্য ফাঁকা জায়গা কম। ফ্লোরে শোয়া যায় না। গরমে তার নিজেরও হাস ফাঁস লাগছিলো। ফ্লোরে শোয়ার জন্যই পাশের রুমে যাওয়া। আর তা না হলে তো বাকি সময়টুকুও তাকে লাশের পাশেই শুয়ে থাকতে হতো। হঠাৎই তনু খেয়াল করে সে শাহেদকে আর তার নাম ধরে নোটিশ করছে না। কাল রাতের কথা যতবারই মনে পরছে, ততবারই “লাশ” শব্দটাই ঘুরে ফিরে মনের মধ্যে আসছে বার বার! আজব! অথচ এই মানুষটার সাথেই সে কাটিয়ে দিয়েছে প্রায় ৭টি বছর!
লাশ বেশি সময় কেউ রাখতে রাজি হচ্ছে না। গরমও একটা কারণ। তাছাড়া শাহেদের সব ভাইবোনরা কাছাকাছি থাকেন। তারা সবাই উপস্থিত। তাদের পরামর্শেই জোহরের নামাজের পরই জানাজা পড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। লাশের মুখটা শেষ বারের জন্য দেখাতে সবাই তনুকে ধরাধরি করে বিল্ডিংয়ের নিচের ফাঁকা জায়গায় যেখানে খাটিয়ায় শাহেদকে শুইয়ে রাখা হয়েছে, সেখানে নিয়ে আসলো। তনুকে ধরে আনার কোন প্রয়োজন ছিলো না। সে মোটেও দূর্বল নয়। একাই হেঁটে আসতে পারতো। কিন্তু কেন যেন মেয়েদের বিয়ের সময়, নতুন বৌকে একজায়গা থেকে আরেকজায়গায় নিয়ে যেতে এবং জামাই মারা যাওয়ার দিন লাশের কাছে নিয়ে যেতে, এই দুই সময়ে কোন মেয়েকেই একা হেঁটে যেতে দেয়া হয় না। চার পাশ থেকে সবাই গোল হয়ে ধরে তাকে নিয়ে যাওয়া হয়। আজ তনু এই ঘটনায় বেশ বিরক্তই হলো। কারণ সবার মাঝে থেকে তার হাঁটতে কষ্ট হচ্ছিলো। একবার তো মনে হলো লোকজনের ধাক্কাধাক্কিতে পরেই যাবে। এসব কি ভাবছে সে! তনু আবারও লজ্জা পেয়ে মাথা আরো নিচু করে একদম তার বুকের কাছাকাছি নামিয়ে ফেললো।
না, একদম কান্না পায়নি তনুর। শাহেদের মুখটা যখন শেষবারের মতো তনুকে দেখানো হচ্ছিলো তখনও তনুর কোন রকম খারাপ লাগা কাজ করেনি। এমন কি চোখটা সামান্য ছলছল করেও উঠেনি। ভাগ্যিস, ঠিক ঐ সময়টাতেই পাশের বাসার ভাবি তনুকে জড়িয়ে ধরে উনি নিজেই ডুকরে কেঁদে উঠে ছিলেন। কিছু সময়ের জন্য হলেও তনু তার মুখটা ভাবির বুকে লুকানোর সুযোগ পেয়েছিলো। তা না হলে সবার কাছে প্রায় ধরা পরেই যাচ্ছিলো, শাহেদের মৃত্যুতে তনু একেবারেই কাঁদছে না! এমন কি শেষ বিদায়ের সময়ও না!
খাটিয়ায় শোয়ানো শাহেদকে যখন সবাই কাঁধে করে দুরুদ পড়তে পরতে গেটের বাইরে চলে গেলো, নিজের অজান্তেই তনুর বুকের গভীর থেকে একটা দীর্ঘ শ্বাস বেরিয়ে এলো। কিন্তু এমন সময় তনুর হাঠাৎ মাথাটাও ঘুরে উঠলো। তনু নিজের তাল সামলাতে না পেরে উপুর হয়ে মাটিতে বসে পরলো। আর ওমনি পেটের নাড়িভুড়ি উল্টে তনু হরহর করে বমি করতে লাগলো।
চলবে…….
আফরোজা খানম তন্দ্রা
সম্পূর্ণ গল্পের লিংক